#চেম্বার কথন
পর্ব ৫৩
ভদ্রমহিলা, “আমার স্বামীকে খুন করতে ইচ্ছে করে! মোটেও সহ্য হয় না! ছেলেমেয়েরা বিরক্ত হয়! কেন আমি এই ৫৫ বছরে এসে ওদের ৮০ বছরের বাবার সাথে এমন করি! কারণ এখনই তো ওদের বাবার সেবা দরকার। আমি নাকি আগে এমন ছিলাম না! ভীষনভাবে বদলে গেছি! আসলেই আমি খুব নরম ছিলাম! একটু পানি হবে?”
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ভদ্রমহিলা একটু থামলেন। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, কি কি বলবেন সেটা বারবার রিহার্সাল দিয়ে এসেছেন।
চা, পানি আসলো। উনি চুপ করে পানির গ্লাসটা বাম হতে ধরে আছেন। চুমুক দিচ্ছেন না। বিখ্যাত লোড শেডিং শুরু হয়েছে। ফ্যানটা ঘুরছে কিন্তু এক রত্তি গুমোট কাটছে না। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে! কিন্ত ওনার সেদিকে ভুরুক্ষেপ নেই।
ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো বিস্মৃত শতাব্দী প্রাচীন রেলওয়ে স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে আছেন। পর্দা সরিয়ে দিলেন। আমার জানালায় ঝুলানো গাছের ফাঁক গলে আলো জাফরি কাটছে ওনার কোলে। অদ্ভুতভাবে একমুহূর্তে যেন মনে হলো উনি আলো ধরতে চাচ্ছেন, কিন্তু আঙ্গুলের ফাঁক গলে আলোটা বার বার পড়ে যাচ্ছে।
ভদ্রমহিলা, “অদ্ভুত তো! আপনি আমাকে তাড়াতাড়ি বলবার জন্য তাড়া দিচ্ছেন না! চেম্বারে যেয়ে চুপ করে বসে থাকলে মানুষ বিরক্ত হয় তো!”
আমি হেসে ফেললাম, “আমি খুব ভালো মানের না! দেখেন না আমার বাইরে কোনো সাইনবোর্ড নেই!”
ভদ্রমহিলা, ” আপনি বিরক্ত হচ্ছেন না?”
আমি মৃদু হাসলাম, “আপনি সময় নিন। স্মৃতির নৌকায় পা দিলে আমরা একটু থমকে যাই সবাই।”
এই পারমিশনটার যেন ওনার অবচেতন মনের দরকার ছিল। সুনসান নিরবতা কাটলো। গলগল করে ঝর্নার মত ভদ্রমহিলার গলা থেকে কথা বের হতে থাকলো।
ভদ্রমহিলা, ” আমার স্বামীর সাথে বয়সের পার্থক্য ২৫ বছর। ৯ বছরে বিয়ে হয়। আমার তখনো মাসিক শুরু হয় নাই। দেখতে এসে শুধু একটা প্রশ্নই আমার শাশুড়ি করেছিলেন। মাসিক শুরু হয়েছে কিনা! আমার বাবা ছিলেন ক্ষয়িষ্ণু জমিদার। ঘটি ডোবে না, নাম তাল পুকুর। শরিকী বাড়ি, এজমালী সম্পত্তি। মা মারা গেছেন, অল্পদিন। এরই মধ্যে বাবার নতুন বউ। থাকার ঘরের বড়ই অভাব। বিয়ের নামে আসলে বাবা আমাকে এক রকম বিক্রিই করে দিলেন। এই টাকায় পরে শুনেছি বাবা বাজারে একটা মুদি দোকান দেন। আমার আর ফিরানি হয় নাই। বাপের ভিটায় এই জীবনে আর পা পরে নাই।”
ভদ্রমহিলা দম নিতে থামলেন। আমি চুপচাপ। বিড়ালটা জানালা তাক করে বসে আছে। একটা চড়ুই পাখি কার্নিশে বেশ লেজ নেড়ে নেড়ে তাকে লোভাতুর করছে।
ভদ্রমহিলা আবার শুরু করলেন, ” শ্বশুরবাড়িতে নতুন জীবন শুরু হল! বাসর রাত্রে ভারী শাড়ি গয়না পড়ে হাঁটতে পারছিলাম না। প্রচুর ভারী ভারী গয়না। কান কেটে যাবার উপক্রম। এখনো মনে আছে ফুপুশাশুড়ি আমাকে কোলে করে খাটে তুলে দিয়েছিলেন। ল্যাজারাস কোম্পানির পালঙ্ক। সিড়ি বেয়ে উঠতে হয়। ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
রাতে স্বামী আসলে আমি বলেছিলাম, চাচা একটু পেশাব করতে যাবো। আমার স্বামী আমাকে কষে একটা চড় মেরে ছিলেন।”
আমি যেন স্পষ্ট গালে আঙ্গুলের দাগ দেখতে পেলাম। ৯ বছরের সদ্য মাতৃহারা বালিকার গালে সদ্য স্বামীত্ব অর্জন করা ৩৪ বছরের যুবার সাপটে স্পর্শ!
ভদ্রমহিলা, ” আমার ভালো বউ হবার ট্রেনিং শুরু হলো। শাশুড়ি ভয়ঙ্কর প্রতাপশালী। বাড়ির বুয়ার ছুটি ছিলো বাৎসরিক। আমার না। দিনগুলি যাও বা যেত রাতগুলি আরো ভয়ঙ্কর! আমার স্বামীর কাছে যৌনতা মানে দৈহিক আঘাত। কখনো চাবুক, কখনো হাত দিয়েই। আমার আগে না কি আরো ৫টা বউ মারা গেছে। আমি ৬ নম্বর বউ। ১১ বছরে প্রথম গর্ভবতি হই। ততদিনে আমি জম্বি। হাসপাতালে নেওয়া হলে মৃত বাচ্চা প্রসব হয়। আমি শুনি ডাক্তার বকা বকি করছেন নাবালিকা মা বলে। ১২ তে প্রথম মা হই। যেই ছেলে আপনার কাছে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়েছে ওর জন্ম। ১৩ বছরে দ্বিতীয় বার। এই বার মেয়ে হয়। এর পর ১৪ বছরে আবার ছেলে! ১৫ বছরে আবার মেয়ে। এরপর আমার শাশুড়ির পরামর্শে আমার স্বামী ভ্যাসেকটমি করে।”
আমি স্তব্ধ। আবার নিরবতা!
কিছুক্ষন পরে ভদ্রমহিলা আবার শুরু করলেন, “বাচ্চারা একটু বড় হতেই ওদের ইন্ডিয়াতে নাম করা কনভেন্টে পাঠানো হতো। একে একে আমার ৪ টা সন্তানই চৌকষ অক্সফোর্ড এক্সেন্ট শিখলো। আমাকে নিয়ে গেলে শেষের দিকে ওদের লজ্জা হতো! কারণ আমি ওদের বন্ধুদের মা’দের মতো চৌকষ না। আমার চৌহদ্দি রান্নাঘরেই আটকে থাকলো। আর দুপুরের শাশুড়ির পা টেপা।
আমি কথা বলতে ভুলে গেলাম। আমার গলার আওয়াজ কেমন ভুলে গেলাম। শ্বশুর মারা যান যখন আমার স্বামীর বয়স তিন বছর। উনার লাইব্রেরীটা হল আমার নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা। বইয়ের জগৎ আমাকে আশ্রয় দিলো। আমি কাউকে না বলে ২১ বছরে আবার পড়াশুনা শুরু করলাম। ততদিনে ছোটো বাচ্চাটিও বোর্ডিং স্কুলে চলে গেলো। এইদিকে স্বামী আমার শরীরের প্রতি মনোযোগ হারিয়েছে। কারণ তার শুধু শিশু শরীর পছন্দ। আমার এখন মনে হয় সম্ভবত আমার শাশুড়ি ইচ্ছে করেই আমার বাচ্চাদেরকে দেশের বাইরে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দিয়েছিল। বাচ্চারা নাম করা সব জায়গা থেকে পাশ করতে লাগলো। বাবার মুখ উজ্জ্বল হতে থাকলো। আমি আরো নিভে যেতে থাকলাম। একদিন সাহস করে শাশুড়িকে বললাম পড়তে চাই। উনি কি বুঝলেন জানি না, মাস্টার রাখলেন। আমি প্রাইভেটে মেট্রিক পাশ করলাম। নেশা হয়ে গেলো পড়াশুনা। এরপর সাইন্স নেবো ঠিক করলাম। কিন্তু প্র্যাক্টিকাল কি হবে? এমন অগুণিত সমস্যা। এর মধ্যে শাশুড়ির প্রথম স্ট্রোক করলো। ঠিক ২ মাস পরে আমার স্বামীর। আমি একই রুমে ২ জন স্ট্রোকের রোগী রাখি। নিয়ম করে ডাক্তার আসে। ৩ বেলা নার্স। আমার সন্তানেরা বাবা আর দাদীর জন্য বিদেশ থেকে চলে আসলো। সম্পত্তি ভাগের কথা উঠলো। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, আমার ভাগের কোনো হিসেব নেই। আমি আসলেই একটা ফালতু। উদ্বৃত্ত। বাপের ঘরে, স্বামীর ঘরে,vএখন বাচ্চাদের ঘরেও। জীবনে ঠোক্কর খেতে খেতে এটা বুঝে গেছি যে টাকাই ক্ষমতার উৎস! স্বামী-সন্তানের সাথে মানসিক সংযোগ নেই, বাপের বাড়ির কেউ নেই। একটা বিশ্বস্ত বন্ধু পরিজন নেই। আমি একা। বুঝলাম আমাকে টিকে থাকতে হবে। খুব প্রেম করতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু কাকে পাবো? শরীরের প্রতি ঘেন্না ধরে গেছে। মানুষ শরীরই চায় দেখি। সব বাদ দিয়ে পড়াশোনাটা চালিয়ে গেলাম। এমএ পাশ করলাম। কম্পিউটার শিখলাম। এর মধ্যে কিছু দিন ভুগে আমার স্বামী, শাশুড়ী আবার ঠিক হয়ে গেলো।
সব কিছু আগের মতো হয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে একদিন শুনলাম আমার স্বামী আবার বিয়ে করবে। কারণ আমি তাকে মনোযোগ দেই না নাকি।
এই বার প্রথম দেখলাম মা ও ছেলের বিরোধ। আমার শাশুড়ি এই বিয়েতে কিছুতেই রাজি হলো না। আমার সামনেই দেখলাম আমার শাশুড়ির গায়ে হাত তুললো আমার স্বামী। একমাত্র সন্তানের হাতের এই মার খেয়ে উনি হঠাৎ বদলে গেলেন। একদম চুপ হয়ে গেলেন। শরীর খারাপ করলো। ওমরাহ তে গেলেন। ফিরে এসে ক্যান্সার ধরা পড়লো। জানি না কেন, মৃত্যুর আগে আমার শাশুড়ি ওনার নামের সমস্ত সম্পত্তি আমাকে দিয়ে যান! আমার স্বামীর নামে নাকি কিছুই সম্পত্তি ছিল না। আমার শ্বশুরকে বঞ্চিত করে সমস্ত সম্পত্তি নাকি আমার শাশুড়ির নামে আমার দাদা শ্বশুর লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন।
এরপর হঠাৎ করে যেন পাশার দান পাল্টে গেলো। আর এক কাপ চা হবে?”
চা আসলো।
ভদ্রমহিলা আবার শুরু করলেন, ” আমার স্বামীর আবার স্ট্রোক করলো। আবার বিছানায়। আবার ডাক্তার, নার্স! আমাকে অকথ্য গালাগালি করে, দারোয়ান, ড্রাইভার, মালি, বাবুর্চি নিয়ে! আমার ইদানিং প্রচন্ড রাগ উঠে। মনে হয় সব লন্ডভন্ড করে দেই। আর কতো? মানুষের সহ্যের কি সীমারেখা নেই?”
আমি তাকিয়ে রইলাম ভদ্রমহিলার দিকে। মনে হলো যিনি এতোটা সহ্য করেছেন জীবনে তাঁকে কিছু বলবার মতো যোগ্যতা আমার আসলেই নেই। আমি আসলে কতোটুকু জীবন দেখেছি? পুঁথিগত বিদ্যার দৌড় দিয়ে ওনাকে ছোঁয়া মানে ওনার এই জীবনের পথ পরিক্রমাকে অসন্মান করা হবে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে। ইদানিং প্রায়ই নিজের চোখে আয়না ধরলে বুঝি যে আমি আসলেই কতটাই কম জানি বা বুঝি।
আস্তে করে ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ভার্বাল বা কথা বলা নাকি মাত্র ৭% যোগাযোগের মাধ্যম। বাকি ৯৩% যোগাযোগ নন-ভার্বাল বা ভাষাবিহীন। আমি চেয়ারটা টেনে ওনার কাছে গিয়ে ঝুঁকে ওনার হাতটা ধরলাম। হাতে কিছু পুরাতন দাঁতের গভীর দাগ দেখলাম মনে হলো। ভদ্রমহিলার হাতটা ধরে ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
উনি চোখ সরিয়ে নিলেন। খরখরে চোখ দ্রোহ কালের আগুনে ভরা। মনে হলো ঠিক যেন এই বারের বাঙলাদেশের অপরিচিত আচরণ করা বৃষ্টিবিহীন ক্লান্ত শ্রাবণকাল।
আমি ভাবতে চেষ্টা করলাম ভদ্রমহিলার মা বেঁচে থাকলে কিভাবে ওনার মাথায় এই মুহূর্তে হাতটা রাখতেন? গালে হাতটা বুলাতেন!
ওনার মাথা ছুঁয়ে গাল স্পর্শ করবার সাথে সাথে শ্রাবণের ধারার মতো পড়তে লাগলো নিঃশব্দ কান্না।
অনেকক্ষন গেলো।
ভদ্র মহিলার ছেলের সাথে কথা বললাম।
আমি, “মানুষের আচরণের বহিঃপ্রকাশ হয় রাগ, দুঃখ, আনন্দ বা ভয় থেকে হয়। উনি রাগী আচরণ করছেন। কিন্তু আরেকটু পেছনে যদি যাই দেখবো, এই রাগটি একটি মৌলিক অনুভুতি। এটা অটো তৈরি হয়। এই রাগ অনুভতিটি মনের মধ্যে তৈরি করে কিছু চিন্তা। সেই মনের অদৃশ্য চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটা়ই আমরা বাহ্যিক আচরণে। আপনারা মায়ের রাগটা দেখছেন কিন্তু কেন রাগটা করছে সেটা কি বুঝতে চেষ্টা করেছেন? ওনার আসল অনুভূতি হচ্ছে প্রচন্ড দুঃখবোধ। উনি নিজেকে পরিত্যাক্ত বোধ করেন। এখানে আমরা যদি সেই দুঃখটাকে স্পর্শ করতে পারি তাহলেই রাগটা কমে যাবে। আপনারা রাগের জন্য এনেছেন আসলে ওনার জন্য দরকার দুঃখ আর ভয়ের জায়গাটা একটা একটা ইটের মতো করে খুলে দেখা। অনেক গুলি সাইকোথেরাপি সেশন দরকার।”
আমরা মাঝে মাঝে মানুষের নির্দিষ্ট একটা আচরণকে অগ্রহণযোগ্য বলে তাঁর নিন্দা করি। কিন্তু কখনোই খতিয়ে দেখতে চাই না এই আচরণটার পেছনে তাঁর কোন চিন্তাটা কাজ করে। অর্থাৎ এই আচরণ তাঁর কোন চিন্তার ফসল। এবং আরো একটু পেছনে যেয়ে ভাবি না কোন অনুভূতিটা থেকে এই চিন্তাটা তৈরি হচ্ছে? আমরা শুধু আচরণটাই দেখি। কিন্তু মানুষ তো তাঁর বুকটা খুলে অনুভূতিটা দেখাতে পারেন না, মাথাটা খুলে চিন্তাটা দেখাতে পারেন না। ফলে আমরা মানুষটিকে ভুল বুঝি। খুঁত ধরি। কি কি ভুল করে বিশ্লেষণ করে এক হাত দেখাতে চাই। প্রতিশোধ নিতে চাই। জাজমেন্টাল ভাবনা তাই অস্বাস্থ্যকর চিন্তার প্রকাশ। কারণ শুধু কাজ বা আচরণ দেখে আমরা বলতে পারব না একজন মানুষের মনের মধ্যে কি অনুভূতি এবং ভাবনা চিন্তা চলছে।
আমাদের প্রত্যেকটা মানুষের নিজেদের অনুভূতি ভাবনা এবং আচরণের লিমিটেশন আছে। কাজেই জাজমেন্টাল না হয়ে অন্যের লিমিটেশনটা বোঝা প্রয়োজন। সেই জন্য সবার আগে দরকার নিজের চোখে নিজে আয়না ধরা। আমি কি করি? নিজের সীমাবদ্ধতাটুকুকে বুঝতে পারলে এবং গ্রহণ করতে শিখলেই আমরা অন্যরটিকেও পারবো। তখন আর দোষ খুঁজতে যাবো না। আর সেই জন্যই আমি একটি অশ্লীল শব্দ। কারণ দিন শেষে we are not independent we are interdependent. তাই না? তাই তো!
অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া
চিকিৎসক, কাউন্সিলর সাইকোথেরাপি প্রক্টিশনার।
ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার বাংলাদেশ।