ভালোবাসা রং বদলায়
পর্ব ৪
রোকেয়া পপি।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শুরু হবার আগেই বাদল ভার্সিটি থেকে চলে আসলো। হঠাৎ করে শশুর কে দেখে খুব অবাক হলেও বুঝতে না দিয়ে
শ্বশুরের সঙ্গে সৌজন্য বিনিময় করে একসাথে খেতে বসলো।
দীপার শাশুড়ি খেতে বসে দেখলো মাংস আর ডাল এর পাশাপাশি তিন রকম ভর্তা ও আছে। বেগুন, আলু, আর ডাল ভর্তা করছে। এগুলো দেখে মুখ চোখ অন্ধকার করে রাখল।
বাদল তো খেতে বসে খুবই অবাক!
এগুলো কি করছো দীপা?
আব্বা প্রথম আসছে আমাদের বাসায় ,
ফ্রিজে কি গরুর মাংস, ইলিশ মাছ কিছুই ছিল না!
দীপা শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো, না আসলে আব্বা তো ভর্তা দিয়ে ভাত খেতে খুব পছন্দ করে। তাই আমি ভাবছি ভর্তা করি।
বাদল অভিমান করে বললো, এটা একদম ঠিক কাজ করোনি দীপা। তোমার কাছে আমি এটা আশা করিনি।
তুমি আমাকে একটু ফোন করতে পারতে। যাও তাড়াতাড়ি ডিম ভেজে নিয়ে আসো বারবার জন্য।
হঠাৎ করে এতো কিছু ঘটে যাওয়াতে দীপার বাবা খুবই অপ্রস্তুত বোধ করছেন। তিনি বাদলকে হাত ইশারায় থামতে বলে বললেন,
বাবা এত অস্থির হয়ো না। ভর্তা হলে আমার আর কিছুই লাগে না। তবু ও দীপা ঝটপট একটা ডিম ঝাল ঝাল করে ভেজে আনলো, সাথে একটা শুকনো মরিচ ভাজা।
দীপার বাবা খেতে খেতে খাবারের ভূয়শী প্রশংসা করলেন।
আমার আম্মাজান তো খুব ভালো ভর্তা বানানো শিখছে। আলহামদুলিল্লাহ। খুব ভালো খেলাম মা।
বাদল তার শ্বশুরের সাথে খুব আন্তরিক ভাবে গল্প গুজব করলেও দীপার শাশুড়ি আর সহজ হতে পারলেন না। কেমন যেন মুখ চোখ অন্ধকার করে রাখলেন।
বাদল এক ফাঁকে তার বাবাকে ফোন দিয়ে জানালো তার শশুর এসেছে।
বাদলের বাবা বিকেলে বাসায় ফেরার সময় হরেক পদের নাস্তা নিয়ে আসলো।
বিকেলে চা পর্ব টা খুব সুন্দর ভাবেই সম্পন্ন হলো।
চা নাস্তা খাওয়া শেষ করে দীপার বাবা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।
মাগো তোমার সুখ দেখে খুব ভালো লাগছে। সবার সাথে মিলেমিশে থাকবা। শ্বশুর শাশুড়িকে নিজের বাবা-মা মনে করে সেবা যত্ন করবা।
এই ব্যাগের মধ্যে তোমার বই খাতা আর সার্টিফিকেট গুলো আছে। যত কিছুই করো, পড়াশোনাটা বাদ দিও না মা। পড়াশোনাটা শেষ করো, তোমার কাছে এই একটাই আবদার আমার।
ছোট্ট এই কথাটা বলতে যেয়ে দীপার বাবার গলা ধরে এলো।
মতিন সাহেব দেখলেন পরিবেশ ভারি হয়ে আছে।
পারলে দীপাও কেঁদে ফেলে।
তিনি ওদের কথার মাঝখানে বলে উঠলেন, এখন যাবেন মানে?
কোন যাওয়া যায়ি নাই । দুপুরে কি খাইছেন না খাইছেন, আমি বাসায় ছিলাম না।
আমি বাজার সদাই করব।
দীপা মা রান্না করবে।
দুই বেয়াই একসাথে বসে খাবো।
কালকে যাবেন।
দীপার বাবা ধরা গলায় বললেন, যাওয়ার অনুমতি দেন বেয়াই সাহেব, আবার আসবো। একদিনের ছুটি নিয়ে এসেছি। সকালে স্কুল আছে, টিউশনি আছে , আমার যাওয়াই লাগবে।
কোনো ভাবে একটা দিন থাকা যায়না?
সম্ভব হলে অবশ্যই থাকতাম। রিকোয়েস্ট করা লাগত না।
আপনি শুধু আমাকে কথা দেন, মেয়েটাকে নিজের মেয়ে মনে করে পড়াশোনাটা করাবেন। আমার কোন ছেলে নেই। আমার তিন মেয়েকে আমি আমার তিনটা ছেলে মনে করি। আমি চাই ওরা পড়াশোনা শিখে মানুষের মত মানুষ হোক, নিজের পায়ে দাঁড়াক।
কথা দিলাম বেয়াই সাহেব, কালকেই আমি খোঁজখবর নিয়ে কাছাকাছি কোন কলেজে ভর্তি করে দেবো। দীপা তো আমার নিজেরই মেয়ে। ওকে নিয়ে আপনার কোন চিন্তা করতে হবে না। এখন থেকে ওর সব দায়িত্ব আমাদের।
আলহামদুলিল্লাহ, খুব শান্তি পেলাম। আমার আর কোন চিন্তা নেই।
আম্মাজান আমার যাওয়ার সময় এভাবে কান্নাকাটি করোনা।
ভালোভাবে থেকো।
আমাদের জন্য দোয়া করো । পড়াশোনাটা ঠিকমতো করো।
আল্লাহ হাফেজ।
********************
দীপার বাবা চলে যাওয়ার পর, দীপার শাশুড়ি প্রচন্ড ক্ষোভে ফেটে পড়লো।
কলেজে ভর্তি করবা মানে কি? আমার সাথে আলোচনা না করে তুমি কথা দেওয়ার কে?
ঘরের বউ কাজকর্ম বাদ দিয়ে কলেজ করবে। বন্ধু বান্ধব নিয়ে ফুর্তি করবে। এটা কোন কথা!
বাদলের মা তুমি ভুলে যাচ্ছো তোমার কঙ্কা ও বিয়ের পর পড়াশোনা করছে, ভার্সিটিতেও যাচ্ছে । তাহলে তোমার ছেলের বউ পড়লে সমস্যা কোথায়?
তুমি কার সাথে কার তুলনা করছো! আমার মেয়ে আর ছেলের বউ এক হলো?
দীপার এমনিতেই প্রচন্ড রকম কান্না পাচ্ছে। ইচ্ছে করছে নিজের রুমে গিয়ে দরোজা বন্ধ করে হাউমাউ করে কাঁদতে। তার ওপরে তার শাশুড়ি মায়ের আচরণে সে হতভম্ব। গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠা কষ্ট টা কোন রকমে গিলে ফেলে বললো,
আম্মা আপনি টেনশন করবেন না। আমার তো ভোরে ওঠার অভ্যাস আছে। আমি ভোরে উঠে সব কাজকর্ম শেষ করে তারপর কলেজে যাবো। দরকার হলে সপ্তাহে দুইদিন বা তিনদিন যাবো। জরুরী ক্লাস না থাকলে বাসায় থাকবো।
মতিন সাহেব গর্জে উঠে বললেন,
কেন তোমাকে ভোরে উঠে সব কাজ করতে হবে কেন ?
এতদিন বাদলের মা সব করতো না।
এখন না হয় একজন মানুষ বেশি। তার জন্য কি সে পারবেনা আগের মত সব কাজ করতে!
কঙ্কা যখন ছিলো, সে তোএকাই সব কাজ করতো।
কঙ্কা তো ফিরেও তাকাতো না ।
ও পড়াশোনা নিয়ে ডুবে থাকতো।
আর তুমি তো সবকিছু গুছিয়ে দিয়ে যাবে, তাহলে সমস্যা কি?
দীপার শাশুড়ি অতিরিক্ত রাগে লাল হয়ে সে তার রুমে চলে গেল।
থাক আব্বা, আম্মা না চাইলে অশান্তি করার দরকার নেই।
আমি ঘরে বসে পড়াশোনা করে শুধু পরীক্ষাটা দেবো।ক্লাস করবো না।
শুধু শুধু এতো অশান্তি করার দরকার নেই।
আপনি যান, আম্মার রাগ ভাঙান।
দীপার চোখে ইদানিং খুব অল্পতেই পানি চলে আসে। ও বুঝতে পারছ না, এটা কি আনন্দের পানি, নাকি দুঃখের চোখের পানি ।
একেক ধরনের পানি একরকম হওয়া উচিত ছিল, দুঃখের চোখের পানি হবে একরকম, আনন্দের পানি হবে অন্যরকম। দীপা চোখের পানি মুছে নিজের রুমে চলে আসলো।
মনে মনে ভাবছে একটা ঘরের চার দেওয়ালের সুখ দুঃখে কত কাব্য রচিত হয় ।
কত গোপন আনন্দ অশ্রু লুকিয়ে রাখতে হয়। বাবা আমাকে কত সাপোর্ট দিচ্ছন। অথচ আমার স্বামী চুপচাপ। এমন একটা বাবা পেয়ে নিজেকে খুবই ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। অসংখ্য দুঃখের মধ্যে ও এখানে হঠাৎ হঠাৎ এমন সব সুখের ব্যাপার ঘটে যায় , যে
সব দুঃখ চাপা পরে যায় ।
বাথরুমের দরজা বন্ধ করে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে দীপা আবার কিছুক্ষণ কাঁদল।
********************
সকালে দীপা যখন নাস্তা বানাচ্ছে, তখন আব্বা আর মায়ের মধ্যে লাগলো তুমুল ঝগড়া।
এরা দুজন যে এভাবে ঝগড়া করতে পারে, তা দীপা কল্পনাও করেনি।
একবার ভেবে ছিলো ঝগড়ার ধাক্কাটা কমানোর জন্য সে কিছু বলবে। কিন্তু বাদল বাঁধা দিলো।
তুমি তোমার নিজের কাজ করো তো।
কিছুক্ষণ পর দেখবে আবার সব ঠিক হয়ে গেছে।
দীপা রান্না ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছে, তার শশুর চিৎকার করে বলছে,
কোথায় যাচ্ছো, তা জানতে পারি?
সাতসকালে ব্যাগ গুছাচ্ছ কেনো?
দীপার শাশুড়ি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে, নিজের কাজে অতিরিক্ত মনোযোগী হয়ে পড়ল।
কথা বলছো না কেন? তোমাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, উত্তর দাও?
আমি কংকার বাসায় যাচ্ছি। কদিন থাকবো। তোমাদের তো এখন আর কোন টেনশন নাই খাওয়া-দাওয়া নিয়ে, তোমার আদরের বউ মা আছে।
সে রান্না করে খাওয়াবে ।
আমার প্রয়োজন তো ফুরিয়েছে।
আমারতো আর কোন প্রয়োজন নাই এই সংসারে। তাই আমার কোন মূল্যায়ন ও নাই এই সংসারে। আমি এখন এ বাড়ির আগাছা।
এমন চেঁচাচ্ছো কেন?আস্তে কথা বলো।
চেঁচাব, চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলব।
কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই উনি ব্যাগ নিয়ে হন করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলেন।
****************
দীপার শাশুড়ির প্রচন্ড রকম মন খারাপ। মেয়ের শাশুড়ির কাছে প্রচন্ড রকম অপমানিত হয়ে সে বাসায় ফিরে আসতেছে। ট্যাক্সি তে বসে চোখের পানি মুছছে আর ভাবছে, এত টাকাওলা ঘরে মেয়েটা বিয়ে না দিলেও পারতাম। এরাতো মানুষকে মানুষ মনে করে না।
কি সুন্দর করে মুখের ওপরে বলে দিলো, রাতে আমাদের একটা পার্টি আছে ।
আপনি কি থাকবেন, না চলে যাবেন ?
কঙ্কাকে তো পার্লারে যেতে হবে সাজতে।
মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। মেয়েটা তার মায়ের অপমান সহ্য করতে না পেরে দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। থাকার ইচ্ছে থাকলেও চলে আসতে বাধ্য হলাম।
বিকেলবেলা শাশুড়িকে মুখ চোখ অন্ধকার করে ফিরে আসতে দেখে,দীপা যার পরনাই অবাক।
সে সুন্দর করে এক কাপ চা বানিয়ে, ঠান্ডা এক গ্লাস পানি আর ঘরে বানানো সিঙ্গারা নিয়ে শাশুড়ির রুমে গেলো।
মা কি হয়েছে, আপনার মন খারাপ কেন ?
আপনার যদি বলতে কোন সমস্যা না থাকে, তাহলে আমাকে নিজের মেয়ে মনে করে বলতে পারেন। দেখবেন অনেক হাল্কা লাগছে নিজেকে।
এতো কথা শোনানোর পর ও দীপার এমন আন্তরিক ব্যাবহারে তার চোখ ভিজে ওঠলো।
সে স্নেহার্ত কন্ঠে দীপাকে কাছে ডাকলো।
আমার কাছে আসো মা।
আমার পাশে বসো।
তুমি অবশ্যই পড়াশোনা করবে, নিয়মিত কলেজে যাবে।
এখন থেকে এই বাড়িটাকে তুমি তোমার নিজের বাড়ি মনে করবা। যা করতে মন চায় করবা।
আমার ভুল হয়েছে মা, আমাকে মাফ করে দিও।
কি বলছেন মা!
আপনি আমার গুরুজন, আমি কোন ভুল করলে বা আপনার মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে, আমাকে মাফ করে দিবেন।
তুমি কোন ভুল করনি মা।
ভুল আমি করছি, আমার অনেক অন্যায় হয়েছে।
তোমার বাবা গরিব জন্য, আমি তাকে মানুষ মনে করিনি।
তুমি আমাকে তোমার বাবার নাম্বারটা দিও, আমি নিজে বেয়াই সাহেবকে ফোন দিয়ে আসতে বলবো। তোমার যা মন চায় তুমি রান্না করে তোমার বাবাকে নিজে কাছে বসে থেকে খাওয়াবা।
তোমার বাবা যা যা খেতে পছন্দ করে আমাকে লিস্ট দিবা।
সুপার শপে গিয়ে আমি নিজে বাজার করে নিয়ে আসবো।
আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে, আমরা সবাই মানুষ।
মানুষ হিসেবে একজন মানুষের অধিকার আরেকজন মানুষের কাছে ভালো ব্যাবহার পাওয়া।
আমার আর কখনো এমন ভুল হবে না মা।
আমরা সবাই এখন থেকে একসাথে মিলে মিশে থাকবো।
দীপা আর দীপার শাশুড়ি মায়ের চোখের পানিতে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে।
মতিন সাহেব দরোজার ওপাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছে আর চোখের পানি মুছছে।
অথচ ঠোঁটে তার মিষ্টি হাসি ঝুলে আছে।
পরিশেষে আমরা চাই, প্রতিটা পরিবারে ভালোবাসার রং গুলো এভাবে বদলে উঠুক।
খারাপ, জটিলতা, কুটিলতার রঙ গুলো মুছে গিয়ে ভালোবাসার রঙে রঙিন হয়ে উঠুক প্রতিটি সংসার।
বি: দ্র: গল্পটা সামাজিক একটা গল্প।
যদিও কল্পনার রঙে রাঙিয়ে লেখা এ গল্প। তারপরও পাঠকের মন্তব্য আমাকে নতুন লেখার প্রেরণা যোগাবে।
আপানাদের কেমন লাগলো জানালে কৃতজ্ঞ থাকবো।
সমাপ্ত।