#প্রণয়ের আসক্তি
পর্ব ৩৫
#writer_Mousumi_Akter
সেদিন ছিলো শ্রাবণ মাস।মৃথিলা মাত্রই ক্লাস ওয়ান এ পড়ে নাবিলা ফোর এ পড়ে।শ্রাবণের ধারায় একটা কচু পাতা মাথায় দিয়ে মৃথিলা স্কুল থেকে ফিরছিলো।রাস্তায় তার বাবা ইমরাণ হাসান রিক্সা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো একটা হোটেলের সামনে।মৃথিলাকে দেখেই রিক্সায় তুলে হোটেল থেকে একটা সিঙ্গারা আর পুরি কিনে দিল।মৃথিলা সিঙ্গারা আর পুরি পেয়ে ভীষণ খুশী হয়ে খেতে শুরু করল।হোটেলের ওয়েটার বলল, ‘চাচা নিজে গরুর গোশত আর ইলিশের ডিম দিয়ে ভাত খাইলেন আর মেয়েটারে একটা সিঙ্গারা দিলেন।মৃথিলা তোমার বাবাকে বলো তুমিও খাবে তাহলে আমাদের ও কিছু লাভ হবে।’
ইমরাণ হাসান রিক্সা চালিয়ে দিলেন আর মৃথিলাকে বললেন, ‘আদুরি মা তোমাকে ক্ষেপাচ্ছে, তোমার বাবা কি তোমাকে রেখে মাছ মাংস খেতে পারে।’
‘আমি জানি বাবা তুমি আমাকে রেখে কিছুই খাও না।’
‘তোমার কি মাংস খেতে মন চাচ্ছে মা।’
‘না,বাবা।’
‘দাঁড়াও মা,চেয়্যারম্যান এর বাড়িতে ইলেকশন এর আগে মানুষ কে খাওয়াবে,আমরা পেট পুরে খাবো সবাই।’
‘আচ্ছা বাবা!’
‘তুমি বড় হয়ে চাকরি করবে, তোমার আপু চাকরি করবে আমি আর রিক্সা চালাব না।আমরা রেগুলার মাংস খাবো বুঝেছো মা।’
‘ বাবা আমি স্কুলের ম্যাডাম দের মতো ম্যাডাম হবো বড় হয়ে।ভাল হবেনা বাবা।’
‘ হ, মা।’
ইমরাণ হাসান বাড়িতে ফিরে দেখল তার স্ত্রী ভাত আর এক মুঠো ডাল ভিজিয়ে রেখেছেন সাথে কচু শাক।মৃথিলা দেখেই মুখ শিঁটকালো সে এসব খাবেনা।নাবিলা মৃথিলাকে কাছে টেনে বলল, ‘আদুরি বুড়ি এদিকে আয় তো।আমাদের থাকার জন্য ঘর ও নেই, ভাজ্ঞিস চেয়ারম্যান চাচা আমাদের এই ঘর টা দিছিলো নইলে ঘুমোতাম কোথায়।আমাদের মা বাবা খুব গরীব।আমরা বড় হয়ে চাকরি করে ভাল চাকরি করব,ভাল খাবো,ভালো পোশাক পরব। ‘
‘আমরা এত গরীব কেনো আপু?’
‘আল্লাহ বানাইছে।’
তহমিনা বলল, ‘তোমাদের দাদা বাড়িতে তোমার বাবার অনেক সম্পত্তি আছে।কিন্তু তোমার বাবা তো সেখানে যায়না।আর তারাও নাকি কিছুই দিবেনা।তোমার চাচা সব নাকি দখল করে খাচ্ছে।’
নাবিলা বলল, ‘মা আমি কিন্ত বড় হয়ে সব বুঝে আনব।’
মৃথিলা বলল, ‘আমিও।’
এভাবেই দিন যাচ্ছিলো তাদের।হত দারিদ্রতার মাঝেও সংসারে সুখ ছিলো।দিন যাচ্ছে,মাস যাচ্ছে নাবিলা আর মৃথিলা দুজনেই বড় হতে লাগল।ওদের বড় হবার সাথেই রানীগঞ্জ অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে শুরু করল।একটা ভয়ানক আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।ধীরে ধীরে গ্রামের সব মেয়ে নিঁখোজ হতে শুরু করল।মেয়ে হোক বউ হোক যা নিখোঁজ হচ্ছিলো সব ই মেয়ে।একটা সময় রাণীগঞ্জ কেমন ফাঁকা হতে শুরু করল।কাকতালীয় ভাবে কেমন যেনো রানীগঞ্জের সব মেয়েই নিঁখোজ হচ্ছিলো।ওই সময়ে নাবিলার ইচ্ছা জাগে সে পুলিশের চাকরি করবে।নাবিলা ছিলো ভীষণ সাহসী একটা মেয়ে আর মৃথিলা অত্যান্ত ভীতু আর শান্ত শিষ্ট মেয়ে।মৃথিলাকে তার মামা বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।হঠাত একদিন নাবিলার মা আর বাবা তুমুল ঝগড়া শুরু করেছে।নাবিলা বাইরে থেকে শুনছে।মৃথিলার মা বলছে, ‘তুমি কেমন বাবা?প্রায় মানুষ বলে তুমি রোজ বাইরে ভাল -মন্দ খাবার খেয়ে আসো। এইদিকে আমার মেয়ে দুইটা ঠিক ভাবে খেতে পারেনা।’
নাবিলার বাবা বলল, ‘মানুষের কথা কিভাবে বিশ্বাস করো তুমি?মানুষ মজা করে। আমি এত টাকা কোথায় পাবো?’
‘বড় মেয়েটা চাকরির চেষ্টা করছে,চেয়্যারম্যান বলেছে তাকে ৫০ হাজার টাকা দিলেই সে নাবিলার পুলিশের চাকতির ব্যবস্থা করে দিবে।কিন্তু এত টাকা কোথায় পাবো আমরা।’
‘আমি আগামি সপ্তাহে আমার বাপের ভিটেতে যাবো।সেখানে গিয়ে আমার অধিকার বুঝে নিবো।আমার পাওণা আমি আদায় করব।অনেক হয়েছে আর নয়।আর আমি ছাড় দিবো না।’
‘দেখো তোমার বাবা আমাকে মেনে নেন নি।আর এখন কি তোমার ভাই কিছু বুঝে নিতে দিবে তোমাকে।’
‘না দিলে আমি আইনি ব্যবস্থা নিবো।’
সাতদিন পরে।গ্রামে একজন পুলিশ অফিসার প্রবেশ করল।গ্রামের এত মেয়ে নিঁখোজ এর দায়িত্ব টা পুলিশ নিনেই নিয়েছে।সেদিন প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি হচ্ছিলো।ভীষণ তুফান ছিলো চারদিকে।গাছ-পালা ভেঙে চুরে পড়ছিলো। সন্ধ্যা থেকে মা-বাবাকে ঘরে না পেয়ে নাবিলা খুব চিন্তা করছিলো।ঝড়ের মধ্য বাইরে বের হলো।আর নিজের মা কে ডাকতে থাকল।বাড়ির পেছনের বাগানে মায়ের একটা আত্মচিৎকার শুনে নাবিলা এগিয়ে গেলো।এগিয়ে গিয়ে মায়ের র*ক্তা*ক্ত দেহ দেখে নাবিলা নিজেও চিৎকার দিয়ে মায়ের কাছে বসে পড়ল।নাবিলার মায়ের পেটে ছুরির আঘাত,গলায় কাটা দাগ,যেনো ধারালো কিছু দিয়ে জ*বা*ই করা।নাবিলা মায়ের এমন অবস্থা দেখে ভয়ানক চিৎকার দেয় কিছুক্ষণের মাঝেই তার বাবার গোঙানির আওয়াজ শুনতে পায়।নাবিলা মাকে ফেলে এগিয়ে যায়।তখন নাবিলা যে দৃশ্য দেখে অটোমেটিক নাবিলার গলার স্বর বন্ধ হয়ে যায়।কেউ একজন গাছের সাথে ঠেসে ধরে তার বাবাকে জ*বা*ই করছে।তখন নাবিলার বাবা বলছে নিরব আমি তোমার আপণ চাচা বাব।আমাকে মেরো না।নিরব কয়েক টা গালি দিয়ে গলায় ছু*রি বসিয়ে দিলো।সাথে সাথে র*ক্ত ছুটে নিরবের চোখ মুখ ভরে গেলো।নিজের চোখের সামনে নিজের মায়ের জ*বা*ই কৃত দেহ বাবার কে স্বচক্ষে জ*বা*ই করতে দেখে নাবিলার মাথায় চক্কর মেরে ওঠে।নাবিলা সেন্সলেস হয়ে পড়ে যায়।পৃথিবীর কোনো সন্তান যদি দেখে তার ই চোখের সামনে তার মা-বাবাকে কেউ জ*বা*ই করছে তার স্বাভাবিক থাকার কথা নয়।নাবিলার হৃদয় জর্জরিত হলো যন্ত্রণায়।সেন্স আসার পরে দেখে সে নিরবের কোলে আছে।নিরব তাকে কোলে নিয়ে তাদের বাড়ি নিয়ে আসছে।নাবিলা নিরব কে দেখে প্রচন্ড ভ*য় পেয়ে যায়,ভয়ে থর থর করে কাঁপতে থাকে।নিরব নাবিলাকে তাদের ঘরে রেখে চলে আসে আর বলে এই মুহুর্তে এই ঘটনা কাউকে বলোনা।আমি একজন পুলিশ অফিসার তোমার কাছে কোনো প্রুভ নেই তাই বলেও কাজের কাজ কিছুই হবেনা।সেদিন নাবিলার প*রা*ণ জলে যাচ্ছিলো।মা -বাবার জন্য বন্দী ঘরে ছটফট করছিলো,হাত পা ছোড়াছুড়ি করছিলো।সেদিন ই প্রথম তার চাচাতো ভাইকে সে দেখল।নাবিলা বারবার নিজেকে দোষারোপ করছিলো তার চাকরির টাকা জোগাড় করতেই তার বাবা তার সম্পত্তির অংশ বুঝে আনতে যাচ্ছিলো।তাহলে কি এই সম্পত্তি তাদের কাল।এই সম্পত্তির জন্য আজ তার মা-বাবাকে তার ভাতিজা এইভাবে নৃসংস ভাবে খু*ন করল।প্রিয়জনদের হারিয়ে অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে নাবিলা।তখন অবুঝ মৃথিলা মা-বাবার এই দুঃসংবাদ শুনে মামা বাড়ি থেকে ছুটে আসতে চাই।মা-বাবা নেই এটা মৃথিলা কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা।এখানে আতঙ্ক বলে নাবিলা মৃথিলাকে আর রানীগঞ্জে আসতে দেয় না।নাবিলা ছুটে যায় মৃথিলার কাছে।মৃথিলা নাবিলাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে, ‘আমার বাবা-মাকে চাই আপু।আমি মাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।’
মৃথিলা তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে।মা বাবা নেই এটা মেনে নিতে পারেনা।অসুস্থ হয়ে পড়ে।মৃথিলাকে হসপিটালে ভর্তি করা হয়।তখন মৃথিলাকে তার মামাদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে সেখানের হসপিটালেই রাখা হয়।
হসপিটালে দিন দিন মৃথিলার অবস্থা খারাপ হয়।নাবিলা হসপিটালে বসে মৃথিলার হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বলে,
‘জানিস মিথু ওই রাতের কথা আমি ভুলতে পারিনা।চোখের সামনে ভাসতে থাকে।আজ যদি ছেলে হতাম তাহলে খু*নে*র বদলে আমিও খু*ন করতে পারতাম।আল্লাহ কেনো আমাকে ছেলে বানাল না।তাহলে সেদিন দুইটা কবর নয় সাথে সাথে ওই পুলিশ অফিসার নিরবের ও ক*ব*র দিয়ে দিতাম।মানুষ এতটাও নৃসংস হতে পারে।মিথু আমার সারাজীবন এ আফসোস মিটবে না যে আমি মেয়ে বলে মা-বাবার খু*নে*র বদলা নিতে পারিনি।আমি ও পুলিশ হতে চাই।আমি বদলা নিতে চাই।কিন্তু কিভাবে নিবো মিথু।নিরব অনেক ধূর্ত।কেউ কোনদিন বুদ্ধির দ্বারা নিরব কে হারাতে পারবেনা।একমাত্র ওর কাছের কেউ ছাড়া নিরব কে কষ্ট দিতে পারবেনা।কেউ নিরব কে ভাঙতে পারবেনা।বাবার মতো ঠিক অতটা বিষাক্ত যন্ত্রণা দিয়ে মারতে পারতাম আমার হৃদয় জোড়াতো।আমাকেও হয়ত ও মে*রে ফেলবে। ও কোনো সাক্ষী রাখবে না।নাবিলা মৃথিলার কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বলে।দুটো নিষ্পাপ মেয়ে সেদিন একা ছিলো ভীষণ একা।পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিলোনা।ভয়ংকর রকমের যন্ত্রণা উপলব্ধি করেছিলো।
চলবে…..