নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৬১.
চারদিকে ভীষণ অন্ধকার। কানের পাশে শো শো বাতাস। জায়গাটা কোনো ব্রিজের কাছে। নিচে টলমলে কালো জল। আকাশে ভীষণ মেঘ। অন্ধকার আকাশে আঁধার করে আসা বিষণ্নতা। থেকে থেকে টিপ টিপ বৃষ্টি। নম্রতার গা ছমছম করছে৷ কানদুটো তালা লেগে যাচ্ছে নিশাচরদের ঝিমঝিম শব্দে। নম্রতা ভয়ে ভয়ে চারপাশটা দেখল, কেউ নেই। এমন একটা নিস্তব্ধ জায়গায় কেন নিয়ে এলো নিষ্প্রভ? নিষ্প্রভ কী জানে না, নম্রতা অন্ধকার ভয় পায়? নম্রতা থেকে বেশ দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে আছে আরফান। গায়ে তার ধূসর রঙের শার্ট। অন্ধকারে চেহারা অস্পষ্ট। এই অস্পষ্ট চেহারার দিকে তাকিয়েও নম্রতা বুঝে ফেলল, আরফানের মনটা ভীষণ খারাপ। চোখ-মুখ শুকনো। নম্রতা উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করল,
‘ আমরা কোথায় আছি ডক্টর? জায়গাটা আমি চিনতে পারছি না। আমার ভীষণ ভয় লাগছে। ফিরে চলুন।’
আরফান নিস্পৃহ কন্ঠে বলল,
‘ এখান থেকে ফেরার উপায় নেই নম্রতা।’
নম্রতা চমকে উঠল। শরীর বেয়ে বয়ে গেল শীতল রক্তস্রোত। আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
‘ উপায় নেই! কেন? এখানে এতো অন্ধকার কেন? এতো অন্ধকার আমার সহ্য হচ্ছে না ডক্টর। আমি আপনাকে দেখতে পারছি না। কাছে আসুন।’
আরফান ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
‘ সম্ভব নয়।’
নম্রতা উম্মাদের মতো বলতে লাগল,
‘ আমি অন্ধকার সহ্য করে পারছি না। আমি অন্ধকার সহ্য করতে পারছি না। এখানে খুব অন্ধকার। আলো জ্বালুন।’
‘ আমার কাছে আলো নেই নম্রতা।’
‘ এটা কোথায়? জায়গাটা আমি চিনতে পারছি না কেন?’
‘ আপনি চিনতে পারছেন। খেয়াল করে দেখুন। এটা আপনার আর আমার খুব পরিচিত জায়গা। খুব।’
আরফানের শেষ কথাটা কেমন ফিসফিসের মতো শোনাল নম্রতার কানে। হালকা বাতাসে ধাক্কা দিয়ে উড়ে গেল অনেক দূরে। নম্রতা চোখ মেলে দেখতে চেষ্টা করল। বিস্ময় নিয়ে খেয়াল করল, জায়গাটা তার পরিচিত। এইতো চির পরিচিত সেই সিঁড়ি। শাহবাগ গ্রন্থাগার। নম্রতা আশেপাশে কোনো ব্রিজ বা নদী দেখতে পেল না। ভীষণ আশ্চর্য হয়ে বলল,
‘ আমরা এখানে কেন এসেছি ডক্টর?’
‘ বিদায় জানাতে।’
‘ বিদায়?’
‘ হ্যাঁ, বিদায় নম্রতা। এখান থেকে শুরু হওয়া গল্পটির বিদায় ঘন্টি বেজে গিয়েছে নম্রতা। এখানে তৈরি হওয়া শ্যামলতা এখানেই নিঃশেষ। আপনার আর আমার পথ ভিন্ন। আমাদের আর এগোনোর পথ নেই।’
নম্রতার ভেতরটা ভয়াবহ শঙ্কায় কেঁপে উঠল। ছলছল চোখে চেয়ে বলল,
‘ কি বলছেন?’
‘ আপনাকে আমি চাই না নম্রতা। আমি যাকে চাই সে আপনি নন। আপনাকে হারিয়ে যেতে হবে নম্রতা। সময়ের কাল গর্ভে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া শ্যামলতার মতোই হারিয়ে যেতে হবে আপনাকে। তবেই না আমি এগোতে পারব।’
নম্রতার চারপাশটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। বুকের ভেতর তীক্ষ্ণ হাহাকার। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির মুখ অস্পষ্ট হয়ে উঠে আরও। তবুও নম্রতা দেখতে পায়, মানুষটির চোখে তীব্র বিরক্তি, ভয়াবহ বিতৃষ্ণা। তীক্ষ্ণ হয়ে বাজে একটাই কন্ঠ,
‘ আপনি হারিয়ে যান নম্রতা। আপনি হারিয়ে যান। আপনাকে আমি চাই না। হারিয়ে যান।’
নম্রতা ডুকরে কেঁদে উঠল। চিৎকার করে উঠল তার কন্ঠনালী। বুকের ভেতরটা দ্বগ্ধ হল। নিঃশ্বাস আটকে এলো। নম্রতার হঠাৎ মনে হলো, সে বাঁচতে পারছে না। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। অসাড় শরীর নেড়ে নিজেকে রক্ষা করতে পারছে না। নম্রতা মারা যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে। তারপর হঠাৎই বহুদূর থেকে ভেসে এলো অসংখ্য কন্ঠস্বর। ওগুলো কে? নাদিম, রঞ্জন? না। ওরা নয়। বাবা। হ্যাঁ, নম্রতার প্রিয় বাবা। নম্রতা বাবার কাছে ছুটতে চেষ্টা করল। ভীষণ চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল, বাবা! আমার বাবা। বাবা শুনেছে। কেউ না শুনলেও তার ডাক শুনেছে বাবা। উম্মাদের মতো ছুটে আসছে। নম্রতাকে বুকে আগলে নিতে ছুটে আসছে।
‘ মা? নমু মা? কি হয়েছে আম্মু? এইতো বাবা। এমন ছটফট করছিস কেন মা?’
নম্রতা বড় বড় নিঃশ্বাস টেনে চোখ মেলে তাকাল। নন্দিতা রুদ্ধ কন্ঠে ডাকল,
‘ আপু?এই আপু? কি হয়েছে তোমার? এমন করছ কেন? বাবা? কি হচ্ছে আপুর?’
নম্রতার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ভীষণ ভয়ে থরথর করে কাঁপছে শরীর। মেহরুমা গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বললেন,
‘ আম্মু? কি হয়েছে আম্মু? নমুর বাবা? আমার মেয়ে এমন করছে কেন? আমার কলিজা, আম্মু? নমু মা? খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস সোনা? কোথায় কষ্ট হচ্ছে মা?’
নুরুল সাহেব ধমকে উঠে বললেন,
‘ আহ! এখন চিৎকার চেঁচামেচি করার সময় নয় মেহরুমা। মেয়েটাকে ইজি হতে দাও। দৌঁড়ে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো। এভাবে চিৎকার করে তাকে ভরকে দিও না।’
মেহরুমা থামলেন না। গুনগুনিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে গেলেন পানি আনতে। নন্দিতা দৌঁড়ে গিয়ে বসল বোনের পাশে। ভয়ে চোখ-মুখ শুকিয়ে গেছে তার। বোনের হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে ক্রমাগত মালিশ করে চলেছে। নুরুল সাহেব নম্রতার গালে হাত দিয়ে আলতো কন্ঠে ডাকলেন,
‘ নমু মা? বাবা পাশে আছে। ভয় কী? ভয় নেই। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে? কী হয়েছে? বাবাকে বল। এই দেখ বাবা পাশে। ভয় নেই তো মা।’
নম্রতার শ্বাসকষ্ট ধীরে ধীরে কমে এলো। চোখ ঘুরিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করল নিজের প্রাত্যহিক বিছানায়। পাশেই বসা বাবা আর বোন। নম্রতার শরীরটা ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ওটা স্বপ্ন ছিল? এতো বাস্তব স্বপ্ন! ঘামে জবজবে শরীর নিয়ে চট করে উঠে বসল নম্রতা। ঘরে তীক্ষ্ণ কোনো আলো নেই, ঢিম লাইট জ্বলছে। খোলা জানালার পাশে গাঢ় অন্ধকার। নম্রতার শ্বাস আটকে এলো। বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে থরথর করে কাঁপতে লাগল। উম্মাদের মতে চিৎকার করতে লাগল হঠাৎ,
‘ অন্ধকার কেন? আমার অন্ধকার সহ্য হচ্ছে না। আলো জ্বালাও। আলো জ্বালাও। বাবা! বাবা! বাবা আলো জ্বালাও। আমি অন্ধকার সহ্য করতে পারছি না।’
নুরুল সাহেব মেয়েকে ঝাপটে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। নন্দিতা ছুটে গিয়ে আলো জ্বালিয়ে ভয়ার্ত চোখে চেয়ে রইল। নম্রতা ধীরে ধীরে শান্ত হলো। নুরুল সাহেব এই নিয়ে কোনো প্রশ্ন করলেন না। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে বসে রইলেন। দোয়া পড়ে মেয়ের গায়ে বার কয়েক ফু দিয়ে মেয়েকে পানি খাওয়ালেন। তারপর আবারও আগের মতোই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন চুপচাপ। সেই রাতে ছোট্ট নন্দিতা পর্যন্ত ঘুমোতে গেল না। বোনের একহাত ধরে চুপ করে বসে রইল। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ধুম করে জ্বর হলো নম্রতার। মেয়ের ভয়ানক জ্বরে দিশেহারা হয়ে পড়লেন মেহরুমা। মেয়েকে বাবার কাছে রেখে ওযু করে জায়নামাজে বসলেন। কলিজার মেয়েটার জন্য ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে তার। বেশ তো বন্ধুর বিয়ে থেকে এলো। হঠাৎ কি হলো মেয়েটার? রাত-বিরেতে ঘুরে বেড়ায়, খারাপ কিছুর নজর পড়েনি তো আবার?
_
তখন মধ্যরাত। বারোটা কি একটা বাজে। ছোঁয়ার বিয়ে থেকে ফিরে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে নীরা। বিছানার এক কোণায় বসে তার দিকেই অপলক চেয়ে আছে অন্তু। ভীষণ অস্বস্তিতে কাটা হয়ে আছে নীরা। কাল রাতের ওমন ঘটনার পর লজ্জায় মাথা তুলে তাকানো যাচ্ছে না। অথচ অন্তুর চোখে যেন আজ রাজ্যের অবসর। নীরা আড়চোখে তাকাল। সাথে সাথেই চোখে চোখ পড়ল দুজনের। নীরা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে অন্তুর দিকে পিঠ করে বিছানায় বসল। চুলগুলো হাত খোপা করে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পড়ল এক কোণায়। কাঁথা দিয়ে টুপ করে মুখ ঢেকে নিয়ে চোখদুটো খিঁচে বন্ধ করে ফেলল লজ্জায়। পুরো ব্যাপারটা সূক্ষ্ম চোখে নিরক্ষণ করে বেশ মজা পেয়ে গেল অন্তু। নীরার দিকে কিছুটা সরে বসে নীরার মাথার কাছাকাছি ঝুঁকে এসে হুট করেই টেনে সরিয়ে দিল কাঁথা। নীরা বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই হাসল অন্তু। চোখ টিপে বলল,
‘ হ্যালো।’
নীরা ভরকে গেল। কাঁথা নিয়ে আবার মুখ ঢাকল। অন্তু আবারও একই কাজ করতেই দুই হাতে মুখ ঢেকে অসহায় কন্ঠে বলল নীরা,
‘ উফ! আমি লজ্জা পাচ্ছি।’
নীরার কথায় হুহা করে হেসে উঠল অন্তু। জোরজবরদস্তি করে নীরার হাতদুটো সরিয়ে দিয়ে, নীরাকে অনুকরণ করে বলল,
‘ উফ! এত লজ্জা কেন পাচ্ছেন?’
নীরা হেসে ফেলল। অন্তু টুপ করে চুমু খেয়ে নিল নীরার কপালে। সেই প্রথমদিনের মতোই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাল অন্তু। নীরার উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে আলো নেভাল। কিন্তু সরে গেল না। জহরি চোখে চেয়ে রইল নীরার চোখে, ঠোঁটে, লতানো দেহে। নীরার গায়ে আজও পাতলা শাড়ি। মৃদু সবুজ আলোতে মোমের মতো জ্বলজ্বল করছে ফর্সা উদর। নারী দেহের আকর্ষণীয় বাঁক। অন্তুর চোখের সুপ্ত মুগ্ধতা এবার জ্বলজ্বল করে উঠল চোখে। মাথা নুইয়ে ঠোঁট রাখল ঠিক সেখানেই যেখানে একবার আকস্মিক কাঁপন ধরিয়েছিল নীরা। গলদেশের পাশটায় আকাঙ্ক্ষিত পুরুষের গাঢ় ছোঁয়া পেয়ে কেঁপে উঠল নীরা। ছোঁয়ার প্রখরতা বেড়ে ঠোঁটের কাছে পৌঁছেতেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল এক অভাবনীয় আনন্দ বার্তা। প্রতীক্ষার সম্ভাব্য অবসান!
_
আকাশের কোণে প্রত্যুষের দেখা মিলতেই জ্বর নেমে এলো নম্রতার। দুর্বল হয়ে পড়ল শরীর। ঠিক আজই, বাদ জোহরে আরফানের বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষার দিন। অন্য কোনো দাওয়াত হলে চোখ বন্ধ করে নাকজ করতেন নুরুল সাহেব। কিন্তু এবার তা করলেন না। মেয়ের এই নাজুক অবস্থায় আরফানের সাথে দেখা হলে ভালো লাগবে ভেবে দাওয়াত রক্ষার প্রস্তুতি নিলেন তিনি। কিন্তু সেখানে গিয়েই ঘটল আরেক দূর্ঘটনা।
#চলবে…
[ বিঃদ্রঃ পর্ব ছোট হওয়ার জন্য দুঃখিত। আগামীকাল বড় পর্ব দেব ইন-শা-আল্লাহ। ]
নীল চিরকুট
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা
৬১ [ বর্ধিতাংশ]
আরফানদের বাড়িতে চাপা উচ্ছ্বাস। চারদিকে নতুন অতিথি আপ্যায়নের ব্যস্ততা। হাসি-আড্ডায় মাতোয়ারা হয়ে আছে চারপাশ। এমন একটা আনন্দঘন পরিবেশে চুপচাপ বসে আছে নম্রতা। চোখ-মুখ ফ্যাকাসে। দৃষ্টি অস্থির। মস্তিষ্কে চলছে ভয়ানক দ্বন্দ্ব, আরফান কেন বাড়ি নেই আজ? নিদ্রা বলেছিল, দুপুরের খাবারটা আজ বাড়িতেই খাবে আরফান। ফিরবে জলদি। কিন্তু ফিরল না তো। নম্রতা অস্থির চোখে ঘড়ির দিকে তাকাল। এক সময় ঘড়ির কাটা এসে ঠেকল দুটোয়। তারপর তিনটা। আরফান ফিরল না। নম্রতার হঠাৎ করেই মনে হল, নম্রতার উপস্থিতি, একমাত্র নম্রতার উপস্থিতিই আরফানের না ফেরার কারণ। নম্রতা আছে বলেই কি বাড়ি ফিরল না আরফান? নম্রতাকে এড়িয়ে চলার জন্য, নম্রতার মুখোমুখি হওয়ার ভয়েই কী আরফানের এই আত্মগোপন? নম্রতার গলা শুকিয়ে এল। অচেনা এক ভয়ে কেঁপে উঠল বুক। গায়ের জ্বরটা আবারও তরতর করে বেড়ে গেল। শরীরটা দুর্বলতায় অসাড়। ঘড়ির কাঁটা তিনটায় গড়াতেই খাবারের জন্য তাড়া দিলেন আরফানের মা। আরফান কোনো কাজে আটকে গিয়েছে ভেবে অপেক্ষা দীর্ঘস্থায়ী না করে খাবার টেবিলে বসল সবাই। কিন্তু নম্রতার মস্তিষ্ক ঘটনাটা সহজভাবে নিতে পারল না। বারবার মনে হতে লাগল, কোনো কাজ নয়, বাড়ি না ফেরাটা আরফানের ইচ্ছেকৃত। নম্রতার উপস্থিতিই তার না ফেরার কারণ। অতিরিক্ত মানসিক চাপ, শারিরীক দুর্বলতা আর জ্বরের প্রখরতায় দুই লোকমা খাবারও মুখে তুলতে পারল না নম্রতা। সবই কেমন বিস্বাদ, তেঁতো। তার থেকেও বড় কথা খাবারটা যে গলা দিয়ে নামছে না! নম্রতা পানি দিয়ে খাবারটুকু গিলে নিতেই নম্রতার মুখোমুখি চেয়ারটিতে এসে বসল নিদ্রা। খাবারের প্লেট তুলে নিতে নিতে বলল,
‘ নিষ্প্রভ ভাইয়া তো হসপিটালে নেই মা। হসপিটাল থেকে জানাল, ভাইয়া প্রায় তিন চার ঘন্টা আগে বেরিয়ে গিয়েছে।’
আরফানের মা ভ্রু কুঁচকালেন। ঘড়ির দিকে চেয়ে বললেন,
‘ হসপিটালে নেই? তবে গিয়েছে কোথায়? ওকে ফোন দাও।’
নিদ্রা ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ ভাইয়ার ফোন একবার সুইচড অফ। একবার নেটওয়ার্ক বিজি। ভাইয়াকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।’
নম্রতা চমকে উঠল। হঠাৎ করেই মনে পড়ে গেল রাতে দেখা স্বপ্নের কথা। আরফানের বলা বিষাক্ত সেই বাক্য, ‘আপনি হারিয়ে যান নম্রতা। হারিয়ে যান।’ তবে কী আরফানই হারিয়ে যাচ্ছে দূরে? নম্রতা থেকে বহুদূরে? নম্রতা তপ্ত শ্বাস ফেলল। আশপাশটা ঝাপসা লাগছে। সেই স্বপ্নের মতোই অস্পষ্ট লাগছে সব। নম্রতা হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাস নিল। কাঁপা কাঁপা হাতে ছলকে উঠল গ্লাসভর্তি জল। দুই ঢোক পানি গলায় ঢালতেই মুখ ভর্তি বমিতে ভাসিয়ে দিল শরীর। নিস্তেজ শরীরে দ্বিতীয় বার বমি করে, তৃতীয়বারে জ্ঞান হারাল নম্রতা। নম্রতার হঠাৎ এই অবস্থায় ভরকে গেল সবাই। আতঙ্কিত হয়ে উঠল। খাবার-দাবার সব সেভাবেই পড়ে রইল, কারো পাকস্থলী পর্যন্ত পৌঁছাল না। নুরুল সাহেব মেয়েকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটতে চাইলেও বাঁধা দিলেন আরফানের মা। নম্রতাকে খোলামেলা একটি ঘরে শুইয়ে দিয়ে পরিচিত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করলেন। নম্রতার কাপড় পাল্টে নিদ্রার কাপড় পরানো হলো। হাতে-পায়ে তেল মালিশ করতে করতে অপরাধী কন্ঠে বললেন,
‘ মেয়েটা আমাদের বাড়িতে এসে এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ভীষণ লজ্জিতবোধ করছি ভাইসাহেব। মেয়েটাকে অসুস্থ অবস্থায় যেতে দিতে বিবেকে বাঁধছে। আমাদের বাড়িতে এসে অসুস্থ হয়েছে, আমাদের সেবায় সুস্থ হোক। নিজ পায়ে হেঁটে এসেছে, নিজ পায়ে হেঁটে ফেরার সামর্থ্য হোক। এটুকু সুযোগ আমাদের দিন। নয়তো নিজের বিবেকের কাছেই বড্ড খচখচ করবে।’
নুরুল সাহেব ভদ্রমহিলার অনুরোধ ফেলতে পারলেন না। আরফানেরই এক ডাক্তার বন্ধু বাড়ি বয়ে এসে নম্রতাকে দেখে গেলেন। কিছু এন্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইভ করলেন। স্ট্রেস কমানোর ঔষধ আর পরপর দুটো স্যালাইন পুশ করলেন। নুরুল সাহেবকে বলে গেলেন,
‘ রাতে আবারও বমি হলে বা শরীর খুব দূর্বল মনে হলে আরও একটা স্যালাইন দিতে হতে পারে। আপনারা আরেকটা স্যালাইন ম্যানেজ করে রাখবেন। আর উনাকে স্ট্রেজ থেকে দূরে রাখুন আপাতত। দুই একদিন যাবৎ হয়ত কোনো কারণে খুব দুশ্চিতা করছেন। প্রেশারের অবস্থা ভয়াবহ।’
নম্রতার জ্ঞান ফিরল প্রায় দুই তিনঘন্টা পর। তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমেছে। জানালার কার্ণিশে এসে বসেছে ক্লান্ত শালিক। নম্রতার জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করছিলেন ডাক্তার। জ্ঞান ফিরতেই দ্রুত একটা ইনজেকশন পুশ করলেন। নম্রতা ঝাপসা চোখে বাবা-বোনের মুখের দিকে তাকাল। ঘোলা মস্তিষ্কে বার দুয়েক কি আরফানকে খুঁজল? হয়তো খুঁজল, হয়তো নয়। মিনিট পাঁচেকের মাঝেই ধীরে ধীরে তলিয়ে গেল অতল অন্ধকার ঘুমের রাজ্যে। ঘুমিয়ে যাওয়ার আগমুহূর্তে খুব মৃদু কিছু শব্দ ভেসে এলো কানে। নম্রতার মনে হলো, এ যেন অন্য কোনো পৃথিবীর শব্দ। বহুদূরের পথ অতিক্রম করে শব্দরা বুঝি ক্লান্ত। অবিশ্রান্ত। নম্রতার মতোই নিদ্রাগত।
‘ ভাবীকে তো বেশ কয়েকবার হসপিটালে দেখেছি। খুব মিশুক আর হাসিখুশিই মনে হয়েছিল তখন। হঠাৎ এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে? আরফান কোথায় আন্টি?’
আরফানের মা ভারী নিঃশ্বাস ফেললেন। কপাল কুঁচকে এলো। দুশ্চিন্তায় থমথমে হয়ে গেল তাঁর সুন্দর মুখ। এক ছেলেকে হারানোর পর ছেলেকে নিয়ে বড় ভয়। ঠিক এই বয়সে এসেই হারিয়ে গেল বড় ছেলেটা। বাড়িতে সেদিনও আত্মীয়-স্বজনের মেলা। স্নিগ্ধার বাড়ি থেকে আত্মীয় এসেছে বিয়ের তারিখ ঠিক করার উদ্দেশ্যে। এমন সময় আইসক্রিমের জন্য বায়না ধরল নিদ্রা। সেই সাথে বিশাল এক টেডিবিয়ার। বোনকে শান্ত করতে হাসিমুখেই বেরিয়ে গেল নেহাল। সেই যে গেল আর ফিরল না। সেই হাসিমুখটা আর হাসল না। ভদ্রমহিলার ভেতরটা হু হু করে উঠল। ভয়ার্ত চোখে নম্রতার ঘুমন্ত মুখটির দিকে তাকালেন। সেদিনও ঠিক এভাবেই, এই বিছানাতেই অচেতন হয়ে পড়ে ছিল স্নিগ্ধা। একই দৃশ্য। একই উৎকন্ঠা। ছেলে তার ঘরে ফিরছে না। ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ভদ্রমহিলার ভেতরটা থরথর করে কাঁপতে লাগল। পুরাতন স্মৃতি, পুরাতন ইতিহাসগুলো ভেসে উঠল একের পর এক। রক্তাক্ত হলো বুক। দলা পাকাল এক সমুদ্র কান্না!
_
সূর্যের আলো যখন নরম হয়ে এলো। গোধূলি হানা দিল দরজায়। কনে দেখা আলোয় উচ্ছ্বসিত হল চারপাশ ঠিক তখনই সিরাজগঞ্জ গিয়ে পৌঁছাল আরফান। ঘড়িতে তখন সাড়ে তিন কী চারটা বাজে। আরফান ক্লান্ত চোখে চারপাশটা দেখল। বাসস্ট্যান্ডের পাশের এক চায়ের স্টল থেকে এক চা খেয়ে আবারও রাস্তায় নামল। বাসস্ট্যান্ডের এক লোককে ডেকে জিজ্ঞেস করল,
‘ ভাই এখান থেকে কামারখন্দ কতদূর?’
লোকটি আরফানকে আগাগোড়া দেখে নিয়ে বলল,
‘ কামারখন্দ কই যাইবেন?’
‘ কামারখন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যাব। এখান থেকে যাওয়ার উপায় কী?’
লোকটি বোধহয় বাসের কন্ট্রাক্টর। আরফানের সাথে কথা বলতে বলতেই একটা চলন্ত বাসে লাফিয়ে উঠে বলল,
‘ এইখান থাইকা পঁয়ত্রিশ চল্লিশ মিনিট লাগব কামারখন্দ যাইতে। সিএনজি বা অটো ধইরা চইলা যান। মোড়েই সিএনজি পাইবেন।’
আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মোড়ে গিয়ে সিএনজি ধরে, সিএনজিতে উঠে বসতেই পেটে মোচড় দিয়ে উঠল ক্ষুধা। হুট করেই মনে পড়ে গেল, সারাদিন খাওয়া হয়নি তার। হাসপাতাল থেকে এগারোটার দিকে বেরিয়ে শাহাবাগ গ্রন্থাগারে গিয়েছিল আরফান। দুই ঘন্টা সময় নিয়ে, দুই তলার সেই পরিচিত তাকের প্রতিটি বইই নিঁখুতভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে সে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। গ্রন্থাগার থেকে বেরিয়েই সিরাজগঞ্জের বাস ধরেছে আরফান। এই দীর্ঘ দিনটিতে খাওয়ার কথা একবারও মনে পড়েনি তার। আরফান সিএনজির সিটে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। মাথাটা ধপধপ করছে। চোখ ব্যথা করছে। এই মুহূর্তে চশমাটা খুব প্রয়োজন। আরফানের মনে পড়ল, চশমাটা চেম্বারেই ফেলে এসেছে সে। সেই সাথে ফেলে এসেছে মোবাইল ফোন। প্রায় চল্লিশ মিনিটের মাথায় কামারখন্দ গিয়ে পৌঁছাল আরফান। সেখান থেকে অটোরিকশায় কামারখন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। আরফান যখন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পৌঁছাল তখন সন্ধ্যা হয়ে হয়ে এসেছে প্রায়। চারদিকে শেষ বিকেলের বিষণ্ন আলো। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। এমন সময় সুন্দর মতোন এই ছেলেটা ডাক্তার মুহিব নামে একজনের খোঁজ করতেই কৌতূহল নিয়ে তাকাল সবাই। গায়ে-গতরে পুরোদস্তুর শহুরে মানবটিকে পরখ করে নিতেই যেন এগিয়ে এলো একজন। সন্দিহান কন্ঠে বলল,
‘ ডাক্তার মুহিবকে দিয়ে কী কাজ? ডাক্তার দেখাবেন।’
আরফান গম্ভীর কন্ঠে বলল,
‘ না। মুহিব আমার পরিচিত। ওকে গিয়ে বলুন ডক্টর আরফান দেখা করতে এসেছে। আমাকে চিনবে।’
লোকটির দৃষ্টি এবার সরু হলো। আরফান যে সাধারণ কেউ নই বুঝতে পেরে তাকে বসতে দিয়ে মুহিবকে ডাকতে পাঠাল। আরফানের নাম শুনে ঠিক চিনতে না পারলেও আরফানকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেল মুহিব। ভীষণ বিস্ময়ে হা হয়ে গেল গোলাকার মুখ। হতভম্ব ভাব কেটে যেতেই দৌঁড়ে গিয়ে জাপটে ধরল তাকে। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
‘ আরফান ভাই! আপনি এখানে? দেশে ফিরেছেন কবে?’
আরফান উঠে দাঁড়াল। শুকনো হেসে বলল,
‘ সে অনেকদিন। প্রায় এক বছর হয়ে যাচ্ছে। রাদিনের কাছে শুনলাম তুই এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আছিস।’
মুহিব হন্তদন্ত করে চা বিস্কুটের ব্যবস্থা করল। আরফানকে নিজের কেবিনে নিয়ে গিয়ে বলল,
‘ হ ভাই। কিন্তু আয় রোজগার তেমন নাই। সরকার ডাক্তারদের জীবনটা একদম খেয়ে দিল। কষ্ট করে বিসিএস পাশ করেই বা কী লাভ হইল? এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে পোস্টিং দিল যে জীবন শ্যাষ। কিন্তু আপনি হঠাৎ এখানে কী মনে করে?’
আরফান চেয়ার টেনে বসল। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে সরাসরি প্রসঙ্গ টেনে বলল,
‘ তোর সাথেই দেখা করতে এসেছি। বিষয়টা সেনসেটিভ। ভেবে জবাব দিবি।’
মুহিব খানিক ভরকে গেল এবার। ব্যাপারটা গুরুগম্ভীর বুঝতে পেরে সোজা হয়ে বসল। ভীত কন্ঠে শুধাল,
‘ কোনো সমস্যা ভাই?’
‘ হ্যাঁ। সমস্যা। ইউএস যাওয়ার আগে একটা চিঠি দিয়েছিলাম তোকে। চিঠিটা গ্রন্থাগারে নির্দিষ্ট একটি বইয়ের মলাটের তলায় রাখতে বলেছিলাম, মনে আছে?’
মুহিব থতমত খেয়ে গেল। এই সামান্য একটা বিষয় জানতে আরফান এতোটা ছুটে এসেছে ভাবতেই অবাক হলো। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে মৃদু কন্ঠে বলল,
‘ জি ভাই। মনে আছে।’
আরফান এবার তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মুহিবের দিকে খানিক ঝুঁকে এসে বলল,
‘ চিঠিটা যার জন্য ছিল সে পায়নি। চিঠিটা বইয়েও নেই। পুরো তাকের কোনো বইয়েই নেই। তারমানে চিঠির জায়গা অদলবদল করা হয়নি। কিন্তু হাত আদলবদল হয়েছে। কোনোভাবে সেটা অন্য কারো হাতে পৌঁছেছে। পাবলিক লাইব্রেরিতে কাকতালীয়ভাবে চিঠিটা অন্যকারো হাতে পড়ে যেতে পারে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক বিষয়টা হলো, এতো খোঁজাখুঁজির পরও না পাওয়া চিঠিটা প্রায় পাঁচ বছর পর হঠাৎই একজনের হাতে পড়ে গেল। যে নিজেকে সেই চিঠির মালিক বলে দাবী করতে লাগল। আমি যদি কিছুক্ষণের জন্য মেনেও নিই যে সে-ই চিঠির মালিক তবুও একটা প্রশ্ন থেকে যায়, সে এতোদিন পর আত্মপ্রকাশ ঘটাল কেন? আর যদি সে চিঠির মালিক না হয়, তাহলে তার কাছে চিঠিটা পৌঁছাল কীভাবে? প্রথম প্রশ্নের উত্তর হিসেবে সে আমায় বলেছে, সে নাকি ভয়াবহ সমস্যায় পড়েছিল তাই তাৎক্ষনাৎ যোগাযোগ করতে পারেনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সে মিথ্যা বলছে। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হিসেবে যদি বলি,কাকতালীভাবে চিঠিটা কারো হাতে লেগে গিয়েছে তবুও খুব লেইম একটা যুক্তি হবে। কাকতালীয়ভাবে চিঠিটা কারো হাতে লাগার পর কেউ নিশ্চয় চিঠিটা সযত্নে রেখে দেবে না। কনফিউশান ক্রিয়েটের চেষ্টা করতে চাইলে তখনই করতে পারত, পাঁচবছর যাবৎ অপেক্ষা করে বসে থাকত না। তারমানে স্পষ্ট, চিঠিটা পাঁচবছর আগে কেউ পায়নি। পেয়েছে আজকালের মধ্যে। কিন্তু কিভাবে সম্ভব?’
মুহিব অবাক চোখে চেয়ে রইল। উত্তর দিল না। আরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘ তুই বোধহয় আমাকে সাহায্য করতে পারিস মুহিব। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বল তো, চিঠিটা কী সত্যিই সঠিক বইটাতে রাখা হয়েছিল? সত্যিই?’
মুহিব থতমত খেয়ে গেল। অসহায় চোখে চেয়ে রইল আরফানের চোখে।
#চলবে….
[ সকালে না দিতে পেরে আমি দুঃখিত। ভর্তি নিয়ে কিছু টেনশন আর ওয়াইফাই জনিত সমস্যার জন্য গল্প দেওয়া সম্ভব হয়নি। এদিকে ঝড় বৃষ্টি শুরু হচ্ছে। ঠিকঠাক বিদ্যুৎ সংযোগ থাকলে রাতে আরেকটি পর্ব পাবেন ইন-শা-আল্লাহ। ]