#পরবাসী মেঘ
পর্ব ২
লন্ডন এসেছি প্রায় দুই সপ্তাহের মতো। বাসার সবাই মোটামুটি ব্যাস্ত আমি ছাড়া । আমার শ্বশুর একটা ছোটখাটো ট্রাভেল শপ চালায়। উনি সপ্তাহের ছয়দিন সকালে বের হয়ে রাত আটটার আগে ফিরেন না। শ্বাশুড়ি একটা স্কুলে চাকরি করেন ।সপ্তাহে পাচদিন। বিকেল পাচটার মধ্যে ফেরেন । শোভন কেবল ইউনিভার্সিটি শুরু করেছে । মেডিসিনে পড়ে সে।রবিবার বাদে সে সব সময় ব্যাস্ত ।মাঝে মাঝে রবিবারও তার দেখা পাওয়া যায় না। পুরা পরিবারে সে যেন এক খোলা দখিনা জানালা। প্রানপ্রাচুর্যে ভরপুর । যত সময় বাসায় থাকে হাসছে গল্প করছে। আমার সাথে ইতিমধ্যেই বেশ ভাব হয়ে গিয়েছে ।
শোয়েব অবশ্য বেশিরভাগ সময় বাসায়ই থাকে । কিন্তু তার থাকা না থাকা সমান ।নীচের স্টাডিতে থাকে প্রায় পুরাটা সময় । খাওয়ার সময় ডাইনিং টেবিলে এসে খেয়ে যায়। তারপর আবার স্টাডিতে। আমার শাশুড়ির কাছে শুনেছি পিএচডির জন্য আ্যাপলাই করছে বিভিন্ন জায়গায়। এই জন্য ব্যাস্ত অনেক। তাছাড়া সপ্তাহে দুই দিন একটা কফি শপে পার্টটাইম কাজও করে।
মাঝেমাঝে টুকটাক জীনিষ পত্র নিতে রুমে আসে । আমার সামনে ভুল করে পড়ে গেলে অল্প পরিচিতের মতো মাপা হেসে কখনো হ্যালো বলে না হলে “আর ইউ ওকে?” টাইপ কিছু । আমি প্রথম প্রথম উত্তরে একটু হাসতাম। ইদনিং কোনো রেসপন্স করি না।
আদিমকালে মানুষ যখন গুহায় বাস করতো। তখন বাইরে খাবারের সন্ধানে বা নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া বের হতো না। তারপর প্রয়োজন শেষ হলেই আবার গুহায় ঢুকে যেত । মাঝে মাঝে আমার মনে হয় শোয়েবের মধ্যেও সেই গুহামানবের বৈশিষ্ট্য পুরা মাত্রাই আছে।
আব্বা আম্মা কে এখনো কিছু জানায়নি। কেন যে জানাচ্ছি না নিজেও বুঝতে পারছিনা।আসলে আমার সময় দরকার ঠান্ডা মাথায় সব কিছু ভালোভাবে চিন্তা করার। মনে হচ্ছে আব্বা জানার সাথে সাথে দেশে নিয়ে আমাকে আবার বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করবে। কোনোমতেই আব্বাকে আর আমি আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে দিতে চাইনা ।
কিন্তু পড়াশুনা শেষ হয়নি আমার। দেশে ফিরে গিয়ে যে কোনো একটা চাকরির চিন্তা করবো। তারও উপায় নেই ।
আব্বাকে যতটা চিনি কোনোমতেই আমাকে পড়াশুনা শেষ করতে দেবেননা। মেয়েদের চাকরির কথা তো চিন্তাই করতে পারেননা উনি।
কিন্তু অবস্থার যদি কোনো পরিবর্তন না হয় তাহলে এখানে আমি আর কতদিন থাকতে পারবো তাও বুঝতে পারছিনা । আমার পক্ষে নিজ থেকে যেয়ে ওর সাথে কোনো রকম সদ্ভাব তৈরি করাও সম্ভব নয়। আমার শাশুড়ি অবশ্য সুযোগ পেলেই চেষ্টা করেন ছুতোনাতা দিয়ে ওর কাছে পাঠানোর । পুরানো রেসিপি বোধহয় নতুন জেনারেশনের কাছেও পুরানো হয়েছে। আর কোনো পক্ষ থেকেই যদি কেউ নাএগোয় তাহলে কোনো কিছুই কি কাজ করে?
আমার মনে হয় সবসময় আমাকে কেন এগিয়ে যেতে হবে। আমাকে তো সে বিয়ে করেছে । বোঝাই যাচ্ছে আমার শ্বশুর শাশুড়ি জোর করে বিয়ে দিয়েছেন। তাতে আমার কি দোষ? বিয়েতে যদি মত নাই থাকবে তাহলে বিয়ে করার দরকার কি ছিল। আর বিয়ে যখন করেই ফেলেছে তাহলে কেন এই নাটক?
এভাবেই যদি চলতে দেওয়া হতো তাহলে হয়তো অনন্তকাল চলতো। কিন্তু আমার শ্বশুর ব্যাপারটা পছন্দ করলেন না। একদিন রাতে ডিনারের পর উনি সরাসরি স্টাডিতে চলে গেলেন ।আমি তখন রান্নাঘরে শাশুড়ি কে রান্না ঘর পরিষ্কারে সাহায্য করছিলাম । আমার শ্বশুর এমনিতেই আস্তে কথা বলেন । শোয়েবও তাই । কিচেনের পাশেই স্টাডি হলেও তাই কিছু শুনতে পেলাম না।
আমি যখন শাশুড়ি কে সাহায্য শেষে উপরে চলে আসলাম তখনও আমার শ্বশুর স্টাডিতে । দরজা বন্ধ ।
কি কথা হলো জানিনা কিন্তু শোয়েব রাত এগারোটার দিকে ল্যাপটপ সহ রুমে ঢুকলো ।আমাকে অবাক্ করে বললো সে রাতে এখানেই ঘুমাবে। তারপর ল্যাপটপ নিয়ে টেবিল চেয়ারে বসে গেলো । ভাবলাম গুহামানব না এই রুমটাকেই আবার গুহা বানিয়ে দেয়।
দেশে আমারা একি রুমে ঘুমিয়েছি ।ব্যাপারটা নতুন নয়। তবু কেন যেন অসস্তি লাগলো । এতোদিন পুরা বিছানা নিয়ে ঘুমিয়েছি । আজ থেকে স্পেস কমে গেল। বিছানার এক কোনে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে গেলাম আমি ।
সকালে চোখ খুলেই ওর দিকে চোখ পড়লো প্রথম । কখন যে পাশে এসে ঘুমিয়েছে রাতে আমি কিছুই টের পাইনি। ঘড়ির দিকে তাকালাম নয়টা বাজে । এতোসময়ে সবাই বেরিয়ে গিয়েছে। তবু আজ বেশি সময় শুয়ে থাকতে লজ্জা লাগলো ।
উঠে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নিলাম ।
অন্যদিন শোয়েব স্টাডিতে থাকে। ব্রেকফাস্ট বা লানচ ও খেয়েছে কি খায়নি তার কোনো খবর নেওয়ার প্রয়োজন পড়েনি । কিন্তু আজ একা ব্রেকফাস্ট করতে কেমন যেন লাগলো । তাই নীচে নেমেও আবার রুমে ফিরে আসলাম সে উঠেছে কিনা দেখতে। এসে দেখি ও বাইরে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে ।
“ ব্রেকফাস্ট রেডি করবো ? “অনেক দ্বিধা নিয়ে জিঙ্ঘেস করলাম ।
“ডোন্ট অরি । আমার এ্যাপয়ন্টমেন্ট আছে ।আই নিড টু গো। “
“ কফি বানিয়ে দেই তাহলে । “
মনে হলো যেন একটু বিরক্ত হলো তারপর নিজেকে সামলে নিল । ঘড়ি দেখলো । বললো , “টেন মিনিট আছে।আই ডোন্ট থিংক আমি কফি ফিনিশ করতে পারবো।”তারপর কিছু না বলে চলে গেল সে।
আমি আর নীচে ব্রেকফাস্ট করতে গেলাম না চুপচাপ রুমে বসে থাকলাম । নীজেকে খুব অসহায় লাগলো ।অপমানিত বোধ করলাম অনেক । এই সেইম কথা হাসিমুখে বললে বোধহয় এতো খারাপ লাগতো না। মনে হলো এখনি আব্বা আম্মা কে কল করে সব সত্যি জানাই। কিন্তু কিছুই করলাম না চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে কখন যে শুয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছি নিজেই জানিনা । ঘুম ভাঙলো বিকেলে সারা গায়ে অসহ্য ব্যাথা মাথা ভার হয়ে আছে আমার । সরাদিন কিছু না খাওয়ায় শরীরও দুর্বল লাগছে । কাকে ডাকবো কাকে বলবো নিজের অসুস্থতার কথা। তার চেয়ে আবার শুয়ে পড়লাম । বুঝলাম জর আসছে সমস্ত গা কাপিয়ে।
কত সময় এই অবস্থায় ছিলাম জানিনা । হঠাত মনে হলো কেউ যেন গায়ে হাত দিয়ে ডাকছে। চোখ খুলে দেখি আমার শাশুড়ি ।
“ কি হয়েছে তোমার ? জ্বর এসেছে নাকি ? “ কপালে হাত রাখলেন উনি। তারপর যেয়ে থার্মোমিটার নিয়ে এলেন। গম্ভীর মুখে জ্বর মাপলেন।
“ অনেক জ্বর তো তোমার ! আমাকে কল করনি কেন? দাড়াও প্যারাসিটামল নিয়ে আসি। “ একদমে কথাগুলো বলে প্যারাসিটামল আনতে চলে গেলেন আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে। মনে হলো আপাতত দৃষ্টিতে শক্ত মনে হলেও মহিলার মন নরম।
প্যারাসিটামলের সাথে এক গ্লাস দুধ নিয়ে এলেন ।
দুধ আমার দুই চোখের বিষ তবুত্ত উনি কস্ট করে নিয়ে এসেছেন দেখে খেয়ে নিলাম । তাছাড়া মায়ের সাথে অনেক নখরা অনেক আবদার চলে শাশুড়ির সাথে কি চলে?
“ তুমি রেস্ট নাও। আমি রাতে ডিনারের সময় তোমাকে ডাকবো।খেয়ে আরেকবার প্যারাসিটামল খেতে হবে। “
খেতে ইচ্ছে করছিল না কিন্তু আমার শাশুড়ির জোরাজুরি তে খেতেই হলো।প্যারাসিটামল খাওয়ার পর সোজা রুমে পাঠিয়ে দিলেন। প্লেট ধুতে গিয়েও বকা খেলাম আমি ।
উনার এই কেয়ার আমাকে আম্মার কথা মনে করিয়ে দিল।
ঐদিন বেশ রাত করে ফিরলো শোয়েব ।সারাদিন ঘুমানোর কারনে রাতে ঘুম আসছিল না আমার । ঘড়ি দেখলাম রাত একটা । ঘরে টেবিল ল্যাম্প জলছিল । ফ্রেশ হয়ে ল্যাপটপে কি যেন চেক করলো তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়েছি ভেবে আমার পাশে এসে খুব সাবধানে শুয়ে পড়লো। আমার কিছুতেই রাতে ঘুম এলো না। সারারাত একা জেগে রইলাম । ভোরের দিকে আবার জ্বর এলো।
সকালে আমার শাশুড়ির ডাকে ঘুম ভাঙলো। বকা দিলেন অনেক প্যারাসিটামল না খাওয়ার জন্য। শোয়েব কেও ঘুম থেকে উঠিয়ে বকা দিলেন ।
“ মেয়েটার এতো জ্বর একটু খেয়াল রাখতে পারিসনি? “
“ওর জ্বর ! হাউ ডু আই নো? জিপিতে নিয়ে যাও ।“ঘুম থেকে ডেকে তোলায় ভীষন বিরক্ত হলো সে। উঠে বাথরুমে চলে গেলো সে।
আমি জ্বরে মাথা উচু করতে পারছিনা ।কোনোরকমে বললা,”আপনি চিন্তায় করবেন না। আমি একদম ঠি.ক আছি। আমার আসলে অল্পতে বেশি জ্বর ওঠে।দুদিন প্যারাসিটামল খেলেই নেমে যাবে।”
“মাত্র দেশ থেকে ফিরলাম লম্বা ছুটি কাটিয়ে এখন তো হুট করে ছুটি দিবে না স্কুল থেকে ।এদিকে তোমার যে অবস্থা । কি যে করি?”
” আপনি চিন্তা করবেন না । কোনো সমস্যা হলে আমি আপনাকে কল করবো। ”
আমার শাশুড়ি কে আসস্ত করলাম আমি । উনি কিছু সময় দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভুগে তারপর স্কুলে চলে গেলেন । যাওয়ার আগে আমাকে ওষুধ খাইয়ে গেলেন সাথে খাবারও ।কিছু স্নাকস আর এক্সট্রা প্যারাসিটামলও রেখে গেলেন রুমে যেন আমাকে কষ্ট করে নীচে যেতে না হয় ।
আধাঘন্টা পর জ্বর নেমে গেলো আমার । কাল থেকে শুধু শুয়ে আছি ।ভাবলাম বাগানে গিয়ে একটু বসি ।এসময় বাসায় কেউ থাকে না। আম্মার সাথে একটু কথা বলবো নিরিবিলে। দুদিন ফোন দেওয়া হয়না । টেনশন করবে।
নীচে যেয়ে দেখি সে বাগানের টেবিল চেয়ারে বসে ফোনে কথা বলছে কারো সাথে । আমাকে দেখে মনে হলো ফোন রেখে দিল। আমার কেন জানিনা প্রচণ্ড রাগ হলো । সোজা সামনে গিয়ে দাড়ালাম ।নিজের উপর কন্ট্রোল হরালাম পুরোপুরি ।
” আমাকে যদি আপনার এতই অপছন্দ তবে বিয়ে করেছিলেন কেন বলুন তো। ”
”আমি তো তোমাকে বিয়ে করিনি আমাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে জোর করে। ” খুব শান্ত স্বরে জবাব দিল । পুরা কথাটা বাংলায় বললো । প্রশ্নটার জন্য মনে মনে প্রস্তুত ছিল মনে হলো।
” আপনি তো বাচ্চা ছেলে না যে আপনাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হলো আর আপনি করে ফেললেন। দেশে তো ছিলেন সাত দিন । তখনও তো বলতে পারতেন আমাকে । কেন বলেননি ? বললে আমি কোনমতেই আপনার আব্বা আম্মার সাথে এই দেশে আসতাম না।”একদমে এতোদিনের জমানো কথাগুলো বললাম ।
”মাই ব্রেইন কাজ করছিল না। এ্যান্ড আই থট ইউ গেট ম্যারিড ফর দা পাসপোর্ট। ”
” পাসপোর্ট ? পাসপোর্ট দিয়ে আমি কি করবো ?” বপাসপোর্টের জন্য যে কেউ কাউকে কেন বিয়ে করবে। ভীষন অবাক হলাম আমি ।
”আমার ক্লোজ ফ্রেন্ডের সাথেই এটা ঘটেছে । ওর ওয়াইফের পাসপোর্ট হয়ে যাওয়ার পর ওকে ডিভোর্স করেছে । আর ওর বয়ফ্রেন্ড কে দেশ থেকে এনেছে । ” জোর দিয়ে বললো সে।আমি বিস্ময়ে ভাষা হারিয়ে ফেললাম ।
”তুমি প্রোবাবলি বিয়ে করেছো সেইম রিজনে। ” আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে আবার বললো সে।
চলবে…
.
.