নীলার শাশুড়ী পর্ব ৫
নাইম চলে গেছে প্রায় দুই মাস হতে চলল । প্রতিদিনই কথা হয় ওদের । একটু একটু করে নীলাও ওর নতুন জীবনের স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছে । স্বপ্নে দেখা সেই ছোট সংসারটাকে ও ওর মনের মাধুরী মিশিয়ে সাজাবে এমনি স্বপ্ন বুনে চলে প্রতিদিন । এদিকে একটু আধটু পড়ালেখার শুরু করেছে ও ওর শাশুড়ী মায়ের পীড়াপীড়িতে। নইলে এই মূহূর্তে ওর পড়াশোনার মন একেবারেই নেই। নীলা অস্ট্রেলিয়া যাবার পর পরই অস্ট্রেলিয়ান মেডিকেল কাউন্সিল এর পার্ট ওয়ান পরীক্ষায় বসবে বলে টুকটাক করে পড়াশুনার শুরু করছে ধীরে সুস্থে।
শুক্রবার সকাল সকাল উঠে দেখে হাফসা বেগম তৈরী হয়ে বের হচ্ছেন। নীলা জানতে চাইলে তিনি জানালেন , তার এক ছোটবেলার বান্ধবী আসবেন আজ । সদরঘাটে তাকে আনতে যাবেন , তার বান্ধবী ঢাকায় এ বাসাতেই থাকবেন। নীলা জানালো গাড়ীতে যদি ফিরবার সময় বেশী মানুষ না হয় সে ও যেতে চায়। হাফসা বেগম জানালেন তার বান্ধবী একাই আসবেন । তাই অনায়াসে নীলা যেতে পারে তার সাথে ।
নীলারা সদরঘাটে গিয়ে পৌঁছনোর পর হাফসা বেগম তার বান্ধবীর সাথে কথা বলে জেনে নিলেন কোথায় আছে সে, তারপর ড্রাইভার আহমেদ সহ তার কাছে পৌঁছলেন তারা দুজন ।
অনেক দিন পর দু বান্ধবীর দেখা হওয়াতে দু’জন দুজনকে জড়িয়ে ধরলেন । গাড়ীতে উঠে হাফসা বেগম তার বান্ধবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন নীলাকে ।
নীলাকে উদ্দেশ্য করে হাফসা বেগম বললেন ,
” জানো নীলা আমরা আর কল্যানীরা বানারীপাড়ায় পাশাপাশি বাসায় থাকতাম ।
আমার বাবা ছিলেন জেলা কৃষি অফিসার তাই আমরা থাকতাম সরকারী কোয়ার্টারে।
আর তার পাশেই কল্যানীদের বাড়ী।
বরিশালের বানারীপাড়া একটি ব্যবসাকেন্দ্র আর ওখানে অনেক হিন্দু ব্যবসায়ী আছে ,যারা সাহা বলে পরিচিত। এলাকার সবার কাছে ওদের বাড়ী সাহাবাড়ী বলে পরিচিত।
কল্যানীরাও সাহা।
ওদের বংশ পরম্পরায় লোহার ব্যবসা ।
আমরা ছোটবেলায় একসাথে স্কুলে গিয়েছি একসাথে খেলেছি । “
এর মাঝে হাফসা বেগমের কথার রেশ ধরেই কল্যানী দেবী বললেন ,
” জানো নীলা তোমার বিয়েতে আসবার বডড ইচ্ছে ছিল , কিন্তু একে তো একা থাকি তারপর তোমার মেসো গত হবার পর থেকে তেমন কোথাও বের হই না আর একা একা ,আর শরীরটাও প্রায়ই ভাল থাকে না।
তোমার শাশুড়ীর সাথে ফোনে যোগাযোগ হয় ।
তেমনি একদিন কথা প্রসংগে বলেছিলাম , মরবার আগে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজো দেবার বড্ড সাধ হয় ,
একে তো আমি নি:সন্তান তায় বিধবা ,
তোমার শাশুড়ী শুনে বললেন , আমি কেবল ঢাকা আসতে পারলে সব ব্যবস্হা সেই করবে ,
তাই তো সাহস করে এই বয়সে ঢাকায় একা একা এলাম ।
আমি জীবনে বার কয়েক বানারিপাড়া থেকে বরিশাল সদরেই গিয়েছি।
তাহলে বোঝ কেমন ঘরকুনো মানুষ আমি!
তোমার শাশুড়ী সাহস না দিলে হয়ত আক্ষেপ নিয়েই মরতে হতো। “
এই বলে আঁচলে চোখ মুছলেন কল্যানী দেবী।
হাফসা বেগম আর কল্যানী দেবী তাদের অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে বাসায় পৌছে গেলেন ।
বাসায় ফিরেই হাফসা বেগম রান্নার তোড়জোড় শুরু করে দিলেন । কাজে সাহায্যকারী মহিলাকে বলে দিলেন এই চার পাঁচদিন কেবল সবজী নিরামিষ রান্না হবে বাসায়। নীলা অবাক হয়ে জানতে চাইল , এর কারন । তখন হাফসা বেগম জানালেন ,কার বান্ধবী কল্যানী বিধবা, সে নিরামিষাশী। দীর্ঘদিন নিরামিষ খেতে খেতে তার এখন আর মাছ মাংসের গন্ধ ভাল লাগে না। তাই তার বান্ধবীর যেন কোন অসুবিধা না হয় তাই এই ব্যবস্থা । নীলা যতই হাফসা বেগম কে দেখে ততই বিস্মিত হয় । আর ভাবে আমরা সবাই যদি এমনি করে , এমনি ভাবে চিন্তা করতাম আর তার প্রতিফলন বাস্তবে ঘটাতাম তবে দুনিয়াটা অন্যরকম হতো!
দু’দিন বাদে দুপুরে খেয়ে দেয়ে নীলা ,হাফসা বেগম ,কল্যানী ঢাকেশ্বরী মন্দিরের উদ্দেশ্য রওনা হলেন । কল্যানী দেবীকে মন্দিরে নামিয়ে দিয়ে , নীলা ও তার শাশুড়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গেলেন । নীলার বড্ড ভাল লাগে এই জায়গাটা । নীলা ওর শাশুড়ীকে নিয়ে ওর মেডিকল কলেজে ঘুরে দেখালো । তারপর টি এস সি এসে চটপটি খেলো শেষে কার্জন হলের পুকুর পাড়ে গিয়ে চিনে বাদাম নিয়ে বসে বসে গল্প করতে লাগল । নীলার বড্ড ভাল লাগছিল এখানে বসে থাকতে। ওর মনে হচ্ছিল বউ শাশুড়ীর সম্পর্কের বাইরে ও আরও একটি সম্পর্কের ছোয়া পাচ্ছে ইদানিং আর তা হলো বন্ধুত্ব ! দুই অসম বয়সি নারী আস্তে আস্তে এক নির্মল বন্ধুত্বের ছোঁয়া পেতে শুরু করেছে , যা তাদের সম্পর্কে অন্যরকম মাধুর্য নিয়ে এসেছে !
সেই কল্যানী দেবী আসার পর থেকেই নীলার মনে একটি প্রশ্ন ঘুরপাক করছিল , এখন হাফসা বেগমকে অনায়াসেই সে অনেক কথা জিগ্গ্যেস করে , করতে পারে।
তাই নীলা বলল,
মা আপনি তো পরিপূর্ন ভাবেই ধর্ম চর্চা করেন , তাহলে আজ যে আপনি আপনার বান্ধবীর নিয়ে মন্দিরে এলেন বা তার জন্য বাসায় খাবারের পরিবর্তন করলেন , এটা কেন করলেন ? এটা কি আপনার ধর্ম চর্চায় কোন সমস্যা করবে না?
হাফসা বেগম হেসে বললেন ,
“না , কারন ইসলামে যার যার ধর্ম সে স্বাধীন ভাবে পালন করবে এমনটিই বলা হয়েছে । আর তুমি জান , এমন কি যুদ্ধের সময়ও অমুসলিমদের মন্দির , গীর্জা তাদের পুরাহিত হ্ত্যা করা যাবেনা বলা হয়েছে। যখন জেরুজালেম বিজয় করে মুসলিম বাহিনী , তখন উমর ( র:) গিয়েছিলেন জেরুজালেমের চাবি গ্রহন করতে , তো নামাজের ওয়াক্ত হলে ওখানকার খ্রীস্টানরা তাদের একটি গীর্জায় তাকে নামাজ পড়তে বললে তিনি তাতে অস্বীকৃতি জানান । কারন হিসেবে তিনি বললেন , তিনি ভয় করেন এখানে নামাজ পড়লে পরবর্তিতে অতি উৎসাহি কেউ এটিকে মসজিদে পরিবর্তিত করে দিতে পারে , তাই তিনি ওখানে নামাজ না পড়ে খোলা জায়গায় নামাজ পড়েছিলেন কারন তখন বায়তুল মাকদিস বা আল আকসা মসজিদ ময়লা আবর্জনায় পূর্ন ছিল । পরবর্তিতে ওমর (র:) সেই নামাজের স্থানে একটি মসজিদ নির্মিত হয় যা আজও উমর (র:) মসজিদ বলে পরিচিত।
আমার বন্ধু কল্যানী একে বিধবা তায় নি:সন্তান । তার মনের ইচ্ছে পূর্ন করবার মতো লোক তেমন নেই তাই তার শখ পূর্ন করার উপায় আল্লাহ যখন আমার মাধ্যমে করেছেন আমি তার চেষ্টা করেছি । আমি যেমন তার সাথে মন্দিরে গিয়ে পূজো দেই নি ,তেমন সেও কিন্তু আমার সাথে রোজা রাখেন বা নামাজ পড়ে না। এখানেই আমাদের স্বাতন্ত্র। লা কুম দ্বীনু কুম ওয়ালিয়া দ্বীন -মানে- যার যার ধর্ম তার তার কাছে ।
কল্যানী আমার অতিথী তাই কোন কিছুতে যেন সে বিব্রত না হয় তা দেখাও আমার কর্তব্য । “
নীলা আজ বলেই ফেলল,
“মা আমার অনেক সৌভাগ্য যে আপনার মত একজন অতি ভাল মানুষকে আমি আমার শাশুড়ী হিসেবে পেয়েছি ,
আপনার জীবনবোধ থেকে আমিও যেন কিছু শিখতে পারি এই দোয়া করবেন আমার জন্য “
হাফসা বেগম হেসে নীলার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন ,
” তুমি অনেক ভাল মনের মানুষ হও মা এই দোয়া করি আর জেনে রেখো প্রকৃত ধর্মচর্চা মানুষকে মানবিক করে তোলে সৎ , সাহসী আর সহনশীল ও করে।”
নীলাদের উঠবার সময় হয়ে গেল । আজ বিকেলটা নীলার বডড ভাল লাগল । কল্যানী দেবী মন্দিরের গেটে দাঁড়িয়ে ওদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন , তাঁকে তুলে ওরা বাসার দিকে রওনা হলেন ।
আরও দুদিন কল্যানী দেবী নীলাদের সাথে থেকে ফিরে গেলেন তার গন্তব্যে।
( চলবে – আগামী পর্বে ইনশাল্লাহ সমাপ্ত )