‘নিরব ভাইয়া জানেন আমি আপনার ছোট ভাইয়ের সন্তানের মা হতে চলেছি।কিন্তু ও আমাকে এখন এক্সেপ্ট করছে না।বরং বলছে আমাকে নাকি কোনদিন দেখেই নি। সে নাকি আমাকে চিনে নাহ।’
কাঁদতে কাঁদতে ব্যাকুল হয়ে খুব করুণ কন্ঠে মৃথিলা কথাটা বললো।নিরব মনোযোগ দিয়ে একটা ইমপরটেন্ট কেসের ফাইল দেখছিলো।মৃথিলার কথাটা কানে যেতেই চোখ তুলে তাকালো নিরব। কথাটা শুনে এতটায় ধাক্কা খেয়েছে মুখ দিয়ে সাথে সাথে উচ্চারণ হয়ে গেলো—
‘হোয়াট।’
মৃথিলা এবার সন্দিহান ভাবে খুব শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
‘আপনি এস এই প্রলয় হাসান নিরব না।’
‘হুম,বাট তুমি কে?’ভাবান্তর কন্ঠে প্রশ্ন করলো নিরব।
কনস্টেবল আলিয়া বললো,
‘স্যার উনার নাম মৃথিলা।বাইরে চারঘন্টা অপেক্ষা করছিলো আপনার জন্য।সকাল আটটায় এসেছে এখন বেলা বারোটা বাজে।উনাকে অনেকবার বলেছি নিরব স্যার আজ অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা কেস নিয়ে বিজি আছেন,কোনোভাবেই দেখা করা যাবেনা কিন্তু মেয়েটি বলছে সে অপেক্ষা করবে।সেই সকাল থেকে অপেক্ষা করেই যাচ্ছে।বাইরে কড়া রোদে বসে ছিলো তাছাড়া মেয়েটির শরীর ও ভালো নয়।বাইরে অনেকবার বমি করেছে।স্যার রোদে ক্লান্ত হয়ে একবার সেন্সলেস ও হয়ে গেছিলো।তাই বাধ্য হয়ে এখন নিয়ে আসলাম।’
নিরব হাতে গোল মার্বেল নিয়ে টেবিলের উপর ঘুরাচ্ছে আর আলিয়ার কথা শুনছে।আলিয়ার কথা শেষ হলে মার্বেল টা খুব জোরে উপর থেকে টেবিলের উপর ফেললো।কাঁচের টেবিলে মার্বেল পড়ে ঝনঝন শব্দ করে নিচে গিয়ে পড়লো।নিরব হাত মুষ্টিবদ্ধ করে টেবিলে আঘাত করে বললো,
‘এই কথা আমাকে এখন বলছো।একজন অসুস্থ মানুষকে বাইরে রোদে চারঘন্টা ফেলে রেখে আমাকে এখন নিউজ দিতে এসছো।এতটা ননসেন্স কিভাবে হতে পারো তোমরা।আমি বাইরে না গেলে দেখতেই পেতাম না।’
‘স্যার আপনাকে বলতাম।’
‘কখন ও মা★রা গেলে।’
আলেয়া মাথা নিচু করে বললো,
‘স্যার আপনি তো নাবিলার গুরুত্বপূর্ণ কেস টা নিয়ে কাজ করছিলেন।আর বলছিলেন কেউ দেখা করতে আসলে নিষেধ করে দিতে।’
‘ওহ শীট!তুমি যাও এখন।আর খাবার নিয়ে এসো বাইরে থেকে আমাদের দুজনের জন্যই।সিফাত ভাই এর হোটেলে গিয়ে বলো আমি খাবার দিতে বলেছি।’
‘ঠিক আছে স্যার।’
আলেয়া খাবার আনতে চলে গেলো।কালো জিন্স আর কালো হাতা লম্বা গেঞ্জি গায়ে নিরবের।নাবিলার কেস নিয়ে মাথা ফেটে যাচ্ছে নিরবের।নাবিলার মতো স্ট্রং আর সাহসী একটা মেয়ে কিভাবে খু**ন হলো।এটা ডিপার্টমেন্ট এর জন্য খুবই লজ্জাজনক ব্যাপার যে নাবিলা খু**ন হয়েছে।আর নাবিলা নেই মানে পাচারকারী দলের মেইন লিডার কে আর খুজে পাওয়া যাবেনা।নাবিলা ই একমাত্র সাক্ষী ছিলো যে ওই দলের মেইন লিডার কে দেখেছিলো।ওহ গড এত চেষ্টা করেও মেইন ক্রিমিনাল এর কাছাকাছি যাওয়া গেলো না।ক্রিমিনাল নাবিলাকে কিভাবে খু**ন করলো।এত কড়া সিকিউরিটির মাঝে কিভাবে নাবিলার খু**ন হলো এটাই মাথায় আসছে না নিরবের।এক ভাবে ইনভেজটিগেশন করে যাচ্ছে নিরব।
নিরব এবার মৃথিলার দিকে তাকালো।চোখের নিচে কেমন শুকিয়ে এসছে মেয়েটির।পরনে একটা হাফসিল্কের শাড়ি।মাথার চুলে হাত খোপা করে রাখা।চোখ ভরা পানি মৃথিলার।মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়েই মনে হচ্ছে খুব শান্ত শিষ্ট স্বভাবের মেয়ে।মেয়েটির মুখের দিকে তাকালে অসম্ভব এক মায়া কাজ করছে নিরবের।নারী এত সুন্দর ও হয়।আর এত সুন্দর মেয়েটি কে কিনা তার ভাই ছেড়ে গেছে।যদিও নিরব কোনো মেয়ের দিকে সেভাবে তাকায় না কখনো।বয়স ত্রিশ বিয়ের বয়স ওভার হয়ে গিয়েছে এখনো বিয়ে করার কথা সে ভাবেই নি।নিরবের মন আর মস্তিষ্ক সব সময় কেসের দিকে থাকে।সব জটিল কেস গুলো নিরব চ্যালেঞ্জ হিসাবেই গ্রহন করে।বাড়ি থেকে এবার জোরপূর্বক তার বাবার বন্ধুর মেয়ে নবনিতার সাথে বিয়ে দিয়েই ছাড়বে এমন সিদ্ধান্ত নিরবের বাবা মায়ের।নিরব এবার বিয়েতে হ্যাঁ বলেছে।
মৃথিলার দিকে অনেক সময় তাকিয়ে আছে নিরব।মৃথিলা ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে একভাবে।মেয়েদের জীবনের এ সময় টা বোধহয় সব থেকে জটিল।নিরব মৃথিলাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে।বোঝার চেষ্টা করছে মেয়েটি সত্য না মিথ্যা বলছে।
নিরব একটু গলা ঝেড়ে প্রশ্ন করলো,
‘আমার ভাই নীলাভ কে তুমি কিভাবে চিনো?’
মৃথিলা এবার চোখ তুলে তাকালো নিরবের দিকে।শান্তভাবে উত্তর দিলো,
‘কলেজ থেকে।’
‘একসাথে পড়তে।’
‘না আমি মহিলা কলেজে আর আপনার ভাই বিএল কলেজে পড়তো।পথে যাতায়াত এর মাধ্যমে পরিচয়।’
‘কতদিনের রিলেশন। ‘
‘দুই বছর প্রায়।’
‘তুমি প্রেগন্যান্ট মানে বুঝলাম না।তোমাদের কি বিয়ে হয়েছিলো।’
‘আপনার ভাই আমাকে দিয়ে একটা মিথ্যা কাগজে সাইন করিয়ে নিয়ে বলেছিলো এটা আমাদের রেজিস্ট্রি পেপার।কিন্তু সেসব ফেইক ছিলো আমি জানতাম না।তারপর’
‘থাক আর বলতে হবেনা। বাকিটা বুঝতে পেরেছি।তোমার ফ্যামিলিতে কে কে আছেন।’
‘আমাকে জন্ম দিতেই মা মা*রা যান।বাবা আর আমার খোজ খবর নেন নি।শুনেছি বাবা আবার ও বিয়ে করেছেন।আমার সাথে যোগাযোগ নেই।আমি মামা মামির সংসারে থাকি।’
‘তোমার মামা -মামি এ ব্যাপারে কিছু জানেন।’
‘প্রায় পনেরোদিন ঘনঘন বমি হচ্ছে আর সব সময় শরীরের মাঝে অশান্তি লাগছে।আমাকে অসুস্থ দেখে মামা আর মামি আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান।সেখান থেকে ডাক্তার জানান যে আমি প্রেগন্যান্ট। আর মামি তখন ই আমাকে গালি গালাজ করে বের করে দেন।আমার যাওয়ার মতো আর কোনো জায়গা নেই। আমাকে সুই**সাইড করতে হবে এই ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।আমার তো আপন বলে এই দুনিয়াতে আর কেউ নেই।মামা আর মামি কখনোই আমাকে জায়গা দিবেন না
।আমি বাচ্চা নষ্ট করে ফেললেও তারা আর আমাকে জায়গা দিবেন না।তাই বাধ্য হয়েই আপনার কাছে এসছি।’
‘তুমি আমাকে কিভাবে চিনো?’
‘নীলাভ বলেছিলো তার ভাই একজন পুলিশের এস আই।অনেক অনেস্ট।সে যদি আমাকে কখনো ঠকায় আমি যেনো সোজাসাপ্টা আপনার কাছে এসে নালিস দিয়ে দেই।কাল সুইসাইড করতে যাচ্ছিলাম।তখন আমার বান্ধবী সুপ্তি আপনার শরনাপন্ন হতে বললো।আমি আসতে চাইনি ও জোর করেই নিয়ে এসছে আমাকে।’
‘সুপ্তি ও কি নীলাভ কে চিনে?’
‘হ্যাঁ চিনে।আমরা যখন এক সাথে ঘুরেছি তখন প্রায় দিনই সুপ্তি থাকতো আমাদের সাথে।’
‘ওকে তোমার সমস্ত বয়ান রেকর্ড করে রাখা হলো।এখনি নীলাভ আসছে ওয়েট শুনে দেখি।’
নিরব ফোন কানে দিয়ে বললো,
‘ভেতরে এসো।’
পরনে জিন্সের প্যান্ট,গায়ে সাদা গেঞ্জির উপর জিন্সের শার্ট পরা।শার্টের বোতাম সব গুলো খুলে রাখা।হাতে বেশ ঢিলেঢালা ব্রেসলেট।গলায় ব্লেড আকৃতির লকেট ঝোলানো।হাতে ঘডি,চুল বেশ বড় পেছনে রাবার দিয়ে বেঁধে রাখা।
নীলাভ ভেতরে প্রবেশ করে বললো,
‘ভাইয়া আমাকে এত জরুরী তলব করলে কিছু হয়েছে?’
নিরব মৃথিলার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘মেয়েটিকে চিনো?’
নীলাভ যেনো কোনদিন মৃথিলাকে দেখেই নি।তেমন ই একটা ভাব নিয়ে বললো,
‘নাতো ভাইয়া, উনি কে?’
নিরব উঠে দাঁড়িয়ে নীলাভ এর গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে বললো,
‘রাসকেল তুমি চিনো না তাইনা?এমনি এমনি চিনবে না সেটা আগেই জানতাম।মেয়েদের মন নিয়ে খেলা করতে খুব ভালো লাগে তাইনা?মেয়েরা কি খেলার বস্তু যে তাদের নিয়ে খেলতে হবে।তাকিয়ে দেখো মেয়েটির দিকে। মেয়েটির কি হাল করেছো তুমি।প্রেগন্যান্ট সে।’
‘কি করেছি আমি ভাইয়া।আর উনি বা কে?আমি সত্যি চিনি নাহ।’
‘মৃথিলা উঠে দাঁড়িয়ে বললো,আর কত নীলাভ।আর কত কষ্ট আমাকে তুমি দিবে বলতে পারো।তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম বলে কি আমাকে এইভাবে ঠকাবে।আমি মা হতে চলেছি তোমার সন্তানের।’
‘নীলাভ উত্তেজিত হয়ে বললো,ভাইয়া এই মেয়ে কে?আমাকে ফাঁসাতে চাইছে।আমি সত্যি এই মেয়েকে চিনি নাহ।প্লিজ ভাইয়া ট্রাস্ট মি!’
নিরব মৃথিলার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘তুমি নীলাভ কে ভালবাসো?’
‘হ্যাঁ ভালবাসি।’
‘আরে এই মেয়ে কে তুমি।আমাকে ভালবাসো মানে।কি সমস্যা আমার সাথে তোমার।আমার নামে মিথ্যা বলছো কেনো?কি প্রুভ আছে তোমার কাছে আমার সাথে তোমার রিলেশন ছিলো।’
মৃথিলা ফোন বের করে নীলাভ আর মৃথিলার অনেক গুলো ছবি বের করে বললো,
‘এইযে প্রুভ।তাছাড়া আমি কি জানতাম তুমি আমার সাথে এমন করবে।জানলে সব প্রুভ রেখে দিতাম।’
‘কসম ভাইয়া, আম এই মেয়েকে চিনিনাহ।কে এই মেয়ে আমার নামে মিথ্যা বলছে।’
‘তোমাকে চিনতে হবে না, পরশু তোমার বিয়ে মৃথিলার সাথে।আমি বাবাকে অলরেডি মেইল করে সব জানিয়ে দিয়েছি।’
নীলাভ প্রচন্ড রাগে উঠে গিয়ে মৃথিলার গলা চেপে ধরে বললো,
‘তোকে আমি মে*রে*ই ফেলবো।ছলনাময়ী মেয়ে।আমার বাবার টাকা দেখে আমাকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করতে চাস না তুই।তোকে আমি জীবনেও বিয়ে করবো।কত টাকা লাগবে তোর বল এক্ষুনি দিয়ে দিচ্ছি।’
নিরব নীলাভ এর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নীলাভ কে আবার ও থাপ্পড় মারলো।মৃথিলা সেন্সলেস হয়ে মাটিতে পড়ে গেলো।নিরব মৃথিলা কে কোলে তুলে নিয়ে বেঞ্চের উপর সুইয়ে দিয়ে আলিয়া কে ডাকলো।এমন সময় রিফাত ও এসে হাজির।রিফাত ও পুলিশে চাকরি করে।আলেয়া মৃথিলার মাথায় পানি ঢালছে।নিরব মৃথিলার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মৃথিলাকে ডাকছে।রিফাত এসে ব্যাপার টা কিছুই না বুঝে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।নীলাভ টেনশনে মাথায় হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে।সারাদিন বাইক নিয়ে টো টো করে বেড়ানো ছেলে জীবনে প্রথমবার এমন পরিস্হিতে।
ভাইব্রেশনে নিরবের ফোন বেজে উঠলো।নিরব ফোন কানে দিতেই ওপাস থেকে গম্ভীর কন্ঠে একটা মেয়ে বলে উঠলো,
‘এস আই নিরব।নাবিলার কেস টা নিয়ে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে।কিন্তু নাবিলার মা বাবার কেস টা নিয়ে কোনোই চিন্তা নেই, কিন্তু কেনো?তারাও তো খু**ন হয়েছে।লা**শ গুম করলেই কি সব সত্য চাপা থাকে।কি ভাবছিলেন কেউ জানেনা কিছু।হাহাহহহা সব জানি আমি, আপনার সব সত্য আমি জানি।বাইরে দায়িত্বশীল অফিসার, আর ভেতরে ভেতরে। ‘
চলবে
গল্পঃ প্রণয়ের আসক্তি পর্ব ১
writer_Mousumi_Akter