ভালোবাসা রং বদলায়
পর্ব ২
দীপার শাশুড়ি মায়ের আর তর সইছিল না। রুমে ঢুকে দরোজা টা ভিজিয়ে দিয়েই আগে মেয়েকে ফোন করলো।
হ্যালো কঙ্কা কেমন আছিস মা?
ভালো আছি মা, তুমি কেমন আছো?
আর বলিস না, আমরা আছি কোনরকম ।
তোর ভাই তো একটা ঘটনা ঘটাইছে ।
কি ঘটনা মা?
দীপা নামের এক মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে আসছে। তারপর আবার দরজার সামনে সেই মেয়েকে ফেলে রেখে পালাইছে।
ফোন টাও অফ করে রাখছে। কেমন বদের বদ, এবার বোঝ। সারাদিনে তার কোন খবর নাই।
ওয়াও! রিয়েলি ?
গ্রেট নিউজ। আমারতো এখনি দৌড়ে আসতে ইচ্ছা করছে মা। তা ভাবি দেখতে কেমন মা?
চেহারা তো ভালোই, গায়ের রং সুন্দর। রান্নাবান্নায় ও এক্সপার্ট। দুপুরে তো খুব সুন্দর করে একাই নিজের হাতে সব কিছু অনেক মজা করে রান্না করছে।
মা তাহলে তো তোমরা খুবই লাকি। ভাইয়া তো তাহলে একটা দারুন কাজের কাজ করছ।
দারুন না ছাই ।
সামনে ফাইনাল পরীক্ষা ।
পরীক্ষা দিয়ে কোথায় চাকরি বাকরি খোঁজ করবে, তা না বিয়ে করে এক মেয়ে এনে বাপের ঘাড়ের উপর ফেলছে।
তুই কালকে সকালেই চলে আয় তো।
কতদিন তোকে দেখি না,
তুই এসে নিজের চোখে তোর ভাবিকে দেখে যা।
কঙ্কা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, আচ্ছা দেখি মা।
তোমার জামাই কে বলে দেখি। এ বাড়ির মূল ডিসিশন তো সব আমার শাশুড়ি মা নেয়। এখনো তার চাপার কত জোর। মা আর মেয়ে মিলে সব সিদ্ধান্ত নেয়। তার ছেলেটা হয়েছে একটা মেরুদন্ডহীন বলদ। মায়ের কথায় উঠে আর বসে। নিজের কোনো ডিসিশন নেওয়ার যোগ্যতা নেই। শাশুড়ি যদি পারমিশন দেয় তাহলে আসব।
থাক মা কান্দিস না, একটু মানিয়ে চলার চেষ্টা কর। বড় ঘরে বিয়ে দিয়েছি। একটু তো মানিয়ে চলতেই হবে। দেখি আমি বেয়াইন সাহেবা কে ফোন দিয়ে পারমিশন নিবনি, তুই কালকে সকাল সকাল চলে আসিস। জামাইকেও সাথে নিয়ে আসিস।
*******************************************
মতিন সাহেব ড্রয়িং রুমে বসে খবর দেখছিলেন।
দীপা এসে বললো, আব্বা রাত দশটা বাজে এখনো তো আপনার ব্যাটা বাসায় আসলো না। ফোনের সুইচ ও অফ। কোন সমস্যা হলো না তো?
এত টেনশন করো না মা ।
ওই গাধাটা বাসার আশেপাশেই আছে। আমি না শুয়া পর্যন্ত ঘরে ঢুকবে না ।
এক কাজ করো , ড্রইংরুম আর আমাদের রুমের লাইটটা অফ করে দাও। শুধু তোমার রুমের লাইটটা জ্বালিয়ে রাখো ।
সব রুম অন্ধকার দেখলে গাধাটা সুড়সুড় করে চলে আসবে।
দীপা মাথা কাত করে বললো, ঠিক আছে আব্বা।
সব লাইট অফ করে দিয়ে দীপা তার রুমে এসে শুয়ে শুয়ে মনে ভাবছে।
সারাদিনে ওনার কোন খবর নেই। এদিকে আমার যে খুবই টেনশন লাগছে, হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে, সে খবর আছে।
সাড়ে দশটার সময় দীপার ফোনটা বেজে উঠলো।
ফোন রিসিভ করা মাত্র ওপাশ থেকে বাদল সুর টেনে বললো,
দীপাআআআআ শোন
খুব আস্তে করে সামনের রুমে দরজাটা খুলে দাও না। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। কোন শব্দ যেন না হয় ঠিক আছে?
আচ্ছা ঠিক আছে।
দীপা দরজাটা খুলে দেওয়া মাত্র, বাদল ভেতরে ঢুকে চোরের মতো আস্তে আস্তে যেই না সামনের দিকে আগানো শুরু করেছে, সাথে এক হুংকার!
কোথায় যাচ্ছিস? দাঁড়া।
বাদলের মা আলো জ্বালাও।
কোথায় ছিলি সারাদিন?
আব্বা রফিকের কাছে কিছু নোট ছিল সেগুলো আনতে গেছিলাম।
বাহ খুব ভালো কথা, আমাদের ছেলে কত পড়ুয়া। রাজশাহী থেকে এসে ঘরে না ঢুকে সে নোট আনতে গেছে। খুব ভালো খুব ভালো ।
তা এই মেয়েটাকে দরজার সামনে রেখে চলে গেছিস কেন?
আব্বা কোন মেয়ে ?
কার কথা বলছেন?
আমি তো কোন মেয়েকে চিনি না।
ও আচ্ছা তাহলে তুই বলতে চাচ্ছিস দীপা কে তুই চিনিস না?
না তো আব্বা আমি তোকে আগে কখনো দেখিইনি।
ঠিক আছে দীপা মা, তুমি তাহলে কঙ্কার ঘরে ঘুমাও। ওই গাধাটা নাকি তোমাকে চিনে না।
জ্বী ঠিক আছে আব্বা।
দীপা কঙ্কার রুমে এসে দরজাটা আটকে দিয়ে শুয়ে পড়লো। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে, কোনভাবেই ঘুম আসছে না। রাত বারোটার দিকে দরজায় টুকটুক করে শব্দ।
দীপা ভয়ে ভয়ে বললো কে?
দীপাআআআআ আস্তে করে দরোজাটা খোলো সোনা, শব্দ করো না প্লিজ।
দীপা উঠে আস্তে করে দরোজাটা খুললো।
তারপর অপরিচিত ভঙ্গিতে বললো, কি চান আপনি?
রাত দুপুরে একটা অপরিচিত মেয়েকে ডাকাডাকি করতে লজ্জা করেনা!
বাদল দীপার মুখটা চেপে ধরলো। প্লিজ দীপা এমন করে না প্লিজ। তুমিও যদি এমন করো আমি কোথায় যাব।
হাত সরান মুখ থেকে।
বাবার সামনে তো খুব বললেন আমাকে চেনেন না। এখন এসে ফিসফিস করছেন কেন ?
যান ঘুমান।
আস্তে আস্তে দীপাআআআআ
আস্তে কথা বলো,বাবা শুনতেপাবে।
আমিতো বাবার ভয়ে এমন বলছি ।
সরি দীপা।
আমার রুমে চলো, সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবার কাছে সব স্বীকার করব। দীপাকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে দীপার হাতটা ধরে টানতে টানতে নিজের রুমে নিয়ে গেলো।
মতিন সাহেব বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে বললেন,কি বুঝলা বাদলের মা। কোন শব্দ পাও?
দেখো তোমার গাধাটা রাত দুপুরে দরজা টাকাচ্ছে।
হা হা হা
আপনি চুপ করেন তো । ঘুমান।
ওদেরকে ওদের মত থাকতে দেন। আপনার ভয়ে আমার ছেলেটা এমন হয়েছে। এত বড় একটা ঘটনা ঘটানোর পরও সত্যি বলার সাহস পায় না।
আপনার কারণেই এই আকামটা করছে। গাধা গাধা বলতে বলতে ওরে একদম গাধা বানায় ফেলছেন। নিজের শখ আহ্লাদের কথা মুখ ফুটে বলতেও পারেনা। এইবার আপনি ওর উপরে একটু মাতব্বরি কমান।
হা হা হা তবে যাই বলো, দীপাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। ছেলে এতো দিনে একখান বুদ্ধিমানের কাজ করছ।
সকালে ঘুম থেকে উঠে রান্না ঘরে এসে দীপার শাশুড়ি মা খুবই অবাক। দীপা কি সুন্দর করে আলু দিয়ে ছোলার ডাল রান্না করে বাটিতে সাজিয়ে রেখেছো। রুটি ও বেলে রাখা ।
আম্মা উঠছেন ?
আমি সবকিছু রেডি করে রাখছি।
আব্বাকে নাস্তা খেতে ডাক দেন।
আপনারা টেবিলে বসেন আমি গরম গরম রুটি ভেজে দিব।
দুজনের কথোপকথনের মাঝে মতিন সাহেব পেপারটা নিয়ে টেবিলে এসে বসলেন। কি দীপা মা, ঘুম হয়েছে ঠিকমত।
জ্বী আব্বা।
কই বাদলের মা, তোমার গুণধর পুত্র কোই। ডাক দাও, একসাথে নাস্তা খাই সবাই।
বাদল এসে বসার পর দীপা ঝটপট তিনটা ডিম পোচ এনে টেবিলে রাখল। দীপা রুটি ভেজে এনে দিচ্ছে আর বাপ ছেলে মিলে মজা করে খাচ্ছে।
বাদলের মা তুমি আবার বসে আছো কেন, খাও গরম গরম খাও ডালটা অনেক মজা হয়েছে।
দীপার ভাজা হোক একসাথে আমরা দুজন খাবো।
দীপা রান্না ঘর থেকে হালকা হেসে বললো, আম্মা আপনি গরম গরম খান তো।
আপনাদের খাওয়া হলে পরে আমি খাবো।
সবার খাওয়া শেষ হলে চায়ের পানি চুলায় বাসায় দিয়ে, দীপা নিজের নাস্তাটা নিয়ে বসলো খেতে।
মতিন সাহেব অবাক হয়ে বললেন, দীপা তোমার জন্য ডিম নাওনি কেন মা?
আব্বা আমার ডাল দিয়ে রুটি খুব পছন্দ। এজন্য ডিম নেইনি।
না না, তা তো হবে না।
বাদলের মা তুমি একটা ডিম পোচ করে এনে দাও মেয়েটাকে।
বাবার কাছ থেকে এমন ভালোবাসা পেয়ে, দীপার চোখে অশ্রু বিন্দু জমা হতে থাকে।
দীপার শাশুড়ি ডিম পোচ টেবিলে রাখতে রাখতে বললেন, শোনো কঙ্কাকে আসতে বলছি জামাইকে সাথে নিয়ে। ও তোমাকে আজ দেখতে আসবে।
একটু তো ভালো মন্দ রান্না করতে হয়।
ঠিক আছে আম্মা, কি রান্না করতে হবে আপনি সব ফ্রিজ থেকে বের করে দেন। আমি ঝটপট করে ফেলব।
না না তুমি একা একা পারবা না ।
আমি হাতে হাতে সাহায্য করবো।ফ্রিজে গরুর মাংস,মুরগি, ইলিশ মাছ আর গলদা চিংড়ি আছে।সব বের করে ভিজাও।
আম্মা সব ভিজাইছি। ওগুলোভিজতে ভিজতে একটু ফিরনি করে ফেলি?
আমি ফিরনি রান্না খুব ভালো পারি।
ঠিক আছে করো। একটা ডেজার্ট আইটেম তো করতেই হয়।
জ্বী আম্মা আমি ফিরনি রান্না করে ফ্রিজে রেখে এগুলো গুছিয়ে ফেলবো। আপনি রেস্ট করেন।
আম্মা আপনি রোস্ট টা করেন। আমি আজকে আপনার করা দেখে শিখে রাখি। চিংড়ি দোপেয়াজো, ইলিশ মাছ ভাজা আর গরু ভূনা আমি করি।
শিখবা মানে?
তুমি রোস্ট করতে পারো না?
জ্বী না আম্মা, আমাদের বাসায় অনেক দিন পর পর মাংস রান্না হয়।
তাও দেশি মুরগি আলু দিয়ে ঝোল। আমার আব্বা দেশি মুরগি ছাড়া খেতে পারে না। আর ঘনো ঘনো মাংস কেনার সামর্থ্য ও নেই আমার বাবার। তাই আমাদের বাসায় কখনো রোস্ট করা হয় না।
আচ্ছা ঠিক আছে, আসো রান্না বসাই। কঙ্কা যেকোনো সময় চলে আসবে। ও আসার আগেই ঝটপট আমরা কাজগুলো শেষ করে ফেলি। কতদিন পর মেয়েটা আসবে, বসে একটু সুখ দুঃখের গল্প করবো।
আবার তো আসতে না আসতেই যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যাবে।
চলবে….