#আমার আব্বার কুরবানী দেয়ার সামর্থ্য ছিলো না।
আমার আব্বা ঈদের নামাজ পড়ে বাড়িতে ফিরে এসে কেঁদেছিলেন।
আমার আব্বার কুরবানী দেয়ার সামর্থ্য ছিলো না।
আমার আব্বা জমির দলিল জমা রেখে ব্যাংক থেকে কৃষিঋণ নিয়েছিলেন।
আমাদের কিনে নেয়া জমি- অথচ পূর্বপুরুষেরা বিক্রি করলেও জমির ওয়ারিশেরা মামলা করে আমাদের বিরুদ্ধে।
একদিন মামলার জবাব দিতে আব্বা জেলা আদালতে আসার পথে পলিথিনের ব্যাগে রাখা দলিল ও কাগজাদী চুরি হয়ে যায়- বাসের ভেতর ঠাসাঠাসি ভীড়ে।
কি নিদারুণ ব্যাপার, আব্বার সাথে থাকা আমাদেরই পক্ষের সাক্ষী দলিলের খোঁজ দেন- সাক্ষীর আত্নীয় পেয়েছে সে দলিল।
আব্বা তাঁর কাদামাটিতে লেপে মুখবন্ধ গোলার সব ধান বিক্রি করে উদ্ধার করেন দলিলগুলো।
একদিন ব্যাংক থেকে উকিলের লাল নোটিশ আসে- ব্যাংক লোন শোধ না করলে পুলিশ কেস।
পড়াশোনা শেষে আমি তখন সদ্য ইশকুল মাস্টার।
বাড়ির সামনের সড়ক দিয়ে মাইকিং হয়- ঋণ খেলাপীগণ, ঋণ পরিশোধ করুন।
অন্যথায় ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আইনের আশ্রয় নিতে বাধ্য থাকবে।…
আমার আব্বা আমাকে মোবাইল ফোনে জানান সে খবর- বড় বেশি উদ্বিগ্ন তিনি। আব্বাকে নকিয়া এগারো’শ মডেলের একটা মোবাইল ফোন কিনে দিয়েছিলাম আমি।
উদ্বিগ্ন আব্বাকে অভয় দিই- তাঁকে বলি, ঠিক আছে, ম্যানেজার সাহেব কে বলুন, সব হিসেব-নিকেশ করে রাখতে- এই আমি রওনা হচ্ছি ঋণ পরিশোধ করতে।
আমি আব্বার কাছে জানতে চাই, সেই ম্যানেজার সাহেব কি এখনো আছেন যিনি আপনার জন্য তেরো হাজার টাকা ঋণ বরাদ্দ করে আপনার হাতে দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন পূর্ব চুক্তিমত?
আমি সেই সুপারভাইজারের কথা জানতে চাই আব্বার কাছে, যার জন্য অনেক বড় সাইজের দুইটি কার্পূ মাছ জিইয়ে রেখেছিলেন আব্বা আমাদের উঠোনে বড় ডেগচিতে।
মাছ পেয়ে খুশি হয়ে সুপারভাইজার সরেজমিন দেখে গিয়ে আপনার কাঙ্খিত ঋণ পাইয়ে দেন যেন- নইলে চাষ হবে কী করে!
আমি আব্বাকে বলি, ম্যানেজার সাহেব কে বলুন, সব হিসেব করে রাখতে। এই আমি রওনা হচ্ছি ঋণ পরিশোধ করতে।
সেদিন এমনি তুমুল বৃষ্টির দিন ছিলো।
আমার পকেটে একবান্ডিল নোট পলিথিনে মোড়া।
আব্বা অপেক্ষা করছিলেন ব্যাংকের বারান্দায়।
আমি এমনি শ্রাবণের ঘোর বৃষ্টির ভেতর প্রায় একশো কিলোমিটার বাইক চালিয়ে পৌঁছে গেছি রায়গঞ্জে- আব্বা সেখানে অপেক্ষা করছেন ব্যাঙ্কে। আমার জিন্সের পকেটে পলিথিনে মোড়ানো পিতৃঋণ পরিশোধের টাকা।
ব্যাংকে পৌঁছে আমি আব্বাকে নিয়ে বসি গিয়ে ক্যাশিয়ারের সামনে। তৎক্ষনাৎ সমস্ত ঋণ পরিশোধ করে দিয়ে আব্বাকে বাইকের পেছনে বসিয়ে বাড়িতে ফিরেছিলাম আমি।
সত্যিই সেদিন অনেক বড় মানুষ মনে হয়েছে আব্বাকে- মনে হয়েছে, পুত্রগর্বে আব্বার উঁচু মাথা যেন ব্যাংকের ছাদ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করছে।
ঈদের নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরে আব্বা কেঁদে ছিলেন।
আমার কৃষক আব্বার দুটি সত্যিকার দূর্দান্ত হালের ষাঁড় একরাতে চুরি হয়ে যায়।
আব্বার কষ্ট বোঝার মত অতটা বয়স আমার তখন ছিল কি? আমি তখন হাই ইশকুলে পড়ি।
কিন্ত আমি আব্বার খাঁ খাঁ বুকের শূন্যতা ঠিকই দেখেছিলাম আমার অল্পবয়সী চোখে।
সে বছর আব্বা এসেছিলেন রংপুরে।
আমি স্কুল শেষে বাসায় ফিরছিলাম।
দূর থেকে দেখি ‘ক্যাটস্ প’ থেকে আমার রিসেন্ট কেনা কালোর ওপর সাদা র্স্ট্রাইপ শার্টের মত একটা শার্ট কেউ একজন পড়ে যাচ্ছেন আমার সামনে দিয়ে। ভালো করে চেয়ে দেখি আব্বা আমার শার্ট পড়ে বের হয়েছিলেন। আমরা বাবা- ছেলে একই শার্ট পড়ি এখনো।
যদিন বাড়িতে ফিরে যাবেন আব্বা, সেদিন তাঁকে এতো করে বললাম শার্টটা নিয়ে যেতে- না, তিনি নেবেন না।
এরপর বাড়ি গিয়ে জোর করে শার্টটি রেখে এসেছিলাম।
একদিন শার্টটি পড়ে বাড়ির পাশের স্কুল মাঠ সংলগ্ন দোকানে গিয়েছেন তিনি। তাঁর বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলেছেন, ছেলেকে পড়ালেখা করিয়েছেন বলেই না এত সুন্দর শার্ট গায়ে চাপাতে পাচ্ছেন তিনি।
কয়মাস পরে মাকে সাথে নিয়ে আব্বা এসেছিলেন আমার রংপুরের বাসায়। তাঁকে
জোড় করে নিয়ে যেয়ে সুন্দর একটা সোনালী চেইন ঘড়ি কিনে দিয়েছি সুপার মার্কেট থেকে। চোখের ডাক্তার দেখিয়ে প্লাস পাওয়ারের চমৎকার ফ্রেমের একটা চশমা গড়িয়ে দিয়েছি। এ্যাপেক্স জুতার শোরুম থেকে একজোড়া স্যান্ডেল কিনে দিয়েছি।
প্রতিটি জিনিস কিনতে দোকানে ঢোকার আগে ঝগড়া করতে হয়েছে তাঁর সাথে, রীতিমত জবরদস্তি করে তারপর কিনে দিতে হয়েছে সবকিছু।
রোজার মাসে সেহরির সময় মাকে ফোন দিয়ে জিগ্যেস করি, বিদ্যুৎ আছে, মা!
মা বলেন, আছে।
আরো বছর কয় আগের কথা।
আশেপাশের বাড়িগুলোতে বিদ্যুৎ সংযোগ গেলেও আমাদের বাড়িতে এতদিন বিদ্যুৎ ছিলো না।
একদিন শুক্রবার কুড়িগ্রাম থেকে তিনশত বিশ হাত ক্যাবল ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি কিনে রংপুর থেকে সিলিং ফ্যান নিয়ে যেয়ে সারাদিন বাড়িতে বিদ্যুতের ওয়্যারিং করিয়ে সব সেট করে দিয়ে এসেছি।
দুপুরের প্রচন্ড রোদে জমির কাজ সেরে বাড়িতে ফিরে বা রায়গঞ্জের হাট থেকে সাপ্তাহিক বাজার করে ফিরে গরমে ফ্যানের নীচে বসলে যখন শরীর জুড়ায় তাঁর, পরম প্রশান্তিতে তিনি মাকে বলেন, আমার বাবা রংপুর থেকে ফ্যান এনে সেট করে দিয়ে গ্যাছে- আমার বাবা।
মার কাছ থেকে ফোনে এসব শুনে গলা রুদ্ধ হয়ে আসে আমার আবেগে। কান্না দলা পাকিয়ে উঠে আসে বুক বেয়ে।
মনেপড়ে, একের পর এক হালের জমি বন্ধক রেখে, জমি, হালের গরু, বাড়ির পুরাতন সব গাছ বিক্রি করে কিভাবে আব্বা আমাদের ভাইবোনদের পড়ালেখার খরচের টাকা পাঠাতেন।
আব্বা, এখন কুরবানী দেন চাচাদের সাথে ভাগে। এখন আব্বার কোন ব্যাংক ঋণ নেই। আব্বা এখন কুরবানীর ঈদে ব্যস্ত থাকেন কাজে। পরশী ও স্বজনদের বাড়িতে তিনিও কুরবানির মাংস পাঠান এখন ঈদের দিন বিকেলে।
আমি কুরবানী দেয়ার মাঠে যাই।
আব্বার ব্যস্ততা দেখি কাছে যেয়ে মিনিটকয়। দেখি ঘামে ভেজা আব্বার প্রশান্তিময় মুখ।
তারপর স্কুল মাঠের দোকান পাড়ে গিয়ে বসি দোকানের ঝাঁপের নিচে পেতে রাখা বেঞ্চিতে।
এখন আব্বার কোন ব্যাংক ঋণ নেই-
আমার ভাবতে ভালো লাগে।
আব্বা ঈদের দিন বাড়ি ফিরে কাঁদেন না আর।