#অন্যরকম তুমি পর্ব ১৯
#তানিশা সুলতানা
“আচ্ছা সিমি তোমার কি একবারও মনে হয় না সিফাতের ওই মেয়ের মুখটা একদম তোমার মুখের মতো? গায়ের রংটাও তোমার মতো। হাসলে ঠোঁটের বা সাইডে টোল পড়ে।
কেনো এমনটা? কি কানেকশন এই মেয়েটার সাথে তোমার? তুমি কি কোনো টান অনুভব করো না?
কেনাকাটা শেষ করে কফি খাওয়ার জন্য একটা কফিশপে বসেছে ওরা। এই মুহুর্তে কফি খাওয়ার কোনো ইচ্ছে ছিলো না কিন্তু হিমু জোর করলো। সিফাত আর পরি চলে গেছে সিমিকে কিছু না বলেই। অবশ্য যাওয়ারই কথা। সিমি ইচ্ছে করেই ইগনোর করেছে ওদের।
কফির মগের চুমুক দেয় সিমি। সত্যিই এমনটা ও ভেবে দেখে নি। বাচ্চাটার প্রতি আলাদা একটা টান অনুভব করে সিমি। মনে হয় এটাই ওর মেয়ে৷ একেই নয় মাস পেটে পুরেছে। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কথাটা কাউকে বলা যাবে না। কেউ বিশ্বাস করবে না।
” আমি দেখেছি তোমাকে নয়টা মাস লড়াই করতে। লেভার পেইন ওঠার পরে তোমার সেই চিৎকার আমি এখনো ভুলি নি।
আমার মন বলছে এটাই তোমার মেয়ে৷ নার্স সেদিন মিথ্যে বলেছিলো। আমি স্পষ্ট সেদিন বাচ্চার কান্না শুনেছিলাম অপারেশন থিয়েটারের ভেতর থেকে৷ কিন্তু জোর দিয়ে বলতে পারি নি। কারণ আশেপাশের অনেক কেবিনের বাচ্চা ছিলো।
হিমু সিমির হাতের ওপর নিজের হাতটা রাখে। কাঁচের টেবিলের দিকে এক মনে তাকিয়ে আছে সিমি। হিমুর কথা গুলো মন দিয়ে শুনছে।
“আমি তোমার বাচ্চাকে তোমার কাছে ফেরাতে লড়াই করবো। আমরা দুজন মিলে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবো আমাদের মেয়েকে।
সিমি এক পলক তাকায় হিমুর মুখের দিকে। চোখ দুটো টলটল করছে।
” তোমার কথা সত্যি হলে আমি নিজে হাতে খুন করবো সিফাতকে। কোনো দিন মাফ করবো না ওকে।
কি দোষ করেছিলাম আমি? যার শাস্তি পেয়ে যাচ্ছি পাঁচটা বছর যাবত।
ভালোবেসে ছিলাম। ভালোবাসার পরিনাম এতোটা ভয়াবহ হয়?
গলা ধরে আসছে সিমি। বুকটা হু হু করছে পরির জন্য। এই তিনটা বছরে খুব কমই মনে পড়েছে সিফাতকে। সবটা সময় স্মৃতি জুড়ে শুধুই মেয়ে ছিলো।
হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে সিমি। হিমু সিমির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
“আমি সবটা ঠিক করে দেবো সিমি। একটু ভরসা করো আমার ওপর। পৃথিবীর সব সুখ তোমার পায়ের কাছে এনে দেবো।
বিরবির করে বলে হিমু।
দুপুরের খাবার রান্না করা প্রায় শেষ সাদির। ডাল ডিম করলা ভাজি আর মুরগীর মাংস রান্না করছে। একা থাকলে শুধু করলা ভাজিই করতো। কিন্তু এয়কন তো এখানে আরও কয়েকজন আছে। তাদের নিশ্চয় করলা ভাজি খেতে অসুবিধা হবে। সবাই তো আর সাদি না। ওদের কথা চিন্তা করেই সাদি মাংস আর ডাল রান্না করেছে।
সাওয়ার নিয়ে রান্না করতে গেছিলো এখন আবার ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। সিফাত সেই কখন এসে রুমে ঘাপটি মেরে শুয়ে আছে। পরি সাদির পাশে টুল টেনে বসে গল্প করছে।
এক রাশ অভিযোগ ঠেলে দিচ্ছে সাদির দিকে। অভিযোগটা সিফাতকে নিয়ে। সে কেনো তাকে বাড়ি নিয়ে এলো? আইসক্রিম কিনে দিলো না
এসব।
সাদি পরির মুখের দিকে এক পলক তাকাচ্ছে তো আবার রান্না করছে।
“এই মিষ্টি মেয়েকে ছেড়ে ওর মা কেনো চলে গেছিলো? না কি ভাইয়াকে তাকে চলে যেতে বাধ্য করেছিলো। না কি অন্য কারণ?
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সাদি। ডালটা বাটিতে ঢেলে বেসিন থেকে হাত ধুয়ে নেয় সাদি।
” মা কি খাবে বলো?
পরির সামনে হাঁটু মুরে বসে পরির মুখের সামনে নিজের মুখটা রেখে বলে।
পরি সাদির ঘামে জর্জরিত মুখটাতে আলতো হাতে ছুঁয়ে দেয়।
“ও আসুক তারপর খাবো।
মিষ্টি হেসে বলে পরি।
সাদি ভ্রু কুচকে তাকায়।
” ও কে?
“ওই মেয়েটা। মাম্মামের আপি। জানো এতোগুলো ভালো মেয়েটা। আমাকে খাইয়ে দেয়, ঘুম পারিয়ে দেয়। খুব ভালোবাসে।
কিন্তু
পরির হাসি মুখটা চুপসে যায়। চোখ দুটো টলমল করে ওঠে।সাদি বিচলিত হয়ে পড়ে। পরির দুই গালে হাত দিয়ে কপালে চুমু খায়।
” কিন্তু কি মা?
“ওই আংকেল টার কাছে গেলে আমার সাথে কথাই বলে না।
ফুঁপিয়ে ওঠে পরি।
” মা কাঁদে না।
সাদি পরির চোখের পানি মুছে দেয়।
“ও কে মেয়েটা না। মামনি বলবে৷ আর ওই অংকেলটা মামনির বর। সে তো তাকে সময় দেবেই বলে।
পরি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সাদির মুখের দিকে। বর শব্দটার সাথে পরিচিত না পরি। তাই বুঝতে পারলো না। কিন্তু কান্না থেমে গেছে।
” আচ্ছা।
আমি তো সাওয়ার নেবো এখন। তুমি কি করবে তাহলে?
“মাম্মামের কাছে যাবো।
ছোঁয়ার কথা মনে হতেই সাদি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে।
” ওকে চলো
পরির হাত ধরে রুমে চলে আসে। ছোঁয়া এখনো একই ভাবে শুয়ে আছে। মাঝেমধ্যে কেঁপে কেঁপে উঠছে। হয়ত জ্বরটা বেড়েছে। কিন্তু সাদিতো ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে। তাহলে কেনো বাড়লো জ্বর?
পরি গিয়ে ছোঁয়ার পাশে বসে পড়ে।
“মাম্মামের কি হয়েছে?
ঘুমন্ত ছোঁয়ার দিকে তাকিয়ে বলে পরি।
– বাঁদর তো তাই বাঁদরামি করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে গেছে।
বিরবির করে বলে সাদি।
তারপর ছোঁয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছোঁয়ার মাথায় হাত রাখে। একটুও জ্বর নেই। তবে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। আর এই ঘামের জন্যই কেঁপে উঠছে।
এই মেয়েরা আস্ত ইডিয়েট।
কোম্বল সরিয়ে ফেলে সাদি। তারপর এসির পাওয়ার বাড়িয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পরে।
পরি ছোঁয়ার পাশে শুয়ে জাপ্টে ধরে ছোঁয়াকে।
সাওয়ার শেষে টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বের হয় সাদি। সর্বপ্রথম চোখ পড়ে বিছানায় শুয়ে থাকা ছোঁয়ার দিকে। পরিকে জাপ্টে ধরে কি আরামসে ঘুমিয়ে আছে।
সাদি ফোঁস করে শ্বাস টেনে তোয়ালে রেখে আবার কিচেনে চলে যায়।
প্লেট ভর্তি করে খাবার নিয়ে আসে। সাথে এক জগ পানি।
টেবিলে রেখে এসির পাওয়ার কমিয়ে দেয়। তারপর সোফায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে পড়ে।
ঘুম ভেঙে যায় ছোঁয়ার। ঘামে জর্জরিত শরীর নিয়ে আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে। চোখ খুলতে ইচ্ছে করছে না। উঠে বসতেই পেটের ভেতর থেকে ঢেকে উঠে। ভীষণ খিধে পেয়েছে। তাকে পরিকে দেখে ঠোঁটের কোনে হালকা হাসি ফুটে ওঠে।
পরির এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করে দেয় ছোঁয়ার।
তারপর বিছানা থেকে নামতে যেতেই চোখের সামনে সাদিকে দেখতে পায়। ছোঁয়ার ড়িক নাক বরাবর বসে এক মনে ল্যাপটপে কিছু দেখছে।
মেজাজ বিগড়ে যায় ছোঁয়ার।
ভেংচি কেটে অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।
“ফ্রেশ হয়ে খাবারটা খেয়ে নাও। আর সাথে মামনিকেও খাইয়ে দাও।
সাদি ল্যাপটপে দৃষ্টি রেখেই বলে। গা জ্বলে ওঠে ছোঁয়ার। আদেশ করা হচ্ছে ওকে? ওই লোকটার আদেশ শুনতে বয়েই গেছে ছোঁয়ার।
” “খ” তে খাবো “ন” তে নাহহহহহহ
সাদি ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ছোঁয়ার দিকে তাকায়।
“আবার থাপ্পড় খেতে মন চাইছে?
ইডিয়েট
আর একটা কথা বললে থাপ্পড়ে গাল লাল করে দেবো।
শান্ত গলায় বলে সাদি।
ছোঁয়া একটুও ভয় পায় না।
” খাবো না মানে খাবো না।
ছোঁয়া একবার যা বলে তাই করে। বলেছি খাবো না তো খাবোই না।
কোলের ওপর বালিশ চেপে মুখ বাঁকিয়ে বসে থাকে ছোঁয়া।
সাদি ল্যাপটপ সাইডে রেখে হনহনিয়ে এগিয়ে আসে ছোঁয়ার দিকে।সাদির এগোনো দেখে এবার ছোঁয়া ভয় পেয়ে যায়৷ আবার থাপ্পড় মারলে দাঁত একটাও পাওয়া যাবে না।
দুই গালে হাত দিয়ে কিছুটা পিছিয়ে যায় ছোঁয়া।
চলবে
.