যেদিনতুমিএসেছিলে
সিজন_টু
পর্ব_৮
মুন্নিআক্তারপ্রিয়া
রাফি তার গোল গোল চক্ষুদ্বয়ে ভারী বিস্মিত হওয়ার ভান ধরে অর্ষাকে পর্যবেক্ষণ করছে। রাগে গাল ফুলিয়ে বসে ছিল অর্ষা। আহনাফের সাথে আর কোনো রকম তর্ক না বাড়িয়েই চলে এসেছে। তখন থেকেই রাফি অর্ষার রাগী মুখটার দিকে তাকিয়ে রয়েছে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে। অর্ষা এতক্ষণ নখ দিয়ে টেবিল খুঁটছিল বলে রাফির তাকানো খেয়াল করেনি। এবার চোখাচোখি হতেই গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করল,
‘কী হয়েছে?’
রাফি মুচকি হাসল। হয়তো এই প্রথমই সে অর্ষার সামনে হেসেছে। এতে অবশ্য অর্ষা কিঞ্চিৎ অবাক হয়েছে বৈকি!
রাফি হেসে বলল,’রাগলে তো তোমাকে দারুণ লাগে।’
ছোটো এক বাচ্চার মুখে এমন প্রশংসার বাণী শুনে অর্ষা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
‘তোমায় কে বলল আমি রেগে আছি?’
‘কেউ বলেনি। তোমায় দেখেই বুঝেছি।’
অর্ষা নিরুত্তর। রাফি বলল,
‘সত্যিই রাগলে তোমায় ভীষণ ভালো লাগে। তুমি অবশ্য এমনিতে সুন্দরী আছো। কিন্তু রাগ করলে বেশি সুন্দর লাগে।’
‘রাফি তুমি কি জানো তুমি একটা ইঁচড়েপাকা?’
‘ইঁচড়েপাকা মানে কী?’
‘অকালপক্ব।’
‘অকালপক্ব মানে কী?’
অর্ষার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে মৃদু ধমক দিয়ে বলল,
‘পড়ো চুপচাপ!’
ধমক খেয়ে রাফি কয়েক পলক ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে বলল,
‘আমায় কেউ কখনও বকে না। তুমি কেন বকো?’
‘কেউ বকে না বলেই তো এমন ইঁচড়েপাকা হয়েছ। আর একটাও কথা না বলে চুপচাপ পড়ো।’
অর্ষার কড়া কড়া কথা শুনে রাফি চুপ হয়ে যায়। মুখটা কেমন যেন চুপসে গেছে। সে মাথা নত করে লিখছে এখন। মূলত অর্ষা অনিচ্ছাতেই আহনাফের ওপর রাগ রাফির ওপর ঝেড়ে ফেলেছে। মিনিট কয়েক যেতে না যেতেই মেজাজ কিছুটা শান্ত হয় অর্ষার। নিজের ভুল বুঝতে পেরে মনে মনে অনুতপ্ত হয়। আরও বেশি আহত হয় রাফির শুকনো মুখটা দেখে।
অর্ষা রাফির বাম হাতের ওপর হাত রেখে বলল,
‘রাগ করেছ? আসলে মেজাজটা খারাপ ছিল তো!’
রাফি বড়োদের মতো শুকনো মুখে বলল,
‘ইট’স ওকে।’
পড়ার মাঝখানে সে আর কোনো কথা বলেনি। সময় শেষ হতেই সে দৌঁড়ে চলে যায়। অর্ষা কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার জন্য। ড্রয়িংরুমে রেণুকে দেখে থেমে যায়। আশেপাশে রাফি নেই লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল,
‘রাফি কোথায়?’
‘দেখলাম তো দৌঁড়াইয়া গেল। মনে হয় খালাম্মার কাছে গেছে।’
অর্ষা বুঝে গেল রেণু আহনাফের মায়ের কথা বলছে। অর্ষা বলল,
‘আচ্ছা আমি তাহলে আসছি।’
‘বসেন একটু।’
‘কোনো দরকার?’
‘আগে বসেন।’
অর্ষা সোফায় বসার পর রেণু রান্নাঘরে ঢোকে। ফিরে আসে খিচুড়ির প্লেট নিয়ে। প্লেটটি অর্ষার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘গরম গরম ভুনাখিচুড়ি। খেয়ে বলেন তো কেমন হইছে।’
অর্ষা নাকচ করে। সে খাবে না। রেণুও নাছোড়বান্দা। অবশেষে রেণুর অনুরোরত স্বর শুনে অর্ষাকে খাওয়ার জন্য রাজি হতে হয়। খাওয়ার মাঝে গল্প করতে করতে অর্ষা অবাক করা এক সত্য কথা জানতে পারে। সে এতদিন ভাবত রাফি আহনাফের বোনের ছেলে। কিন্তু আজ জানল রেণুর ছেলে।
অর্ষার বিস্মিত মুখ দেখে রেণু মুচকি হেসে বলে,
‘প্রথম প্রথম সবাই ভাবে রাফি এই বাড়ির পোলা। আহনাফ ভাইজান ওরে ওমনেই পালছে।’
‘আপনার হাজবেন্ড কোথায় তাহলে?’
‘হেয় বিদেশ থাকে। বিয়ের আগে থেইকাই আমি এই বাড়িতে কাম করি। বিয়ের এক বছর পর হেয় বিদেশ চইলা যায়। তখন থেইকা রাফিরে নিয়া আমি এই বাড়িতেই থাকি।’
‘উনি আসেন না?’
‘আসে। পাঁচ বছর পরপর।’
অর্ষা প্লেট রেখে রেণুর হাত থেকে পানির গ্লাস নিল। পানিটুকু পান করে বলল,
‘আজ তাহলে আসি আপু।’
‘আচ্ছা আপা।’
‘এত মানুষ ম’রে তুই ম’র’তে পারস না? তুই ম’র’লেও তো আমি একটু শান্তি পাই। আল্লাহ্ কি তোরে কৈ মাছের জান দিছে? এ’ক্সি’ডে’ন্ট হইল তবুও ম’র’লি না ক্যান?’
শিমলা বেগমের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা আচরণ এবং তিরস্কার শুনেও আহিল চুপ করে থাকে। মাঝে মাঝে ভীষণ ইচ্ছে করে প্রতিটা কথার জবাব দিতে। কিন্তু পারে না। এর সাথে খারাপ ব্যবহার করতে গেলেই নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে। দমে যায় সে। এভাবে যে কতবার প্রতিবাদ করতে গিয়েও ফিরে এসেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সে ভাবত একদিন হয়তো শিমলা বেগম থেমে যাবেন। কিন্তু না! আহিলের নীরবতায় তার তিরস্কারের পরিমাণ বাড়তেই থাকে। খুব ইচ্ছে করে বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যেতে। সেই উপায়টাও নেই। সে চলে গেলে তার বৃদ্ধ বাবাকে দেখবে কে? শিমলা বেগম কতটা ডে’ঞ্জা’রা’স সেটা তার থেকে ভালো আর কে জানে! এসব ভেবেই মনে মনে একটা ভারী শ্বাস নিল আহিল। শরীরে এখনও বেশ ভালো রকম ব্যথাই আছে বলে বাড়ির বাইরে যায়নি। আশিক, দিদার অনেকবার বাড়ির ঠিকানা চেয়েছিল। আহিল দেয়নি। এই বাড়ির ঠিকানা দিয়েই বা কী হবে? বন্ধুরা তো নূন্যতম সম্মানও পাবে না এখানে। এছাড়া সে চায় না তার তিক্তময় জীবনটার কথা বাড়ির বাইরের কেউ জানুক। একটা শক্ত খোলসে সে যেমন নিজেকে আবদ্ধ করে রেখেছে, বাইরের মানুষগুলোও সেই শক্ত আবরণটাই শুধু দেখুক। ভেতরের ক্ষ’তে না হয় একটু একটু করে দ’গ্ধ হোক সে।
.
.
রাত ১০টার দিকে শামীমের কল আসে। ফোন চার্জে দিয়ে শুয়ে ছিল অর্ষা। হয়তো এর মাঝে ঘুমিয়েও পড়েছে। অনেকক্ষণ যাবৎ রিং হওয়ার পরও অর্ষা উঠছে না দেখে সকাল ফোন নিয়ে অর্ষাকে ডাকে।
‘আপু তোর ফোন।’
‘কে ফোন করেছে?’ ঘুমঘুম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে অর্ষা।
‘শামীম ভাইয়া।’
অর্ষা এবার ফোন হাতে নেয়। রিসিভ করে হু, হা, আচ্ছা এসবই বলে। ফোন রাখার পর সকাল জিজ্ঞেস করে,
‘কী বলল?’
‘চাকরিটা হয়ে গেছে! কাল সকালে অফিসে যেতে বলল।’
‘তোর না বলে চাকরি হয়নি?’
‘আমি তো এটাই ভেবেছিলাম।’
‘তুই তো সবসময় শুধু বেশি বেশি ভাবিস। বাই দ্য ওয়ে, চাকরি হয়েছে শুনে খুশি না হয়ে মুখটা ওমন করে রেখেছিস কেন?’
‘আরে আমি তো ভেবেছিলাম আমার চাকরিটা হয়নি। হওয়ার কথাও ছিল না অবশ্য! এজন্য রাফির মামার সাথে আজ ঝগড়া করেছি।’
সকাল অবাক হয়ে বলল,
‘কী! কেন?’
অর্ষা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কাহিনি খুলে বলল। সকাল কপাল চাপড়ে বলে,
‘মেয়েরা দুই লাইন বেশি বুঝে জানতাম। কিন্তু তুই তো চার লাইন বেশি বুঝিস। যাই হোক, স্যরি বলে দিস।’
‘স্যরি বলব কেন? সে আমার সাথে মিজবিহেভ করেছে।’
‘কিন্তু ঝগড়ার শুরুটা তো তুই-ই করেছিলি তাই না?’
‘তা ঠিক।’
‘কাজেই স্যরিটাও তোরই বলা উচিত।’
‘স্যরি বলব বলছিস?’
‘হ্যাঁ।’
অর্ষা মৌন রইল। যার অর্থাৎ সে স্যরি বলবে। আর তার মৌনতাই তার কাল হয়ে দাঁড়াল। পরেরদিন অফিসে গিয়ে সে জবে জয়েন করে। তবে একটা জিনিসই তার মাথায় ঢুকছে না সে চাকরিটা পেল কী করে? কোনো প্রশ্নের উত্তরই সে ঠিকমতো দিতে পারেনি। অথচ তবুও তার চাকরিটা হয়ে গেছে। মিরাকল! তার কাজ সে বুঝে নেওয়ার পর অপেক্ষা করছিল আহনাফকে খুঁজে পাওয়ার।শামীম তখন আসে। জিজ্ঞেস করে,
‘কোনো সমস্যা আছে?’
‘আপাতত নেই।’
শামীম হেসে ফেলে। হেসে বলে,
‘আচ্ছা কোনো সমস্যা হলেই আমাকে জানিও। ফোন দিও।’
‘ঠিক আছে।’
অর্ষার কাজ রিপোর্ট করা। সে কম্পিউটার ঘেটে আগের রিপোর্টগুলো দেখতে থাকে।
‘আপনি কি এখানে নতুন?’
অর্ষা পিছু ফিরে একটা ছেলেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। সে মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘জি।’
‘আমি আপনার সিনিয়র স্যার। আমার নাম মিজান। কোনো রকম সমস্যা হলে আমায় জানাবেন।’
‘জি স্যার।’
‘আপনার নাম কী?’
‘অর্ষা।’
‘আচ্ছা কাজ করুন।’
অর্ষা প্রত্যুত্তরে মাথা নাড়াল। সে চেয়ারে হেলান দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে কিছুক্ষণ বসে থাকে। আজ কলেজে যাওয়ার কথা ছিল। যাওয়া হবে না। বন্ধুদের সাথে দেখাও হবে না। একটা টেক্সট করে গ্রুপে জানিয়ে দেওয়া উচিত। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে গ্রুপে ম্যাসেজ করে রাখে। হঠাৎ তার পানি পিপাসা পায়। তার কাছে কোনো পানির বোতল নেই। সে পাশের একজনকে জিজ্ঞেস করে পানি আনতে যায়। লাইন ক্রস করে যাওয়ার সময় একটা মেয়ে স্লিপ খেয়ে পড়ে যায়। পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে অর্ষা কাছে থাকায় সাপোর্ট হিসেবে মেয়েটা অর্ষাকে টেনে ধরে। এদিকে অপ্রস্তুত অর্ষা আচানক এমন ঘটনায় টাল সামলাতে না পেরে নিজেও পড়ে যায়। এমনভাবে পড়েছে যে হাঁটুতে আর ডান হাতের কনুইতে ভীষণ ব্যথা লেগেছে। আশেপাশে থাকা কয়েকজন অর্ষা এবং সেই মেয়েটাকে ধরে তোলে। কিছুটা দূরে মিজান দাঁড়িয়ে ছিল। সে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে আসে। সেই মেয়েটাকে একটু বকাঝকাও করে। ব্যথায় অর্ষার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
মিজান জিজ্ঞেস করল,’খুব বেশি ব্যথা পেয়েছ?’
অর্ষা হাসার চেষ্টা করে বলল,’না, তেমন না। ঠিক আছি।’
অর্ষা পানি না নিয়েই নিজের ডেস্কে চলে যায়। কিছুক্ষণ বাদে একজন এসে বলে যায় আহনাফ তাকে ডেকে পাঠিয়েছে। সে কোনো রকম পা টেনে টেনে আহনাফের কেবিনে যায়। দরজায় নক করে বলে,
‘আসব?’
আহনাফ মুখ তুলে একবার তাকাল। কয়েক সেকেণ্ড মৌন থেকে বলল,
‘আসুন।’
অর্ষা ভেতরে গিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আহনাফ বলল,
‘বসুন।’
অর্ষা বসল। আহনাফ হাতের ফাইলটা বন্ধ করে কিছু বলতে যাবে সেই মুহূর্তে অর্ষা বলল,
‘স্যরি।’
আহনাফ ভ্রুঁ কিঞ্চিৎ কুচকে বলল,’স্যরি! কিন্তু কেন?’
‘না জেনেই কাল আপনাকে অনেক কথা শুনিয়েছি তাই।’
মৃদু হাসল আহনাফ। বলল,’আমি কিন্তু আসলেই আপনাকে চাকরিটা দিতাম না। শামীমের রেফান্সেই আপনাকে নেওয়া।’
চোয়াল শক্ত হয়ে যায় অর্ষার। ঠাণ্ডা মেজাজ গরম হয়ে যায়। সে মনে মনে বিড়বিড় করে বলে,
‘ব্যাটা বদ!’
‘যাই হোক, চাকরি যখন হয়েই গেছে তখন কাজটা মন দিয়ে করবেন আশা করি।’
‘আমি আমার বেস্টটাই দেওয়ার ট্রাই করব ইন-শা-আল্লাহ্।’
‘গুড। এখন আপনি আসতে পারেন।’
অর্ষা চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়। পেছন থেকে আহনাফ জানতে চায়,
‘আপনার হাতে-পায়ে কী হয়েছে?’
অর্ষা পিছু ফিরে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
‘হা-ডু-ডু খেলতে গিয়ে পড়ে গেছি।’
বিস্ময়ে হতবাক আহনাফের মুখের দিকে আর না তাকিয়েই অর্ষা বের হয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। কনুই লাল হয়ে আছে। সে হাতে অল্প অল্প পানি নিয়ে কনুইতে দেয়। জ্বা’লা-পোড়া-ও করছে। ওয়াশরুম থেকে ফিরে গিয়ে দেখে ডেস্কের ওপর মলম এবং ব্যথার ওষুধ। সাথে একটা কাগজ; যেখানে লেখা রয়েছে,
‘ফর ইউ।’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]