ডিভোর্স পেপার ৩য় ও শেষ পর্ব
যে চোখের সাগরে ছিলো ভালোবাসার ঢেউ
সে চোখে আজ প্রতিশোধের দাবানল
করছে দাউ দাউ।
এই মিলি তোকে ফোন দিয়ে
কান্নাকাটি করবে না রিয়াদ,
চোখের জলে ভাসিয়ে দেবে না আগমনী সময়,
তোর মতো লম্পটের জন্য গড়বে না আর
স্বপ্ন সজ্জা।
খালামণির বাসায় সেদিন আরও মেহমান আসে।
আমি ব্যালকনিতে বসে একা। শুধু খালামণিকেই বলেছি আর কাউকে বলতে পারি নি। কোথায় কার কাছে প্রকাশ করা যায়? কোথ্থাও না। কাউকে বলতে পারিনি রিয়াদের আগে বিয়ে ছিলো এবং বউ এখনো আছে শুধু আছে তা নয় সম্পর্কও স্বাভাবিক। এ কথা কাউকে বিশ্বাস করানোও কঠিন। স্বাভাবিক সম্পর্ক থাকলে আবার বিয়ে করতে পারে কিভাবে?
হয়তো রিলেশনে জড়িয়েছে এমনটাই সবাই ধারণা করতে পারে। এর বেশি কারো মাথায়ই আসতে পারে না। আমার পরিবারের বাইরে আজ ছোট খালামণি ই শুধু জানলো। তারও বিশ্বাসে দ্বিধা।
বলে- হয়তো ওই মেয়েকে বিয়ে করতে চায় এজন্য ডিভোর্স দিয়েছে।
একটা ডিভোর্স পেপার একজন মেয়েকে যে কতটা সামাজিক ভাবে হেয় করতে পারে তা অনেকেরই ভাববার বাইরে। এই সমাজ কিভাবে নেবে, কাকে কি বলে বোঝানো যাবে আসল ঘটনা টা?
হয়তো আস্তে আস্তে সত্য প্রকাশিত হবে কিন্তু ততদিনে বাবার মান সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। পুরো ইউনিয়নে বাবার সুনাম একজন সম্মানিত শিক্ষক আর সমাজকর্মী হিসেবে আমাদের সব ভাই- বোনদের সবাই খুব ভালো এবং মেধাবী হিসেবে জানে সেখানে এই ঘটনা হয়তো অনেকের মনেই নেতিবাচক ভাবে স্থান পাবে।
আমার আর ভালোই লাগছে না কোনো কিছু ভাবতে। ভীষণ রকম খারাপ লাগছে। মাথা ব্যথা করছে। রাত বেড়ে যাচ্ছে কিন্তু নিজেকে অস্থির অস্থির লাগছে। খালামণি বারবার খাওয়ার জন্য বলছে, ব্যালকনি তে এসে হাজারো স্বান্তনা দিচ্ছে। মা বারবার ফোন দিয়ে খবর নিচ্ছে, খালামণি কে খেয়াল রাখতে বলছে।
আমি আমার মনের অন্ধকারেই অন্ধকারাচ্ছন্ন। কোনো কিছুই স্পর্শ করছে না আমাকে, কোনো কথাই পৌঁছছে না আমার কর্ণকুহরে। আমি হেরে ছিলাম বার বার আমার ভালোবাসার কাছে। আমার দুর্বলতা সেখানেই ছিলো। সব মিথ্যে দূরের মরীচিকা।
আমার ভালোবাসার বিশ্বাস ভাঙা কষ্ট,
একটা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার কষ্ট,
প্রতারিত হওয়ার কষ্ট,
তুচ্ছ তাচ্ছিল্যে অপমানিত হওয়ার কষ্ট,
মন ভেঙে যাওয়ার কষ্ট,
বোকার মতো মানিয়ে নেয়া লজ্জার কষ্ট,
সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার কষ্ট,
আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছে যখন তুঙ্গে
তখন ডানা ভেঙে পড়ে যাওয়ার কষ্ট,
মানসিক ভাবে পিছিয়ে যাওয়ার কষ্ট,
ভুলতে না পারার কষ্ট,
নাটকীয়ভাবে ডিভোর্সি পরিচয় পাওয়ার কষ্ট,
প্রথম দুপুরে অপরাহ্ন আসার কষ্ট,
অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র
ফিরে না পাওয়ার কষ্ট।
সব একসঙ্গে জড়ো হয়ে আছে।
যে আমি এক সপ্তাহ ধরে আইনজীবীর সাথে আলোচনা করছিলাম এই প্রতারককে কিভাবে আইনি ভাবে শাস্তি দেয়া যায়, ছোট ভাই ওদের এলাকার চারটা কাজী অফিস তন্ন তন্ন করে খুঁজেছে ওদের বিয়ের ডকুমেন্টস কিন্তু পেলো না কোথাও। তবে কি ওকে আর কোনো শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না? ওর শাস্তি না হলে যে আমার শান্তি নেই। আমি যে এই অপমানের যন্ত্রণা মেনে নিতে পারবো না।
এতো কষ্ট বুকে চেপে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার প্রত্যয়। শপথ নিতে হবে যুদ্ধ করার এ পরিস্থিতির বিরুদ্ধে। আমি কষ্টের সাগরে হাবুডুবু খেলে ওকে তো জিতিয়েই দেয়া হবে। সব কষ্ট কে এক পলকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে নতুনভাবে শুরু করার প্রতিজ্ঞা আজই নিতে হবে।
ভাবতে ভাবতে কেটে গেলো পুরো রাত। ছোট খালামণি হলেন সে রাতের সঙ্গি আর সাহসদাতা।
পরের দিন সকালে বাবা ফোন দিয়ে বললো শহরের সেরা একজন আইনজীবী বাবার বন্ধু তার সাথে কথা হয়েছে ওর বিরুদ্ধে মামলা করা হবে। খুশির সংবাদ পেলাম। বাবা ওর কলেজে গেলেন এবং প্রিন্সিপালের সাথে কথা বললেন।
তিনি জানালেন- রিয়াদ সাহেবের নাকি নানী মারা গেছেন এজন্য ছুটি নিয়েছেন।
বাবার মুখ থেকে এ কাহিনী শুনে সবাই আশ্চর্যান্বিত। এটাও সম্ভব?
তারা বলেন- সেতো সবসময় আপনার মেয়ের প্রশংসা করতো। তার মধ্যে এতো দ্রুত ডিভোর্স দিয়ে দিলো? ওরে কঠিন শাস্তি দেয়া দরকার। এতো ধুরন্ধর লোক দেখে তো কল্পনাও করা সম্ভব না।
প্রিন্সিপাল আরও বললেন- কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হলে বলবেন নিশ্চয়ই করা হবে।
২১ তারিখ সন্ধ্যায় দেখি রিয়াদ একের পর এক ফোন দিয়ে যাচ্ছে আমার মোবাইলে। কিন্তু না আমি আর রিসিভ করছি না। আর কখনোই আমার সাথে কথা হতে পারে না। আমি কোনোদিন ই আর তোর সাথে কথা বলবো না।
মামলা হলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এবং বদমাইশ রিয়াদ গ্রেফতার হলো। ওর মামা সহ আত্মীয় স্বজনরা এবার ফোন দিয়ে যাচ্ছে আমাকে এবং বাবাকে।
ভুল হয়েছে ক্ষমা চাচ্ছে। ইসলাম সম্মত ভাবে ডিভোর্স দেয়নি এবং হয়নি। আসুন আমরা বসি এবং আলোচনা করি। অনেক চাপের মধ্যে ভুল করে ফেলেছে।
কিন্তু না ওদের সাথে আর বসাবসির প্রয়োজন নেই- বাবার মন্তব্য। যা হবার কোর্টে হোক।
গ্রেফতারের পরে ও চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয়। পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ওর বাজে চরিত্রের সংবাদ। সুমীর বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয় সে পত্রিকা। ওদের এলাকায় কয়েক’শ পত্রিকা ফ্রী বিতরণ করা হয় যেখানে মিছকা শয়তানের কুকীর্তি তুলে ধরা হয়।
কর্মস্থল, নিজ এলাকা, শশুরালয় সহ সামাজিক ভাবে ওকে যথেষ্ট শিক্ষা দেয়া হলেও আমার ভেতর থেকে আজও ঘৃণা কমেনি।
শত সহস্র ফোন, ক্ষমা চাওয়া ম্যাসেজ, গণ্যমাণ্য লোকের দ্বারা আবার সংসার করার রিকোয়েস্ট, প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দেয়ার ঘোষণা কোনো কিছুতেই আমাকে আর ওর প্রতি আগ্রহী করতে পারে নি।
তার ডিভোর্সের বয়ান ছিলো- আমাকে ডিভোর্স ইসলাম সম্মত ভাবে দেয়া হয় নি কারণ এটা একটা নাটক ছিলো যাতে সে ফ্রি হলো এবং এখন প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে দিতে পারবে সহজে। আমাকে নিয়ে সংসার করবে বলেই বিয়ে করেছিলো, বাসা নিয়ে থেকেছিলো। আমাকে নিয়েই তার পজিটিভ পরিকল্পনা ছিলো। বিষয়টা দ্রুত প্রকাশ হওয়ায় সে চাপে পড়ে যায়। তখন প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দেয়া কঠিন হতো তাই আমার সাথেই নাটকটা করতে হয়েছে। যা অনিচ্ছাকৃত ভুল ছিলো।
যখন আমার সময়গুলো বিষণ্ণতায় ঘেরা,
যখন আমার কাছের মানুষ বাঁকা চোখে তাকায়,
ব্যস্ততাহীন একলা সময়
একলা দুপুর একলা বিকেল
বর্ষা বিহীন বৃষ্টি ভেজা,
তখন যেনো এক ফালি রোদ
ঝলমলে আর কাঙ্ক্ষিত তা
একটি সুসংবাদ।
হ্যাঁ, বিসিএস নন ক্যাডারে আমি টিকে গেছি। আমি ভেঙে গেছি কিন্তু উঠে দাঁড়াতে পেরেছি। যদিও আমি ক্যাডারের ই উপযুক্ত ছিলাম তারপরও যারপরনাই আনন্দিত এই সংবাদে। বাবা এই নিউজ শুনে যেনো হিমালয় জয়ের আনন্দে ভেসেছে।
আল্লাহ যা করেন বান্দার ভালোর জন্যই করেন।
আমার পুরো পরিবারে যেনো ঈদের খুশি।
বাবা প্রায় দুই মণ মিষ্টি প্রতিবেশী, আত্মীয় স্বজন এবং তার বন্ধু বান্ধবদের বাড়ি বাড়ি পাঠিয়েছেন।
মনে পড়ে গেলো যখন লিখিত পরীক্ষা চলছিলো তখন রিয়াদ আমাকে পরীক্ষা কেন্দ্রে আনা নেয়া করতো। আমার মন খারাপ থাকতো কিন্তু রিয়াদ ই আবার উৎসাহ দিতো। খুব সকাল সকাল আমাকে জাগিয়ে দিতো। কতটুকু পড়া কমপ্লিট হয়েছে খোঁজ নিতো। পরীক্ষা শেষে বাইরে খেয়ে বাসায় ফিরতাম। ভাইভা চলাকালীন আমি মানসিক ভাবে অনেক টা বিপর্যস্ত। কিন্তু আল্লাহ সহায় ছিলেন। আমি সফল হলাম।
বিশ্বাসে চির ধরায় আর নতুন সম্পর্কে জড়ানোর কোনো ইচ্ছে হচ্ছে না। কোনো প্রস্তাব আমার আর ভালো লাগে না। প্রত্যেকটি পুরুষের মাঝেই আমি যেনো রিয়াদের প্রতারক মুখটাকে দেখতে পেতাম। রাজস্ব কর্মকর্তা হিসেবে পোস্টিং হওয়ায় ব্যস্ত সময় এখন আমার। সমস্ত কষ্ট উপলব্ধি মনের মধ্যে কবর দিয়ে ভালো কাটছে দিন। আমার অফিসের এক কলিগ আমাকে পছন্দ করে মুখে না প্রকাশ করলেও কাজে শতভাগ প্রমাণ পাই। কিন্তু আমার বিশ্বাস বাড়ির অন্ধকার আজও কাটেনি।
END
উম্মে কুলসুম লাইজু
বি:দ্র: পাঠকদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আগের পর্বে আপনাদের সপ্রতিভ মতামতে আমি প্রাণিত। সবমিলিয়ে আমার প্রথম গল্প টি কেমন হলো জানাবেন আশা করি। সবাইকে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।