নীলার শাশুড়ী ৬ ও শেষ পর্ব
লেবার রুমের বাইরে হাফসা বেগম , তার স্বামী , নীলার বাবা মা প্রতীক্ষা করছেন একটি নতুন মানুষের জন্য । হ্যা আজ নীলার প্রথম সন্তান পৃথিবীর আলো দেখবে আর সেই শুভক্ষনের সাক্ষী হতে পরিবারের সবাই হাসপাতালে জড়ো হয়েছে । নীলা পুরো গর্ভকালীন সময়ে মোটামুটি সুস্হ থাকায় ও নাইমকে বলেছিল ও চায় সকলে যেন ডেলিভারীর আগে আগেই অস্ট্রলিয়া আসে ।
তাহলে বাচ্চা হবার পরে অনেকটা সময় ও পরিবারের মানুষগুলোকে কাছে পাবে। প্রায় দু বছর হয়েছে নীলা অস্ট্রেলিয়া এসেছে। একটু একটু করে ওর নিজের সংসারটা গুছিয়ে নিয়েছে। এরই মধ্যে এ এম সি পার্ট – ওয়ান পরীক্ষায়টাও শেষ করেছে। সংসার গোছানোর সময়টাতে নীলার ওর শাশুড়ীর কথা বডড মনে পড়ত । দুজন মিলে যখন সংসারে ছোট ছোট জিনিস কিনতো এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করত। হাফসা বেগম বলেন সংসার এক মায়া , দিনে দিনে সেই মায়া বেড়েই চলে! তারপর একদিন এই মায়ার ভূবন ছেড়ে চলে যেতে হয় সকলকেই!
প্রতিটি মানুষের জীবনে একজন আদর্শ থাকে ! যে তাকে সবসময় ভাল কাজে উৎসাহিত করে , সুকুমার বৃত্তিগুলো পাপড়ী মেলে ওঠে তারই স্পর্শে। নীলার জীবনে ওর শাশুড়ী হাফসা বেগম এমনি একজন । কথা ছিল নীলার ডেলীভারী ক’মাস আগেই হাফসা বেগম আর তার স্বামী আসবেন । কিন্তু তিনি তার ছেলেকে নীলার বাবামাকে আগে আনতে পরামর্শ দেন । তার মতে এসময় মেয়েরা মায়ের কাছে অনেক আবদার করতে পারে নি:সংকোচে, যা অন্য কারও কাছে পারে না । তাই নীলার বাবা মা বেশ ক’মাস আগে এসেছেন আর নীলার ডেলিভারীর এক মাস আগে হাফসা বেগম আর তার স্বামী এসেছেন ।
নীলা স্বাভাবিক প্রকৃয়ায় সন্তান জন্মদিতে ইচ্ছুক আর এখানে বিনাকারনে সিজারিয়ান অপারেশন করাকে নিরুৎসাহিত করা হয় । মিডওয়াইফরা নীলাকে নিয়ে যখন লেবার রুমে ঢুকল সাথে নাইম ও । বাইরে তখন নীলা নাইমের অনাগত সন্তানের নানা নানী আর দাদা দাদী সব কিছু যেন সুন্দর সহি সালামতে হয় এজন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করছিলেন। নীলা আর নাইম ইচ্ছে করেই বাচ্চার লিঙ্গ জানতে চায় নি। এখানে জানতে চাইলে বলে দেয় কিন্তু ওরা চাইছিল চমক টা থাকুক , আর আল্লাহর কাছে কেবল একটি সুস্থ বাচ্চাই তাদের একমাত্র কাম্য ছিল । তা ছেলে হোক বা মেয়ে হোক ।
নীলার মা হাফসা বেগমের কাছে জানতে চাইলেন ছেলের ঘরের প্রথম নাতি হিসেবে তার কি প্রত্যাশা । হাফসা বেগম উত্তরে জানালেন ছেলে বা মেয়ে নয় তিনি চান একটি সুস্থ বাচ্চা আল্লাহ দিন নীলা আর নাইমকে।
নীলার মা অবাক হয়ে জানতে চান , সাধারনত ছেলের ঘরের সন্তানের ক্ষেত্রে ছেলের পরিবারের প্রথম পছন্দ থাকে ছেলে সন্তান , ছেলের মা হিসেবে ,বংশের বাতি হিসেবে বরাবর তিনি দেখেছেন ছেলে শিশুই সকলের কাম্য থাকে ,আর হাফসা বেগমের এমন কোন চাওয়া নেই শুনে নীলার মা একটু বেশীই অবাক হলেন ।
নীলার মায়ের কথা শুনে হাফসা বেগম হেসে বললেন ,
“বেয়াইন সমাজে এই সব কুপ্রথা চালু আছে আমাদেরই অজ্ঞতার কারনে কারন আমরাই তা লালন করছি । জানেন , আমাদের ধর্মে বংশ রক্ষা বলে কোন ব্যাপার নেই। আমাদের নবী (স:) সব কজন পুত্র সন্তান শিশু বয়সেই মৃত্যুবরণ করলে , মক্কার মুশরিকরা যখন তাকে অপুত্রক বলে ঠাট্টা মস্করা করতে শুরু করেন , আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তখন সুরা কাউসার নাজিল করেন । এর মাধ্যমে জাহেলী যুগের পুত্র সন্তানের আধিপত্য ইসলাম রহিত করে দেয় । আর যে আরবরা কন্যা সন্তান কে জীবন্ত কবর দিত ,ইসলাম এসে এক অভূতপূর্ব কথা শোনাল , যে নারীর প্রথম সন্তান কন্যা শিশু , সেই নারী সৌভাগ্যবতী! এমন কথা এর আগে কেউ কখনো শোনে নি। কারন এর আগে কন্যা সন্তানকে মন্দ ভাগ্য বা দুর্ভোগ্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো। এমনকি কন্যা শিশুকে তার পৈত্রিক সম্পত্তির উত্তরাধিকারীও করা হলো।
আবার আমাদের রাসুল (স:) বলেন , যার দুটি বা তিনটি কন্যা সন্তান আছে , আর সে তাদেরকে যথাযথ আদর ভালবাসা দিয়ে লালন পালন করবে , জন্নাতে সে আর আমি পাশাপাশি থাকব , বলে তিনি দুই আঙ্গুল একসাথে করে দেখান !!
দেখুন বেয়াইন এর পরেও আমরা যখন কেবল ছেলে সন্তানের জন্য হাহাকার করি তখন কতোট নির্বুদ্ধিতার পরিচয় আমরা দেই , সেই জাহেলী যুগের মানুষদের মত !!
আমি বলছিনা ছেলে সন্তান কারও চাওয়াই উচিত নয় বা খারাপ কিন্তু যুগ যুগ ধরে যে মেয়েদের মন্দভাগ্যের কারন বলা হতো , আপনি আমি যে ধর্ম পালন করছি, সেখানে কন্যাশিশুকে তার উল্টো সৌভাগ্যের প্রতীক বলা হলো আমাদের তা অন্তর দিয়েই মানতে হবে!”
নীলার মা হাফসা বেগমের কথা শুনে বললেন ,
“জানেন বেয়াইন আজ আপনার কথা শুনে মনে বড় শান্তি পেলাম ! আমার বিয়ের বেশ কয়েক বছর পর নীলার জন্ম । একে তো বিয়ের এতো বছর পরে সন্তান তায় আবার মেয়ে ।মানুষের কথায় আমার তখন ত্রাহি ত্রাহি দশা। সবচেয়ে কথা শুনিয়েছে খুব কাছের আত্মীয়স্বজরাই বেশী। আমার শাশুড়ী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার মেজো ছেলের বংশরক্ষা হলো না বলে হা হুতাশ করে গেছেন ।
মাঝে মাঝে আবার বিয়ে করবার জন্যও নীলার বাবাকে বলতেন কেবল ছেলে নেই বলে । আমার অন্য সব বোনেরই ছেলে আছে । কেবল আমারই একমাত্র মেয়ে তাই আমার খুব দু:ক্ষ ছিল এতোদিন আর পারিপার্শিক চাপ তো ছিলই। তবে নীলার বাবা মেয়ের বাবা হয়ে কখনোই একটুও অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে নি এই যা শান্তনা আমার । আজ আপনার কথা শুনে আমার এতো দিনে দু:ক্ষ, কষ্ট, না পাওয়ার বেদনা সব সব মুছে গেল আপা। “
এরই মধ্যে মিডওয়াইফ বের হয়ে জানালো তাদের নাতনী হয়েছে । মা এবং মেয়ে সুস্থ আছে। হাফসা বেগম আলহামদুলিল্লাহ বলে তার বেয়াইনের দিকে তাকিয়ে বললেন ,
“বেয়াইন আপনার মেয়েও আপনার মতো সৌভাগ্যবতী। তারও প্রথম সন্তান মেয়ে । আমরা নানা নানী দাদা দাদী হয়ে গেলাম আল্লাহর রহমতে । আসুন সকলে হাত তুলে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাই “।
নীলার মেয়ের নাম নীলা রেখেছে হাফসা ,তার শাশুড়ীর নামে । এর পর নীলা আরও দুটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেয় । তৃতীয় বার হাফসা বেগম তার স্বামীর অসুস্হতার জন্য আসতে পারলেন না । কিন্তু তিনি মেয়ে হবার খবরে অসম্ভব খুশী হলেন ।আর নীলাকে আর নাইমকে বললেন তারা জান্নাতে যাবার টিকেট পেয়ে গেছে, তা যেন নিজেদের ভুলে হারিয়ে না ফেলে।
নীলার শশুড় আর বাবা মারা যাওয়ার পর নীলা ওর শাশুড়ীকে নিজের কাছে নিয়ে আসার কথা জানালে , হাফসা বেগম বেঁকে বসেন । তিনি জানান নীলার মা তার চেয়েও একাকী হয়ে গেছেন । তার আরও এক ছেলে আছে । কিন্তু নীলার মা একেবারেই একা ! যদি যেতেই হয় দুই বেয়াইন এক সাথে যাবেন ।
নীলার এখন ভর ভরন্ত সংসার । তিন মেয়ে হাফসা, আইশা আর সওদা আর দুই মা আর স্বামী নিয়ে ওর সংসার কানায় কানায় পূর্ন !
হাফসা বেগম গত হয়েছেন প্রায় তিন বছর হলো আর তার মাত্র এক বছর পরই নীলার মাও গত হন ।
নীলা নীলার মেয়েদেরকে কখনো কোন রূপকথার গল্প শোনায় না। ও কেবল ওদেরকে ওদের দাদীমা’র গল্প শোনায়। মেয়েরা জানতে চায় তার দাদীমা কি কোন রাজকন্যা ছিলেন ! নীলা বলে না তিনি ছিলেন আমাদের পরিবারের রানী! যার সংস্পর্শে সবকিছু হেসে উঠত, অন্ধকার দূর হয়ে আলোর দেখা মিলত !
নীলা তার মেয়েদের বলে একজীবনে তারা যেন তাদের দাদীমা’র মতো হবার চেষ্টা করে । আর কোন চাওয়া নেই!!
নীলার ঘরে আগামী দিনের তিনজন হাফসা বেগম বেড়ে উঠছে! আমরা সেই ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখি যেদিন প্রতিটি সংসারে একজন করে হাফসা বেগম থাকবে! সেই সুদিনের প্রতীক্ষায় রইলাম আমরা !!
-: সমাপ্ত :-
ভাবির সংসার গল্পের লিংক
STORY line ta atotai sundor je ami sese ase kede felechi. Arokom sasuri jodi sobar ghor e thakto tobe meder jibon ato koster hotona. Love this story.
Vai onak dhonnobad ato sundor akta golpo upohar dawar janno asha rakhi ai dhoronar gothon mulok golpo aro pabo asha rakhi
ato sundor lihkoni.. ato sundor vabe dormo chorccha k futiye tulche j ber ber amar choker kone pani jome gese…