#পরবাসী মেঘ
শেষ পর্ব
কয়েকদিন হলো শোয়েব পিএইচডি শুরু করেছে । অনেক ব্যাস্ত আগের মতো বাসায় থাকে না । মাঝে মাঝে বেশ রাত করেও ফেরে। রবিবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি দিন গুলো সারাদিন কেউ বাসায় থাকে না । আগে না থাকার মতো করে হলেও বাসায় থাকতো শোয়েব । আমার শাশুড়ি অবশ্য শনি রবি দুই দিন বাসায় থাকে । এবং সপ্তাহের বাকি দিনগুলো সবার আগে ফেরেন। রাতের খাবার রেডি করেন সবার জন্য ।আমি সাথে থেকে সাহায্য করি।
এই সাহায্যটুকু ছাড়া আমার সারাদিন অখন্ড অবসর। বই পড়ি , মুভি দেখি, বাগানের গাছে পানি দেই । আপাতত দৃষ্টিতে আমি মহা সুখে আছি। কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমি একদম ভালো নেই । আমার কোনো কিছু করতেই ভালো লাগেনা। সারাক্ষন এক ভীষন অস্থিরতা আমাকে তাড়িয়ে ফেরে। আম্মার সাথে যখনি কথা হয় একই কথা । সব কিছু ঠিকহ হয়ে যাবে সময়ের সাথে সাথে । আরো ধৈর্য ধরতে হবে।
ধৈর্য ধরলে যদি সবকিছু ঠিক হয়ে যায় তাহলে
তো ভালোই হয়। কিন্তু কোনো লক্ষন দেখি না। বরং ইদানীং প্রায় সারাদিন ইউনিভার্সিটি থাকে সে। কথা হয় না একদম। সম্পর্কের কোনো উন্নতি নেই । কি করবো আমি ?
এগুলো চিন্তা করতে করতে বাগানে বসে কাদছিলাম। নিজের চিন্তায় এতো বিভোর ছিলাম কখন যে পেছনে আমার শাশুড়ি এসে দাড়িয়েছেন দেখিনি।
এখানের লকগুলো এমন বাইরে ভেতরে দুই দিক থেকে খোলা যায়। সবার কাছে চাবি থাকে ।যে যার মতো খুলে ঢোকে। তাই আমার শাশুড়ি বাসায় ঢুকলেও আমি টের পাইনি।
উনি ধরেই নিয়েছিলেন সব কিছু ঠিক হয়ে যাচ্ছে । তাই আমাকে এভাবে কাদতে দেখে ভীষন অবাক্ হলেন । প্রথমে জিঙ্ঘেস করলেন দেশের জন্য মন খারাপ কিনা। আমি না বলতেই উনি জেরা শুরু করলেন। কেন কাদছি ? শোয়েব কিছু বলেছে কিনা? ঝগড়া হয়েছে কিনা?
আমি শুধু উত্তরে বললাম ”ঝগড়া হওয়ার মতো সম্পর্ক কখনো তৈরি হয়নি শোয়েবের সাথে ।“
“কখনোই কি তোমাদের রিলেশন একদমই জোড়া লাগেনি।“
আমি উত্তরে মাথা নাড়লাম শুধু ।
“ আমাকে কি তোমাদের সমস্যাটা কোথায় হচ্ছে খুলে বলবে প্লিজ ।“
কখনো আমার সাথে উনি ঠি.ক ট্রাডিশনাল শাশুড়ির মতো আচারন করেননি । বরং উনি আছেন বলেই আমি এতোদিন এই বাড়ি থাকতে পেরেছি । তাই কি ভেবে সব কিছুই খুলে বললাম ওনাকে । কিছুই বাদ দিলাম না। শুধু আম্মা যে আমাকে দেশে ফিরতে মানা করেছে সেটা বললাম না।
সব শুনে আমার শাশুড়ির মুখ পুরা কালো হয়ে গেলো। এতোটা বোধহয় আশা করেননি নিজের ছেলের কাছ থেকে। বেশ অনেকটা সময় নিলেন নিজেকে সামলে নিতে তারপর কিছুটা স্বগতোক্তির মতো করে বললেন , “ আমি জানি প্রথম ভুল আমারি । দেশে নিয়ে ওকে বিয়ে দেওয়া । ভেবেছিলাম তোমার মতো এরকম একটা লক্ষী মেয়ে পেলে ওর জীবনটা সুন্দর হবে। কিন্তু মানুষ ভাবে এক জীনিষ আর হয় অন্য জীনিষ ।“ কথাগুলো বলে লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন । তারপর আবার বললেন , “ এখন তুমি কি চাও বলোতো মা? “
“ আমি জানিনা। আসলে কিছুই বুঝতে পারছিনা আমি। “ আসলেই কোনো ডিসিশনে আসতে পারছিনা আমি।
“ আমি কিছু পরামর্শ দিতে পারি । তোমার ভালো নাও লাগতে পারে ।কিন্তু মানলে মনে হয় খুব বেশি ক্ষতি নেই । দেখ মা, শোয়েব যেমন তোমাকে আপন করার চেষ্টা করেনি তুমিও কিন্তু কখনো ওর কাছে গিয়ে আপন হওয়ার চেষ্টা করোনি । দুজন ইগো মাঝখানে রেখে দুরে সরে থেকেছো। আজ যদি সেই ইগোকে মাঝখানে রেখে দুজন দুরে সরে যাও,তাহলে সুদূর ভবিষ্যতে যখন বয়স বাড়বে বুদ্ধি পরিপক্ক হবে অনুশোচনা হতে পারে এই ভেবে আরেকটু চেষ্টা করলে বোধহয় সংসারটা বাচতো। “একটু থামলেন আমার শাশুড়ি তারপর আবার বললেন, “আলাদা হওয়াটা তো সহজ । যে কোনো সময় হতে পারো । কিন্তু একটু চেষ্টা করে দেখো যদি এটাকে আটকানো যায় । সমাধান যে হবেই তা আমি বলছিনা। চেষ্টা করে দেখতে তো ক্ষতি নেই । যদি কোনোকিছু সমাধান না হয় তাহলে তুমি যেটা চাও সেটাই হবে। তুমি দেশে ফিরে গেলে যেতে পারো ।আবার এখানে থেকে যদি পড়াশুনা শেষ করতে চাও সেখানেও আমি সাধ্যমতো সাহায্য করবো। তুমি ভাবো ।ডিসিশন নাও । তবে আস্তে ধীরে ঠান্ডা মাথায় । যেটাই তুমি করবে আমাকে তোমার পাশে পাবে।“
আমার শাশুড়ির কথাগুলো নিয়ে কয়েকদিন অনেক ভেবেছি । কথাগুলো বোধহয় খুব খারাপ না । আমার শাশুড়ির পরামর্শ মানলে সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে কোনোকিছু ওয়ার্কআউট না করলে এ্যাটলিস্ট একজন মানুষকে আমার পাশে পাবো।উনার কাছ থেকে কোনো ধরনের সাহায্য নিতে আমার মনে হয় খারাপ লাগবেনা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে পটানো জীনিষটা একেবারে আসেনা আমার ।
কিভাবে আগানো যায় ভাবছিলাম কিন্তু এখানেও আমার শাশুড়ি হেল্প করলেন।
এক শনিবার শোয়েব কে ডেকে বললেন , “ সেদিনের অনুষ্ঠানে বেশ অনেকে ক্যাশ টাকা দিয়েছে তোদের দুজন কে । বৌমা কে একটু সাথে করে নিয়ে যা শপিং করিয়ে আন । ওতো আসার পর থেকে তেমন বের হয়নি । “
শোয়েবের চেহারা দেখে মনে হলো এমন আজব কথা সে জীবনে শোনেনি।
“তুমি নিয়ে যাও, না হয় শোভনের সাথে যাক।“মুখ বেজার করে বললো সে।
আমি বলতে যাচ্ছিলাম যে আমার কিছু লাগবে না কিন্তু আমার শাশুড়ি ইশারায় থামিয়ে দিলেন।
“শোভনের সাথে ওর বিয়ে হয়নি। “বেশ শান্ত গলায় বললেও আমার শাশুড়ির চেহারায় এমন কিছু ছিল যে ও আর কিছু বললো না।
যে শপিংসেন্টারে আমাকে নিয়ে গেল সেটা বিশাল বড়ো । কিন্তু আমার তো কেনার মতো কিছু ছিলনা । শাশুড়ি আসার সময় বার বার করে বলে দিয়েছেন । কিছু কিনি আর না কিনি দুজন একসাথে যেন সময় কাটানোর চেষ্টা করি। চট কর যেন চলে না আসি। তাই ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম । একটা ব্যাগের দোকানে যেয়ে পার্স দেখছিলাম । দাম দেখে মাথা ঘুরে গেল। হানড্রেড পাউন্ড । তাড়াতাড়ি রেখে দিলাম ।
“ কিছু বাই করবেনা তো কেন এসেছো ? হোল ডে ওয়েস্ট হয়ে গেল আমার । “
এত রুঢ়ভাবে বললো যে ভীষন কান্না পেল আমার । কিন্তু কিছুতেই ওর সামনে কাদতে চাই না।
আরেক দিয়ে তাকিয়ে চোখের পানি মুছতে চেষ্টা করলাম । নিজেকে সামলে কোনোরকমে বললাম , “চলুন , বাসায় চলে যাই। “
কিন্তু শোয়েব জানালো ওর ক্ষুধা লেগেছে । আগে কোথাও বসে কিছু খাবে তারপর আমি আর কিছু না কিনলে বাসায় চলে যাবে।
একটা কাবাব সপে বসলাম আমরা । আমাকে জিঙ্ঘেসা করলো কি অর্ডার করবে আমার জন্য । আমি বললাম আমার ক্ষুধা লাগেনি। আমি কিছু খাবো না।
“এ্যাটলিস্ট ওয়ান জুস নাও । “
“ না , আমার কিছু লাগবেনা। “
হঠাত প্রচণ্ড রেগে গেলো শোয়েব “দ্যাটস হোয়াই , আমি বাংলাদেশে বিয়ে করতে চাইনি। নোবডি নোস এনি ম্যানার। অল আর হিপোক্রেটস “ তারপর কোনো কিছু অর্ডার না করেই আমাকে ফেলে গট গট করে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেলো।
আমি রেস্টুরেন্ট থেকে আস্তে আস্তে বের হয়ে আসলাম । এক ফোটাও কাদলাম না। কতো সময় একা একা শপিং সেন্টারটার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া মানুষের মতো ঘুরলাম। মনে হলো আমি তো হারিয়ে যাওয়াই মানুষ । তারপর টায়ার্ড হয়ে শপিং সেন্টারের মাঝখানে যে বসার জায়গা গুলো থাকে , ওখানে বসে পড়লাম । কাওকে ফোন দেওয়ার কথাও মনে পড়লো না।মাথা খুব ভালো কাজ করলো না। খেয়াল করলাম না লোকজন কমতে শুরু করেছে।
এরপর একজন এইদেশি লোক এসে ইংলিশ এ্যাকসেন্টে কিছু জিঙ্ঘেস করলেও কিছু বুঝলাম না। চেষ্টাও করলাম না। এর কিছু সময় পরে দুজন পুলিশ অফিসার চলে আসলো।ইংলিশ বলতে পারিনা দেখে পুলিশ স্টেশনে নিয়ে গেলো আমাকে । ইন্টারপ্রেটার (দোভাষী )কল করলো। দোভাষীর মাধ্যমে সব শুনলো আমার কাছ থেকে। ওদের আচারন দেখে মনে হলো না অবাক হয়েছে বা নতুন কিছু শুনছে। শুধু জিঙ্ঘেস করলো, আমি এখন কি চাই । হাসি আসলো আমার । কিছুদিন আগে এই কথাটা আমার শাশুড়িও জিঙ্ঘেস করেছিল। আমার আব্বা বিয়ের সময় আমাকে একবার এই কথাটা জিঙ্ঘেস করলে আর শোয়েবের বাবা মা যদি ওর কাছে জিঙ্ঘেস করতো তাহলে আজ আমাকে বিদেশে এই পরিস্থিতিতে পড়তে হতো না।
নিজেকে সামলে নিয়ে অফিসারের কথার জবাবে বললাম অবশ্যই বাংলাদেশে ফিরতে চাই ।কিন্তু তার আগে আমি একবার আমার আব্বার সাথে কথা বলে ফাইনাল ডিসিশন জানাতে চাই । রাত নয়টা বাজে তার মানে বাংলাদেশে তখন রাত তিনটা।
সরাসরি আব্বার নাম্বারে কল দিয়ে জিঙ্ঘেস করলাম । একটা ডিভোর্সি মেয়ের জায়গা তার বাড়ি হবে কিনা । একে মাঝরাত তারপর আমার কাছ থেকে এমন অদ্ভুদ কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলেন। শুধু জিঙ্ঘেস করলেন “কি হয়েছে মা ?”
বাবার গলায় কোমল স্বরে মা ডাক শুনে আমি ঝরঝর করে কেদে ফেললাম । কান্না কিছুতেই সামলতে পারছিলাম না। তাই দোভাষী লোকটি আমার কাছ থেকে ফোন নিয়ে সব কিছু খুলে বললো আব্বাকে। আমি একটু সামলে নিলে আমাকে আবার ফোনটা ফিরিয়ে দিল । আমি হ্যালো বলতেই আব্বা আমাকে বললেন “তুই চিন্তা করিসনা মা। আমি ওদেরকে প্লেন ফেয়ার আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি । ওরা টিকি.ট বুকিং দেওয়ার চেষ্টা করছে ।সম্ভব হলে কালকেই ওরা তোকে প্লেনে উঠিয়ে দেবে।আর আমাকে তুই মাফ করে দিস। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। তুই দেশে আয় আবার পড়াশুনা শুরু কর। সবকিছু যেভাবে চাইবি ইনশাল্লাহ সেইভাবে হবে।“ আসলে বাবা মারা যতো কঠিনই হোক না কেন সন্তানের বিপদের শুনলে আর কঠিন থাকতে পারে না।
পুলিশ যেয়ে পাসপোর্ট আর আমার প্রয়োজনীয় জীনিষপত্র নিয়ে এসেছিল শ্বশুরবাড়ি থেকে।না ঐবাড়িতে আমি আর ফেরত যায়নি। তবে আমার শ্বশুর,শাশুড়ি আর শোভন এসেছিল এয়ারপোর্টে । উনাদের কাছ থেকে জানতে পারলাম যে পুলিশ বাসায় যাওয়ার আগে উনারা বুঝতে পারেননি এতো কিছু ঘটে গিয়েছে । কারন উনারা ভাবছিলেন আমি আর শোয়েব শপিং শেষে অন্য কোথাও গিয়েছি ।অনেক মাফ চাচ্ছিল সবাই । কিন্তু আমার তো কারো উপর কোনো রাগ নেই ।
প্লেনের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি আমি ।মেঘের অনেক উপর দিয়ে প্লেন চলছে । পরবাসে যে বিশাল মেঘখণ্ড আমার জীবনটাকে ঢেকে ফেলেছিল । পরম করুনাময়ের অশেষ কৃপায় সেটা সরে গিয়েছে ।জানিনা ভবিষ্যত আমার জন্য কি নিয়ে অপেক্ষা করছে । আরো বড় মেঘখন্ড নাকি সূর্যের দিন।
যেটাই হোক সেটা অন্য গল্প ।সুযোগ পেলে বলবো আপনাদের।