#চেম্বার কথন পর্ব ৩৯
ভদ্রমহিলা, ” জানেন, আমি ডিভোর্সের পরে খুব কষ্ট করেছি! চাকরি, একহাতে বাচ্চা পালা, সন্ধ্যায় টিউশনি! হাজব্যান্ডের মারের দাগগুলি তখনও তাজা! তারপর বাচ্চা ক্যাডেট কলেজে চলে গেলো, একটু একটু করে প্রমোশন হলো, স্বস্তি পেলাম। এর মধ্যে একটা ট্রেইং এ এই ভদ্রলোকের সাথে পরিচয়। বিবাহিত, ২ বাচ্চা নিয়ে ভালই সংসার। বন্ধুত্ব হলো। তারপর কখন যেন এই সীমারেখাটা ফিকে হয়ে গেলো। আমরা বেশ বুঝতে পারলাম দুজনেই দুজনকে ভালোবেসে ফেলেছি। তারপর ঠিক মতো বুঝে উঠবার আগেই মন থেকে শরীর সব যে কখন দেয়া নেয়া হয়ে গেলো বেহিসেবী ভাবে। আমি কখনই তাঁর সংসার ভাঙতে চাইনি। তিনিও না। এভাবেই চলছিল। মুশকিলটা বাঁধলো এখন যখন ভদ্রলোক আমার অফিসেই বদলি হয়ে এসেছেন। আমাদের প্রোটোকল হলো স্বামী স্ত্রী একসাথে প্রোগ্রামে যাবে। এখন যখন ওদের অফিসিয়াল অনুষ্ঠানগুলিতে একসাথে দেখি না, তখন আমার ভীষণ কষ্ট হয়। চাকরির খাতিরে না যেয়েও উপায় নেই। “
বোবা কষ্টগুলি কখনো কখনো না বলা ভাষায় চোখের কোনা বেয়ে অদৃশ্য অশ্রুবিন্দুর মতো গড়িয়ে পড়ে। আমি সেই জলের দাগে ভদ্রমহিলার চোখের কোনা, ঠোঁটের কোনা, নাকের হীরের নাকফুল মাখা মাখি হতে দেখলাম।
আমার রবীন্দ্রনাথের একটি লাইন মনে পড়লো,
“এ কী খেলা মোরা খেলেছি,
শুধু নয়নের জল ফেলেছি–“
আমি, ” কাউন্সেলিং থেকে কি চান?”
ভদ্রমহিলা, ” আমি এই কষ্টটা নিতে আর নিতে পারছি না। চাই ও না। আগে সুখে না থাকি স্বস্তিতে তো ছিলাম। আমি আর আমার একাকিত্ব! এখন তো কোনটাই নেই। আমি এখন কি করবো?”
আমি, ” ভদ্রলোক আপনার এই অনুভুতিগুলি জানেন?”
ভদ্রমহিলা, ” হা!”
আমি, ” ওনার ভাষ্য কি?”
ভদ্রমহিলা, ” তিনি বলেন, তুমি তো আমার বউ হয়ে গেছো! আমি তো তোমার ! যার কথা বলছো সে তো শুধু কাগজের বউ।”
আমি, ” এই স্বীকারোক্তি কি আপনার কাছে গ্রহণযোগ্য?”
ভদ্রমহিলা, ” না! গ্রহণযোগ্য হলে তো ওদের দুজনকে একসাথে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে দাঁড়াতে দেখলে আমার এত কষ্ট হতো না। আমার কাছে এই অনুষ্ঠানগুলো এখন বিভীষিকাময় মনে হয়। আগামী সপ্তাহেও আছে। আমি আর নিতে পারছি না।”
হঠাৎ ভদ্রমহিলা আমার হাতটি চেপে ধরলেন। ঝর ঝর করে চোখের পানিতে আমার হাত ভেসে গেলো। কখনো কখনো মনে হয় সময় স্থবির হয়ে যায়। বাইরে প্রবল বৃষ্টি, বাতাস ধাক্কা দিচ্ছে জানালার কাঁচ। হু হু শব্দ পাক খাচ্ছে ইথারে। বাতাসের গর্জন ক্রমে হুংকারে পরিনত হচ্ছে। কারেন্ট চলে গেছে। বিড়ালটা আইপিএসের সুইচে তার দুষ্টামির দৌরাত্ম্যের মুনশিয়ানা রেখেছে বলে ঘর অন্ধকার। ভদ্রমহিলা জানালাটা খুলে দিলেন। বৃষ্টির দমকা এসে ছুঁয়ে গেলো আমাদের।
পলকে মনে পড়লো নজরুল লিখেছিলেন,
“বাহিরে অন্তরে ঝড় উঠিয়াছে
আশ্রয় যাচি হায় কাহার কাছে!”
নিরবতা ভেঙ্গে ভদ্রমহিলা কাতর কণ্ঠে বললেন, “আপনি আমাকে একটা কথা শুধু স্পষ্ট করে বলেন, আমি কি ওঁর রক্ষিতা?”
কি ভয়াবহ শুন্যতা মানুষের বুক ছাপিয়ে চোখের পাড়ায় ছড়ায় আমি সেটাই দেখলাম। কি ভয়াবহ আত্মগ্লানি! কি নিদারুণ কুল কাঠের আগুন! সুতীব্র দহন!
আমি, ” আপনার বিলিভ সিস্টেম কি বলে? বউ বা স্বামী কি শেয়ার করা যায়? আলোচনার খাতিরে ধরে নেই কোনো কোনো সমাজ ব্যাবস্থা সেটা করে, সেখানে একাধিক স্ত্রী থাকতে পারে, আবার আমাদের এই উপমহাদেশে দ্রৌপদী একাধিক স্বামী নিয়েও ছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হল আপনার নিজস্ব বিলিভ সিস্টেম কি বলে? “
আমরা কিছু কিছু সম্পর্কে একাধিক উপস্থিতি সহজেই মেনে নেই। যেমন একাধিক ভাই, বোন, সন্তান, বন্ধু, সহকর্মী। কিন্তু আমাদের মা একটাই, বাবাও একজনই। ঠিক সেরকম জীবন সঙ্গীও একটাই।
আমরা মানুষরা মনস্তাত্ত্বিকভাবে সুবিধাবাদী। সভ্যতার বিবর্তনে মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটারের পুরুত্ব যত বেড়েছে আমরা ততো সুবিধাবাদী ভাবে ভাবতে শিখেছি।
এই সুবিধাবাদী ভাবনার সামাজিকীকরণ না হলে মানুষ রাজত্ব করতে পারতো না সৃষ্টিকুলের উপর। ফলে সত্যের যতটুকু অংশ নিলে আমার সুবিধা হয় আমরা ঠিক ততটুকুই বেছে নেই। আমরা কখনোই সম্পূর্ণ সত্যটিকে মোকাবেলা করতে চাইনা। সেই কারণেই আমি কি করছি এই বিশ্লেষণের আয়নায় নিজের মুখটা দেখি না। অথচ খুব সহজেই অন্যের দোষ ধরাটাতে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
আমি ভদ্রমহিলাকে বললাম, ” আপনি নিজেকেই নিজেকে প্রশ্ন করুন যে আমি আসলেই রক্ষিতা কিনা অথবা আমি আর নিতে পারছিনা এই ভাবনাটা ভাববার পেছনে,
১. প্রকৃত কারণটা কি?
২. পুরো সত্যটা কি?
৩. আমি কি শুধু আংশিক সত্যটা বেছে নিচ্ছি?
৪. আমি কি শুধু যেটা বিশ্বাস করতে চাই সেটাতেই ডাইভার্ট হচ্ছি?
৫. আমি কি যেভাবে চিন্তা করলে আমার সুবিধা সেভাবেই ভাবতে নিজেকে ডাইভার্ট করছি?
৬. আমি কি নিজের সুবিধার জন্য ভাবনাটাকে আমার কমফোর্টজোনে প্রবাহিত করছি?
৭. এভাবে ভাবলে আমি কোন কোন মনো-সামাজিক সুবিধা পাবো নিজের বিবেকের কাছে?
৮. কাগজের বউ আর মগজের বউ এর বেসিক পার্থক্য কোথায়?
৯. আমার আজন্ম বেড়ে ওঠা নৈতিকতা কাগুজে বনাম মগুজে কোন বউটাকে সন্মান করে?”
অন্যের দোষ না ধরে মনের আয়নায় নিজের মুখটা দেখা বেশি জরুরী। আমি কি করছি? এই দ্বন্দ্ব তৈরিতে আমার অবদান কি?
ইদানিং পদে পদে উপলব্ধি হয় আমি এতো কম বুঝি। সাথে তো আর সক্রেটিস বলেন নাই, know thyself!
( কথোপকথনের এই অংশটুকু আমার চেম্বারে আসা ভদ্রমহিলার অনুমতি সাপেক্ষে মনোসামাজিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কনফিডেনশিয়ালিটি রেখে প্রকাশ করা হলো।
পুনশ্চ:
* এখানে ভদ্রমহিলা কি সিদ্ধান্ত নিলেন সেটা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেখান থেকে শিক্ষনীয় কিছু না খুঁজে বরং আমি, আমার নিজের চোখে আয়নাটা কিভাবে ধরতে পারছি, সেই ভাবনাটা ভাবতে শুরু করাটা বেশি জরুরি।
* অপরের কাজের সমালোচনা পরিহারযোগ্য কারণ এর উৎপত্তি জাজমেন্টাল ভাবনা থেকে।)
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া,
চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার।