রোদ শুভ্রর প্রেমকথন পর্ব ৩৮
#লেখনীতে – নৌশিন আহমেদ রোদেলা
আমাদের জীবনটা অনেকটা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো। আদর করে হাতে তুলে নিতেই যেন মিলিয়ে যেতে চায়। মুখে দেওয়ার সাথে সাথেই মনে হয়, কোথায় গেল? কিছু বুঝে উঠার আগেই শেষ হয়ে গেল, কি আশ্চর্য! একটা জীবন মানেই আস্ত একটা সারপ্রাইজ বাক্স।
খারাপ, ভালো মিলিয়ে কতশত সারপ্রাইজ তার ভাঁজে ভাঁজে। এইতো, মামানি যখন ফোন দিয়ে বলল মামু হসপিটালে আমরাও সারপ্রাইজড হয়েছিলাম। বিস্ময়ে ‘থ’ মেরে বসেছিলাম অনেকক্ষণ। আম্মুর কান্নার আওয়াজে আমাদের চমক কেটেছিল। এই অপ্রত্যাশিত সারপ্রাইজটার কথা স্বপ্নেও কল্পনা করি নি। আসলে, জীবন আমাদের স্বপ্ন এবং কল্পনার বাইরে গিয়েও অনেক কিছু দেয়। ভয়ঙ্কর কিছু সারপ্রাইজে বিস্মিত, স্তব্ধ হতে বাধ্য করে।
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছি। সবার চোখে-মুখেই দুঃখ আর হতাশার ছাপ। মামু স্টোক করেছেন। হঠাৎ করেই এমন কিছু কখনোই আশা করি নি আমরা। স্টোকটা ছোট-খাটো আর প্রথমবার বলেই হয়ত তেমন একটা ক্ষতি হয় নি মামুর। হয়ত হয়েছে যা আমার অজানা। মামানি আমার ডান হাত আঁকড়ে ঝিম ধরে বসে আছেন।
আমরা যাওয়ার কিছুক্ষণ পর পরই শুভ্র ভাই এলেন। শুভ্র ভাই একটা বিশেষ প্রয়োজনে আজ সকালের গাড়িতেই চট্টগ্রাম রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু মামুর খবর শুনে মাঝ রাস্তা থেকেই ফিরতে হয়েছে তাকে। শুভ্র ভাই করিডোরে পা রাখতেই উঠে দাঁড়ালেন মামানি। শুভ্র ভাই কাছাকাছি আসতেই মুখ চেপে ডুকরে উঠলেন মামানি। শুভ্র ভাইয়া দ্রুত পায়ে মামানির সামনে এসে দাঁড়ালেন। মামানিকে দু’হাতে আগলে নিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললেন,
—-” ইশ! বাচ্চাদের মতো কাঁদছ কেন আম্মু? বাবা ঠিক আছে তো। আমি ডাক্তারদের সাথে কথা বলছি। কালই বাবাকে বাসায় নিয়ে যাব দেখো।”
মামানি ফুঁপিয়ে উঠলেন। ছেলেকে কাছে পেয়ে এতক্ষন যাবৎ চেপে রাখা কান্না, অসহায়ত্বগুলো মুক্ত করে দিলেন। শুভ্র ভাই মামানিকে জড়িয়ে ধরেই দাঁড়িয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। শুভ্র ভাইয়ের চোখে-মুখে অদ্ভুত একটা ভয় আর অসহায়ত্ব চোখে পড়ছিল আমার। আমাদের মামু, চাচ্চু, ফুপি নামক অনেকগুলো ছায়া থাকলেও শুভ্র ভাইদের ছায়া হিসেবে শুধুই আমার আম্মু। তিন কোলে আর কেউ নেই। কেউ না। কিছুক্ষণ পর মামানিকে শান্ত করে ডাক্তারের কাছে ছুটলেন উনি। চোখে-মুখে নিদারুণ ক্লান্তি তার। উনার ক্লান্ত মুখটার দিকে তাকাতেই হঠাৎ করেই ভীষণ কান্না পেয়ে গেল আমার।
কারণ-অকারণের বিষয়গুলো না ভেবে ডুকরে কাঁদতে ইচ্ছে করতে লাগল। বিকাল পাঁচটার দিকে ডাক্তার জানাল, মামু মোটামুটি ভালো আছেন। এতো চিন্তার কোনো কারণ নেই। হসপিটালে এডমিট থাকুক, তারা রুগীর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিবেন। সারাদিন না খাওয়া প্রতিটি প্রাণ যেন অল্প বিস্তর স্বস্তি পেল। সন্ধ্যার মধ্যে সবাই একে একে বাড়ি ফিরল। মামানি পুরোটা সময় আমার হাতটা এতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছিলেন যে সেই শক্ত মায়াজাল ছেড়ে আমার আর বাসায় ফেরা হলো না। আম্মুকে মিনমিনিয়ে বললাম,
—-” আমি থাকি আম্মু। মামানি একা কিভাবে….”
হাসপাতাল নামক জায়গাটাকে ছোট থেকেই ভীষণ অপছন্দ করি আমি। কাছের কেউ অসুস্থ হলেও থাকতে পারি না, দমবন্ধ লাগে। কিন্তু আজ কিভাবে যে সাহসটা জুটে গেল, কে জানে? সারা সন্ধ্যা শুভ্র ভাই দৌঁড়াদৌঁড়ির মধ্যেই থাকলেন। নয়টার দিকে ভাইয়া খাবার দিয়ে এলে সাহস করে মামানির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি। মামানির যে পরিস্থিতি তাতে খাবারের কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা তা নিয়ে বেশ ভাবনায় পড়লাম। অল্প কিছুক্ষন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে মৃদু গলায় বললাম,
—-” মামানি? সারাদিন খাও নি। অল্প একটু খেয়ে নাও প্লিজ।”
মামানি তখন মামুর পাশে ঝিম ধরে বসে আছেন। আমার কথায় চমকে তাকালেন। হালকা হেসে আমার হাতটা টেনে নিয়ে বললেন,
—-” আমার ক্ষুধা নেই। আমায় নিয়ে চিন্তা করিস না। তুই একটু শুভ্রকে ডেকে খাওয়া। সেই ভোর পাঁচটায় দুটো রুটি খেয়েছিল। তারপর সারাদিন না খাওয়া ছেলেটা।”
আমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলাম। কেবিনের সামনের করিডোরেই মাথা নিচু করে বসে আছেন শুভ্র ভাই। আমি কিছুক্ষণ দু’মনা করে উনার পাশে গিয়ে বসলাম। উনি আগের মতোই মাথা নিচু করে বসে রইলেন। আমার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল আমি কাউকে সান্ত্বনা দিতে জানি না। কাউকে দুঃখী হয়ে বসে থাকতে দেখলে কি বলা উচিত খুঁজেই পাই না। আমাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে শুভ্র ভাই নিজ থেকেই বললেন,
—-” বাসায় যাস নি কেন?”
আমি কি বলব বুঝে উঠার আগেই সোজা হয়ে বসলেন উনি। কপাল কুঁচকে বললেন,
—-” তুই এখানে থাকলেই কি বাবা সুস্থ হয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দেবেন? আজাইরা ঝামেলা।”
আমি অবাক চোখে তাকালাম,
—-” আমি ঝামেলা?”
—-” অবশ্যই ঝামেলা। একদিকে বাবা অসুস্থ, অন্যদিকে আম্মুকে সামলাও, তারওপর এক্সট্রা ভাবে তুই। এদিক-ওদিক কোথায় গিয়ে হারিয়ে যাবি, কে জানে? তোকে চোখে চোখে রাখার জন্য হলেও আরেকজনকে নিযুক্ত করতে হবে এখন।”
—-” আপনার ধারণা আমি হসপিটালের মধ্যে হারিয়ে যাব? হসপিটাল কোন হারানোর জায়গা হল? এমনভাবে বলছেন যেন মেডিক্যালে আজ আমি প্রথম আসছি।”
—-” তুই তো নিজের রুমের মধ্যেই হারিয়ে যাস। সেখানে হসপিটালের মত জায়গা তো তোর হারানোর জন্য বেস্ট প্লেস।”
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম,
—-” এমন একটা পরিস্থিতিতেও আমার সাথে ঝগড়া না করে চলছে না আপনার?”
উনি ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন,
—-” আমি ঝগড়া কখন করলাম? ঝগড়া তো তুই করছিস। আমি তোকে স্বাভাবিক সত্যগুলো বুঝাতে চাচ্ছিলাম কিন্তু তোর জন্মগত সমস্যা হল তুই স্বাভাবিক বিষয়গুলোকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারিস না।”
উনার কথায় রাগ নামক বিশ্রী অনুভূতিটা ধপ করে জ্বলে উঠলেও চুপচাপ বসে রইলাম। লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিয়ে কন্ঠটা যথাসাধ্য নরম করে বললাম,
—-“খাবেন না? আম্মু খাবার পাঠিয়েছে।”
উনি উত্তর দিলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
—-” ক্ষুধা নেই।”
—-” সারাদিন ধরেই তো কিছু খান নি। নয়টার বেশি বাজে। এখনও ক্ষুধা নেই?”
উনি ক্লান্ত শরীরটা চেয়ারের গায়ে মেলে দিয়ে চুপ করে রইলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর বললেন,
—-” চল তোকে বাসায় দিয়ে আসি। এখানে থাকতে হবে না।”
উনার কথায় ভ্রু কুঁচকালাম আমি। জেদ ধরে বললাম,
—-” আমি যাব না। আপনি খাবেন চলুন।”
—-” খাব না। ক্ষিধে নেই। রাহাত ভাই নিচে আছে। উনাকে উপরে আসতে বলছি, উনার সাথে চলে যা….”
আমি গাঢ় গলায় বললাম,
—-” বলছি তো যাব না।”
উনি কোন উত্তর দিলেন না। নিরুত্তর চোখে ছাঁদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। উনার চোখে-মুখে একরাশ চিন্তা। কিছু একটা নিয়ে গভীর চিন্তায় আচ্ছন্ন উনি। আচ্ছা? মামুর কি ভয়ানক কোন সমস্যা হয়েছে? হঠাৎ করেই উনাকে ডাকার সাহস পেলাম না আমি। প্রায় ঘন্টাখানেক চুপচাপ বসে থাকার পর হসপিটালের ঘড়িতে দশটা বাজল। রাতের হসপিটালে মানুষের আনাগোনা কম। এদিকটায় কেউ নেই বললেই চলে। আমি সাহস নিয়ে একটু এগিয়ে শুভ্র ভাইয়ের পাশের চেয়ারটাতে গিয়ে বসলাম। উনার দিকে ঘুরে বসে নরম গলায় বললেন,
—-” মামু ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না।”
উনি এক নজর আমার দিকে তাকালেন। মৃদু গলায় বললেন,
—-” খেয়েছিস? এখানে ঘুমানোর জায়গা নেই। রাত জাগতে পারবি না তুই। চল বাসায় দিয়ে আসি। অযথা জেদ করে জ্বালাস না। এসব ঢং আর ভাল্লাগছে না।”
কিছু বলতে গিয়েও উনার গম্ভীর চাহনিতে বলা হয়ে উঠল না আমার। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আরেকটু পাশ ঘেঁষে বসলাম আমি। অস্বস্তি নিয়ে উনার ডানহাতটা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলাম। মনে মনে ধমক খাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকলেও উনি কিছু বললেন না। আমি সাহস নিয়ে বললাম,
—-” আমি কি হসপিটালে ঘুমানোর জন্য এসেছি? আর ঘুম পেলে এভাবেই ঘুমাব আমি। সমস্যা হবে না।”
উনি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
—-” সারাদিন দৌড়ঝাঁপ পেরেছি….গোসল সারা হয় নি। এই পরিস্থিতিতে যানবাহন আর হসপিটাল দুটোই রিস্কি জায়গা। আর সারাদিন এই দুটোর সংস্পর্শেই ছিলাম আমি। বাসায় ফিরে যা…”
—-” উহু।”
তারপর সব নীরব। আমি চোখ তুলে উনার দিকে তাকালাম। উনার চোখ-মুখ ফ্যাকাশে লাগছে। সিল্ক চুলগুলোও উসকোখুসকো হয়ে পড়ে আছে কপালে। আমি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললাম,
—-” মামু ভালো হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না।”
আমার কথায় কপাল কুঁচকালেন উনি। ধমকের মতো করে বললেন,
—-” আপনাকে পাকামো করতে কে বলছে? ঘুম পাচ্ছে ঘুমা নয়তো সর।”
উনার কথায় মুখ ফুলিয়ে সরে গেলাম আমি। উনার থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে একহাতে কপাল চেপে চুপচাপ বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পরই উঠে কেবিনের ভেতরের দিকে চলে গেলেন উনি। উনাকে চলে যেতে দেখে দু’হাতে মুখ চেপে চোখ বন্ধ করলাম। সারাদিন হসপিটালে কাটানোই মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ঘন্টাখানেক শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলে বেশ হত।
দশ পনের মিনিটের মাথায় ফিরে এসে আমার পাশের চেয়ারটাতে বসলেন শুভ্র ভাই। আমি হাত সরিয়ে এক নজর উনার দিকে তাকালাম। ব্রাউন শার্ট পাল্টে কালো রঙের টি-শার্ট পড়েছেন উনি। চোখ-মুখ স্নিগ্ধ লাগছে। চুলগুলোও ভেজা। আমার কপাল কুঁচকে এলো। উনি কি গোসল সেরে এলেন? কাপড়ের ব্যাগ উনার সাথে ছিল ঠিক কিন্তু গোসল কোথায় করলেন? মামুর কেবিনে? আমাকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নরম গলায় বললেন উনি,
—-” ঘুম পাচ্ছে? চাইলে… ”
—-” আপনাকে এতো দয়া দেখাতে কি বলেছে? আমার ঘুম পেলে পাচ্ছে না পেলে নাই। আপনি নিজের কাজ করুন। আজাইরা ঢং দেখাতে আসবেন না।”
আমার ঝাঁঝাল উত্তরে খানিকটা নিভলেন উনি। কিছু বলবেন তার আগেই কাবিনের সামনে এসে দাঁড়াল একটি মেয়ে। গায়ে ডাক্তারদের এপ্রোন। এই মাঝ রাতেও ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটিকে। মেয়েটি কবিনের দরজায় হাত রেখে পেছন ফিরে মুচকি হাসল। তার হাসির উত্তরে মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালেন শুভ্র ভাই। মেয়েটির পেছন পেছন কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড দরজার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে থেকে আগের মতোই বসে রইলাম আমি। সুন্দরী মেয়ে দেখে পাগল হয়ে যাওয়াটা ছেলে জাতির স্বভাব।
কথায় আছে, মৃত্যুর আগ মুহূর্তেও যদি সুযোগ পায় তবুও পুরুষেরা অন্য মেয়েদের দিকে তাকাবে। এটাই স্বাভাবিক। তার মধ্যে শুভ্র ভাই তো আলট্রা লিজেন্ড….. সুন্দরী ডাক্তার দেখে পটে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এদের সবকটাকে ধরে ব্রহ্মপুত্র নদে চুবানো উচিত, মেয়েবাজ কোথাকার। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করলাম।
কিছুক্ষণ ঘুমোতে পারলে বেশ হত। আপাতত এদের বাংলা ঢংটা দেখতে হত না। আরও কিছুক্ষণ পর আমার পাশে গা ঘেঁষে বসল কেউ। গায়ের গন্ধেই বুঝতে পারছিলাম মানুষটির পরিচয়। শুভ্র ভাই কয়েক মিনিট চুপচাপ বসে থেকে আমার মাথাটা নিজের কাঁধে রাখলেন। ব্যাপারটাতে চরম রকম মেজাজ খারাপ হল আমার। উঠে দাঁড়িয়ে ধমাধম মাইর বসাতে ইচ্ছে করল উনার পিঠে। তবুও নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করে চুপচাপ বসে রইলাম। উনার সাথে ঝগড়া করার মত ন্যূনতম শক্তি আমার নেই। এখন একটা ঘুম প্রয়োজন। চমৎকার একটা ঘুম। আমাকে ডানহাতে আলতোভাবে জড়িয়ে নিয়ে, কপালে সাবধানে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফোনালাপে মনোযোগী হলেন শুভ্র ভাই,
—-” হ্যাঁ তুষার,বল।”
তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ। তারপর আবারও ক্লান্ত গলায় বলে উঠলেন উনি,
—-” ফুল ফ্যামিলিই তো হসপিটালে আছি। আর কত লাগে? তুই কাল সকালে আসিস। এখন আসার প্রয়োজন নেই। রো….”
তারপরের কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে এল আমার কানে। রাজ্যের ঘুমগুলোকে দু’চোখের পাতায় জায়গা দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে পড়ে রইলাম বিরক্তিকর মানুষটার কাঁধে। তারপর যখন চোখ খুললাম তখন তীক্ষ্ণ কোন আলো দৃষ্টি পথে বাঁধা দিচ্ছিল আমার। হাত বাড়িয়ে আলোটা ঢাকার চেষ্টা করতেই হাতটা সরিয়ে দিল কেউ। আবারও একই চেষ্টা করতেই গমগমে গলায় প্রশ্ন ছুঁড়া হল,
—-” কি সমস্যা?”
আমি চোখ কুঁচকে বললাম,
—-” চোখে আলো লাগছে। বন্ধ করো আলো।”
গমগমে কন্ঠটা এবার ধমকে উঠে বলল,
—-” বন্ধ করা যাবে না। অনেক ঘুমিয়েছিস এবার সর। ফজরের আজান পড়ে গিয়েছে। নামাযে যাব আমি। হসপিটালে রুগীর সেবা করতে এসে ঘুমিয়েই পাড় পাস না। থাকতে বলছে কে তোকে? সর জলদি।”
আমি ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসলাম। ভারী মাথাটা চেয়ারের পাশের দেয়ালে এলিয়ে দিলাম। উনি হাত-পা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। কোন কথা না বলে নিচে নেমে গেলেন। তারমানে সারারাত এভাবেই টানা বসে ছিলেন উনি? হাত-পা ব্যথা করে নি? এই ছোট্ট প্রশ্নের উত্তর মিলল সকাল দশটায়। দশটার দিকে মামুকে দেখতে এলেন নুরজাহান আন্টি আর উনার দুই ছেলে। করিডোরে দাঁড়িয়ে গল্প করার সময় হঠাৎই প্রশ্ন করলেন নাঈম ভাইয়া,
—-” বার বার হাত ঢলছ, কোন সমস্যা শুভ্র?”
শুভ্র ভাই হাসার চেষ্টা করে বললেন,
—-” না। কোন সমস্যা নেই। সারারাত চেয়ারে বসেছিলাম তো হাত-পায়ের পেশিতে হালকা ব্যথা করছে। তেমন কিছু না।”
নাঈম ভাইয়া মাথা দুলিয়ে বললেন,
—-” ওহ আচ্ছা। রোদেলা? তুমিও হসপিটালে ছিলে নাকি?”
—-” জ্বি ভাইয়া।”
—-” ওহ্। সেদিনের পর তো আর আমাদের বাসায় গেলে না রোদেলা। নাহিদ প্রায়ই বলে তোমার কথা।”
আমি জোরপূর্বক হাসি দিয়ে নাহিদ ভাইয়ার দিকে তাকালাম। নাহিদ ভাইয়া হেসে বললেন,
—-” ছাঁদে বেশ কিছু গাছ লাগিয়েছি এবার। তুমি তো গাছ পছন্দ কর, ওটাই বলছিলাম নাঈমকে। গাছ দেখতে অবশ্যই যাবে আমাদের বাসায়। গাছ দেখার নিমন্ত্রণ রইল পিচ্চি।”
আমি হাসলাম। শুভ্র ভাই যে ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি ঝুলিয়ে রেখেছেন তাও বুঝলাম। নাহিদ ভাইয়াকে অযথাই সহ্য করতে পারেন না উনি। নাহিদ ভাইয়া যদি বলে ‘ভাত খেয়েছ? ‘ সেটাও উনার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্রী কথা বলে মনে হবে ৷ আমার ধারণা ঠিক থাকলে এই মুহূর্তে নাহিদ ভাইয়ার প্রতি উনার মনোভাব হল, ‘কেন ভাই? সারা ময়মনসিংহ শহরের মধ্যে কি শুধু তোর বাসার ছাঁদেই গাছ আছে? আর কোথাও গাছ নাই? তোর বাসাতেই গাছ দেখতে যেতে হবে কেন? শালা মতলববাজ।’ কথাটা ভেবেই হুহা করে হাসতে ইচ্ছে করল আমার। আমাকে হাসতে দেখে প্রশ্ন ছুঁড়লেন নাহিদ ভাইয়া,
—-” পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন পিচ্চি? পরীক্ষার ডেইট বোধহয় আজকালের মাঝে পড়ে যাবে।”
—-” জ্বি, মোটামুটি।”
—-” এডমিশন তো দিবে? আমিও হিউমিনিটিসের স্টুডেন্ট ছিলাম। ইংলিশে হেল্প লাগলে বলো। আর ইকোনমিক্সের জন্য নাঈম আছে। এডমিশনের জন্য ইংলিশ খুব ইম্পোর্টেন্ট।”
—-” জ্বি ভাইয়া। বলবো।”
—-” তোমাকে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছি কাল। আই থিংক চেইক করো নি।”
আমি অস্বস্তি নিয়ে বললাম,
—-” সরি ভাইয়া। আসলে, ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট চেইক করা হয় নি। বাসায় গিয়ে একসেপ্ট করে নিব। সমস্যা নেই।”
শুভ্র ভাইয়ের সহ্যের বাঁধ বোধহয় ভাঙল এবার। চাপা রাগ নিয়ে বললেন,
—-” রোদ ভেতরে যা। আম্মু কি খাবে জিগ্যেস করে আয়। খাবার কিনতে যাব।”
আমি অবাক হয়ে বললাম,
—-” কিন্তু আম্মু তো খাবা…”
—-” যেতে বলছি তোকে। আর একটু পর রাহাত ভাই আসবে, উত্তর- দক্ষিণ না দেখে তার সাথে বাসায় যাবি। এখন যা….”
নাঈম ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,
—-” বাই রোদেলা। বাসায় গিয়ে রেস্ট নেওয়া উচিত তোমার। সারারাত জেগেছ। ”
আমি হাসার চেষ্টা করে দরজা ঠেলে কেবিনের ভেতরে ঢুকলাম। সত্যিই বাসায় ফেরা উচিত। হসপিটালের বাতাসটাও কেমন বিষাক্ত লাগছে এখন। মামানির কাছাকাছি গিয়ে বিরস মুখে প্রশ্ন করলাম,
—-” কি খাবে মামানি? তাড়াতাড়ি বলো খাবার কিনতে যাবে।”
মামানি অবাক হয়ে বললেন,
—-” খাবার কিনতে যাবে মানে? তোর মা তো খাবার পাঠিয়েছে আবার খাবার কেন?”
—-” তোমার ছেলের আমার মায়ের হাতের খাবার পছন্দ না৷ তার টাকা আছে সে খাবার কিনে কিনে খাবারের গোডাউন বানাবে। তাড়াতাড়ি বল কি খাবে। আমি উনাকে জানিয়ে বাসায় ফিরব।”
মামানি কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর মৃদু হেসে বললেন,
—-” হুম যা। বাসায় গিয়ে রেস্ট নিয়ে কাপড় গুছিয়ে নে।”
—-” কাপড় গুছাব মানে?”
—-” তোর মামুকে বিকেলে ছুটি দিয়ে দিবে। তোর আম্মুর সম্মতিতে আগামী এক সপ্তাহ তুই আমাদের বাসায় থাকবি।”
আমি আৎকে উঠে বললাম,
—-” কি?”
মামানি ভ্রু উঁচু করে বললেন,
—-” কোন সমস্যা?”
মামানির প্রশ্নে বিরক্তিতে চোখ-মুখ কুঁচকে এলো আমার। উনাকে কি করে বলি, উনার এই অসহ্যকর ছেলেকে গোটা এক সপ্তাহ সহ্য করার মতো সহ্য শক্তি আমার নেই। কথায় কথায় উনার ত্যাড়ামো জাস্ট অসহ্য!
________________________
রাত দশটা। সোফায় বসে চ্যানেলের পর চ্যানেল পাল্টাচ্ছি আমি। মামানি নিজের বরকে নিয়ে ব্যস্ত। সেখানে তো ডিস্টার্ব করা চলে না। শুভ্র ভাইও ঘুমোচ্ছেন। দু’দিনের টানা পরিশ্রমে নেতিয়ে গেছে বেচারা। তবে, উনি ঘুমিয়েছেন বলেই রক্ষা নয়ত উনার ফালতু কাজকর্মে আমাকে এই পৃথিবী ছাড়তে হত।
আমি বিরস মুখে টেলিভিশনের দিকে তাকিয়ে আছি। কোন চ্যানেলেই ভালো কিছু দেখাচ্ছে না। আমাদের জীবনে এমন কিছু দিন থাকে যে দিনগুলোতে পৃথিবীর কোথাও ভালো কিছু হয় না। যেদিকে তাকাই সেদিকে বিরক্তিকর, অসহ্য ধরনের জিনিস চোখে পড়ে। আজকে নিশ্চয় সেই দিনগুলোর মধ্যে একদিন।
সবকিছু খারাপ হওয়ার দিন। আমার খারাপ প্রহরের চিন্তার মাঝখানে রুমের পর্দা ঠেলে বেরিয়ে এলেন শুভ্র ভাই। উনাকে বেরুতে দেখেই টেলিভিশন অফ করে উঠে দাঁড়ালাম। টেবিলে খাবার দিতেই চেয়ার টেনে বসলেন উনি। নিজেকে পার্ফেক্ট কাজের বুয়ার মত ফিল হচ্ছে আজ। আম্মুর ষড়যন্ত্রে শেষ পর্যন্ত কাজের বুয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে সমর্থ্য হলাম আজ। শুভ্র ভাই মুখে খাবার তোলার আগে অভ্যাসবশত জিগ্যেস করলেন,
—-” আম্মু খেয়েছে?”
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
—-” হুম।”
উনি এবার আমার দিকে তাকালেন। উনার প্রশ্ন বুঝতে পেরে ঝটপট উত্তর দিলাম,
—-” আমি পরে খাব। ক্ষুধা নেই। আপনি খান।”
উনি প্লেট থেকে হাত সরিয়ে হাত গুটিয়ে বসে রইলেন। উনাকে নিরুত্তর বসে থাকতে দেখে একঝাঁক বিরক্তি এসে হানা দিল আমার ভ্রু জোড়ার ফাঁকে। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে উনার প্লেটটা টেনে নিয়েই খেতে বসে গেলাম। উনি কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে থেকে আরেকটা প্লেট নিয়ে খাবার নিলেন। আমার সামনের প্লেটটা টেনে নিয়ে নতুন প্লেটটা আমার সামনে বসিয়ে দিয়ে শান্ত হয়ে বসলেন। ধীরেসুস্থে আমার প্লেট থেকে খেতে শুরু করলেন। আমি বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম,
—-” ওটাতে আমি খাচ্ছিলাম।”
উনি ছোট্ট করে জবাব দিলেন,
—-” আমিও খাচ্ছিলাম।”
—-” আপনি খান নি। শুধু ছুঁয়েছিলেন। আমি তো অনেকটাই খেয়ে ফেলেছি। জোডা হয়ে গেছে।”
উনি চোখ তুলে তাকালেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন,
—-” আমি নিজের প্লেট ছাড়া খেতে পারি না।”
উনার কথায় সামনের চোয়ালটা ঝুলে পড়ল আমার। পাগল নাকি লোকটা? নির্দিষ্ট একটা প্লেট ছাড়া খেতে পারে না অথচ অন্যের খাওয়া জিনিসটা খেয়ে চলেছেন। অদ্ভুত…. সেই সাথে বিশ্রী! আমার সামনের প্লেটটাতে খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে এসব কথায় ভাবছিলাম। এমন সময় উনার ফোন বাজল। উনি কন্ঠে গাম্ভীর্য ঢেলে বললেন,
—-” হুম। বল।”
অপর পাশের কথাগুলো কান পর্যন্ত পৌঁছাল না। উনি আবারও বললেন,
—-” আমিও দেখেছি। ও যে ময়মনসিংহ মেডিক্যালেই ইনটার্ন করছে জানতাম না। হঠাৎ দেখে অস্বস্তিতে পড়েছিলাম।”
আমার দৃষ্টি অযথায় তীক্ষ্ম হয়ে এলো। কান খাঁড়া করে খাবার গিলতে লাগলাম,
—-” আগে ছোট ছিল এখন বড় হয়েছে। পরিবর্তনটা তো স্বাভাবিক। আমি অবাক হই নি।”
—-“………………………………..…………”
—-” আমার কাছে আহামরি কিছু মনে হলো না। হ্যাঁ, দুর্বলতা কিছু থাকলে থাকতে পারে। বিয়ে করে নি এখনও?”
আমি খাওয়া রেখে উনার দিকে তাকালাম। উনি খেতে খেতেই হাসলেন। হাসিমুখেই বললেন,
—-” আরে ধুর! সে কবে কার কথা। তুই আসলেই একটা থার্ডক্লাস। সে ডাক্তার দেখে আমার অনুভূতি চেঞ্জ হয়ে যাবে নাকি? ফাউল আলাপ বাদ দিয়ে রাখ তো। খাচ্ছি আমি।”
উনি ফোন রাখলেন। আমি কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে বললাম,
—-” ওই মেয়ে ডাক্তারটা আপনার গার্লফ্রেন্ড?”
উনি অবাক চোখে তাকালেন। হেসে ফেলে বললেন,
—-” ঠাস করে গার্লফ্রেন্ড বলে ফেললি। তোর আত্মা কাঁপে না?”
আমি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
—-” কাঁপবে কেন? আপনারা হলেন পাবলিকিয়ান থাকতেই পারে দু’একটা গার্লফ্রেন্ড। ওই ডাক্তারটাও আপনার গার্লফ্রেন্ড?”
উনি স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। উনার চোখ দেখে মনে হচ্ছে আমার কথা উনার পছন্দ হয় নি। আমি উনার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আবারও প্রশ্ন করলাম। উনি ছোট্ট একটা শ্বাস টেনে নিয়ে হালকা হাসলেন। খেতে খেতে বললেন,
—-” একদা এক সময় সে আমার প্রেমিকা ছিল। ওর নাম তাসনিম।”
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম,
—-” কি সুন্দর দেখতে! এতো সুন্দর মেয়ের সাথে ব্রেকআপ কেন হল?”
উনি অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। তারপর হাসিমুখেই বললেন,
—-” ওকে আমার ভাল্লাগে নাই আর।”
এবার গলায় খাবার আটকে গেল আমার। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম। উনি নিজে থেকেই বললেন,
—-” তখন ক্লাস টেনে পড়ি। এই বয়সটাতে ফ্যান্টাসি কাজ করে প্রচুর। তখন হয়ত ২০১১ সাল। আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে ছিল তাসনিম। হঠাৎ একদিন চোখে পড়ল। বন্ধুদের বললাম মাইয়াটা চরম। সেদিন থেকেই বন্ধুরা ভাবি ভাবি বলে চিল্লাচিল্লি শুরু করল।
আমার মধ্যেও ফ্যান্টাসি কাজ করতে লাগল। পড়তে বসে হঠাৎ তাসনিমের কথা মনে হতেই ভাবলাম নির্ঘাত প্রেমের লাস্ট লেভেলে এসে গিয়েছি, মেয়েটাকে না পটালে আর হচ্ছে না। আমাদের স্কুলেই তখন কোচিং ক্লাস হত। এক সপ্তাহ পর, সিদ্ধান্ত নিলাম প্রোপোজ করব। সারাদিন বেশ এক্সাইটমেন্টে কাটলো।
রাত আটটায় কোচিং শেষ করে তাসনিম বের হতেই হাত চেপে ধরলাম। বললাম,’ আই থিংক আই এম ইন লাভ উইথ ইউ।’ তাসনিম কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে লাজুক হাসল। বললো, সেও নাকি সেইম ফিল করে। তার কথা শুনে আমি চরম অবাক। মেয়েটা আগে থেকেই পটে আছে। বন্ধুদের ট্রিট দিয়ে হুলস্থুল কান্ড বাঁধালাম। স্কুলের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েকে চুটকিতে পটিয়ে ফেলেছি, সাংঘাতিক ব্যাপার। দ্বিতীয় দিন তাসনিমের কথায় স্কুল বাম্প করে তাসনিমকে নিয়ে ফুসকা খেতে গেলাম। হাত ধরাধরি করে এখানে সেখানে ঘুরলাম। একটা সিনেমাও দেখেছিলাম সিনেমা হলে।
কি যেন একটা সিনেমা চলছিল তখন। বেশ হিট সিনেমা। সিনেমা দেখে কোচিং ক্লাস কমপ্লিট করে বাসায় ফিরলাম। সেই দ্বিতীয় দিন থেকেই তাসনিমের প্রতি ইন্টারেস্ট কমে এলো আমার। ধীরে ধীরে ওর প্রতি বিরক্তি কাজ করতে লাগল। এসব জান, কলিজা ঢং আমার আজও ভালো লাগে না তখনও ভালো লাগত না। তাই সাতদিনের মাথায় বললাম ব্রেকআপ। কিন্তু তাসনিম কিছুতেই রাজি নয়। তার জীবন নাকি আমাকে ছাড়া অন্ধকার। আমি তাকে বুঝালাম, বুঝল না।
শুরু হলো ওকে এবোয়েড করা। এক মাসের মাথায় তাসনিম সুইসাইড এট্যাম্প করল। আমি অবাক। আমি ওর সাথে এমন কিছুই করি নি যার জন্য ওর জীবন শেষ করে দিতে হবে। শুধু হাতটাই ধরেছিলাম তবু ও ধরতে বলেছিল বলে। ওর বাবা-মা জানল ব্যাপারটা। আমাকে এসে রিকুয়েষ্ট করল রিলেশন রাখার জন্য। ব্যাপারটা তখন চরম রকম মেজাজ খারাপের কারণ হয়ে দাঁড়াল। তাসনিমের বাবা আমাকে হুমকি দিল উনি পুলিশ কেইস করবেন।
আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। তাসনিমের বাসায় গিয়ে ওর গালে ঠাডিয়ে দুটো চড় বসিয়ে দিয়ে এলাম। ওর বাবা-মা হতবাক। পরের দিন জানতে পারলাম তাসনিম আবারও সুইসাইড এট্যাম্প করেছে। তখন আমার টেস্ট পরীক্ষা চলে। তাসনিমের বাবা আবারও আমায় শাসালেন। আমিও ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘ যান। এখান থেকে পুলিশ স্টেশন যেতে দশ টাকা ভাড়া লাগে। দশ টাকা আমি দিয়ে দিচ্ছি। অ্যাফায়ার করে আমাকে একটা কল করবেন।
আপনার বাসায় গিয়ে আপনার মেয়েকে আগে খুন করব তারপর দশ টাকা ভাড়া দিয়ে পুলিশ স্টেশন চলে যাব। সমস্যা নেই। এখন শুধু শুধু চিল্লাচিল্লি করবেন না। পরীক্ষার টেনশনে মেজাজ খারাপ। আম্মু বলেছে নাইন্টি প্লাস মার্কস আনতে। আপনার কারণে তা এইট্টিতে নেমে গেছে। যান প্লিজ।’ লোকটা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল।
সেবার আর এসএসসি পরীক্ষা দেয় নি তাসনিম। ওর বাবা ওকে অন্য স্কুলে আবারও দশম শ্রেণিতে ভর্তি করেছিলেন। তারপর আর তাসনিমের খবর টবর নিই নি আমি। আজ এতো বছর পর হসপিটালে হুট করে দেখা হয়ে যাবে ভাবি নি। ওর এক্সপ্রেশন দেখে মনে হল আমাকে পেয়ে সে ভীষণ খুশি হয়েছে। তুষার বলল তাকেও নাকি জিগ্যেস করেছিল আমার কথা। ওর এতো ইন্টারেস্ট আর খুশি হওয়া দেখেও অবাক হয়েছি।”
এটুকু বলে থামলেন উনি। আমি চোখ-মুখ কুঁচকে বললাম,
—-” আপনি কতটা হার্টলেস। মেয়েটা আপনাকে কত ভালোবাসত।”
উনি স্বাভাবিক গলায় বললেন,
—-” তো?”
—-” তো মানে? সে আপনাকে ভালোবাসতো তার কোনো গুরুত্ব নেই আপনার কাছে? এতো পাগলামোর পরও ওকে ভালোবাসতে পারলেন না?একটুও না?”
—-” ওকে আমার ভালো লাগে না।”
উনার কথায় তেতে উঠলাম আমি। দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,
—-” ভালো লাগে না মানে কি? আপনার কাছে ভালোবাসাটা ভালোলাগার মধ্যে সীমাবদ্ধ? কাল ভালো লাগবে না তাহলে পরশু ছুড়ে ফেলবেন?”
উনি শক্ত গলায় বললেন,
—-” এতো হাইপার হওয়ার কিছু নেই। সেটা কিশোর বয়সের আবেগ ছিল। আর এমন তো নয় ওকে বছরব্যাপী ইউজ করেছি আমি। সাত দিনের মাথায় ব্রেকআপ করেছিলাম।”
আমি নরম গলায় বললাম,
—-” মেয়েটা আপনাকে ভালোবাসতো। “
—-” আই ডোন্ট কেয়ার।”
—–” ভালোবাসাটা আপনার কাছে কিছুই না? ইউজলেস তাই না?”
উনি হেসে বললেন,
—-” আমার ভালোবাসা ছাড়া অন্যেরটা আমার কাছে ইম্পোর্টেন্ট নয়। আমি এমনই… আনফরচুনেটলি তোর ভাগ্যটা খারাপ।”
আমি বিরবির করে বললাম,
—-” হার্টলেস। “
উনি হাসলেন। খাবার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার চোখের দিকে তাকালেন। বললেন,
—-” থেংক গড আমি হার্টলেস। আর তাই হয়তো আরেকজন হার্টলেসের পেছনে পড়ে আছি বছরের পর বছর।”
এটুকু বলে থামলেন উনি। আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এসে বললেন,
—-” আই এম হ্যাপি ফর বিং হার্টলেস এন্ড আই এম হ্যাপি ফর হ্যাভিং দিস হার্টলেস বার্ড।”
উনার চোখদুটো গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার চোখে। সেই চোখে হাজার খানেক মায়া। হাজার আকুতি আর বুক ভরা প্রেম। আমার হঠাৎ করেই মনে হল উনার চোখ হাসছে। সেই সাথে হাসছে ভালোবাসায় ভরপুর মস্ত এক মন……ভালোবাসাময় অদ্ভুত এক হৃদয়।
#রোদবালিকা
রোদ শুভ্রর প্রেমকথন সম্পূর্ণ গল্পের লিংক
https://kobitor.com/rodsuvro/