#প্রণয়ের আসক্তি
পর্ব ১৮
#writer_Mousumi_Akter
নিরার ফোনের স্ক্রিনে ভেষে উঠেছে নিরবের নাম্বার।দাদা ভাই দিয়ে সেভ করা নাম্বার।হোয়াটস এপ্স এ কল এসছে।নিরবের ফোন দেখেই নিরা সোয়া থেকে উঠে বসে গায়ে ওড়না ঠিক করে নিয়ে মৃথিলার দিকে ফোন টা ধরে চোখ দিয়ে ইশারা করে দেখালো আর বললো,
‘ভাবি দেখো দাদা ভাই এর ফোন।’
মৃথিলার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো নিরবের নামটা দেখে।নিরবের নাম টায় মৃথিলার কাছে ভাল লাগার কারণ। মৃথিলা ও বিছানা থেকে উঠে বসে নিরার পেছনে গিয়ে বসে নিরার ঘাড়ের উপর থুতনি রাখলো।মৃথিলা লজ্জা পাচ্ছে বেশ।
নিরা বললো,
‘ভাবি সামনে এসো।দাদাভাই তোমাকে দেখবে বলে ভিডিও কল দিয়েছে।’
‘তোমাকে কে বললো?’
‘আমি বুঝি ওসব।আমার দাদাভাই এই মধ্যরাতে কেনো কল দিয়েছে।তুমি সামনে এসো তো ভাবিজান।’
‘না আমার লজ্জা লাগছে তুমি কথা বলো।’
নিরা ফোন রিসিভ করে দেখলো নিরব তার হাসি মাখা মুখ টা বের করে রেখেছে।ঠোঁট নড়ছে কিছু একটা চিবোচ্ছে।নিরব ফোনের ব্যাক ক্যামেরা ধরলো।ঝলমল করছে কৃত্তিম আলোতে চারদিক।সামনেই গামলা ভরা মাছ,মাংস রান্না করা।মৃথিলা উঁকি মেরে দেখছে।নিরা আর মৃথিলার বুঝতে বাকি নেই একটা রেস্টুরেন্টে বসে খাবার খাচ্ছে নিরব।
নিরব খেতে খেতে বললো,
‘কি বুড়ি ঘুমোও নি।’
‘না দাদাভাই গুমোয় নি আজ।’
‘কি করছো এতরাতে।’
‘এইতো ভাবি আর আমি গল্প করছিলাম।’
‘রাতে খেয়েছো।’
‘হ্যাঁ।’
‘বাড়ির সবাই খেয়েছে তো।’
‘তুমি কি বাড়ির সবাই বলতে ভাবির কথা জানতে চাইছো।’
‘কোথায় তোমার ভাবি।ওষুধ খেয়েছে?’
‘তুমি নিজেই জিজ্ঞেস করোনা।’
নিরা বিছানা থেকে ঘুরে বসে মৃথিলার দিকে ফোন ধরলো।মৃথিলা লজ্জায় মুখে শাড়ির আঁচল চেপে ধরে রাখলো।মৃথিলার ভীষণ লজ্জা লাগছে।নিরব সামনের ক্যামেরা দিয়েছে আবার।নিরা আর মৃথিলার মিষ্টি সম্পর্ক দেখে নিরবের খুব ভালো লাগলো। নিরা টানাটানি করে শাড়ির আঁচল টা সরালো।লজ্জায় যেনো মৃথিলা মিহিয়ে যাচ্ছে।চোখ মুখ জুড়েই লজ্জাভরপুর।নিরব নয়ন ভরে দেখছে মৃথিলাকে।নিরবের যেনো কোনো হুঁশ নেই।মৃথিলা তার সামনে আসলে পৃথিবীর কোনো হুঁশ ই তার থাকে না।নিরবের মানসিক তৃপ্তির কারণ মৃথিলা।
সাইড থেকে রিফাত বলছে,
‘ভাবি সামনে আসলে তো আসামি সব পালাবে।একটাও ধরতে পারবিনা।কেননা ভাবিকে দেখলে রাত দিনের হুঁশ থাকে না তোর।’
নিরব মৃদু হাসছে রিফাতের কথা শুনে।
সাইড থেকে একটা ছেলে বলে উঠলো,
‘দেখ ওই কালো গেঞ্জি পরা ভাই একটা মেয়ের সাথে ফোনে কথা বলছে।মেয়েটা কি সুন্দর দেখতে।মেয়েটারে যদি পাইতাম না।’
নিরবের র*ক্ত সাথে সাথে গরম হয়ে গেলো।মুহুর্তের মাঝে নিরবের ঘাড়ের শিরা ফুলে উঠলো।নিরব ফোন না কেটেই উঠে গেলো।এটো হাতেই ছেলেটার কলার চেপে ধরলো।ভয়ানক রাগী চোখে নিরব গর্জে উঠে বললো,
,’এই কু*ত্তা*র বাচ্চা কি বললি।ও আমার বউ হয়।আমার বউকে নিয়ে একটা বাজে কথা বললে জান্ত লা**শ বানিয়ে টুকরো করে ভাগ করবো চিনিস আমায়।যাকে আমি ভালবাসি তার ব্যাপারে স্বার্থপর আমি।সবার জা**ন কেড়ে নিতে একবার ও ভাববো না।’
শুধু মার এর শব্দ হচ্ছে। আর কোনো কিছুর শব্দ হচ্ছেনা।রিফাত নিরব কে আটকানোর চেষ্টা করছে।নিরব আরো কয়েক টা গালি দিয়ে ছেলেটাকে মেরেই যাচ্ছে।ছেলেটা ভয়ে মাফ চাচ্ছে শুধু।
নিরা মৃথিলাকে বললো,
‘আচ্ছা ভাবি দাদাভাই হঠাত সাইকোদের মতো ব্যবহার করছে কেনো?ভালবাসলে কি মানুষ সাইকো হয়ে যায়।এমন একটা প্রেমিক যেনো আমার ও হয়।সাইকো লাভার রা দারুন ভালবাসতে জানে তাইনা ভাবি।’
‘মেয়েদের অসম্মান তোমার দাদাভাই দেখতে পারেনা তাইনা নিরা।’
‘ হ্যাঁ ভাবি।দাদাভাই মেয়েদের খুব সম্মান করে।’
মৃথিলা সারারাত এপাস ওপাস করলো।তার ঘুম আসছে না।নিরবের বলা কথা গুলো শুধু কানে বাজছে তার।বুকের মাঝের ব্যাথাটা যেনো অজানা।নীলাভ না এসে তার জীবনের শুরুতে হয়তো নিরব আসলে ভালো হতো।নিরব এমন একজন কেয়ারিং মানুষ যাকে ভালবাসতে বাধ্য হবে যেকোনো নারী। মৃথিলার সর্বনাশ বোধহয় আজ ই হয়ে গেলো।নিরব এর কথা বার বার মনে পড়ছে।প্রণয়ের ঝড় উঠেছে মৃথিলার মনে।তীব্র অস্হিরতা কাজ করছে।মনের খুব গভীরে নিরবের ছবি আঁকা হয়ে গেলো।বিগত সাতদিন নিরব যেভাবে তার পাশে থেকেছে যেভাবে তার যত্ন করেছে যে কোনো মেয়েই তাকে ভালবাসতে বাধ্য হবে।তাছাড়া মন বড় বেপরওয়া।কারো কথা ই শোনেনা।মন মৃথিলার বিরুদ্ধে গিয়ে নিরব কে ভাবছে।মৃথিলা নিজের মনের কন্ট্রোল করতে পারছে না।
পরেরদিন সকালে খামারের সাইডে কেউ টিকতে পারছে না।গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে বাড়ির দিকেও কিছুটা চলে এসেছে।ছোট খাটো কিছু ম*র*লে এমন গন্ধ হবার কথা নয়।ইরিনা হাসান নাকে কাপড় দিয়ে বসে আছেন। ইসহাক হাসান খামারে যারা কাজ করে তাদের সাথে ভীষণ রাগারাগি করছে। চারদিক ভালোভাবে খুজে দেখতে বলছে।আরিফা আর রাহিলা দুজন রান্নার জোগাড় করছে।ইসহাক হাসান আরিফা আর রাহিলাকে রান্না ঘর থেকে ডেকে এনে বাড়ির সবাইকে নিয়ে খুজতে গেলো কোথায় কি পঁচেছে দেখার জন্য।সবাই নাকে কাপড় বেঁধে খুজে চলেছে খামারের চারপাশ।কিন্তু খামারের আশেপাশে কিছুই নেই।গন্ধটা ঘেরের পাড় থেকে আসছে।কেউ আইডিয়া ও করতে পারছেনা কি অজানা ঝড় তাদের জন্য অপেক্ষা করছে।এখনো সবাই হাসি খুশি মনেই এক সাথে খুজে চলেছে সেই জিনিস যার জন্য চারদিক দূ্ষিত হয়েছে।কোনো একটা আশংকা পাচ্ছে ইসহাক হাসান।আরিফ খুব জোরে হাসছে।ইসহাক হাসান ধমক দিয়ে বললো,
‘এত হাসাহাসি কিসের জন্য।’
গম্ভীর ভাব ইসহাক হাসানের চোখে মুখে।দুঃচিন্তা করছে খুব।ইসহাক হাসানের বাড়িটা অনেক এরিয়া নিয়ে।বাড়ির বিল্ডিং থেকে খানিক ট দূরে খামার।মানে বাড়ির শেষ সীমানায়।খামার থেকে উত্তরে বড় মাছের ঘের করা। ঘেরের পাড় দিয়ে আমগাছ লাগানো সারি সারি।ঘেরের সাইড দিয়ে লতাপাতার জঙ্গল আছে।ঘেরের দিকে সবাই যতই এগোচ্ছে গন্ধটা যেনো ততই বেশী স্পষ্ট হচ্ছে।কেউ আন্দাজ করতে পারছে না কিসের গন্ধ আসছে।নিরা বলেই ফেললো,
‘বাবা মনে হচ্ছে মানুষ মরা গন্ধ।এখানে কেউ মরে পঁচে যায় নিতো।’
ইসহাক হাসান পৃথিবীর সবার সাথে রাগারাগি করলেও এই একটা জায়গা সে খুব দূর্বল।সে হলো নিরা।নিরার এমন কথায় ইসহাক হাসান নিরার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘এসব বলতে নেই মা।তুমি মৃথিলাকে নিয়ে আমাদের আমবাগান ঘুরে দেখাও।’
নিরা আর মৃথিলা খামার আর ঘের ঘুরে দেখছে।নিরা মৃথিলাকে সব ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছে।দুজনে বেশ হাসি খুশি ভাবে ঘেরের পাড় দিয়ে বেড়াচ্ছে।
নিরা বললো,
‘ভাবি জানো আমাদের এইযে সুন্দর বাড়ি এখানে দাদাভাই থাকে না।’
‘কেনো?’
‘তাতো জানিনা।মাঝে মধ্য আসে।দাদা ভাই আসলে করে টা কি বুঝিনা।’
‘মনে হয় চু*রি করে বেড়ায়।’
নিরা আর মৃথিলা দুজনেই বেশ জোরে জোরে হাসছে।ঘেরের পশ্চিম পাশের লতাপাতার জঙ্গলের থেকেই এই গন্ধ ভেষে আসছে।ইসহাক হাসান, ইরিনা হাসান খানিক টা দূরে দাঁড়িয়ে আছে নাকে কাপড় দিয়ে আর বারবার থুথু ফেলছে।রমিজ,রফিক,আবদুল্লাহ লতা পাতা পরিষ্কার করছে।খানিক্টা পরিষ্কার করে একটা ছালার বস্তা দেখা গেলো।আবদুল্লাহ বস্তা দেখেই জোরে চিৎকার দিলো।ইসহাক হাসান বললো,
‘গাঁধা ভূ**ত দেখছিস নাকি এর চিল্লাস কেনো?’
‘স্যার এখানে বস্তায় যেনো কি।’
‘যায় হোক খুলে বের কর।এভাবে চিল্লাছিস কেনো?ষাড়ের সাথে থাকতে থাকতে তোরা ও ষাড় হয়ে গিয়েছিস।’
‘স্যার এ বস্তা খুলতে পারবোনা।বিশ্রি গন্ধ এই বস্তা থেকেই আসছে।’
‘বের না করলে গন্ধতে কি টিকতে পারবি।পেটের অসুখে ম*র*বি।নাকে কাপড় দিয়ে খুলে দেখ।’
গন্ধের মাত্রা এখন আরো কয়েকগুন বেড়ে গিয়েছে।রমিজ,আব্দুল্লাহ নাক মুখ বন্ধ করে কোনো ভাবে বস্তার মুখ খুলে ভ*য়ে চিৎকার দিলো।ভয়ংকর ছিলো সে চিৎকার।তারা সবাই ভয় পেয়েছে।সবাই দ্রুত ওখান থেকে খানিক দূরে ছিটকে এসে দাঁড়ালো।হাঁপাতে হাঁপাতে ইসহাক হাসানের সামনে এসে জড়ানো কন্ঠে বললো,
‘স্যার ওখানে লা*শ।’
ইসহাক হাসানের মুখের অদল সাথে সাথে পরিবর্তন হয়ে গেলো।লা**শ তার এই শান্তির নীড়ে লা**শ কিভাবে আসবে।অবাক হয়ে ইসহাক হাসান বললো,
‘লা*শ মানে? ‘
‘হ্যাঁ স্যার।অই বস্তায় মানুষের হাত পা।’
ইসহাক নিজে দ্রুতগতিবেগে এগিয়ে গেলো।দুঃচিন্তায় তার হাত পা কাঁপছে।ইরিনা হাসান সহ বাকিরা আস্তেধীরে ইসহাক হাসানের পিছ পিছ গেলো।ইসহাক হাসান বস্তার মুখ খুলে চমকে গেলেন।কা*টা হাত পা দেখা যাচ্ছে শুধু।কারো দে*হ কয়েক খন্ডে খন্ডিত করে বস্তায় ভরে রাখা হয়েছে।ইসহাক হাসানের টেনশন আরো বেড়ে গেলো।কপালে ঘাম জমেছে।নিরা আর মৃথিলা সবাইকে একজায়গা হতে দেখে তারাও সেখানে গেলো।ইসহাক হাসান বস্তা খুলতে গেলে ইরিনা হাসান বললো,
‘তুমি হাত দিও না।নিরব কে খবর দাও।পুলিশ এসে দেখুক।না হলে আমাদের আবার বিপদ হতে পারে।কেউ প্লান করে এখানে কাউকে মে*রে ফেলে যায়নিতো।’
স্ত্রীর কথা সঠিক মনে হলো।ইসহাক হাসান নিরব কে খবর দিলো।নিরব আর রিফাত সাথে চারজন পুলিশ নিয়ে আধাঘন্টার মাঝে উপস্হিত হলো।নিরব এর চোখে মুখে দুঃচিন্তা।সে একজন এস আই তার বাড়িতেই কারো লা*শ পাওয়া অত্যান্ত দুঃখজনক ব্যাপার।সবাই খানিক টা দূরে দাঁড়িয়ে আছে।চারজন কনস্টেবল বস্তা টেনে পরিষ্কার জায়গা নিয়ে এলো।বস্তা থেকে পুরো লা*শ টা বের করলো।
হাত পা কু*চি কু*চি করে কা**টা মাথা টা আলাদা করে রাখা।এমন ভয়ংকর ভাবে কেউ কাউকে মারতে পারে।আঙুল গুলো ও কুচি কুচি করে রাখা।প্রত্যোকে শিউরে উঠলো এমন ভয়াবহ ডেড বডি দেখে।।হাত পা সব বের করার পর মাথাটা বের করলো।মাথাটা দেখেই সবার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো।বিদ্যুৎ কম্পনের মতো কেঁপে উঠলো সবার শরীর।সবার শরীর আর মস্তিষ্কে বড় একটা ধাক্কা খেলো।মানুষ যা কখনো কল্পনা করেনা তাই বাস্তবে ঘটে গেলে কেউ মেনে নিতে পারেনা।নিরব ইসহাক হাসান ইরিনা হাসানের নাকে এখন যেনো কোনোই গন্ধ যাচ্ছে না।তারা সবাই অনুভূতি হীন।
নীলাভ এর এমন ভয়ংকর মৃ*ত্যু ইসহাক হাসান আর ইরিনা হাসান মেনে নিতে পারছে না।নিরা ভাইয়া বলে চিৎকার দিলো।নিরব ইরিনা হাসান ইসহাক হাসান ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো।ইসহাক হাসান আর ইরিনা হাসানের বুকে অসহ্য ব্যাথা শুরু হলো।এক চিৎকার দিয়ে ইরিনা হাসান বাকশক্তি হারালো।ইসহাক ছেলের টুকরো টুকরো অংশ হাতে ধরে ধরে দু’চোখের পানি ছেড়ে নীলাভ এর নাম ধরে ধরে ডাকছে আর কাঁদছে।নিরব এর চোখ দিয়ে অঝরে পানি পড়ছে।তার জীবনের সে অনেক লা*শ দেখেছে কিন্তু কখনো ভাবতে পারেনি এমন ভয়ংকর ভাবে নিজের ভাইকে দেখবে।খুব আশ্চর্যজনক বিষয় এটা যে নিরব এর আগেও বস্তয় ভর্তি এমন অনেক লা*শ পেয়েছে
তাদের সবার মৃ*ত্যু ই এমন ভয়ানক ভাবে দেওয়া হয়েছিলো।নিরা, ইরিনা হাসান,ইসহাক হাসান কাঁদতে কাঁদতে বেসামাল হয়ে পড়লো।ছেলের অকাল মৃ*ত্যু কোনো মা-বাবা সহজ ভাবে নিতে পারে না।অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে তারা।নিরব কপালে শক্তভাবে হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে নিজেকে শক্র করার চেষ্টা করছে।তাকে ভেঙে পড়লে হবেনা।তার পরিবার কে বাঁচাতে তাকে শক্ত হতেই হবে।আরিফা, রাহিলা,কুতুবের মা সবাই ইরিনা হাসান আর নিরা কে সামলাচ্ছে।সবার চোখ ই অশ্রুসিক্ত। রিফাত ইসহাক হাসান কে ধরে রেখেছে।রিফাত নিরবের দিকে তাকিয়ে জোরে বললো,
‘মৃথিলাকে ধর নিরব।’
নিরব মৃথিলার দিকে তাকিয়ে দেখে সে পড়ে যাচ্ছে অচেতন হয়ে।নিরব ছুটে গিয়ে মৃথিলাকে ধরলো।নিরবের হাতের উপর অচেতন হয়ে পড়লো মৃথিলা।নিরব মৃথিলার মুখে হাত দিয়ে ডাকছে কিন্তু মৃথিলার কোনো হুঁশ নেই।নিরব গালে হাত দিয়ে দেখলো মৃথিলার দাঁত লেগে গিয়েছে।নিরব ডাকাডাকি করেও কোনোভাবে মৃথিলার জ্ঞান ফেরাতে পারলো না।খুব বড় সড় রকমের ধাক্কা খেয়েছে মৃথিলা।ইরিনা হাসান মৃথিলার দিকে তাকিয়ে এবার আরো বেশী জোরে কেঁদে বললো,
‘নিরব মেয়েটাকে এখান থেকে নিয়ে যা বাবা।এখানে থাকলে এসব দেখে সহ্য করতে পারবে না।মেয়েটা ম*রে যাবে।আমার নীলাভ এর শেষ চিহ্ন ওর গর্ভে।মেয়েটাকে নিয়ে যা। ‘
নিরব মৃথিলাকে পাজা কোলে তুললো কিন্তু নিতে পারছে না।মৃথিলা তার সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে দিয়েছে।নিরব মৃথিলার মাথা তার কাধের উপর দিয়ে দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে আসলো।আসার সময় আরিফাকেও ডেকে নিয়ে আসলো।নিরব মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললো,
‘তোমাকে সুস্থ হতে হবে মৃথিলা।আমাদের এই পরিবারের জন্য তোমাকে সুস্থ হতেই হবে।প্লিন চোখ খোলো মৃথিলা।আমার খুব ভ*য় করছে তুমি কেনো চোখ বন্ধ করে রেখেছো।’
মৃথিলা কোনোভাবেই উঠছে না।কোনো রেসপন্স নেই মৃথিলার।আরিফা পানি নিয়ে এলো।মৃথিলার মাথায় ক্রমাগত পানি ঢেলেই যাচ্ছে। কিন্তু কোনো ভাবেই মৃথিলার কোনো হুঁশ আসছে না।রিফাত সুপ্তুকে ফোন করে জানিয়েছে মৃথিলা অসুস্থ। সুপ্তি ছুটতে ছুটতে এসেছে মৃথিলার কাছে।নিচতলার একটা রুমে মৃথিলাকে অচেতন হয়ে পড়ে থাকতে দেখে সুপ্তি ঘাবড়ে যায়।তাছাড়া নীলাভ এর সাথে ঘটে যাওয়া এমন ঘটনায় সুপ্তি মর্মাহত।সুপ্তি মৃথিলার হাত ধরে মৃথিলার পাশে বসে আছে।দু-চোখ বেয়স পানি গড়িয়ে যাচ্ছে সুপ্তির।সে মৃথিলাকে এভাবে দেখে সহ্য করতে পারছেনা।নিরব এর মামাবাড়ি থেকে ও লোকজন চলে এসছে।মীজান মুন্সি,নবনিতা ও এসছে।চারদিকে যেখানে যত আত্মীয় আছে তারা সবাই এসছে কেউ বাদ নেই।এমন পঁচা লাশ আর বেশীক্ষণ রাখা যাবে না। এমনিতেই দূর্গন্ধ ছড়িয়েছে চারদিক।বাড়িতে মানুষ ভরে গিয়েছে।এক্ষণি জানাজা হবে।নিরব জানাজায় শরিক হবে।সুপ্তি আর আরিফাকে বললো,
‘মৃথিলার খেয়াল রাখতে সে এক্ষুনি আসছে।’
বাড়ির ভেতরেই প্রচুর জায়গা ইসহাক হাসানের।বাড়ির পেছনে জানাজা হচ্ছে নীলাভ এর।জানাজায় উপস্হিত হয়ে বুকে ব্যাথায় সুয়ে পড়লেন ইসহাক হাসান।সে কিছুতেই নিজের ছেলের জানাজা পড়তে পারছে না।ইরিনা হাসান পা*গ*লে*র মতো বকবক করে যাচ্ছে।সে কোনভাবেই তার ছেলের এমন মৃ*ত্যু মেনে নিতে পারছেনা।জানাজা শেষে দাফন এর জন্য ঘেরের উত্তর পাশে নিজেদের কবরস্হানে নিয়ে গেলো।ইসহাক হাসান বললো,
আমার প্রাণের থেকে প্রিয় ভাই এর মৃ*ত্যু*তে আমি কেঁদেছিলাম আর আজ কাঁদছি।আমার ভাই এর পাশেই আমার ছেলের কবর হোক।ইসহাক হাসানের ভাই এরশাদ হাসানের কবরের পাশেই নীলাভের কবর দেওয়া হলো।
নিরব এর চোখ অশ্রুসিক্ত কষ্ট প্রকাশ করতে পারছে না।মৃথিলার এখনো জ্ঞান ফেরে নি প্রায় চারঘন্টা হয়ে গিয়েছে।সুপ্তি কেঁদেই যাচ্ছে।বাড়ির সবাই আর আত্মীয় স্বজন সব মৃথিলাকে ঘিরে রয়েছে।সবাই বলছে পুতুলের মতো সুন্দর মেয়েটার পেটে নীলাভ এর বাচ্চা।পৃথিবীতে আসার আগেই বাবাকে হারালো।
দিন গড়িয়ে বিকাল বাইরের মানুষ সব চলে গিয়েছে নিজেদের কিছু আত্মীয় ছাড়া।মৃথিলার জ্ঞান ফিরেছে কিন্তু কারো সাথে কোনো কথা বলছে না।মৃথিলা কি ভাবছে তা কেউ বুঝতে পারছে না।তবে সবাই অনুমান করতে পারছে মৃথিলা অস্বাভাবিক হয়ে পড়েছে।ইরিনা হাসান ছেলে হারানো শোক সহ্য করতে না পেরে ওয়ালে মাথা দিয়ে ঘন ঘন আঘাত করছে।কপাল ফেটে র*ক্ত গড়িয়ে পড়লো ইরিনা হাসানের।নিরব দ্রুত গিয়ে মা’কে ধরে বললো,
‘মা এখন কি তুমি নিজেকে শে*ষ করে ফেলবা।আমাদের তুমি ছাড়া কে আছে মা।প্লিজ শান্ত হও।’
‘তুই কেমন পুলিশ নিরব।তোর নাকি অনেক ক্ষমতা।তোর বাড়ি থেকে তোর ভাই কে এমন ভয়ংকর ভাবে মে*রে ফেলে রেখে চলে গেলো আর তুই বুঝতেও পারলিনা।’
‘মা আমি নীলাভ এর খু*নী*কে খুজে বের করবোই।আমার ভাই এর খু*নী*কে আমি আমার ভাই এর মতোই টুকরো করবো।আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি মা।’
‘আমাকে কথা দে আমার নীলাভ এর খু*নী কে খুজে বের করবি।তাকে শাস্তি দিবি।’
‘আমি তোমাকে ছুঁয়ে কথা দিলাম মা।আমি তাকে শাস্তি দিবো।তার শাস্তি দেখার জন্য হলেও তোমাকে বাঁচতে হবে।’
দিন গড়িয়ে রাত হলো।
রাত বারোটা বাজে মৃথিলা সুয়ে আছে।নিরব বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টেনেই যাচ্ছে।আজ কত গুলো সিগারেট খেয়েছে নিরব তার হিসাব নেই।এরই মাঝে মৃথিলা কেশে উঠলো।নিরব সিগারেট ফেলে মৃথিলার কাছে এলো।মৃথিলা করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিরবের দিকে।
নিরব চিন্তায় কপালে হাত ঠেকিয়ে বললো,
‘তোমাকে স্বান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা আমার জানা নেই।আমি কি বলবো তোমাকে জানিনা।তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাইনা?’
মৃথিলা দু’চোখ দিয়ে পানি ছেড়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
‘আমার নিজের জন্য কষ্ট হচ্ছে না একটুও।আমার আপনার জন্য কষ্ট হচ্ছে। ‘
‘নীলাভ এর জন্য কষ্ট পাচ্ছো আমি জানি।’
‘আমি আপনার জন্য কষ্ট পাচ্ছি।আমার কষ্ট আপনার জন্য হচ্ছে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।আপনার চোখের পানি দেখে আমি সহ্য করতে পারছি না।’
নিরব মৃথিলার চোখে তার জন্য পানি দেখলো।তার জন্য কষ্ট দেখলো মায়া দেখলো।
ভালবাসা সত্যি খুব অদ্ভুত তাইনা?যাকে পাওয়ার জন্য জীবনের রিস্ক নিয়ে এসেছিলো।যার জন্য রাতের পর রাত ঘুম হয়নি যার জন্য বউ সেজে থেকেও বিয়ে হলোনা।আজ তার মৃ*ত্যু সংবাদেও মৃথিলার মাঝে কোনো হেলদোল নেই।আজ সে নিরব কে ভালবাসে তাই নীলাভ এর কোনো কিছুই তাকে কষ্ট দিতে পারছে না।কোনো অনুভূতি ই আর মৃথিলার হচ্ছে না।আজ মৃথিলার সব অনুভূতি জুড়েই নিরব।
একবার মন থেকে কেউ উঠে গেলে সে ম*রে গেলেও কিছুই যায় আসে না।এটাই হয়তো বাস্তব সত্য।মন থেকে উঠে যাওয়া মানুষ কখনো আর মনে জায়গা পায় না।
চলবে?..