#শিমুল ফুল
পর্ব ৫
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
শিমুল রাত বারোটা বাজে ঠিক আসলো।কয়েকবার পায়চারী করে পুষ্পর জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।টোকা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,আবার টোকা দেয়,বারবার টোকা দেয় কিন্তু পুষ্প খুলছে না।
পুষ্প বিছানায় শুয়ে অন্ধকারেই জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে।শিমুল আসবে বলেছে তাই তার ঘুম আসছিলোনা।শিমুলের উপস্থিতিতে পুষ্পর বুক ভার হয়ে আসে।এই যে টোকা দিচ্ছে পুষ্প তো খুলবেনা।কেন খুলবে?প্রেম করবে ফুফাতো বোনের সাথে রাতে দেখা করবে তার সাথে!এটা কেমন কথা?খেলনা পেয়েছে নাকি!পুষ্প চুপচাপ শুয়ে থাকে।শিমুলের প্রতি অভিমান ষোলকলা পূর্ণ হয়ে যেন উপচে পড়ছে।
শিমুল যানে পুষ্প জেগে আছে।সে আসবে বলেছে আর পুষ্প ঘুমিয়ে পড়বে তা তো হয় না!কিন্তু জানালা খুলছেনা কেন?এতো অভিমান এই ছোট্ট মানুষের?শিমুল মুচকি হেসে জানালার সাথে চেপে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে ডাকে
“এই পুষ্প,খুল না।”
“পুষ্প,এই।”
“পুষ্প।”
শিমুল।অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে ছয়টা সিগারেট শেষ করে ফেলে।কিন্তু কোন উত্তর নেই।এখানে দাঁড়িয়ে আছে একঘন্টা হয়ে যাচ্ছে।মেয়েটার মায়া টায়া নেই নাকি?ছোট একটা শরীরে এতো রাগ?শিমুল এবার জোরে জানালায় থাপ্পড় দেয়।ভয়ে পুষ্প ছটফটিয়ে উঠে বসে।বুকে থু থু ছিটিয়ে জানালা খুলে।শিমুল চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।এই যে শিমুল তার সাথে দেখা করতে এতো পাগলামি করে এটা পুষ্পর খুব ভালো লাগে।ফিসফিস করে বললো,
“কি হয়েছে?এতো রাতে এমন করেন কেন?”
শিমুল আদেশের সুরে বলে,
“বাহিরে আয়।”
পুষ্প বললো,
“আসবো না।চলে যান।”
“আসতে বলছি।”
“যান নয়তো আব্বারে ডাকতেছি।”
শিমুল ভ্রু কুচকে পুষ্পকে ভেঙ্গিয়ে বললো,
“আব্বারে ডাকতেছি!ভয় পাই তোর বাপেরে?যা ডাক।”
পুষ্প কিছু বলেনা দেখে শিমুলই বললো,
“মাত্র দুই মিনিটের জন্য আয়।”
পুষ্প মাথা নেড়ে বললো,
“জীবনেও না।”
দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে শিমুলের পা ব্যাথা হয়ে গেছে।এক পা ঝাড়া দিয়ে বললো,
“এতোক্ষণ খুললি না কেন বেয়াদব?”
পুষ্প অভিমানে মুখ নামিয়ে বললো,
“আমি কি আপনার প্রেমিকা হই নাকি যে রাতে দেখা করবো?যার সাথে প্রেম তার সাথেই দেখা করেন।”
শিমুল আবছা আবছা পুষ্পর মুখটা দেখে যেখানে অভিমানের গাঢ় ছাপ।বাচ্চাটা অভিমান করেছে তাও এতোদিন যাকে যমের মতো ভয় পেতো সেই শিমুলের সাথেই,বাহ।শিমুল তার কোকড়া চুলে হাত ভুলিয়ে জানালার গ্রীল ধরে দাঁড়ায়।ফিসফিস করেই বললো,
“অভিমান করেছিস?”
পুষ্প কিছু না বলে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।শিমুল আদ্র গলায় বলে,
“কাছে না আসলে অভিমান গলাবো কি করে?বাহিরে আয় না “
পুষ্প শিমুলের দিকে তাকায়।শিমুলের চোখে মুখে বুনো বাতাসের ছড়াছড়ি।এই নেশা নেশা চোখজোড়ায় কিছু আছে যা পুষ্পর শরীর শিতল করার ক্ষমতা রাখে।বুনো বাতাসটাই পুষ্পকে জানে মেরে দিলো।মাথা নাড়িয়ে বললো,
“না।”
“জানালায় এমন থাপ্পড় দিবো তোর বাপ মা চলে আসবে।দিবো?”
পুষ্প শিমুলের দিকে তাকিয়ে থাকে।এই ঘাড়ত্যাড়া ছেলে যা বলে তাই করে।বের হওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে বজ্জাত একটা।পুষ্প মাথা নাড়িয়ে না করে আস্তে আস্তে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে।
শিমুল সামনের বাশ ঝাড়ের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।পুষ্প জড়সড় হয়ে এগিয়ে যায়,প্রেমহীন একটা ছেলে একটা মেয়ে রাতে দেখা করার মানে কি?পুষ্প এতো মানে টানে যানেনা।কিন্তু শিমুলের পাগলামিতে সায় দিতে ভালো লাগে যদিও ভয় হয় তারপরেও।জ্যোৎস্নার আলোয় সামনে তাকিয়ে দেখে মাথা ভর্তি কোকড়া চুল নিয়ে উঁচু লম্বা ছেলেটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে।দু হাত পকেটে পুড়ে কেমন করে তাকিয়ে আছে,পুষ্পর নরম মনে প্রেমান্দোলনের দোলা তিরতির করে বয়ে যায়।অদৃশ্য কেউ হাত পা টেনে ধরে।পুষ্প এগিয়ে গিয়ে শিমুলের কাছে দাঁড়ায়।
শিমুল পাগলের মতো মেয়েটাকে দেখছে,এই পিচ্ছিকে দেখতে এতো ভালোলাগে কেন?এই মুখে এতো আদর আদর লাগতে হবে কেন?শিমুল নরম গলায় বললো,
“অভিমান হয়েছে?”
পুষ্প কিছু বলে না।
এতো বড়ো ছেলেটা যেন বাচ্চাটার কাছে কৈফিয়ত দেয়ার মতো বললো,
“সুইটি আমাকে পছন্দ করে,কিন্তু আমি না।”
পুষ্প আর রাগটা চেপে রাখতে পারে না,
“তাইতো বাইকে নিয়ে বিশ্রীভাবে হেসে হেসে ঘুরেন।”
শিমুল নিঃশব্দে হাসে।পুষ্পর রাগ অভিমান সবকিছুই তাকে সুখ দেয়,চরম শান্তি।একটু এগিয়ে বললো,
“জ্বলে?”
পুষ্পর খুব কাছে শিমুল।তার নেশা নেশা চোখে তাকিয়ে বললো,
” না।”
শিমুল বুকে ইশারা করে বললো,
“এই যে এখানটায় পুড়ে যাচ্ছে।আমি স্পষ্ট দেখছি।”
পুষ্পর বেহায়া নিলজ্জ চোখে পানি এসে পড়ে।পিছিয়ে গিয়ে দাতে চেপেচেপে বললো,
“উল্টাপাল্টা কথা বলবেন না।”
এটা বলেই পুষ্প হাটতে শুরু করে শিমুল জলদি এসে হাত টেনে ধরে। দুজনে খুব কাছে দাঁড়ায়।শিমুলের চোখ দিয়ে যেন পুষ্পকে মেরে ফেলার পায়তারা করছে।পুষ্প ফুপিয়ে কেঁদে দেয়।হাত ছাড়ানোর জন্য মুচরাতে থাকে।জড়ানো গলায় বলে,
“ছাড়েন।”
শিমুল হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বলে,
“এইটুকুন একটা শরীরে এতো রাগ কই থাকে?হ্যাঁ “
পুষ্প ফুপিয়ে কাঁদে।শিমুল হাত ছেড়ে বলে,
“আমিতো সুইটিকে ভালোবাসিনা।”
পুষ্প মাথা নেড়ে বললো,
“আচ্ছা।”
“রাগ কমেছে?”
“কমেছে।”
“কেঁদে যেন আর চোখ মুখ না ফুলে।”
চোখ ফুলেছে এটাও শিমুল লক্ষ করেছে!পুষ্প লজ্জা পায়।মাথা নিচু করে রাখে।
“নড়াচড়া করবি না সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাক।”
“কেন?”
“আমি এখন দেখবো দেখার সময় নড়াচড়া করলে ডিস্টার্ব হয়।”
এমন পাগল করা বেশামাল কথায় পুষ্পর গাল ভারী হয়।ঠোঁট কাঁপে তিরতির করে।এই কথাগুলোর মানে কি?এতো জ্বালাচ্ছে কেন?সোজা কেন কিছু বলে না?”
শিমুল ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে তাকিয়ে থাকে।পুষ্পর তিরতির করে কাঁপা ঠোঁট গুলো উষ্ণ আদরে ভরিয়ে দিতে মন চাইছে,ছোট নরম শরীরটাকে শক্ত বুকের খাচায় চেপে নিশ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু সব ইচ্ছা তো পুরন করা সম্ভব না। শিমুল নিজেকে সামলে চুপচাপ দেখে গেলো।এতোদিনের অপেক্ষা এভাবে শেষ হতে দিবে না।এতো বছর সইতে পেরেছে আর কয়েকদিনও পারবে।এইতো পুষ্প সহজ ভাবে কথা বলছে,নিজের অভিমান প্রকাশ করছে।এটাইতো চেয়েছে শিমুল।তার শুকিয়ে যাওয়া গাছে ফুল ফুটাক।নিজেই বুঝে নিক শিমুল কি।শিমুল যে আগুনে পুড়ে তার তাপ পুষ্পর গায়েও লাগুক।যন্ত্রনায় ছটফট করে শিমুলের উতপ্ত বুকে পানি হয়ে পড়ুক।
শিমুলের এমন অবশ করা চোখের দৃষ্টি পুষ্পর ভেতরটা নাড়িয়ে দেয়।চোখ দিয়েই যেন বুঝিয়ে দেয় অন্য অধ্যায়ের আলাপন।শিখিয়ে দেয়,কাঁপিয়ে দেয়,পুষ্পর নরম মনটা।এই দৃষ্টিটা পুষ্প আর সহ্য করতে পারে না।জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বললো,
“আমাকে দেখার কি আছে?আর দেখবেন না।”
শিমুল ধমকে বললো,
“পকপক করিস না তো!আমি দেখছি।”
“অনেকক্ষন হয়েছে বের হয়েছি।বাড়ি যাই?”
শিমুল মাথা ঝাকিয়ে বললো”
“আমি যে এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলাম,চলে যাওয়ার জন্য?”
পুষ্প ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,
“কি করবো?”
“আমার চোখে তাকা।”
পুষ্প শিমুলের চোখে তাকায়।
শিমুল এক পা এগিয়ে বলে,
“কি দেখা যায় আমার চোখে?”
পুষ্প মনে মনে বলে,’আমার সর্বনাশ শিমুল ভাই।আমার যে ভিষন ভাবে ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।অবুজ মনটা যেন তরতরিয়ে অনেককিছু শিখে যাচ্ছে।’পুষ্প কিছু বলার আগেই,একটা পুরুষালী গলা চেচিয়ে বললো,
❝এই বাশগাছের নিচে কে রে…….❞
চলবে……