#বনলতা
পর্বঃ১
আমার বিলু আপা যেদিন মারা গেলো সবচেয়ে বেশি কেঁদেছিলো মনে হয় সজল ভাই, বিলু আপার স্বামী। সে কি আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কান্না। একটা পর্যায়ে সবার নজর উনার দিকেই চলে যায়। আপার মৃত্যুর শোকের থেকে সজল ভাইকে থামানোই যেনো সবার কাছে বেশি প্রকট হয়ে ওঠে। কেউ কেউ একরাশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,”আহা রে! স্বামীর এমন ভালোবাসা রেখে অকালে মেয়েটা চলে গেলো। আসলেই অতিরিক্ত সুখ পাওয়া মানুষ বেশিদিন বাঁচে না।” আরো হাজারটা কষ্টের কথা কানে আসে সেদিন। বিলু আপার মৃত্যুটা কোনো সাধারণ মৃত্যু ছিলো না। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে আপার মৃত্যু হয়, হাসপাতালে নেওয়ার সময়টুকু পর্যন্ত দেয় নি। বাসার গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফারিত হয়ে আগুন ছড়িয়ে যায় সারাবাড়ি। আপা বাসায় সেদিন একাই ছিলো। সজল ভাই ব্যবসার কাজে শহরে গিয়েছিলেন আর সেদিন সকালেই আপার শ্বাশুড়ি তার বড় মেয়ের বাড়ি গিয়েছিলেন বেড়াতে। আপার শ্বাশুড়ি খুব ভালোবাসতেন আপাকে। তিনি তার ছেলেকে জড়ায় চুপ করে বসে কাঁদছেন একপাশে। আমার যেনো সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগছিলো। কীভাবে এমন কিছু হয়ে যেতে পারে, যে কিনা ঘটনার দিন সকালে আমার সাথে ফোনে কতো কথা বললো। আপাকে যখনই ফোন দেওয়া হতো, সবকিছুর উপরে শুধু তার একটাই কথা থাকতো, তার বর তাকে কতো ভালোবাসে। আমারও শুনতে খুব ভালো লাগতো। আপা সুখী আছে এটা ভেবেই প্রশান্তি পেতাম আমি। কিন্তু সেই কথা যে আপার সাথে শেষ কথা হবে আমার কে জানতো? আমার কেনো জানি কান্না পাচ্ছিলো না। ভীষণ চোখ জ্বালা করছিলো। একটা পর্যায়ে আমার সামনে দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসলো, আমি জ্ঞান হারালাম।
আমার যখন জ্ঞান ফেরে ততক্ষণে আপার দাফনকাজ শেষ হয়েছে। আপাকে শেষ দেখা দেখানোর জন্য আমার জ্ঞান ফেরাতে কম চেষ্টা করা হয়নি। অবশ্য শেষ দেখা দেখবোই বা আর কি। সমস্ত শরীর পুড়ে গিয়েছিলো। জ্ঞান ফেরার পর আমার খুব ইচ্ছা করছিলো চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু তখনও আমি কাঁদতে পারলাম না। নিজের ঘরে এসে দরজা আটকে দিলাম। এই ঘরটা আগে আমার আর বিলু আপার ছিলো। আপার বিয়ের পর আমি একাই থাকি এই ঘরে। ঘরের পাশে একটা শিউলি ফুলের গাছ। আপার খুব পছন্দ ছিলো শিউলি ফুল। আমি জানালা খুলে দিলাম। গাছটা ফুলের ভারে নুয়ে পড়েছে যেনো। অসহ্যরকম সুন্দর ঘ্রাণ আসছে। আমি জানালা আটকে দিলাম। আপার প্রিয় ফুলের সুগন্ধটাও আমি যেনো সহ্য করতে পারছি না। পুরো ঘরটার দিকে তাকালাম আমি একবার। আপার খুব বেশি স্মৃতি আর নেই এ ঘরে। বিয়ের পর নতুন জামাইয়ের জন্য বাবা বাড়ির দক্ষিণ পাশে বাথরুমসহ একটা বিশাল ঘর বানিয়ে দিয়েছিলেন।
আপা তার যাবতীয় সব জিনিস সেই ঘরে নিয়ে রেখেছিলো। আপার স্মৃতি বলতে এই ঘরে শুধু ছিলো দেয়ালে বাঁধানো আমার আর আপার একটা ফটো। যেই ফটোটায় আপা আমার চুল বেঁধে দিচ্ছেন হাসি হাসি মুখ করে, আর আমি বিরস মুখে বসে আছি। আহামরি এমন কোনো ছবি না বাঁধিয়ে রাখার মতো। কিন্তু বাবার কাছে মনে হয়েছিলো তার দুই রাজকন্যাকে এই ছবিতে অপ্সরীর মতো লাগছে। তাই তৎক্ষনাৎ তিনি এই ছবি বাঁধিয়ে এনে আমাদের ঘরে টাঙিয়ে দেন। আপা সেদিন মুখ কালো করে বলেছিলো,”বাবা এতোই যখন পছন্দ হয়েছে এই ছবি, বাইরের বসার ঘরে টাঙিয়ে দিতে পারতে। কেউ বেড়াতে আসলে দেখতে পেতো।”
বাবা বেশ গম্ভীর হয়ে বললেন,”মা বনলতা। আমার মায়েদের বাইরের লোকরা এসে আগেই দেখে নেবে এইটা তুমি ভাবলে কীভাবে? এতো বোকা তো আমি নই।”
বিলু আপার ভালো নাম বনলতা, আর আমার নীলাঞ্জনা। এতো সুন্দর নাম আমার বাবার রাখা। কিন্তু মায়ের আবার এতো বড় নামে ডাকতে খুব আপত্তি ছিলো। তাই ছোট করে বিলু আর নীলু ডাকতে শুরু করেন তিনি। সেই থেকে বিলু নীলুই আমাদের ডাকনাম হয়ে যায়। কিন্তু বাবা কোনো সময় আমাদের সেই ডাকনামে ডাকেননি। মা বনলতা আর মা নীলাঞ্জনা তার দুই চোখের দুই মণি ছিলো।
আমি আস্তে করে পা ফেলে সেই ছবিটার সামনে যেয়ে দাঁড়াই। ভিতর থেকে চাপাকান্না ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। আপার সেই হাসি মুখ, সেই মায়াবী চাহনি। আমি আর সামলাতে পারিনা। দুই হাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি আমি। চিৎকার করে বলতে থাকি,”আপা রে! আমার সোনা আপা। তুই আমারে একা করে কোথায় চলে গেলি রে আপা? তুই তো ভয়ে একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠিও জ্বালাতে পারতি না রে আপা। কতোটা কষ্ট পেয়েছিস তুই। আমি তোর বোন হয়ে কেনো সেই কষ্টের ভাগ নিতে পারলাম না রে? সারাজীবন তো আমার সব কষ্টের সাথী ছিলি তুই। তবে আজ আমি কেনো তোর কষ্টের ভাগ নিতে পারলাম না রে আপা?”
আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কাঁদতে থাকি আমি। বাইরে মা বাবা আর সজল ভাইয়ের আহাজারি। সেদিন আমাদের এই ছোট্ট বাড়িটা যেনো নরকে পরিণত হয়েছিলো। বারবার মনে হচ্ছিলো আমার জ্ঞানটা আবার কেনো চলে যাচ্ছে না? তাহলে এই নারকীয় যন্ত্রণা আর সহ্য করতে হতো না আমার।
আপার মৃত্যুর পর প্রাকৃতিক নিয়মেই সময় কেটে যেতে লাগলো। জানিনা আমরা স্বাভাবিক হতে পেরেছি কিনা। সবাই অদক্ষ অভিনেতার মতো দিন কাটাতে থাকি। বাকিদের সামনে স্বাভাবিক প্রমাণ করার চেষ্টা করি নিজেকে। কিন্তু ভিতরে কি তাণ্ডব আমাদের প্রতিদিন চলে সে শুধু আমরাই জানি। বাবা তারপর থেকে আর কোনোদিন বড় মাছ কিনে আনেননি। বড় মাছ দেখলেই আপা মুখ কালো করে বটি নিয়ে বসে যেতো মাছ কুটতে। যদিও বাবার সামনে ভাব করতো সে খুবই বিরক্ত হয়েছে, কিন্তু আপার চোখ চকচক করতো। বড় মাছ আপার খুব পছন্দ ছিলো। আমরা সবাই জানতাম। বাবা আপার অন্ধকার মুখ দেখতেন আর মিটিমিটি হাসতেন। আপার শ্বশুরবাড়ি ছিলো আমাদের বাড়ি থেকে কুড়িটাকা রিকশাভাড়ার পথ। আপার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে বাবা বড় মাছ আনলে মাছ নিয়ে আগে বাড়ি আসতেননা। সোজা আপার শ্বশুরবাড়ি যেতেন। একটা মাছ ও বাড়ি দিতেন। আপা একইভাবে মুখ অন্ধকার করে মাছ কুটতে বসে যেতো। বাবা আগে আপার মাছ কোটা দেখতেন এরপর আমাদের বাড়িতে আরেকটা মাছ আনতেন। আপার মৃত্যুর পরে বাবা আর বড় মাছ কেনেননি। মা ও কেমন যেনো পাগলের মতো হয়ে গেছেন। বেশিরভাগ সময় এক জায়গায় একা একা বসে থাকেন আর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আমি চেষ্টা করি দিনের অধিকাংশ সময় বাইরে কাটিয়ে আসতে। কারণ বাড়িতে ঢুকলেই এক অসহ্য যন্ত্রণা চারদিক থেকে চেপে ধরে আমাকে।
তবে এই কয়টা মাসজুড়ে প্রায় প্রতিদিন সজল ভাই আমাদের বাড়ি আসেন। অফিস শেষ করেই বাড়িতে না যেয়ে আগে সোজা আমাদের বাড়িতে আসেন। বাবার হাত ধরে বসে থাকেন। মায়ের ওষুধ ঠিকমতো খাচ্ছেন কিনা, বাবার হাই প্রেশারটা কন্ট্রোলে আছে কিনা, বাড়িতে ঠিকমতো বাজার বা রান্না হচ্ছে কিনা সবকিছুর খোঁজ নেন তিনি। প্রায়ই এটাওটা খাবার নিয়ে আসেন আমাদের সবার জন্য। এতো করে তাকে বলা হয়েছে বাড়িতে তিনজন মাত্র মানুষ, তার উপর তিনজনই শোকে মুহ্যমান। কে এতো খাবার খাবে? কিন্তু তিনি কোনো কথাই শুনেন না। হাতভর্তি ফলমূল, হরলিক্স এসব আসতেই থাকে আমাদের বাড়ি। আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশিদের মুখে শুধু একটাই কথা, সজলের মতো স্বামী পেয়েছে যেই মেয়ে তার ছিলো রাজকপাল। কিন্তু কপালে সুখ সহ্য হয়নি তাই বাঁচতে পারেনি। সব শুনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না আমাদের।
এরমধ্যে একদিন আমি ভার্সিটির ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে শুয়ে ছিলাম। হঠাৎ দরজায় টোকা দেওয়ার আওয়াজ শুনে তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। বাবা বা মা কেউ আসেনি কারণ তারা আসলে দরজায় কড়া না নেড়ে আমাকে ডাকে। আমার ইচ্ছা করলো না দরজা খুলতে, আজকাল প্রায়ই বিভিন্ন আত্মীয়স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশি এসে স্বান্তনা দিয়ে যায়। তবে স্বান্তনা দেওয়ার নাম করে সজল ভাইয়ের গুণকীর্তন করা থাকে তাদের মূল লক্ষ্য। সেসব শোনার পর নিজের বোনকে হারানোর কষ্ট আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায় আমার কাছে। তাই আমি আজকাল যথাসম্ভব তাদের এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি। ভাবতে ভাবতে আবার দরজায় শব্দ। আস্তে করে উঠে দরজাটা খুলতেই কিছুটা চমকে উঠি আমি, সজল ভাই এসেছেন। চমকে ওঠার কারণ তিনি এই ঘরে খুব বেশি আসেন না। বিয়ের আগে থেকেই সজল ভাইয়ের আসা যাওয়া ছিলো আমাদের বাড়ি। কারণ আপা যখন ইন্টারে পড়ে, সজল ভাই তখন আপাকে পদার্থবিজ্ঞান পড়াতে আসতেন। আপা প্রায়ই বলতেন তার মাথা যন্ত্রণা করছে, সে বাইরের ঘরে বসে পড়তে পারবে না। সজল ভাইকে যেনো তার ঘরে যেয়ে পড়িয়ে দিয়ে আসা হয়। আমি তখন এইট কি নাইনে পড়ি। সবকিছুর প্রতি বেশিই কৌতুহল আমার, আবার অনেক নিষিদ্ধ কাজের প্রতি টানটাও বেশি। আমি খুব করে চাইতাম আপা যেনো বাইরের ঘরেই পড়তে বসে সজল ভাইয়ের কাছে, যাতে তাকে দূর থেকে হলেও বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি। কারণ আমাদের ঘরে যতক্ষণ আপা পড়তো সজল ভাইয়ের কাছে, ততক্ষণ আমার প্রবেশ নিষেধ ছিলো ও ঘরে। তাতে নাকি আপার পড়ার ক্ষতি হয়। কিন্তু আমার অবাধ্য মন বারবার সজল ভাইকে একটা নজর দেখার জন্য ছটফট করতো। আমি বেশ বুঝতে পারতাম আপার আসলে মাথা যন্ত্রণা বা কোনো অসুস্থতা ছিলো না। শুধুমাত্র সজল ভাইয়ের সাথে মন খুলে গল্প করাই ছিলো তার মূল লক্ষ্য। প্রায়ই জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমি। চাপা হাসির শব্দ শুনতাম দুইজনের বদ্ধ জানালার বাইরে থেকে। সেই শব্দগুলো তীরের মতো বিঁধতো আমাকে। ছুটে চলে যেতাম সেখান থেকে।
আপার বিয়ের পর থেকে সজল ভাই আর এই ঘরে আসেননা। আমি চাইতামও না আসুক। আমার আপা সুখে থাকুক সবসময় তাই চেয়েছি আমি। নিজের সুখের থেকে আপার সুখের মূল্য আমার কাছে অনেক বেশি ছিলো।
মাথায় ওড়না টেনে দিয়ে সজল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,”সজল ভাই আপনি? কিছু বলবেন?”
মুচকি হেসে উনি বললেন,”ভিতরে যেতে বলবে না নাকি বাইরে দাঁড়িয়েই কথা বলবো?”
আমি একটু ইতস্ততবোধ করলাম। আপার বিয়ের পর থেকে আমি সজল ভাইয়ের সাথে খুব বেশি কথা বলিনি সেভাবে। হয়তো কষ্ট হবে ভেবে নিজেকে দূরে রাখতে চাইতাম সবসময়। কিন্তু এখন আর এসব ভেবে কি হবে। উনি আমাদের এই পরিবারটার জন্য যা করছেন আপার মৃত্যুর পর থেকে সেই কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা নেই আমার কাছে। আমি একটু হেসে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালাম,”আসুন না সজল ভাই, ভিতরে আসুন।”
ভিতরে এসে উনি একটা চেয়ার টেনে বসলেন। আমি খাটের একপাশে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে রাখলাম। কেমন যেনো সঙ্কোচ কাজ করছে। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম আমরা দুইজনই। উনিই প্রথম নীরবতা ভাঙলেন।
“নীলাঞ্জনা।”
চমকে উঠে তাকালাম আমি উনার দিকে। বনলতা আর নীলাঞ্জনা নামে শুধু বাবা নয় আরো একজন ডাকে আমাদের, সজল ভাই। কিন্তু তবুও উনার মুখে এই নামটা শুনে বুকটা কেমন কেঁপে উঠলো আমার। কোনো কথা বললাম না আমি। উনি আবার বললেন,”নীলাঞ্জনা বসো। দাঁড়িয়ে আছো কেনো?”
আমি ধীরপায়ে খাটে উনার মুখোমুখি হয়ে বসলাম। উনি স্মিত হাসলেন। আমি তাকালাম সেই হাসির দিকে, কিছুক্ষণ পর নিজেই চোখ সরিয়ে নিলাম। এটা যে পাপ, কি করতে যাচ্ছি আমি?
“নীলাঞ্জনা তুমি ভালো আছো?”
আমি আস্তে করে মাথা নাড়লাম। কিছু বলার মতো ভাষা আমি খুঁজে পাচ্ছি না।
“তুমি তো জানো নীলাঞ্জনা যে বনলতা আমার কাছে কি ছিলো।”
আমি এখনো চুপ করে থাকলাম। সবকিছুই জানি আমি। বাবা সেবার জোর করে আপার বিয়ে ঠিক করে ফেলেন অনেক বড় ঘর দেখে। কারণ তিনি বুঝে ফেলেছিলেন তার বড় মেয়ে সজল ভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। সারাজীবন প্রেম-ভালোবাসার বিরোধে থাকা বাবা সেই প্রথমবার আপার উপর রেগে যান। মাত্র সাত দিনের মধ্যে পাত্র ঠিক করে ফেলেন। আপা তখন পাগলপ্রায়। দিনরাত ঘরবন্দী হয়ে থাকে আর কাঁদে। সজল ভাই তখন কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্র। বাবা নেই। পরিবার বলতে শুধু মা আর সে, দুই বোন তাদের বিয়ে হয়ে গেছে আগেই। বাবার পেনশন আর সজল ভাইয়ের টুকটাক টিউশনের টাকায় খেয়ে না খেয়ে তাদের দিন চলে। এই অবস্থায় আপাকে বিয়ে করা তার ক্ষমতার বাইরে। তিনি বারবার বাবার কাছে আসতেন একটু সময় চাওয়ার জন্য। কিন্তু বাবা আরো রেগেমেগে তাকে তাড়িয়ে দিতেন। কি এক দিন গেছে তখন আমাদের। আপা তো নাওয়া খাওয়া সব ছেড়েই দিয়েছিলো। সজল ভাইকে দেখলেও চিনতে পারতাম না। খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কোটরে ঢুকে যাওয়া চোখ আর সিগারেটের ধোঁয়ায় প্রতিনিয়ত পুড়ে যাওয়া ঠোঁট দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হতো। খুব করে চাইতাম, বাবা ওদের মেনে নিক। টাকা-পয়সা কম থাকলেও সুখের কমতি হবে না কখনো। কিন্তু বাবা কোনোভাবেই রাজি হন না। এদিকে বিয়ের দিন আরো ঘনিয়ে আসতে থাকলো। এরমধ্যে হঠাৎ একদিন দেখি সজল ভাই তার মা কে সাথে করে এনেছেন বাবার কাছে। হয়তো শেষ চেষ্টা করতে চাচ্ছেন। ভিতরের ঘরে যেয়ে আপাকে এই খবর দিলাম আমি। আপার মুখটা যেনো খুশিতে চকচক করে উঠলো। কি সুন্দর একটা মায়াবী মুখ, এই মুখের জন্য আমি আমার সব ভালো লাগা বিসর্জন দিতে পারি। আপা মাথায় ওড়না দিয়ে ঘর থেকে বাইরে এসে দাঁড়ালো। বসার ঘরে কি কথা হলো আমরা কেউ জানিনা। বাবা, সজল ভাই আর সজল ভাইয়ের মা তিনজন নিজেদের মধ্যে কি কথা বললেন আমাদের জানা হলো না কারণ আমাদের প্রবেশ নিষেধ ছিলো ওখানে। শুধু মনে মনে দোয়া করে যাচ্ছিলাম আমি সবকিছু যেনো ঠিক হয়ে যায়। আর আপা তো উত্তেজনায় কাঁপছিলো শুধু।
হঠাৎ বাবা ডাক দেন আপাকে। আপা কাঁপাকাঁপা পায়ে উপস্থিত হয় বসার ঘরে। আপাকে দেখে সজল ভাইয়ের মা তাকে জড়িয়ে ধরেন। জানতে পারলাম বাবা সজল ভাইকে এক বছর সময় দিয়েছেন। এই এক বছরে একটা চাকরি যোগাড় করে আপাকে বিয়ে করতে হবে তার। আপা অবিশ্বাস্য চোখে বাবার দিকে তাকালো। বাবা ভরসার হাসি হাসলেন। অনেকদিন পর আপা শব্দ করে কেঁদে উঠলেন বাঁধভাঙা আনন্দে। আচ্ছা সেদিন কি আমার একটু হলেও কষ্ট হয়েছিলো? সজল ভাইও ঘন ঘন চোখ মুছে আপার দিকে তাকাচ্ছিলো। সেই চাহনি কি আমার বুকে তীরের মতো বিঁধেছিলো? একছুটে ছাদে চলে গিয়েছিলাম আমি। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজের ভিতরের কষ্টটা হাওয়ায় মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলাম সেদিন।
এসবই ভাবছিলাম চুপ করে বসে। আবারও নীরবতা ভাঙলেন সজল ভাই,” কি ভাবছো নীলাঞ্জনা?”
“কিছু ভাবছি না সজল ভাই। আপনি কি চা খাবেন? চা করে আনি?”
“নাহ। তোমার আপার মৃত্যুর পর থেকে আর চা খাইনা। তোমাদের বাড়িতে যখন আগে আসতাম তোমার আপাকে পড়াতে তখন সে খুব সুন্দর করে চা বানিয়ে দিতো আমাকে। সেই থেকে অভ্যাসটা এমন হয়েছে তার হাতের চা ছাড়া অন্য কারো হাতের চা খেতে ভালো লাগে না। তাই সে চলে যাওয়ার পর থেকে চা খাওয়া একরকম ছেড়েই দিয়েছি বলতে পারো।”
ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। আপা রে, এক সমুদ্র ভালোবাসা রেখে যেয়ে কেমন আছিস তুই কবরে?
“আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান সজল ভাই?”
“না তেমন কিছু না। এই তুমি কেমন আছো? পড়াশোনা কেমন হচ্ছে এসবই জানতে এসেছিলাম।”
আমি ম্লান হাসি,”যতোটা ভালো এই মুহুর্তে থাকা যায় ততোটাই আছি। আপনি তো জানেন বিলু আপা শুধুমাত্র আমার বোন না, আমার দ্বিতীয় মা ছিলো। ছোট থেকে আগলে রেখেছে আমাকে দুইহাত দিয়ে। মা কখনো আমাকে মারতে আসলে আপা ছুটে চলে আসতো। তার সামনে আমাকে কেউ কটু কথা বলবে তা সে কোনোদিন সহ্য করতে পারতো না। কতো রাগ অভিমান খুনসুটি, ঝগড়া আবার দিনশেষে আমি তাকে ছাড়া আর সে আমাকে ছাড়া থাকতে পারতাম না আমরা। আমার সেই বোনের এমন বীভৎস মৃত্যু আমি সহ্য করতে পারছি না সজল ভাই।”
নিজেকে আর সংবরণ করতে পারলাম না। দুইহাতে মুখ ঢেকে শব্দ করে কেঁদে উঠলাম আমি।
“আমাকে ক্ষমা করো নীলাঞ্জনা। তোমাকে কষ্ট দেওয়া আমার উদ্দেশ্য ছিলো না। নিজেকে শক্ত করো। বনলতার মৃত্যুটা আমিও সহ্য করতে পারছি না। শুধু বারবার মনে হচ্ছে আমি নিজে কেনো সেদিন বাড়িতে থাকলাম না। হয়তো একসাথে বাঁচতে পারতাম দুইজন নাহয় একসাথে মরতাম। যেখানেই থাকতাম একসাথে তো থাকতে পারতাম।”
চোখের কোণে আসা পানিটা মুছে নিলো সজল ভাই। আমি মাথা নিচু করে বসে নখ খুটতে লাগলাম। এরপর অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বললাম না। এক পর্যায়ে সজল ভাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঘর ছেড়ে বাইরে চলে গেলেন। আবার কি মনে করে দরজার কাছে ফিরে এসে বললেন,” কখনো কোনো প্রয়োজন হলে আমাকে জানাবে। যে কোনো দরকারে আমি তোমাদের পাশে আছি।”
এই বলে আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে উনি চলে গেলেন। আমি একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকলাম।
আপা আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রায় আটমাস হতে চললো। আমরা অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি দিনের পর দিন। এ কয়দিনে সজল ভাইয়ের সাথে আমাদের পরিবারের অন্যরকম একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এখন সে আর এ বাড়ির জামাই না, এ বাড়ির ছেলেতে পরিণত হয়েছে। বাড়ির সিদ্ধান্ত এখন সে-ই নেয় বেশিরভাগ। এছাড়াও বাবার সাথে প্রতিদিন বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। আমি সেসব জানিনা কিংবা জানার প্রয়োজনও মনে করিনা। শুধু বাবাকে দেখি আলোচনার পরে বেশ গম্ভীর হয়ে যান। মা কে ফিসফিস করে অনেক কিছু বলেন। মা শুধু আস্তে করে বলে,”আপনি যেটা ভালো মনে করেন।” প্রতিবার এই বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে মা। আমি জানার চেষ্টা করি মাঝে মাঝে মায়ের থেকে কি বিষয়ে এতো কথা হচ্ছে। মা কিছু বলেন না। আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন শুধু। এরমধ্যে একদিন সজল ভাইয়ের মা ও এসে আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে গেছেন। আমাকে কাছে বসিয়ে বললেন,”সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে মা, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”
আমি জানিনা কি ঠিক হবে। আমার বোনকে আমরা আর ফিরে পাবো না। আর কি বাকি আছে ঠিক হওয়ার আমি জানিনা। কিন্তু মুরুব্বি মানুষের মুখের উপর কিছু বলিনা। মাথা নিচু করে বসে থাকি আমি।
সেদিন রাতে নিজের ঘরে বসে ছিলাম আমি। জানালা খুলে বাইরের উথাল পাথাল জ্যোৎস্না দেখছিলাম। মনের ভিতর কেমন অস্থির লাগছিলো আমার। কোনো কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। একদৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এতোটাই ধ্যানমগ্ন হয়ে ছিলাম যে বাবা আর মা যে আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতেই পারিনি আমি।
“মা নীলাঞ্জনা।”
বাবার ডাকে সম্বিত ফিরে পাই আমি। চমকে যেয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়াই আমি। বাবার হাত ধরে বাবাকে খাটে বসিয়ে বলি,”বাবা তোমরা এখানে? কিছু বলবে? আমাকে ডাকলেই তো পারতে। কষ্ট করে তোমরা আসতে গেলে কেনো?”
মা এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন। বাবা আমার দুইহাত তার হাতের মধ্যে নিলেন। আমি নিশ্চিত বাবা আমাকে গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা বলবে কারণ এমন কিছু বলার সময়ই শুধু বাবা আমার হাত এভাবে ধরেন।
আমি বাবার পাশে এসে বসলাম। আস্তে করে বললাম,”বাবা কি বলবে তুমি বলো?”
বাবা একবার মায়ের দিকে তাকালেন। তারপর আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,”দেখো মা, তোমাদের দুইবোনকে আমি কতোটা ভালোবাসি তা নিশ্চয়ই তোমাদের বলে দিতে হবে না। আমার জীবনে তোমাদের স্থান কোথায় তা মনে হয় শুধু আমিই জানি। তোমরা অবশ্য আমার সেই ভালোবাসার মান রেখেছো। কোনোদিন আমার মুখের উপর তোমরা কিছু বলোনি। যখন যা বলেছি মেনে নিয়েছো।”
এই বলে বাবা একটু থামলেন। আমি বুঝতে পারছি না বাবা কোনদিকে ইঙ্গিত দিচ্ছেন। কৌতুহলী দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালাম, দেখলাম সে চুপ করে আছে।
বাবা আবার বলতে শুরু করলেন,”তোমার কাছে একটা আবদার আছে মা।”
আমি তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ালাম,বাবার হাত ধরে বললাম,”বাবা আবদার কেনো বলছো? তুমি আদেশ করো আমাকে। আমি তোমার আদেশ অবশ্যই রাখবো।”
“শান্ত হও নীলাঞ্জনা। যে আবদারটা এখন তোমাকে করবো তার সাথে তোমার জীবন জড়িয়ে আছে। তোমার অবশ্যই অধিকার আছে তোমার সিদ্ধান্ত জানানোর। তোমার উপর কিছু চাপায় দিবো না আমরা।”
আমি একটু বিস্মিত হই। কি এমন আবদার বাবা করবেন যার সাথে আমার জীবন জড়িয়ে আছে? আমি বাবার দিকে তাকালাম। বাবা তার চশমাটা খুলে ভালো করে মুছে নিলেন। তারপর বললেন,”আমি চাই তুমি সজলকে বিয়ে করো। তোমার মা ও তাই চায়।”
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম বাবার কথা শুনে। এক ঝটকায় পিছনে ছিটকে আসি আমি। একবার বাবার দিকে একবার মায়ের দিকে তাকাই। তারা দুইজনই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হতভম্ব হয়ে যাই আমি। কি বলছেন বাবা এসব?
বাবা উঠে দাঁড়ান। আমার কাছে এসে বলেন,” দেখো মা, আমি জানি এটা এতো সহজে মেনে নেওয়া তোমার পক্ষে অসম্ভব। আমাদের পক্ষেও এতোটা সহজ ছিলো না। কিন্তু পাড়াপ্রতিবেশিরা আজকাল অনেক কথা বলে। বাড়িতে বিবাহযোগ্যা মেয়ে আর বিপত্নীক মেয়েজামাই বারবার আসছে এ বাড়িতে। বিভিন্ন কানাঘুষা আজকাল শুনতে পাই আমি। আর সজল তো শুধু আমাদের বাড়ির জামাই না, ছেলের মতো হয়ে গেছে। সে এ বাড়িতে আর না আসুক তা আমরাও চাইনা। তাই অনেক ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা।”
আমি বিস্ফারিত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললাম,”বাবা, যে সংসার আমার বোনের ছিলো, সেই সংসারে আমি যাবো? তা কি করে হয় বাবা?”
মা এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন,”শান্ত হও নীলু। তোমাকে আমরা জোর করবো না। সবকিছুই তোমার সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে।”
আমি আস্তে করে বললাম,”সজল ভাইকে তোমরা এই কথা জানিয়েছো?”
“তার সাথে কথা বলেই আমরা এই সিদ্ধান্তে রাজি হয়েছি। সজল বলেছে, আমরা যা ভালো মনে করি তাই হবে।”
এতোটা অবাক এই ছোট্ট জীবনে আমি খুব কমই হয়েছি। এই সময় আমার কি করা উচিত আমি জানিনা। হ্যা এটা ঠিক, একটা সময়ে সজল ভাইকে আমি আমার জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসতাম। উনাকে নিজের করে পেতে চাইতাম। কিন্তু যখনই জেনেছি সজল ভাই আমার আপার ভালোবাসা, তখন থেকে আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছি আমি। তবুও প্রতিরাতে কেঁদে বালিশ ভিজিয়েছি আমি, আপা রাতজেগে সজল ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলতো আর আমি ঘুমের ভান করে অন্যপাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে শুয়ে কাঁদতাম। কিন্তু আমি এইভাবে কখনো সজল ভাইকে পেতে চাইনি। যে স্বামী-সংসার আমার আপার ছিলো সেই সংসার আমি নিজের করে পাবো? এটা কি সম্ভব?
আমার চুপ করে থাকতে দেখে বাবা বললেন,”তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই মা। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত জানাও। কোনোকিছুই তোমার উপর চাপিয়ে দিবো না আমরা। তবে একটা কথা, আমরা তোমার ভালোই চাই। আমাদের একটা ছেলে নেই। তোমরা দুইবোনই আমাদের সব। একজনের সুখের কপাল ছিলো, কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সেই সুখ তার কপালে সইলো না। আমরা চাই তুমি সুখী হও। আর কিছু না।”
আমি পাথরের মতো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। বাবা চলে গেলেন ঘর ছেড়ে। মা এসে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,”রাজি হয়ে যাও মা। তুমি ভালো থাকবে।” এই বলে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন তিনি।
আমি ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম। আমি জানিনা আমার রাজি হওয়া উচিত কিনা। সজল ভাইয়ের জন্য এখনো আমার মনের কোণে যে জায়গাটা আছে সেই জায়গা কি ভরাট করা উচিত হবে আমার? হঠাৎ করে আমার মাথায় আসলো, কথা বলতে হবে, এক্ষুনি সজল ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে আমাকে।
তাড়াতাড়ি করে ছুটে যেয়ে ফোন করলাম আমি। দুইবার রিং হওয়ার পরই ফোন ধরলেন সজল ভাই, তার কণ্ঠে উদ্বেগ,”কি হয়েছে নীলাঞ্জনা? কোনো সমস্যা হয়েছে বাড়িতে? বাবা মায়ের শরীর ভালো আছে? তুমি? তুমি ভালো আছো?”
আমি শান্তস্বরে বললাম,”সবাই ভালো আছি আমরা। আর বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়নি।”
“তাহলে এতো রাতে ফোন দিয়েছো? কিছু বলবে?”
আমার খুব ইচ্ছা করছিলো ফোনেই সবকিছু খুলে বলতে। কিন্তু না, এতো বড় সিদ্ধান্তের কথা ফোনে বলা যাবে না, সামনাসামনি বলতে হবে।
“আপনার সাথে কিছু কথা আছে সজল ভাই।”
“হ্যা বলো কি বলতে চাও।”
“ফোনে না, সামনাসামনি বলতে হবে।”
একটু অবাক হলেন মনে হয় উনি,”হ্যা বেশ তো। কাল তোমাদের বাড়ি যাবো। তখন নাহয় শুনবো সব।”
“না, বাড়িতে হবে না। বাইরে কোথাও দেখা করতে হবে।”
বেশ কৌতুহলী কণ্ঠে উনি বললেন,”বাইরে বলতে হবে? কি এমন কথা?”
“তা দেখা হলেই জানতে পারবেন। আগামীকাল ঠিক সকাল দশটায় আমার ভার্সিটির সামনে থাকবেন আপনি।”
“বেশ তাই হবে।”
আমি আর কোনো কথা না বলে ফোন রেখে দিলাম। সারারাত এপাশ ওপাশ করলাম আমি। কি সিদ্ধান্ত নিবো? কি সিদ্ধান্ত নিলে বাবা মা খুশি হবেন? ঘুম হলো না সে রাতে আমার।
সকালে উঠে কোনোমতে তাড়াতাড়ি করে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম আমি। দশটার আগেই ভার্সিটির গেটে যেয়ে উপস্থিত হলাম। অবাক ব্যাপার, সজল ভাই তারও আগে চলে এসেছেন। আমাকে দেখেই ছুটে আসলেন আমার কাছে। উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,” কি ব্যাপার নীলাঞ্জনা? কি বলবে তুমি? দুশ্চিন্তায় সারারাত ঘুম হয়নি আমার।”
আমি পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালাম তার দিকে। চোখের নিচে কালি, সত্যিই সারারাত ঘুম হয়নি তার।
আস্তে করে বললাম,”এখানে না, পাশের একটা রেস্টুরেন্টে চলুন। ওখানে যেয়েই সব কথা হবে।”
দুইটা কফি অর্ডার করে দুইজন মুখোমুখি বসলাম আমরা। সজল ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমি কোনো ভণিতা না করেই বললাম,”বাবা গতকাল আমাকে তার একটা সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন।”
“কি সিদ্ধান্ত নীলাঞ্জনা?”
“কি বিষয়ে জানাতে পারেন এটুকু না বোঝার মতো বোকা আপনি নন সজল ভাই।”
উনি ইতস্তত করতে লাগলেন। মুচকি হাসলাম আমি সেদিকে তাকিয়ে।
কিছুক্ষণ পর আস্তে করে বললেন,”কেউ তোমাকে জোর করবে না নীলাঞ্জনা। তুমি যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই হবে।”
আমি সরু চোখ করে উনার দিকে তাকালাম। সেই দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে একটু ভড়কে গেলেন সজল ভাই। ততক্ষণে আমাদের কফি চলে এসেছে। আমি শান্ত ভঙ্গিতে কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললাম,”আপার জায়গা আপনি অন্য কাউকে দিতে পারবেন সজল ভাই?”
কিছুটা চমকে উঠলেন উনি, হাত থেকে কফি উনার সাদা শার্টে যেয়ে পড়লো কিছুটা। আমি টিস্যু এগিয়ে দিলাম। উনি এখনো হতভম্ব পর্যায়ে আছেন।
“নীলাঞ্জনা, তুমি ঠিক বলেছো। বনলতার জায়গা আমি কাউকে দিতে পারবো না এটা ঠিক। সে শুধু আমার সহধর্মিণীই নয়, আমার সুখ-দুঃখের সাথী ছিলো। আমার মনপ্রাণ জুড়ে ছিলো। তবে হ্যা, তোমাদের পরিবারটিকে আমি এই কয়েকমাসে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি। একদম নিজের পরিবারের মতো। তাই বাবা যখন বললেন আশেপাশের পাড়াপ্রতিবেশিরা কি বলছে আমাদের নামে তখন আমি নিজে থেকে বাবাকে এই সিদ্ধান্ত জানাই। তবে সবকিছুই তোমার উপর নির্ভর করছে। তুমি যদি চাও হবে, না চাইলে হবে না।”
আমি এখনো সরু চোখে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি আমার দিকে তাকাতে পারলেন না, অন্য দিকে তাকিয়ে বললেন,”কিন্তু তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি, তোমাকে কখনো অযত্ন করবো না আমি। তোমাকে তোমার প্রাপ্য সম্মান আমি দিবো।”
আমি উঠে দাঁড়ালাম। সজল ভাইও সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালেন। আমি রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আসলাম, উনিও পিছন পিছন আসলেন।
“কি ভাবলে নীলাঞ্জনা? কি করবে তুমি?”
“আমি কিছুদিন সময় চাই সজল ভাই। এই কয়দিন একটু চিন্তাভাবনা করবো আমি। তারপর আমার সিদ্ধান্ত জানাবো সবাইকে।”
“কতোদিন সময় লাগবে নীলাঞ্জনা?”
আমি উনার দিকে তাকালাম। উনার ব্যস্ততা দেখে অবাক হলাম একটু। সামলে নিয়ে বললেন,”না মানে। আমাদের দিক থেকেও তো প্রস্তুতির দরকার আছে, তাই বললাম আর কি।”
আমি কঠিন স্বরে বললাম,”যতোটা তাড়াতাড়ি পারা যায়, আমি চেষ্টা করবো সাধ্যমতো।”
ওভাবেই উনাকে রেখে একটা রিকশা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসলাম আমি। আজ আর ক্লাস করতে মন চাইলো না। অস্থির হয়ে আছে মন, কোনো কিছুতেই শান্তি মিলছে না। বাড়ি ফিরেই নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম আমি। আমাদের দেয়ালে বাঁধানো ছবিটার দিকে তাকালাম। আপার হাসি হাসি মুখটার দিকে তাকিয়ে বললাম,”আপা আমাকে ক্ষমা করে দিস রে,ক্ষমা করে দিস।”
চলবে…
#বনলতা
পর্বঃ২(অন্তিম পর্ব)
এরপরের কিছুদিন আমার ভীষণ অস্থিরতায় দিন কাটলো। ক্লাসে যাওয়া একদম কমিয়ে দিলাম। বেশিরভাগ সময় নিজেকে ঘরবন্দী করে রাখি, দমবন্ধ হয়ে আসলে বাইরে যাই। বাবা-মাও নিজে থেকে আমাকে কিছু বলেন না। আমি আমার সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য তাদের কাছ থেকেও কিছুটা সময় চেয়েছি। তবে সেই ঘটনার পর থেকে সজল ভাই আমাদের বাড়ি খুব কম আসেন। আসলেও খুব অল্প সময়ে থাকেন। আমার সাথে দেখা করতে চান,কিন্তু আমি ঘর থেকে বের হইনা। উনি প্রায়ই ফোন দেন, আমি রিসিভ করিনা। বেশ কিছুদিন এভাবে যাওয়ার পর আমি ঠিক করলাম আমি আমার সিদ্ধান্ত জানাবো। প্রথমে সজল ভাইয়ের সাথে কথা বলবো এরপর বাবা মা কে জানাবো। প্রায় পনেরো দিনের মাথায় আমি সজল ভাইকে ফোন করি। উনি যেনো আমার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলেন। একবার রিং হওয়ার সাথে সাথে ফোন তুললেন,”নীলাঞ্জনা? ওহ মাই গড, তুমি ফোন দিয়েছো আমাকে? আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। তুমি জানো? এই কয়দিন কতোটা দুশ্চিন্তায় আমার দিন কেটেছে। তোমাকে কতোবার ফোন দিয়েছি আমি। না রিসিভ করেছো আর না তো আমি তোমাদের বাড়িতে গেলে আমার সাথে দেখা করেছো। কি সিদ্ধান্ত এটা বাবা-মা কে ও জানাও নি তুমি। তারাও কিছু বলতে পারেননি আমাকে। কি ভীষণ দুশ্চিন্তায় আমার দিন কেটেছে তুমি জানো,নীলাঞ্জনা?”
আমি স্মিত হাসলাম। আমাকে নিয়ে সজল ভাইয়ের এতোটা উদ্বেগ আগে জানতাম না তো। অনর্গল কথা বলে যাচ্ছেন তিনি।
আমাকে চুপ থাকতে দেখে আবার বললেন,”নীলাঞ্জনা তুমি কি শুনতে পাচ্ছো আমার কথা? চুপ করে আছো কেনো?”
আমি শান্ত স্বরে বললাম,”শুনতে পাচ্ছি সজল ভাই। আসলে আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। সেইটাই আপনাকে জানাতে চাই আমি।”
একপ্রকার চিৎকার করে উঠলেন তিনি,”সত্যি সিদ্ধান্ত নিয়েছো তুমি? আমাকে বলো কি সেইটা?”
“এতো ব্যস্ত হচ্ছেন কেনো সজল ভাই? বলবো তো। কিন্তু ফোনে না। আগামীকাল সন্ধ্যায় আপনি আমাদের বাড়িতে আসবেন। সামনাসামনি যা জানানোর জানাবো আমি।”
“আগামীকাল কেনো? আজ সন্ধ্যায় আসি?”
আমি কঠিন গলায় বললাম,”না।”
এই বলে উনাকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে ফোন রেখে দিলাম আমি। আবারও আমাদের ছবিটার সামনে এসে দাঁড়াই আমি,”আপা আমি কি কোনো ভুল করতে যাচ্ছি? আমাকে ক্ষমা করে দিবি তো আপা?”
পরের দিন সকালে বাবা আর মা কে জোর করে আমার ছোট খালার বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম আমি। এই কয়মাসে বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও যাননি তারা। এবারও আমাকে রেখে কোথাও যেতে চাননা। কিন্তু আজকে একটা প্লান সাকসেসফুল করতে হবে আমাকে। যার জন্য ফাঁকা বাড়ি লাগবে আমার। এখনই কিছু জানালাম না তাদের। একরকম জোর করে পাঠিয়ে দিলাম। নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও দুপুরের দিকে বের হয়ে গেলেন তারা।
উত্তেজনায় আমার শরীর কাঁপছে। সবকিছু ঠিকমতো পারবো তো আমি? কিছু ভুল হয়ে যাবে না তো? খুব ভয়ংকর একটা কাজ আমি করতে যাচ্ছি। সামান্য ভুলে বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
বিকাল না গড়াতেই আমি সুন্দর করে সাজতে বসলাম। আপার সাদা রঙের জামদানী শাড়িটা পরলাম আমি। আপার ভীষণ পছন্দের ছিলো শাড়িটা। আমি নষ্ট করে ফেলবো ভেবে কখনো দেয়নি আমাকে পরতে। আজ প্রথমবারের মতো পরলাম আমি শাড়িটা। গাঢ় করে কাজল দিলাম চোখে। লম্বা চুলগুলো ছেড়ে দিলাম,ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। হাতভর্তি সাদা কাঁচের চুড়ি। ব্যস! আর কিছু না। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই চমকে উঠলাম আমি। একদম যেনো বিলু আপা দাঁড়িয়ে আছে। এরকম সাজের পিছনে অবশ্য কারণও আছে। আপা সবসময় নিজেকে এভাবে সাজিয়ে রাখতে পছন্দ করতো। আমি অবশ্য শাড়ি খুব বেশি পছন্দ করিনা। কিন্তু আজকে পরেছি আমি, আপার মতো করে সেজেছি। মনে হচ্ছে অনেকদিন পর আপাকে দেখতে পাচ্ছি আমি আয়নাতে। ক্রুর একটা হাসি দিলাম, হাসিটা আপার সাথে মিললো না। আপা মিষ্টি করে হাসতো সবসময়।
সময়টা কোনোভাবেই যেনো যাচ্ছেনা। ভিতর ভিতর ভীষণভাবে অস্থির হয়ে যাচ্ছি আমি। রান্নাঘরে যেয়ে দুই কাপ চা বানালাম আমি আপার মতো করে। আপার হাতের চায়ের স্পেশালিটি হলো আপা সবসময় চায়ে একটা এলাচ ছেঁচে দিতো। আমিও দিলাম। ভারী মিষ্টি গন্ধ আসছে চা থেকে। আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে সজল ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম।
সন্ধ্যা মিলানোর সাথে সাথেই কলিংবেল বেজে উঠলো আমাদের। বুক কাঁপতে থাকে আমার। শেষবারের মতো আমাদের ছবিটার দিকে তাকালাম এরপর আস্তে আস্তে পা ফেলে দরজা খুলে দাঁড়ালাম আমি। ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো সজল ভাই। চোখের পলক ফেলতে যেনো ভুলে গেছেন উনি। উনাকে ওই অবস্থায় দেখে শব্দ করে হেসে উঠলাম আমি। নিজে হেসে নিজেই অবাক হলাম, একদম যেনো বিলু আপার মতো হাসলাম। আর সজল ভাই আরো একপ্রস্থ অবাক হলেন। কোনোরকমে বললেন,”নীলাঞ্জনা।”
আমি হাসতে হাসতেই বললাম,”কেনো? বনলতা ভেবেছিলেন?”
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন সজল ভাই আমার দিকে। আমি উনাকে বললাম,”বাইরে থেকেই এভাবে হা করে দেখবেন নাকি ভিতরে আসবেন?”
আমি দরজা থেকে সরে দাঁড়ালাম। কাঁপা কাঁপা পায়ে ভিতরে ঢুকলো সজল ভাই। বসার ঘরে সোফায় এসে বসলো সে। আমিও মুখোমুখি হয়ে বসলাম।
“তারপর সজল ভাই? কেমন আছেন বলেন।”
“ইয়ে মানে, ভালোই আছি।”
“ইজি হয়ে বসেন। আপনি কি ভয় পাচ্ছেন কোনো কারণে?”
একটু চমকে গেলেন উনি। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,”ভয়? ভয় পাবো কেনো?”
“তাহলে কিছু বলছেন না যে?”
“তোমাকে সুন্দর লাগছে নীলাঞ্জনা।”
আমি আবারও শব্দ করে হাসলাম। বারবার উনি চমকে উঠে উঠে আমার দিকে তাকাচ্ছেন।
“তাই নাকি? ভালো করে দেখে বলেন তো আপনার বনলতার মতো লাগছে কিনা।”
“বনলতার মতো লাগছে না। তোমাকে তোমার মতো করে সুন্দর লাগছে।”
আমি ছোট্ট করে হাসলাম। এরপর উঠে যেয়ে দুই কাপ চা এনে উনার সামনে রাখলাম।
“আমাকে বনলতার মতো না লাগলেও, তার মতো করে চা বানানোর চেষ্টা করেছি আজকে। খেয়ে বলুন তো কেমন হয়েছে?”
“আমি চা খাবো না নীলাঞ্জনা।”
“আমি জানি আপনি ধোঁয়া ওঠা গরম চা খেতে পারেন না। তাই অনেকক্ষণ আগেই চা বানিয়ে সামান্য ঠান্ডা করে রেখেছি। আর এক টুকরো এলাচও দিয়েছি। এবার নিশ্চয়ই খাবেন আপনি।”
সজল ভাই একটু ইতস্তত করতে লাগলেন। এরপর কাঁপা কাঁপা হাতে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দিলেন চায়ে।
“কি বিলু আপার মতো হয়েছে তো?”
“হয়েছে। তবে তুমি নীলাঞ্জনা, বনলতা নও। তোমাকে জোর করে বনলতা সাজতে হবে না।”
আমি আবারও একটু হাসলাম। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। সজল ভাইয়ের চায়ের কাপ প্রায় শেষের দিকে। আমি এবার নিজের চায়ে ছোট করে একটা চুমুক দিলাম। কাপটা টেবিলে আস্তে করে রেখে সজল ভাইয়ের চোখের দিকে তাকালাম আমি। উনি আমার দিকে তাকাতে পারছেন না। অন্য দিকে তাকিয়ে আছেন।
শান্ত স্বরে আমি বললাম,”আপা কে মারলেন কেনো সজল ভাই?”
লাল বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকালেন সজল ভাই। তার হাত থেকে চায়ের কাপ নিচে পড়ে যেয়ে ভেঙ্গে গেলো।
জোরে চিৎকার করে ওঠে সে,”নীলাঞ্জনা, অনেক বেশি বলে ফেললে। তুমি জানো তুমি কি বলছো? মাথা ঠিক আছে তোমার? বাবা মা কোথায়? তাদের ডাকো। তারা শুনুক, কি বলছো তুমি।”
আমি পূর্বের চেয়েও শান্ত হয়ে বললাম,”চিৎকার করছেন কেনো সজল ভাই? শান্ত হয়ে বসুন না। আর বাবা মা তো বাড়িতে নেই। তারা আজ দুপুরে ছোট খালার বাড়িতে গেছেন। এই বাড়িতে এখন শুধু আপনি আর আমি।”
ভয়াবহ দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন সজল ভাই। আমি আবারও চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। চোখের ইশারায় উনাকে সোফায় বসতে বললাম। উত্তেজনায় উনি সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন।
তোতলাতে তোতলাতে উনি বললেন,”তুমি জানো না কি বলেছো তুমি। আমার ভুল হয়েছে এতোদিন তোমাদের সাথে যোগাযোগ রাখা। ভালোমানুষি দেখাতে যেয়ে এসব শুনতে হচ্ছে আমাকে।”
আমি উনাকে বলতে সুযোগ দিলাম। উনি নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য থামলেন। আমি ধৈর্য্য ধরে বসে থাকলাম।
এরপর বললাম,”রেগে যাচ্ছেন কেনো সজল ভাই? রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।”
ক্রোধে কাঁপতে লাগলেন উনি।
“আপা তো গ্যাসের চুলায় রান্না করতে ভয় পায়। এজন্য আপনাদের বাড়িতে খুব একটা গ্যাসের সিলিন্ডার প্রয়োজন হয়না। ছোট থেকেই ওর একটা ফোবিয়া ছিলো। গ্যাসের চুলাকে খুব ভয় ও। তাই সবসময় আপনাদের বাড়িতে ইলেক্ট্রিক চুলায় রান্নাবান্না করতো ও। সেদিন গ্যাসের চুলা কেনো জ্বালালো ও?”
ভয়ংকররকম তোতলানো শুরু করলো সজল ভাই,”সে জ্বালাতেই পারে। তাতে ক্ষতি কি হয়েছে? তার জন্য তুমি ধারণা করে নিলে যে আমিই বনলতাকে মেরেছি?”
“আমি ওই দোকানে খোঁজ নিয়েছি, যেখান থেকে আপনি সেদিন গ্যাসের সিলিন্ডার কিনেছিলেন। তারা আমাকে বলেছে আগের গ্যাসের সিলিন্ডারে অল্প হলেও গ্যাস ছিলো, যেটায় কিনা আপনার মা মাঝে মাঝে রান্না করতো। গ্যাস থাকা অবস্থাতেও নতুন গ্যাস সিলিন্ডার আনার কি প্রয়োজন ছিলো সজল ভাই? আর আমার জানামতে ওইদিন আপনার মায়ের আপনার বোনের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার কথা। আপনি জানেন যে, আপা গ্যাসের চুলায় রান্না করবে না,তারপরও নতুন সিলিন্ডার কেনো আনলেন আপনি?”
“নীলাঞ্জনা, তুমি কিন্তু এবার অতিরিক্ত বলছো। সেদিন বাড়িতে কারেন্ট ছিলো না। ইলেক্ট্রিক চুলায় কীভাবে রান্না করবে? তাই তো নতুন সিলিন্ডার নিয়ে আসলাম আমি।”
“আপনার বাড়ির আশেপাশে খোঁজ নিয়ে দেখেছি আমি সেদিন। সব বাড়িতে কারেন্ট ছিলো। শুধু আপনাদের বাড়িতেই কারেন্ট ছিলো না।এতোদিন পরেও এটা জানতে পেরেছি, কীভাবে জানতে চান? সেদিন আপনাদের পাশের বাড়ির টেলিভিশনে উচ্চ শব্দে গান চলছিলো, এই কারণে অনেকক্ষণ পর্যন্ত আপার আর্তচিৎকার তারা শুনতে পায়নি। বাসায় কারেন্ট না থাকলে কীভাবে টেলিভিশন চলতে পারে? এটা কি কাকতালীয় নাকি কোনো রহস্য?”
“হয়তো আমাদের সুইচবোর্ডে কোনো সমস্যা ছিলো সেদিন।”
“সমস্যা ছিলো নাকি সমস্যা সৃষ্টি করা হয়েছিলো?”
“মা মা মানে? কি বলতে চাও তুমি? আমি সুইচবোর্ডে সমস্যা করেছি?”
“আমি বলতে চাইনা, বলছি। কারণ সাধারণত কারেন্ট চলে গেলে আমরা জানি বড়জোর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে কারেন্ট চলে আসবে। কিন্তু আপনি কীভাবে এতোটা শিওর ছিলেন যে, সেদিন সারাদিন কারেন্ট আসবে না। গ্যাসের চুলাতেই সেদিন রান্না করতে হবে।”
আস্তে আস্তে ক্রোধান্বিত চোখে ভয়ার্ত চোখে পরিণত হতে থাকলো সজল ভাইয়ের।
“আপনার কি মনে পড়ে সজল ভাই? সেদিন আপনাদের বাড়ির পিছনে আপনি যখন যান, যেখানে আপনাদের বাড়ির মেইন সুইচ থাকে সেদিন পাশের বাড়ির দারোয়ানের সাথে আপনার দেখা হয়? সে আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলো বাড়ির পিছনে নোংরা জায়গায় আপনার কি কাজ?”
সজল ভাইয়ের ঠোঁট কাঁপতে থাকে,”তু তু তুমি কীভাবে জানলে?”
“সেইটা তো বড় কথা নয়। কেনো গিয়েছিলেন আপনি ওখানে? কি কাজ ছিলো আপনার?”
কিছু একটা বলতে যেয়েও থেমে গেলো সজল ভাই।
“গ্যাসের দোকানের লোক বলেছে, তাদের লোক যখন আপনাদের বাড়ি সিলিন্ডার সেট করে দিয়ে আসে তখন চুলা জ্বালিয়ে ঠিকঠাক আছে কিনা দেখে তারপর সে চলে গেছে। নতুন সিলিন্ডার লিক হলো কীভাবে? বাড়িতে তো আপনি আর আপা ছাড়া কেউ ছিলো না তখন।”
সারা গায়ে দরদর করে ঘাম ছুটতে থাকে সজল ভাইয়ের। আমি উনাকে কিছু বলার সুযোগ দিই। কিন্তু উনি শুধু এদিক ওদিক তাকাতে থাকেন।
“আপনার মায়ের সেদিন আপনার বোনের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিলো না। আগেরদিন রাতে হঠাৎ করে তাকে কেনো বলেছেন আপনার বোন তার মা কে দেখতে চায়? সকাল সকাল যেনো চলে যায় সে। আপনার বোনের সাথে কথা বলেছি আমি, সে বলেছে এই ধরণের কোনো কথা সে বলেনি। হয়তো সে জানতো না তার ভাই ফেঁসে যাবে, জানলে এটা বলতো না নিশ্চয়ই। তবে সত্য কখনো চাপা পড়ে থাকে না সজল ভাই। একদিন না একদিন ঠিক বের হয়ে আসবে। সেদিন আপার সাথে যখন ফোনে কথা বলছিলাম সে বলছিলো, আপনি তাকে মাছের মাথা দিয়ে মুড়োঘণ্ট করতে বলেছিলেন, দুপুরে বাইরে থেকে এসে খাবেন। আপনি খুব ভালো করে জানতেন আপনি যখন খেতে চেয়েছেন যেভাবে হোক আপা তা রান্না করে রাখবেন। সেদিন বাসায় কারেন্ট নেই, আপনার মা ও বাসায় নেই। জোর করে তাকে কেনো গ্যাসের চুলায় রান্না করতে বললেন? বাইরে থেকে কিছু কিনে এনে খেতেন সেদিনের মতো।”
সজল ভাই এবার উঠে দাঁড়ালেন। মারমুখো হয়ে আমার দিকে ছুটে আসতে লাগলেন। কিছুটা ভয় পেয়ে যাই আমি। এরকম লম্বা একজন পুরুষ মানুষ, তার শক্তির সাথে কি আমি পারবো?
কিন্তু আগাতে পারেন না উনি। ধপ করে মেঝেতে পড়ে যান। আমি আবারও ক্রুর হাসি। উনার কাছে যেয়ে বলি,”যাক ওষুধে কাজ করেছে তাহলে। চায়ের সাথে তিনটা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলাম। চাইলে অনেকগুলো মিশিয়ে মেরে ফেলতে পারতাম আপনাকে। কিন্তু তাতো আমি করবো না। আমার আপাকে যে কষ্ট দিয়ে মেরেছেন আপনি, এতো শান্তির মৃত্যু তো আপনার পাওনা নয়।”
সজল ভাই শোয়া অবস্থায় আমার পা চেপে ধরে বলে,”আমাকে ক্ষমা করে দাও নীলাঞ্জনা।বিশ্বাস করো আমি যা করেছি সব তোমার জন্য করেছি, তোমাকে পাওয়ার জন্য করেছি। ক্ষমা করে দাও আমাকে।”
ঘেন্নায় শরীর জ্বলে ওঠে আমার। একটা নরকের কীটের মতো লাগছে লোকটাকে আমার। লাথি দিয়ে পা ছুটিয়ে চিৎকার করে বলি,”একদম চুপ। ওই নোংরা মুখে তুই আমার নাম নিবি না। এসব কেনো করেছিস তুই সব জানি আমি। আপার মৃত্যুর পর থেকে তোর আচরণ সন্দেহজনক লাগে আমার কাছে। ওইযে কথায় আছে অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। কিন্তু আমি চুপ করে ছিলাম আমার বাবা মায়ের কথা ভেবে আর প্রমাণের অভাবে। সেদিন বাবা যখন আমার কাছে তোকে বিয়ে করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছিলো, তুই আমাকে বিয়ে করতে রাজি এটা শুনেই সন্দেহের দানা বাড়তে থাকে আমার। এরপর দিন তোর বিয়ে করা নিয়ে এতো ব্যস্ততা দেখে আরো বেশি করে বুঝতে পারি আমি। এই কয়দিন আমি সময় নিয়েছিলাম সব প্রমাণ যোগাড় করতে। হঠাৎ সেদিন আমাদের বাড়ির কিছু কাগজপত্র আমার চোখে পড়ে। সেসব কাগজ ছিলো আমাদের এই বাড়িটা ডেভেলপার দের হাতে দিয়ে দেওয়ার। তারা আমাদের বেশ অনেকগুলো ফ্লাট দিবে। যেগুলোর উত্তরসূরী ছিলো আপা আর আমি। সারাজীবন বাবা ডেভেলপার দের দেওয়ার বিরোধী ছিলো। তাই অনেক আগে থেকে প্লান কষে ফেলিস তুই। আপাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিবি। এরপর বাবার দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাবাকে রাজি করিয়ে ফেলবি। আর দাবার গুটি হিসেবে ব্যবহার করবি আমাকে। এক ঢিলে দুই পাখি মারার প্লান করলি তুই। একে তো আপাকে মেরে ফেলবি, এরপর পুরো সম্পত্তির উত্তরসূরী শুধু আমি থাকবো। আমাকে বিয়ে করে পুরো সম্পত্তির মালিক হবি তুই। এতো লোভ ছিলো তোর? তোর এই লোভের জন্য আমার আপাকে বলি দিতে হলো?”
ঘৃণায় এক দলা থুথু ফেললাম অসভ্যটার মুখের উপর।
“বিশ্বাস করো নীলাঞ্জনা। আমি সত্যি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। বনলতাকে আমি মারতে চাইনি। ওকে বলেছিলাম আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিতে। ও ছিলো ভীষণ আনস্মার্ট। আমার বন্ধুদের সামনে ঠিক করে কথাই বলতে পারতো না। টেনেটুনে ইন্টার পাশ করে আর পড়াশোনা করলো না। অফিসের একটা পার্টিতেও ওকে নিয়ে যাওয়া যেতো না। আর গেলেও সবসময় মুরুব্বিদের মতো শাড়ি চুড়ি পরে যেতো। আমার কলিগরা দেখে হাসাহাসি করতো। দিনদিন হাঁপিয়ে উঠতে থাকি আমি। তারপরও সবকিছু মানিয়ে নিচ্ছিলাম আমি। কিন্তু যেদিন জানতে পারি ওর মা হওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই, আমাকে বাবা ডাক কোনোদিন শোনাতে পারবে না, সেদিন ওকে আমি ডিভোর্স দিতে চাই। কিন্তু তারপর থেকেই ওর প্যানপ্যানানি কান্না শুরু হয়। ও আমাকে ডিভোর্সও দিবে না আবার আরেকটা বিয়ে করার অনুমতিও দেবে না। সতীনের ঘর নাকি সে করতে পারবে না। দিনদিন অসহ্য লাগতে শুরু করে ওকে আমার। একটাই কথা তার, এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছি, যদি যেতেই হয় জীবিত অবস্থায় নয়, লাশ হয়ে এই বাড়ি থেকে যাবো। রাগের মাথায় এই অন্যায়টা করে ফেলেছি আমি। ক্ষমা করে দাও আমাকে নীলাঞ্জনা। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি।”
রাগে আমার চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো। শয়তানটার জন্য ঘৃণায় শরীর জ্বলতে থাকে আমার।
চিৎকার করে বললাম,”এই কারণে আমার ফুলের মতো আপাকে শেষ করে দিলি তুই? আবার ক্ষমা চাচ্ছিস আমার কাছে? আমার আপাকে ক্ষমা করছিলি তুই?”
ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো লোকটা। আমাকে দুইহাতে নাইলনের দড়ি পেঁচাতে দেখে হতবিহ্বল হয়ে যায় ও। কোনোমতে ওঠার চেষ্টা করে, কিন্তু ওষুধের তীব্রতা তাকে বাঁধা দেয়। তোতলাতে তোতলাতে বলে,”দড়ি? দড়ি দিয়ে কি হবে নীলাঞ্জনা? ওটা ফেলে দাও।”
আমি এগিয়ে যেতে থাকি পিশাচটার দিকে। আমি এখন নীলাঞ্জনা নই, আমি বনলতা।
“নীলাঞ্জনা থামো, আর এক পা ও এগোবে না তুমি। আইন হাতে তুলে নিবে না। কি করতে যাচ্ছো কি তুমি?”
পিশাচটা শোয়া থেকে উঠতে পারছে না, কারণ তার শরীরে সেই শক্তি নেই। তীব্র ঘুমের ওষুধ তাকে কাবু করে রেখেছে। আমি ওর কোনো কথা শুনবো না এখন। আমার বোনকে যে কষ্ট দিয়ে ও মেরেছে তার থেকে কয়েকগুণ বেশি কষ্ট দিয়ে ওকে পৃথিবী থেকে নিঃশেষ করে দিবো আমি।
“নীলাঞ্জনা, আমি কি বলছি তুমি কি শুনতে পাচ্ছো না? থামো বলছি।”
প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছি ওর, নাইলনের দড়িটা প্রথমে ওর গলায় পেঁচিয়ে ওকে আধমরা করে দিবো, এরপর একটু একটু করে কষ্ট দিয়ে ওকে মারবো।
হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো ও,”আমার সব কথা আগে শুনো তুমি। আমি যখন ফেঁসেই গেছি সব আমি এখন খুলে বলবো তোমাকে। হ্যা আমি স্বীকার করছি এসব আমি করেছি। কিন্তু সবকিছুর পিছনে কার মাষ্টার প্লান এটা কি তুমি জানো? আমাকে দিয়ে এ সবকিছু কে করিয়েছে জানতে চাও না তুমি?”
আমি দুই কদম পিছিয়ে গেলাম। মাষ্টার প্লান? কার মাষ্টার প্লান থাকতে পারে এই ঘটনার পিছনে? সারাজীবন চুপচাপ থাকা আমার আপার কোনো শত্রু ছিলো না বলেই আমার জানা ছিলো। কে এই ভয়ংকর কাজে তার স্বামীকে উষ্কে দিতে পারে? নিশ্চয়ই নিজে বাঁচার জন্য অসভ্যটা মিথ্যা কথা বলছে।
আমিও চিৎকার করে বললাম,”তোকে আমি বিশ্বাস করিনা। তোর মতো জঘন্য বিষাক্ত কীটকে আমি কোনো সুযোগ দিবো না আর। আমার ফুলের মতো বোনকে তুই নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিস। এখন নিজে বাঁচার জন্য আবার নতুন নাটক সাজাচ্ছিস? মরতে তো তোকে হবেই আজকে। কোনো মিথ্যা নাটকে কাজ হবে না।”
কাঁদো কাঁদো গলায় সজল বললো,”আমাকে কিছু বলার সুযোগ দাও নীলাঞ্জনা। সবকিছু শুনে তোমার যা করার তুমি করবে। কিন্তু আমার কথা না শুনে আমাকে মেরে ফেললে আরেকজন অপরাধী বেঁচে যাবে। যাকে তুমি কোনোদিন ধরতে পারবে না। সবকিছু তার প্লানেই হয়েছে।”
আমি ঠান্ডা গলায় বললাম,”আমি তোকে কীভাবে বিশ্বাস করবো?”
“আমার কাছে সব প্রমাণ আছে। তুমি চাইলে দেখাতে পারবো আমি। আমি সব প্রমাণ রেখে দিয়েছি কারণ আমি জানতাম যদি কখনো ধরা পড়ে যাই দোষ সব আমারই হবে, আরেক অপরাধী বেঁচে যাবে। তাই সব প্রমাণ আমার কাছে আছে।”
প্রমাণের কথা শুনে একটু থমকে যাই আমি। মরতে তো অসভ্যটাকে হবেই, কিন্তু তার আগে যদি ওর মুখ থেকে আরেক অপরাধীর নাম শুনতে পারি তাহলে তাকেও শাস্তি দিতে পারবো আমি, দুইজনই শাস্তির যোগ্য ওরা।
আমি সোফায় যেয়ে বসলাম। পিশাচটা এখনো মেঝেতে শুয়ে আছে,উঠতে পারছে না।
শান্ত গলায় বললাম,”বেশ বল সেই ব্যক্তির নাম সাথে প্রমাণও দেখা। তাকেও একই শাস্তি দিবো আমি।”
ক্রুর একটা হাসি দিলো সজল। আমি একটু ভড়কে গেলাম। হাসি থামিয়ে ও বললো,”তাই নাকি? তাহলে নিজের জন্মদাত্রী মা কে শাস্তি দিতে পারবে তো নীলাঞ্জনা?”
এক ঝটকায় বসা থেকে দাঁড়িয়ে যাই আমি। আমার সমস্ত দুনিয়া উল্টাপাল্টা হয়ে গেলো চোখের সামনে। কান গরম হয়ে ঝা ঝা করতে লাগলো। পিশাচটাকে আমি এক্ষুনি শেষ করে দিবো, ওর এতো বড় সাহস ও আমার মায়ের দিকে আঙ্গুল তোলে। একছুটে ওর পেট বরাবর একটা লাথি দিতে উদ্যত হলাম। হঠাৎ ও আমার পা চেপে ধরলো।
“আমার কাছে কিন্তু সব প্রমাণ আছে নীলাঞ্জনা আগেই বলেছি। এতোক্ষণ তুমি বলেছো, আমি শুনেছি। এখন আমি বলবো তুমি শুনবে।”
আমি রাগে লাল হয়ে আছি। সজল কোনোরকমে হাতড়ে হাতড়ে উঠে বসলো, ওর চোখ রক্তের মতো লাল। আমি ওর পাশে দাঁড়িয়ে ফুঁসতে লাগলাম।
“নীলাঞ্জনা, তোমাকে এখন আমি এমন একটা সত্যি কথা বলবো, যা শুনে তুমি হয়তো আমার অবিশ্বাস করবে সাথে সাথেই। কিন্তু সত্যি তো সত্যিই।”
আমি রক্তিম চোখ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। আমিও দেখছি শয়তানটা কতো দূর বাড়তে পারে।
সজল ঘন করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,”তোমার মা কিন্তু বনলতার মা নয়।”
আমি যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম, কি বলছে ও? হাতপা উত্তেজনায় কাঁপছে আমার। প্রচন্ড রেগে গেলে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ে। আমি চিৎকার করে বললাম,”মানে? কি বলছিস তুই? নিজেকে বাঁচানোর জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই?”
“আমি জানি নীলাঞ্জনা, এই সত্যিটা তুমি জানো না, আমি না বললে কোনোদিন জানতেও পারতে না। বনলতা তোমার বাবার আগের ঘরের মেয়ে। বনলতা জন্মানোর সময় তার নিজের মা প্রচুর রক্তক্ষরণে মারা যায়। দুধের শিশুকে মানুষ করার জন্য তোমার বাবা পুনরায় বিয়ে করেন তোমার মাকে। ভীষণ গরীব ঘরের মেয়ে ছিলেন তোমার মা। তোমার বাবা তাকে প্রাচুর্যতার মাঝে নিয়ে আসেন কোনো দাবিদাওয়া ছাড়া। তার একটাই দাবি ছিলো, তার বনলতাকে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করা। কোনোদিন যেনো কেউ বুঝতে না পারে সে বনলতার আসল মা নয়।”
নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য একটু থামলো সজল। আমার হাতপা অসম্ভব কাঁপছে। মনে হচ্ছে যে কোনো মুহুর্তে মাথা ঘুরে পড়ে যাবো।
একটু থেমে সজল আবার বলতে শুরু করলো,”তোমার মা সবকিছু মেনে নিয়েছিলো শুধু তোমার বাবার অর্থের লোভে। উপরে উপরে সে বনলতাকে খুব ভালোবাসতো। বরং এমন ভাবে অভিনয় করতো যেনো তোমার থেকে বড় মেয়েকেই বেশি ভালোবাসতো, কিন্তু তার ভিতরে ছিলো অন্য চিন্তা।”
আমি কোনোরকমে জিজ্ঞেস করলাম,”কি চিন্তা?”
মুচকি হাসলো সজল। তারপর বললো,”তোমার বাবার স্থাবর অস্থাবর সব সম্পত্তি যেনো তার এবং তার নিজের মেয়ে নীলাঞ্জনার হয়। সে অনেকভাবে চেষ্টা করেছে বনলতাকে সব সম্পত্তি থেকে বহিষ্কার করতে। কিন্তু তোমার বাবা তার বড় মেয়েকে নিজের জীবনের থেকে বেশি ভালোবাসতেন। তিনি তার সম্পত্তির সিংহভাগ তার বড় মেয়ের নামে লিখে দেন আমাদের বিয়ের পরে। তুমি হয়তো জানো না, এই বাড়ি ছাড়াও তোমার বাবার আরো অনেক সম্পত্তি আছে। তোমার নামে তার অনেক কিছু থাকলেও, তোমার বাবার মনে হয়েছিলো তিনি মারা যাবার পর বনলতাকে তোমার মা কিছুই দিবে না।তাই সেসব সম্পত্তির বেশিরভাগ তোমার আপার নামে তিনি লিখে দেন। তখন থেকেই তোমার মায়ের ক্ষোভ শুরু হয় বনলতার প্রতি। সবার সামনে হয়তো দেখাতো না। কিন্তু মনে মনে হিংসার আগুন জ্বলতে থাকে তার।”
আমি আর নিতে পারছি না এতোকিছু। ধপ করে সোফায় বসে পড়লাম। দুইহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলাম। মাথার শিরাগুলো যেনো ছিঁড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম, দমবন্ধ হয়ে আসছে আমার। মনে করতে লাগলাম, কোনোদিন মায়ের এমন কোনো আচরণ দেখেছি কিনা, যার দ্বারা মনে হয়েছে আপা মায়ের আসল মেয়ে না। এমন কিছু মনে করতে পারলাম না। আপার মৃত্যুতে মায়ের আহাজারি মনে পড়লো। না, এটা কিছুতেই হতে পারে না। এই লোকটা নিজেকে বাঁচাতে মিথ্যা বলছে নিশ্চিত। কিন্তু ও যে বললো প্রমাণ আছে?
সজল আবার বলতে শুরু করলো,”তোমার মা সবসময় চিন্তা করতে লাগলো, কীভাবে বনলতাকে তার পথ থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু কোনোভাবে তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে পারছিলো না। আমি বনলতাকে নিয়ে সুখেই ছিলাম। কিন্তু বিয়ের দুই বছর যেতে না যেতেই আমার বনলতাকে অসহ্য লাগা শুরু করলো। ও আনস্মার্ট, ঠিকমতো কথাও বলতে পারতো না আমার অফিস কলিগদের সামনে। তবুও ভালোবেসে বিয়ে করেছি যখন সবকিছু মানিয়ে নিতে শুরু করলাম। কিন্তু যখন জানলাম বনলতা কোনোদিন মা হতে পারবে না তখন থেকে ওকে আমি আর একবিন্দুও সহ্য করতে পারছিলাম না। ওকে ডিভোর্স দিতে চাইলাম আমি, কিন্তু ও নারাজ। ও আমাকে ডিভোর্সও দিবে না, আবার আরেকটা বিয়েও করতে দিবে না। মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো আমার তখন। আমার হঠাৎ মনে হলো তোমার মায়ের সাথে এ ব্যাপারে আমি কথা বলবো। কারণ ততদিন আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। আমি তখনও জানতাম না যে, তোমার মা বনলতার আসল মা নয়। আমি তার কাছ থেকে তোমাকে চাইলাম শুধু। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি আমাকে বললেন বনলতাকে যদি পৃথিবী থেকেই সরিয়ে দেওয়া যায়, তবে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। এক তো তার নামের সব সম্পত্তি তোমার আর তোমার মায়ের নামে হবে, আর তোমাকেও আমি নিজের করে পাবো। সেক্ষেত্রে তোমার সম্পত্তি আমারও হবে।”
আমি একরাশ ঘৃণা নিয়ে তাকালাম লোকটার দিকে। এতো লোভ সম্পত্তির? একটা জ্বলজ্যান্ত মেয়েকে পুড়িয়ে মারতেও দ্বিধা হলো না তোদের?
“আমি প্রথমে রাজি হইনি। যতই হোক বনলতা আমার স্ত্রী। কিন্তু প্রতিনিয়ত তোমার মা আমাকে জোর করছিলেন। এদিকে এক পর্যায়ে আমিও বনলতার উপর অতিষ্ঠ হয়ে যাই। সাথে সাথে তোমাকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে যাই। তাই সব ঘটনা এমন ভাবে সাজাই যাতে এটা যে একটা ঠান্ডা মাথার খুন তা বোঝা না যায়। পুরো ব্যাপারটিকে দুর্ঘটনায় রূপ দিয়ে দিই। মেয়ের মৃতদেহকে তোমার মা কোনোভাবে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠাবে না, এই ধরণের একটা ইমোশনাল সিনক্রিয়েট করে পুরো ব্যাপারটিকে ধামাচাপা দেয় তোমার মা।”
আমার মনে হচ্ছে আমি জ্ঞান হারাবো যে কোনো মুহুর্তে। এগুলো আমি কি শুনলাম? সামান্য সম্পত্তির লোভে আমার নিজের মা এমন করতে পারে? আমার ছোট্ট মাথা এতো ভার নিতে পারছিলো না আর।
আমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম। কড়া গলায় বললাম,”কি প্রমাণ আছে এসবের? আমার মা কে যে তুই ফাঁসাচ্ছিস না তার কি নিশ্চয়তা?”
সজলের অবস্থাও তখন খারাপ, কড়া ঘুমের ওষুধে সে অজ্ঞানপ্রায়। কোনোমতে নিজের ফোনটা বের করে বেশ কিছু কলরেকর্ড আমাকে বের করে দিলো। প্রত্যেকটা কলরেকর্ডে আমার মায়ের কণ্ঠ চিনতে আমার একটুও দেরি হলো না। কি করবো এখন আমি? আমি চেয়েছিলাম আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় বোনের হত্যার শাস্তি দিবো আমি নিজে হাতে। অপরাধীকে আপার থেকেও কয়েকগুণ বেশি কষ্ট দিয়ে আমি মারবো নিজে হাতে। কিন্তু মা? নিজের মা কে কীভাবে শাস্তি দিবো আমি? আমি শুণ্যের দিকে তাকিয়ে বসে থাকলাম। আমার শরীরে কোনো শক্তি নেই উঠে দাঁড়ানোর।
আজকে কোর্টে শুনানির দিন ছিলো। সজলকে ফাঁসির সাজা শোনানো হয়েছে আর মা কে চৌদ্দ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। কোর্ট খালি হয়ে গেলো। অপরাধীদের নিয়ে যাওয়া হলো। যাওয়ার সময় আমি মায়ের দিকে তাকাতে পারলাম না। ভিতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার। অনেক কষ্টে ঠোঁট কামড়ে কান্না সংবরণ করার চেষ্টা করি আমি। কোনোভাবেই পারছি না। ভিতরের চাপাকান্না যেনো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। মা, কেনো করলে এমনটা? কেনো এতো লোভ করলে তুমি? আমরা কি ভালো থাকতে পারতাম না একসাথে? সবকিছু কেনো এমন ওলটপালট হয়ে গেলো? আমাদের ছবির মতো সাজানো জীবনটা কেনো এমন ধ্বংস হয়ে গেলো? কি নিয়ে বাঁচবো আমি এখন?
হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়লো আমার। মানুষটা এই কয়দিনেই ছোট বাচ্চাদের মতো হয়ে গেছে। জবুথবু হয়ে শুণ্যের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি একছুটে যেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। চিৎকার করে কাঁদতে থাকলাম। বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন আর আস্তে করে বললেন,”কাঁদে না মা, কাঁদে না। আমার বনলতা যে তার ছোট বোনের কান্না দেখে কষ্ট পাবে।”
আমি বাবার বুকের একপাশে সরে আসলাম, আমার মনে হচ্ছে আরেকপাশে বুঝি আপা এসে এক্ষুনি ঝাপিয়ে পড়বে, জায়গাটা খালি থাক আমার বিলু আপার জন্য।
(সমাপ্ত)