#আঠারো_বছর_বয়স
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৪
বিভোর অনেক ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালো যে রুহিকে ওর বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে আসবে। দরকার হলে ওর ফ্যামিলিকে বোঝাবে যে এখন যাতে ওর বিয়ে না দেয়। তাছাড়া এক্সিডেন্টলি ওদের যে বিয়ে হয়েছে সেটা ভাঙার জন্যও কিছু করতে হবে। ও কিছুতেই বিয়েটা মানতে পারছেনা। নিশ্চয়ই রুহিও৷ বিয়েটা মানবেনা। যেই ভাবা সেই কাজ।
‘ আমি তোমাকে বাড়ি দিয়ে আসবো, সত্যিই যাবে?’
রুহি মাথা নেড়ে বলল,
‘ হুম।’
‘ শিওর?’
‘ জ্বি!’
‘ কতদূর পড়াশোনা করেছো? কিসে পড়ো?’
‘ এইট অবধি পড়েছিলাম। এরপর ভাইয়া পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়েছে, কিন্তু আমি লুকিয়ে এস.এস সি এক্সাম দিয়েছি। কেউ জানেনা।’
বিভোর চোখ কপালে তুলে বলল,
‘ রিয়েলি?’
‘ হুম। কিন্তু জানতে পারলে ওরা আমাকে মেরেই ফেলবে!’
‘ কেন?’
‘ কারণ ওরা চায়না আমি পড়াশোনা করি।’
‘ এটা তো খারাপ।’
রুহি মাথা নিচু করে বসে রইলো। বিভোর পানি এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ পানি খাও। ভালো লাগবে।’
‘ আপনি সত্যিই ডাক্তার?’
বিভোর হেসে বললো,
‘ হুম।’
‘ ডাক্তারদের আমি পছন্দ করি।’
‘ জানি।’
‘ আচ্ছা।’
বিভোর অস্বস্তি বোধ করছে। কিন্তু তাও সাহস করে বলল,
‘ তোমার সাথে আমার কিন্তু বিয়ে দিয়ে দিয়েছে ওরা। কিন্তু আমি এই বিয়েটা মানিনা। আমি এটা থেকে খুব শ্রীঘ্রই বেরিয়ে আসবো, ডোন্ট ওরি!’
রুহি কিছু বললো না। ভাবতেই পারছেনা ও এখম বিবাহিতা আর সামনে বসা অচেনা ব্যক্তিটি ওর স্বামী। যার সাথে কাল রাতে ট্রেনে দেখা হলো মাত্র। সময়ের মূল্য অনেক। নইলে রুহি কী কোনোদিন ভেবেছিলো নরক থেকে পালিয়ে এসেও ও বাঁচতে পারবেনা? ভাবেনি। ওইখানে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই ওর। বেরুবার সময় মাথায় এতোকিছু আসেনি, কিন্তু এখন আসছে। কোথায় যাবে, কি করবে, কি খাবে সেসবই ঠিক করে উঠতে পারেনি, তার মধ্যেই হুট করে কয়েকটা ছেলে ওর বিয়ে দিয়ে দিলো।
মাথাটা ঝিমঝিম করছে। ও মানুক আর না মানুক বিয়ে হয়েছে ওর। বাড়ি ফিরলে মাহিম ওকে আবার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে, তাও সজীবের সাথে। এবার বোধহয় বিয়েটা করতেই হবে। কারণ যে ডাক্তারের সাথে ওর বিয়ে হয়েছে সেই লোকটা ওকে মানেনা। আর কোনোই পথ খোলা নেই রুহির কাছে।
‘ কি ভাবছো?’
‘ কিছুনা। আচ্ছা এটা কোন জায়গা?’
‘ এটা ফেনী।’
রুহি চোখ কপালে তুলে বলল,
‘ আমরা তাহলে যাচ্ছিলাম কোথায়? ট্রেনটা কোথায় যেতো?’
‘ ঢাকায়। কিন্তু তোমার বাড়ি কোথায়?’
‘ মহেশখালী!’
‘ ওহহ আচ্ছা। সকালেই নিয়ে যাবো।’
রুহি কিছু না বলে জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে রইলো। ঘরে লাইট অফ করা, টিমটিমে একটা বাতি জ্বলছিলো এতোক্ষণ। জানালা খুলতেই বাইরের কালচে-সাদ রুপ আবর্তিত হলো। নদীর পাশে হুজুরের এই দোতলা বাড়িটা হওয়ায় পানির শব্দ শোনা যাচ্ছে। বাতাস খুব জোরে বইছে। দমকা হাওয়ায় রুহির চুলগুলো লেপ্টে গেলো বিভোরের মুখে। মিষ্টি সুবাস আছে ওর চুলে। ঘ্রাণটা মোহনীয়!
না চাইতেও বিভোর চুলগুলো সরিয়ে দিলো। মেয়েটা কাগজেই ওর স্ত্রী। মন থেকে কোনোদিন বিভোর মানতে পারবেনা একে। কিন্তু এই মুহূর্তে রক্তজবার মতো আকর্ষণীয় লাগছে রুহিকে। সদ্য ফোঁটা তাজা রক্তজবা ভোরবেলা যেভাবে কলি ফেটে বেরিয়ে আসে ঠিক তেমনই। মুগ্ধ হওয়ার মতো কিছু সময়।
রুহির সেদিকে খেয়াল নেই। ও আছে গভীর দুশ্চিন্তায়। সকাল হতেই বিভোর রুহিকে তাড়া দিলো। হুজুর ওদেরকে জোড়াজুড়ি করলো খাবার খাওয়ার জন্য। কিন্তু বিভোর আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়াতে চাইলো না। রুহির কাছ থেকে ঠিকানা জেনে নিয়ে বাসে চাপলো দুজনে। খুব বেশি যাত্রী নেই গাড়িতে। এদিকে ক্ষুধায় পেট জ্বলে যাচ্ছে রুহির। বিভোর রোল নিয়েছিলো দুইটা, নিজে একাই খাচ্ছে৷ পাশে কে আছে তাতে হুঁশ নেই। হঠাৎ রুহির দিকে চোখ পড়তেই মনে পড়লো মেয়েটা না খেয়ে আছে। ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করলো,
‘ কিছু খাবে?’
রুহি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো। বিভোর ওর দিকে রোল এগিয়ে দিলে রুহি বলল,
‘ আমি রোল খাইনা।’
বিভোর রেগে বলল,
‘ আশ্চর্য! আমি বাসের মধ্যে এখন কি বিরিয়ানি এনে দিবো?’
‘ নাহ। আচ্ছা থাক লাগবেনা।’
রুহি হেসে না বললো। তারপর বাইরের দিকে মনোযোগ দিলো। বিভোর রেগে কিছুক্ষণ ভাবনাচিন্তা করে ড্রাইভারকে বলল,
‘ এই মামা, গাড়ি থামাও।’
রুহি চমকে ওঠে বলল,
‘ আমার বাড়ি এখানে নয়।’
‘ একদম চুপ। বেশি বুঝো কেন? আমি কি বলেছি এখানে তোমার বাড়ি? রাবিশ!’
ড্রাইভার গাড়ি থামাতে চাইলো না। হেল্পার এসে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিলো। বিভোর রেগে গেলো প্রচন্ড। বলল,
‘ এক্ষুণি গাড়ি থামান বলছি।’
‘ কেন থামামু? এই বাস মহেশখালী গিয়াই থামবো। আর কোনোহানে থামানো যাইব না।’
‘ দেখুন,প্রবলেম না থাকলে বলতাম না। আমার দরকার আছে।’
‘ দরহারটা কী?’
‘ বলা যাবেনা।’
‘ তাইলে আমিও থামামু না।’
‘ আরে আমি খাবার কিনতে চাই। ক্ষিধে লেগেছে।’
বাসের হেলপার দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো,
‘ পালোয়ানের মতো শরীর আর দুই মিনিট পরপর আপনের ক্ষিধা লাগে? এক্ষুণি দেখলাম রোল খাইসেন আর এক্ষুনি ক্ষিধা লাইগা গেল? আজব কারবার।’
বিভোর কালো চেহারা করে বলল,
‘ এই আপনি বেশি বুঝেন ক্যান হ্যাঁ? যত্তসব আজাইরা।’
‘ আপনি বেশি খাইবেন আর আমরা কইলেই দোষ? কোথা থেকে আসেন মিয়া।’
‘ একদম ঠাট্টা করবেন না। আমি আমার জন্য না, ওই মেয়েটার জন্য খাবার কিনতে যাচ্ছি।’
সবার চোখ পড়লো রুহির উপর। রুহি মাথা নিচু করে ফেললো। হেলপার ওকে একপলক দেখে বলল,
‘ মাইয়াডা কিডা? আপনের বোন?’
বিভোর ইতস্তত করে বলল,
‘ না।
‘ তাইলে কে?’
‘ বলতে পারবোনা।’
হেলপার যতোটা না ত্যাড়া তার চেয়ে বেশি বিভোর ত্যাড়া। দুজনের কেউ কাউকে ছাড় দিচ্ছেনা। বিভোর কিছুতেই স্বীকার করবেনা এই মেয়ে কে? রুহি ওর কি লাগে। কিসের সম্পর্ক। বাসের এক যাত্রী চিৎকার করে বলল,
‘ মনে হয় দুইজন বাড়ি থেইকা পালায় আসছে৷ বুঝো না? হা হা!’
বিভোর রেগে ওই ছেলের কাছে গিয়ে ঠাস করে চড় মেরে দিলো। ছেলেটা গালে হাত দিয়ে ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।
ডাক্তার যে এভাবে ঝগড়া করতে পারে রুহি ভাবতেও পারেনি। এতো পুরোই সাইকো। রুহি অসহায় গলায় বলল,
‘ আমি কিছু খাবোনা। আপনি চুপ করে বসুন।’
হেল্পার কাটা গায়ে নুনের ছিঁটা দিতে বলল,
‘ চুরি চুরি আবার সিনাজুড়ি! মাইয়াডারে ভাগাইয়া নিয়ে আইসা এখন আমাগো যাত্রীদের উপর ক্ষেইপা লাভ আছে? তোমরা দোষ করলে কিছু না, আমরা কইলেই দোষ!’
বিভোরের মাথা গরম হয়ে গেলো নীতিবাক্য শুনে। এমনিতেই মনমেজাজ খারাপ তার উপর বাসের লোকগুলো যা নয় তা বলে যাচ্ছে দেখে বিভোর চিল্লিয়ে বলল,
‘ এই মেয়েটা আমার বউ। ওকে? আমি কাউকে পালিয়ে নিয়ে আসিনি, আর আমার বউয়ের ক্ষিধে লেগেছে তাই খাবার কিনতে যাবো। এখন গাড়ি থামান।’
ওর চিৎকার শুনে সবার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। রুহি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। বিভোর বলছেটা কী? আশ্চর্য! ড্রাইভার বাধ্য হয়ে এবার গাড়িটা একটা হোটেলের সামনে থামালো। হেল্পারকে তাচ্ছিল্যভরা একটা হাসি উপহার দিয়ে বিভোর গাড়ি থেকে নামলো। ছাউনিঘেরা ছোটখাটো ভাতের হোটেল। কি কি মেন্যু পাওয়া যায় তার তালিকা বাইরে ঝোলানো আছে। ভাত, ডাল, সবজি, মাংসের তরকারি আর বিরিয়ানি। এছাড়া কিছু ফার্স্টফুড। বিভোর দুই প্যাকেট বিরিয়ানি আর কোল্ড ড্রিংকসের বোতল নিয়ে এক হাজার টাকার নোট দিলো দোকানিকে। ভাংতি টাকা না পাওয়ায় পুরো টাকাটা দিয়েই খাবার নিয়ে চলে এলো।
ও খাবার নিয়ে গাড়িতে উঠতেই বাস ছেড়ে দিলো। রাগে গজগজ করছে ও। বিভোরের রাগ দেখে রুহি চুপচাপ বিরিয়ানি খেতে লাগলো। কি ভয়ংকর পরিস্থিতি রে বাবা। বাড়ি গেলে তো এরচেয়ে ভয়ানক পরিস্থিতিতে পড়তে হবে ভেবেই গলা শুকিয়ে গেলো রুহির। খাবার মুখে তোলার ইচ্ছেটাও মরে গিয়েছে।
‘ কী? খাচ্ছোনা কেন? আমি কি টাকা দিয়ে আনিনি? আজব!’
‘ খেতে ইচ্ছে করছে না।’
‘ দেখো আমাকে রাগালে ভালো হবেনা, এমনিতেই মাথা গরম আছে।’
‘ জ্বি খাচ্ছি!’
‘ নাও স্টার্ট। আর এভাবে খাচ্ছো কেন? খাওয়া শিখোনি? ঠিকমতো খাও, খাবার কেউ চুরি করতে আসবেনা।’
অপমানিত বোধ করলো রুহি। এরপর আর কথাই বললো না। বাড়ি পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা হয়ে গেলো অনেক। বিভোর নিজেই নিয়ে এলো বাড়িতে। ভয়ে কান্না চলে এলো রুহির। উঠোনে আসতেই মাহিমকে দেখতে পেলো ওরা। ফোনে কার সাথে যেন রেগে কথা বলছে। হঠাৎ রুহিকে দেখতে পেয়েই ফোন কেটে দিয়ে তেড়ে এলো ওর দিকে। হিংস্র গলায় বলল,
‘ ওই হারামি, কই গেছিলি তুই? তোরে খোঁজার জন্য চারদিকে লোক পাঠাইছি আর তুই এখন বাড়ি ফিরছস। তোর সাহস তো কম না, তুই জানালা দিয়া পলাস।’
রুহি কাঁদতে থাকে। বিভোর অবাক হয়ে যায় মাহিমের মুখের ভাষা শুনে। কিসব ভাষায় কথা বলছে বোনের সাথে। ছিঃ!
মাহিমের স্ত্রী ফাহিমা এসে রুহির গালে কয়েকটা থাপ্পড় মেরে বলল,
‘ সজীবের লগেই তোর বিয়া দিমু আইজকা। দেখি কেমনে ঠেকাইতে পারস। তোর রুপের দেমাগ না কমাইতে পারলে আমিও ফাহিমা না। আর এই পোলা কেন তোর লগে? কেমনে বাঁচবি আমিও দেখুম!’
রুহিকে নিরুত্তর থাকতে দেখে ওকে মাটিতে ফেলে মার্তে থাকে মাহিম। বিভোর গিয়ে আটকায়। মাহিম এতক্ষণ খেয়ালই করেনি বিভোরকে। এবার দেখতে পেয়ে ক্ষেপে যায়। বলে,
‘ এই নাগরের লগে পলাইছিলি বুঝি হারামজাদি!’
বিভোর ধমক দিয়ে বলল,
‘ এসব কি বলছেন আপনি? সম্মান দিয়ে কথা বলুন।’
‘ কারে সম্মান করমু? তোরে না এই হারামজাদিরে?’
ক্ষেপাটে গলায় বিভোর উত্তর দেয়,
‘ বিশ্রি ভাষা যদি আরেকবার ব্যবহার করেন তাহলে এক থাপ্পড়ে দাঁত ফেলে দিবো আপনার!’
‘ দেমাগ দেখাস? কু* বাচ্চা!’
বিভোর এবার আর সহ্য করতে পারেনা। ঠাস করে একটা থাপ্পড় মারে মাহিমকে। দূরে ছিঁটকে পড়ে মাহিম। বিভোর রুহিকে মাটি থেকে তুলে মাহিমের উদ্দেশ্যে বলল,
‘ এই মেয়েটাকে আমি আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে পুলিশকে জানাতে বাধ্য হবো।’
রুহি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়। পুলিশের কথা শুনে চুপসে যায় মাহিম-ফাহিমা। বিভোর কিছুতেই নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা। একটা মেয়েকে এভাবে মারধর করা হয় তার উপর জোর করে বিয়ে দেওয়ার কথা বলছে? কত বড় সাহস ওদের। কিন্তু বিভোর থাকতে রক্তজবাকে এই নরকে রেখে যেতে পারবেনা। স্ত্রী হিসেবে না মানুক, অন্তত সাহায্য তো করতে পারে। ঢাকায় নিয়ে গিয়ে না হোক কোনো একটা ব্যবস্থা করা যাবে, যেহেতু মেয়েটার কেউ নেই।
গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি। ভুল ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।
চলবে…ইনশাআল্লাহ!