#পরবাসী মেঘ
পর্ব ৩
প্রায় তিন দিনের বেশি হয়ে গেল আমার জ্বর কমছেই না। শোয়েব ছাড়া বাড়ির সবাই একটু হলেও টেনশনে পড়ে গেলো । এদিকে আমার জিপি রেজিস্ট্রেশন করা হয়নি। এদের কাছে শুনে যতটা বুঝলাম জিপি হলো এখকার লোকাল ডাক্তার । সমস্যা হলো এরা রেজিস্ট্রেশন ছাড়া দেখবে না। আমার শ্বশুর বাড়ির কাছের জিপিটা নয়টা পাচটা খোলা থাকে শুধু । এসময় গিয়ে রেজিস্ট্রেশন ফর্ম আনতে হবে আবার জমা দিতে হবে। এসময় বাসার সবাই যে যার কাজে থাকে ।কে করবে? শেষে আমার শাশুড়ি তার স্কুলে বলে অর্ধেকদিন ছুটি নিয়ে আমার রেজিস্ট্রেশন করলেন। কিন্তু তারপরও সমস্যা, পনেরও দিনের মধ্যে কোনো এ্যাপয়ন্টমেন্ট দিতে পারবেনা ওরা ।
অনেক ঝামেলা করে শোভন শেষে ওর এক বাঙালি বন্ধুর সদ্য পাশ করা বড় ভাইকে ধরে আনলো। সে এসে চেক করলো । নরমাল ফ্লু । হালকা ইনফেকশ আছে গলায় কিন্তু এখনি এ্যান্টিবায়োটিকের দরকার নেই।প্যারাসিটামলটা একটু নিয়মিত খেতে হবে।
আমার যদিত্ত জ্বর চলে গিয়েছিল তবুও দুই তিনদিন পর আবার এসে চেক করে গেল সে।শোয়েবের কাছাকাছি বয়স ইয়াং ডাক্তারটির ।নাম রেজোয়ান। শোভনের মতোই হাসিখুশি। আমার শাশুড়ি খুব পছন্দ করলেন ডাক্তারটাকে। দ্বীতিয় দিন যখন আসলো তখন রাতের খাবার না খাইয়ে ছাড়লেন না। ডিনারের পরও বেশ কিছুসময় বসলো।
জ্বর চলে গেলেও শরীর অনেক দুর্বল আমার । আমি কোনো রকম মুখে কিছু দিয়ে রুমে চলে আসলাম ।
আমার শরীর খারাপের পুরো সময়টা শোয়েব ছিল নির্লিপ্ত । আমার কোনো কিছুতেই যেন কিছু যায় আসে না তার। আমি মনে মনে ভাবলাম মানুষটা কি পাথরের।
সেই দিন পাসপোর্টের ব্যাপারটা শুনে আমি আরো অথৈ জলে পড়েছি । এই পাগোল কে নিয়ে কি করবো আমি । ওকি আসলেই আমার সাথে সংসার করবে না। ওই দিন এতই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম যে আমি আর বেশি কিছু জিঙ্ঘেস করতে পারিনি।ভাবলাম আজ সরাসরি জিঙ্ঘেস করবো সে কি চায় ।
তবে আজ একটা জিনিস অবাক করেছে আমাকে ।এমনিতে আমার কোনো ব্যাপারে থাকে না সে। কিন্তু ডাক্তার যখন আমাকে চেক করছিল সে কাছাকাছিই ছিল ।
রাতে এখানে ঘুমালেও সে বাকি সময়টা তার গুহায় মানে স্টাডিতে থাকে। তবে সে আজ রুমে আসলো বেশ তাড়াতাড়ি।
“ ইয়ং ডাক্তারটারও কিন্তু পাসপোর্ট আছে। “গা জালানো হাসলো শোয়েব । “হি লুকস ইনটারেস্টেড ঠু”
“আপনার কি ধারানো বাংলাদেশের সব মেয়েরা দেশের বাইরে বিয়ে করে পাসপোর্টের জন্য। ইউকে পাসপোর্ট দেখলেই যার তার গলায় ঝুলে পড়ে।“ রাগে মাথা খারাপ হয়ে গেলো আমার । “আপনি আমার সাথে থাকতে চাননা । আমাকে আপনার পছন্দ হয়নি । সেটা সোজাসুজি বলুন। আমাকে মিথ্যে অপবাদ কেন দিচ্ছন? “
একটু চুপসে গেলো মনে হলো সে। ভেবেছিল আগের দিনের মতো আমি চুপ হয়ে যাব।
“ একটা কথা আজ আমি আপনাকে ক্লিয়ার করে বলতে চাই । পাসপোর্টের আর আপনার সাথে আমার বিয়ে এই দুটির মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই । আপনার বন্ধুর বউ তার সাথে কি করছিল তার সাথে প্লিজ আমাকে মেলাবেন না। আমি বিয়ে করে সংসার করতেই এসেছিলাম । সেটা যদি না হয় আমি দেশে চলে যাব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে । আপনি কি চান? “নিজেকে সামলে নিয়ে বাকি কথা গুলো বললাম ।
“ লুক,আই এ্যাম এ ফ্রি ম্যান। আমার পিএচডি এ্যাপলিকেশন এ্যাকসেপটেড হয়েছে। আমি আরো বিজি হয়ে যাবো ইন এ ভেরি ফিউ ডেইস। তুমি যদি পাসপোর্টের জন্য আমাকে বিয়ে নাও করে থাকো স্টি ল আমি রেডি না কারো রেসপন্সেবিলিটি নিতে । স্পেশালি এ্যাট দিস মোমেন্ট। “ খুব সহজ শান্ত গলায় কথাগুলো বললো সে।
আমার উত্তরে হয়তো হয়তো বলতে পারতাম ।তাহলে মাঝখান থেকে আমার জীবন নষ্ট করলো কেন?দেশে থেকে আমাকে কেন আনলো ?কিন্তু আমার কেন যেন মনে হলো লাভ নেই । যে আমাকে বোঝা মনে করছে তাকে আমি কি বলবো।
আমি শুধু খুব শান্তভাবে জিঙ্ঘেস করলাম । “ তাহলে আমি কি করবো এখন? “
“ইটস রিয়েলি তোমার উপর। দেয়ার ইস নো গ্যারান্টি আমি ইন ফিউচার তোমার রেসপন্সেবিলিটি নেবো। উই আর নট ইন লাভ । কোনো গ্যারান্টি এটারও নেই যে ইন ফিউচার আই উইল নট ফল ফর সামওয়ান এলস।আমি রিয়েলি সরি। “একটু থেমে কি যেন ভাবলো তারপর আবার বললো , “তুমি এখানে থেকে তোমার স্টাডিস কমপ্লিট করতে পারো পার্টটাইম কাজ করে। লিভ ইন দিস হাউস। তোমার একসপেন্স কম হবে। আমার প্যারেন্টসকে কিছু বলার দরকার নেই আপাতত । ইন ফিউচার তোমার অন্য কাওকে ভালো লাগতে পারে । সে অপশনও খোলা থাকছে। তোমার সাথে যে ইনজাস্টিস হয়েছে এটা তার কামপেনসেশন ধরে নাও।“
বলে কি লোকটা ?আমার মনে হচ্ছে আমি মনে হয় কোনো বলিউড মুভি দেখছি।কারন একমাত্র মুভিতেই এরকম অদ্ভুদ কথা শুনেছি। বাস্তবে না। বুঝতে পারছি না এই অবাস্তব কথার আনসার কি দেবো ।
মনে হচ্ছে লোকটা হয় হার্টলেস অথবা পাগোল । আর তাই যদি নাও হয় ।যেটাই হোক না কেন আমার মতো কনজারভেটিভ ফ্যামিলির মেয়ের পক্ষে এধরনের কথা চিন্তা করাও অসম্ভব ।
এরকম অদ্ভুদ পরিস্থিতি কি যে করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা ।যদি সরাসরি বলতো চলে যাও তাহলে ডিসিশন নেওয়া সহজ হতো। ওর ওই অদ্ভুদ প্রোপোজালের পরদিন আম্মা কে আমি সবকিছু না বললেও মোটামুটি বলেছি । কিন্তু আম্মা বলেছে একসাথে থাকতে থাকতে একসময় সব ঠি ক হয়ে যাবে। আমি যদি নিজে থেকে ডিভোর্স নিয়ে চলে আসি তাহলে আব্বার মান সম্মান থাকবে না।
আম্মাকে কি করে বোঝাবো যে সরাসরি অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্কের অপশন খোলা রাখছে এবং একই সাথে আমার অন্য পুরুষের সাথে সম্পর্কের অনুমতি দেয় তার সাথে আর যাই হোক সংসার করা যায় না।
একবার ভাবলাম শাশুড়ি কে বলি ।কিন্তু যেখানে আমার আম্মাই আমাকে সাপোর্ট করছেনা সেখানে শাশুড়ি কি তার ছেলের বিরুদ্ধে যেয়ে আমাকে সাপোর্ট করবে!
দ্বিধা দ্বন্দ্বে আরো কয়েকটি দিন কাটলো। একই ঘরে রাত কাটিয়েও দুজন দুই পৃথিবীতে বাস করি। ইদানীং আর কোনো আড়াল নেই আর কোনো মুখোস নেই তাই ও টুকটাক কথা বলে। যেমন” নীচে গেলে আম্মু কে বলো এক কাপ কফি বানিয়ে দিতে।” এই টাইপ । ধরেই নিয়েছে ওর অনৈতিক অযোক্তিক শর্ত আমি মেনে নিয়েছি।
এতদিন এখানে আমি আসলেও আমার শাশুড়ি কোনো দাওয়াতে নিয়ে যাওয়া বা কাওকে বাসায় ডাকা এই জাতীয় সামাজিক ব্যাপার গুলো এড়িয়ে গিয়েছেন। ওর আচারন দেখে আমার শাশুড়ির ভুল ধারনা হলো যে আমাদের মধ্যের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে ।তাই উনি আমাদের বিয়ে উপলক্ষে বাসায় একটা ছোটখাট পার্টির আয়োজনের প্লান করে ফেললেন। আমাকে এব্যাপারে জিঙ্ঘেস করলে আমি শোয়েবের সাথে কথা বলতে বললাম । কথা বললেন কিনা জানিনা কিন্তু উনি মহা উৎসাহে লোকজন দাওয়াত দেওয়া শুরু করলেন। বাসায় রান্না করবেন না তাই ক্যাটারিং সার্ভিস নিলেন । উৎসাহের চুড়ান্ত হিসাবে উনি আমাকে এখানকার এশিয়ান শপিংয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন । অনুষ্ঠানের জন্য শাড়ি কিনবেন। আমি কিছুতেই রাজি হলাম না অজুহাত দিলাম বিয়ের সময় ওনারা যে পরিমান শাড়ি দিয়েছেন তার কিছুই পরা হয়নি। তাছাড়া আমার বাবার বাড়ি আর আত্মীয় স্বজনের দেওয়া সব পার্টি শাড়িও আমি নিয়ে এসেছি । ওখান থেকে বাছাই করে একটা পরবো।
একটু মন খারাপ করলেও আবার বাসা ডেকোরেশন অনুষ্ঠানের অন্যান্য হাবিজাবি নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে গেলেন। সামনের রবিবার অনুষ্ঠান। আর মাত্র দুই দিন আছে।
আমার জ্বরের পর থেকে বউ শাশুড়ির দুরত্ব অনেক কমে গিয়েছে । ওই সময়টা অনেক কেয়ার করেছেন উনি । ওনাকে দেখে আমার সত্যি খারাপ লাগছিল ।। উনি কতই না খুশি । কিন্তু আসল সত্যটা জানলে মন একদম ভেঙে যাবে তার। ভাবলাম যতদিন আছি এখানে ওনাকে যতটা সম্ভব খুশি রাখার চেষ্টা করবো। স্নেহের ঋন কিছুটা হলেও যদি শোধ করতে পারি।
অনুষ্ঠানের দিন একটা সাদা জামদানি পরলাম। সাথে রুপার গহনা। শাশুড়ি এই বিদেশেও ফেক বেলি ফুলের মালা জোগাড় করে দিলেন খোপায় পরার জন্য । পার্লারে নিয়ে যেতে চাইলেন আমার শাশুড়ি । কিন্তু আমি ঘরে সাজতে চাইলে উনি আর বেশি কিছু বললেন না।
ছোট অনুষ্ঠান বললেও একশর বেশি মানুষ দাওয়াত করলেন আমার শ্বশুর শাশুড়ি । রাতে অনুষ্ঠান কিন্তু বিকেল থেকেই লোকজন আসা শুরু করলো। বাগানে চেয়ার টেবিল বসিয়ে লোকজন বসার ব্যাবস্হা করা হয়েছে। সবাই যে যার মতো খাবার উঠিয়ে হাতে নিয়ে খাবে।শোভন আর শোয়েব দুজনই পাজ্ঞাবী পরেছে। শোভন সাদা আর শোয়েব নীল। শোয়েব কে দেশি পোশাকে অনেক ভালো লাগছে । টকটকে ফর্সা না হলেও একমাথা কোকড়া কালো চুল আর গভীর চোখের শোয়েবের অন্য রকম আকর্ষন আছে। আমি নিজের স্বামিকেই দুইবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম লুকিয়ে । নিজের বুকের গহীনে কি একটু কষ্ট হলো ?জানিনা । নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।
“হ্যা তোমার বর তোমারই আছে । কেউ ছিনতাই করছেনা।” চমকে তাকিয়ে দেখি পিয়া , শোয়েবের চাচাতো বোন ।সম্প্রতি এদেশে মাস্টার্স করতে এসেছে । হাসতে হাসতে এদিকেই আসছে । এতো জোরে কথাটা বললো বেশি কেউ এখনো না আসলেও যারা এসেছে অনেকেই মাথা ঘুরিয়ে দেখলো ।
আমি শিউর শোয়েব শুনেছে । যদিও তাকালো না। অনেক লজ্জা পেলাম আমি।
রাতের দিকে ইয়াং ডাক্তারটিও আসলো । আমাকে দেখে এগিয়ে আসলো, ”আমি তো আমার পেশেন্টকে রিকগনাইজ করতে পারছিনা । আই ওয়াজ থিঙ্কিং হু ইজ দিস বিউটিফুল গার্ল ।“শোয়েবের চেয়েও ভয়াবহ বাংলায় বললো । আমি বেশি কিছু না বলে হেসে সরে আসলাম ।
হঠাত খেয়াল করলাম দুর থকে এদিকেই তাকিয়ে আছে শোয়েব ।
চলবে…