#পরবাসী মেঘ
পর্ব ১
‘ বৌমা , এটা তোমার ঘর। ‘ বলে আমার শ্বাশুড়ি যে ঘরটা আমাকে দেখালেন সেটাকে দেখে আমার প্রথম উপলবদ্ধি হলো যে ব্যাচেলর রুম আর ঘর বলতে যা বোঝায় তার মধ্যে বোধহয় সামান্য পার্থক্য আছে।
টাওয়ালটা বিছানার উপর পড়ে আছে, বাইরে যাওয়ার জুতা পড়ে আছে খাটের পাশে, ল্যাপটপ বই মিলে চুড়ান্ত আগোছালো টেবিল , কাপড় চোপড়, অন্যান্য জিনিসপত্রের কথা আর নাই বলি। এই ঘরে আমাকে থাকতে হবে এটা চিন্তা করে আমার গায়ে জ্বর চলে আসলো।
শাশুড়ি আমার অবস্থা দেখে হেসে ফেললেন, ‘তোমার ঘর তোমাকেই গোছাতে হবে । লন্ডনে কাজের লোক পাবে কোথায় ? আমি আগে আসলে অবশ্য আর একটু গোছানো পেতে। তা যখন হয়নি জিনিসপত্র একপাশে সরিয়ে চেন্জ করে শুয়ে পড় আজকের রাতের মতো । কাল গোছানোর কথা চিন্তা করো। লম্বা ফ্লাইট । কম ধকলতো যায়নি। ‘একদমে কথাগুলো বলে উনি একটু থামলেন ,তারপর আবার বললেন, ‘প্যাসেজের ঐ পাশের রুমটা আমার । ‘ ইঙ্গিতে দেখলেন। ‘ কোনোকিছুই দরকার হলে নক করো। ‘
নতুন দেশের একটা অগোছালো রুমে আমাকে একা রেখে চলে গেলেন আমার শাশুড়ি । বিছানার উপরের ছড়িয়ে থাকা কাপড়চোপড়গুলো ঘরের এক কোনে পড়ে থাকা ছোট্ট সিঙ্গেল সোফায় কোনোরকম সরিয়ে রেখে খাটের উপর ধপ করে বসে পড়লাম । শরীর ভেঙে আসছে । মনে হচ্ছে এখনি ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু যার ঘর যার জন্য আমার এই সাত সমুদ্রের ওপারে আসা তার সাথেই তো এখোনো দেখা হলো না ।হোক অগোছালো ঘর কিন্তু ঘরের মালিক তো থাকবে।
এ্যায়ারপোর্টে ছিল না দেখে ভেবেছিলাম কোনোকারনে কোথাও আটকে গেছে ।হয়তো বাসায় থাকবে।
নিজেকে কেমন যেন অনিমন্ত্রিত অনাকাঙ্ক্ষিত লাগছে ।
আমার দুই চাচাতো বোনের দেশের বাইরে বিয়ে হওয়ার পর বাবার মনে হয়েছিল আমাকে বিদেশে বিয়ে না দিলে তার ভাইদের কাছে তার মান সম্মান থাকবেনা। তাই বিদেশে থাকা বিদেশে বড়ো হওয়াসম্পূর্ণ অজানা ছেলের সাথে তড়িঘড়ি করে আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন।
অজানা অচেনা কথাটা মা বলায় বাবা ভ্রু কুচকে বললেন , ‘অচেনা কোথায় রফিক সাহেবের বন্ধুর ছেলে। ‘আমার গম্ভীর বাবার ঐ ভ্রু কোচকানোটাই অনেক ।আমার ভিতু মা আর কথা বাড়ানোর সাহস পেলেননা।
তিরিশ বছর আগে দেশ ছাড়া অফিস কলিগের বন্ধু । আর সেই বন্ধুর বিদেশে জন্মানো বেড়ে ওঠা ছেলে পরিচিতই বটে! এই হাস্যকর কথা বাবাকে বলার মতো সাহস কারো না থাকায় বিয়েটা হাসি মুখে মেনে নিতে হলো।
আর বিয়ের মাত্র সাতদিনের মাথায় শোয়েব আমার স্বামী লন্ডনে ফিরে যান। চলে যাওয়ার পর মাঝে কয়েকবার ফোন দিয়েছে। কোনদিনই পাচঁ মিনিটের বেশি কথা হয়নি । কিংবা কয়েকমিনিট পর আমাদের কথা ফুরিয়ে যেত।
আমার শ্বশুর শাশুড়ি অবশ্য দুই মাস থেকে আমার পাসপোর্টভিসা করেছেন।আর আমাকে সাথে করে নিয়েও এলেন আজ ।
আসার সময় এ্যায়ারপোর্টে এসেছিলেন বাবা মা আর আমার ছোট ভাই রন্জন।বাবাকে দেখলাম চশমার ফাক দিয়ে চোখ মুছতে । মা আর রন্জনকে ধরে আমিও অনেক কাদঁলাম কিন্তু বাবার পরে প্রচণ্ড রাগও হচ্ছিল । বাবা না চাইলে সবাইকে রেখে এই বিদেশে যাওয়া লাগতো না আমার ।
এখন অবশ্য এই একা ঘরে বসে সবার জন্যই অনেক খারাপ লাগছে। কখন যে চোখ দিয়ে পানি পড়া শুরু হয়েছে খেয়ালই করিনি।
চোখের পানি মুছে একটু শক্ত হতে চেষ্টা করলাম । ল্যাগেস খুলে একটা সালোয়ার কামিস বের করে চেন্জ করে ফ্রেশ হয়ে নিলাম । আটার্চড না হলেও রুমের পাশেই বাথরুম।আমার শাশুড়ি বাথরূমটা প্রথমেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন তাই অসুবিধা হলো না।
ফ্রেশ হওয়ার পর এতো ঘুম আসছে কিন্তু আরেকজনের বিছানায় এভাবে ঘুমাতে খুব অসস্তি লাগছিল । ঘরের মাঝখানে দাড়িয়ে সাতপাচ ভাবছি । এসময় প্যসেজে পায়ের শব্দ পেলাম । দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো শোয়েব ।
আমাকে দেখে একটু অবাক হলো মনে হলো । তারপর নিজেকে সামলে কেমন যেন প্রানহীন গলায় বললো, ‘ হোয়াট এ সারপ্রাইস! তুমি চলে এসেছো! আই থট তুমি টুমওরো আসবে। ‘
সত্যি কি ওকে কেউ বলেনি নাকি ভান করছে বুঝতে পারলাম না। কিন্তু কোনো অনুযোগ করলাম না কারন অনুযোগের সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি আমাদের । শুধু একটু আড়ষ্ঠ হাসলাম ।
‘ লং জার্নি ছিল । ভেরি টার্য়াড তুমি না? ‘ ইংরেজি মিশ্রিত ভয়াবহ বাংলায় আবার বললো সে।
উত্তরে আবার হ্যা সুচক মাথা নাড়লাম । কেমন যেন আড়ষ্ঠ লাগছে।
‘ তাহলে তুমি রেস্ট করো। আমাকে একটু ল্যাপটপে বসতে হবে। আই নীড
টু ডু সাম ওর্য়াক। ‘আবার বললো সে।তারপর ল্যাপটপটা নিয়ে চলে গেল ।
বোঝাই গেল আমাকে দেখে একটুও খুশি হয়নি । একবার জিঙ্ঘেসও করলো না কেমন আছি আমি।স্রেফ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য কাজের বাহানায় চলে গেল।যদিও খুব বেশি কিছু আশা করিনি তবুও কেন যেন বুকের মধ্যে এক অদ্ভুদ শূন্যতা চেপে বসলো।
বিয়ের পর যে কয়েকটি দিন দেশে ছিল । প্রচুর আনুষ্ঠানিকতা, দাওয়াত আর ব্যাস্ততায় কেটেছে । আত্মীয়স্বজনের ভিড়ে খুব বেশি সময় ওর সাথে একা হওয়ার সুযোগ বা ইচ্ছে কোনটাই ছিল না।তবু যেটুকু সময় একা হয়েছি একটু চুপচাপই ছিল।যেটাকে আমার এ্যারেন্জড ম্যারেজের সাইড ইফেক্ট মনে হয়েছে। তারপর মাত্র সাতদিনের মাথায় চলে গেল । এসেও খুব বেশি যোগাযোগ করেনি। তার ব্যাখ্যা ছিল পিএচডির জন্য প্রপোজাল রেডি করছে বিভিন্ন জায়গায় এ্যাপলাই করছে।অনেক ব্যাস্ত ।
কিন্তু আজকের আচরন দেখে ব্যাস্ততাটাকে মিথ্যে বাহানা মনে হচ্ছে । কান্না আসছে ।মনে হচ্ছে দৌড়ে আম্মার কাছে চলে যাই ।কিন্তু কোথায় আম্মা ! সাত সমুদ্রের ওপারে ! এসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে কখন যে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে গেছি আমি নিজেও জানিনা।
ঘুম ভাঙলো নকের শব্দে । তাড়াহুড়া করে উঠে ওড়না গায়ে জড়ালাম। পাশে তাকালাম । না রাতে সে রুমে আসেনি । দরজা খুলে দেখি আমার একমাত্র দেবর শোভন দাড়িয়ে । ‘সরি,তোমার ঘুম ভাঙালাম । মা তোমাকে নীচে ডাকছে ব্রেকফাস্টের জন্য । ‘হাসিমুখে বললো সে।
সকালবেলা ওর হাসিমুখ দেখে ভালো লাগলো । বললাম ফ্রেশ হয়ে নীচে আসছি।
নীচে এসে দেখি ।সবার নাস্তা শেষ । শুধু শোভন পাউরুটিতে বাটার লাগাচ্ছে ।
‘ ভাবি এসো আমার সাথে ব্রেকফাস্ট করো। ‘ হাসিমুখে ডাকলো সে।শোয়েবর মতো
শোভনের বাংলায় ইংরেজি টান নেই বললেই চলে।বেশ পরিষ্কার বাংলা বলে ও। কিচেনের ভেতরেই বিশাল ডাইনিং টেবিল । কিচেন থেকেই বাগানে যাওয়ার দরজা । শোয়েব দেখলাম বাগানে হাটছে মোবাইল কানে।
আমার শাশুড়ি টোস্টার থেকে বের করে আমার দিকে পাউরুটি এগিয়ে দিলেন সাথে ডিম পোচ ।বললেন ওনার নাকি ডায়াবেটিক আছে উনাকে টাইমলি খেতে হয়। তাই উনি খেয়ে নিয়েছেন । আর আমার শ্বশুর সকালেই বেরিয়েছেন বাজার করতে। অনেকদিন বাংলাদেশে থাকার কারনে বাসায় বাজার তেমন কিছু নেই । এই কয়েকমাস শোয়েব শোভন বাইরেই খেয়েছে।তাই বাসা একদম ফাকা।
আমি কিছু না বলে খেয়ে নিলাম । খেয়াল করলাম খাওয়া শেষে শোভন নিজের প্লেট নিজেই ধুয়ে রাখলো।তাই আমিও নিজের প্লেট ধুয়ে রাখলাম ।
শ্বশুর বাজার নিয়ে এলে শাশুড়িকে যতটা পারলাম সাহায্য করলাম । আজ রবিবার হওয়া সবাই বাসায় । তাই শাশুড়ি অনেক কিছু রান্না করলেন। রান্নার সময় পাশে থেকে সাহায্য করলাম । দেখলাম খুশি হলেন উনি। দুপুরে খাওয়ার পর উপরে এসে শোয়েবর রুম (কোনমতেই নিজের রুম বলে ভাবতে পারছিনা )যতটা সম্ভব গুছিয়ে ফেললাম । কিন্তু নিজের জীনিষ রাখার মতো জায়গা পেলাম না । তাই লাগেজ থেকে কিছুই বের করলাম না। কে জানে হয়তো আমাকে এভাবেই বাংলাদেশে চলে যেতে হবে। দুপুরে ডাইনিং টেবিলে সে থাকলেও কারো সাথে খুব বেশি কথা বলল না।চুপচাপ খেয়ে চলে গেল। সে তুলনায় শোভন অনেক হাসি খুশি । সে একাই বকবক করছিল ।
গোচগাছ করতে বেশি সময় লাগলো না আমার । দুপুরে ঘুমানোর অভ্যাসও নেই আমার । কি করবো ভাবছি। হঠাত বাগানের কথা মনে হলো। ভাবলাম খোলা বাতাসে গিয়ে একটু হাটবো।
কিচেন থেকে বাগানের দরজা । দেখি শোয়েব ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে টেবিলে ।আমি কিছু না বলে বাগানে চলে এলাম ।
জুলাই মাস। একদম ঠান্ডা নেই ।এখন নাকি এখানে সামার । কয়েকমাস পরেই নাকি শীত পড়বে। এসব আমাকে শোভন বলেছে ।
ভারি সুন্দর করে সাজানো বাগান এদের। বিভিন্ন জাতের ফুল দিয়ে ভরা । একটা আপেল গাছও আছে। একপাশে একটা দোলনা ভারি সুন্দর । গাছপালা আমার ভীষন প্রিয় ।তারপর এতো সুন্দর বাগান
কিন্তু তারপরও আমার মন ভালো হচ্ছে না।কি এক ভীষন অস্হিরতা যেন ধাওয়া করছে আমাকে । কি করবো ? কাকে জিঙ্ঘেস করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা।
আম্মা আব্বা কে এখনি কিছু বলে চিন্তায় ফেলতে চাইছিনা। কয়েকটা দিন দেখি না কি হয়। কিচেনের দিকে তাকালাম একবার একমনে ল্যাপটপে কাজ করছে।
আমার কোনো অস্তিত্বই যেন নেই তার কাছে ।একি করলেন আব্বা। মাত্র উনিশ বছর বয়স আমার । অর্নাস ফাস্ট ইয়ারে ভর্তি হয়েছিলাম । কি দরকার ছিল এতো তাড়াহুড়া করে বিয়ে দেবার । নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো আমার।
চলবে……
পরবাসী মেঘ সম্পূর্ণ গল্পের লিংক