#চিত্ত চিরে চৈত্রমাস ..
#মম_সাহা
পর্বঃ আট
রাত গভীর থেকে গভীর হলো, সাথে অনুভূতিদের ঝিমিয়ে থাকা অঘোষিত যুদ্ধ টা নিবিড় ভাবে চলতেই থাকলো। ঘড়ির কাঁটায় তখন সময় একটা সাতচল্লিশ। চিত্রার কেবিনের ভেতর চিত্রা সহ আরও দু দু’টো মানুষও নিস্তব্ধ হয়ে আছেন। নুরুল সওদাগরের কথা থামতেই বাহারের হুট করে আগমনে কথার স্রোত একটু ভিন্ন দিকে গেলেও অতঃপর তা আবার আগের জায়গাতেই এসে খুঁটি বাঁধলো। মুনিয়া বেগম স্বামীর দিকে বিষ্ময় ভরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন কিয়ৎক্ষণ। অতঃপর খুব ধীরে, ছোটো কণ্ঠে বললেন,
“কি বলছো, বুঝেশুনে বলছো তো?”
নুরুল সওদাগরের মুখ-চোখ তখনো কঠিন। কর্কশ কণ্ঠে সে জবাব দিলেন,
“প্রমাণ কথা বলছে, আমি না।”
মুনিয়া হতাশার শ্বাস ফেললেন। হতভম্ব চোখে তাকিয়ে থাকা চিত্রার দিকে একবার দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ক্ষীণ স্বরে স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,
“চিত্রার জন্য এটা কি কোনো বিপদ ডেকে আনবে?”
“প্রমাণ যেহেতু চিত্রার বিরুদ্ধে তাই যেকোনো পদক্ষেপই নিতে হতে পারে আমাদের।”
“আপনার অযৌক্তিক প্রমাণকে একটু দূরে ছুঁড়ে ফেলে যদি মস্তিষ্ক দিয়ে ভাবেন, খুশি হবো। অন্তত এতটুকু তো বুঝবো যে আপনারও ব্রেইন নামক কোনো বস্তু আছে যেটা যুক্তিও বুঝে।”
বাহারের কথায় তুমুল তাচ্ছিল্যের সুর। অথচ নুরুল সওদাগরের তাতে যেন কিছু যায় আসে নি। সে স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
“আইন প্রমাণ চেনে।”
“আর আপনি চেনেন মিথ্যা অহংকারে। কিসের আইন শেখাচ্ছেন আমাদের? আপনার আইন কি এতই যুক্তি ছাড়া চালাচল করে যে, একটা মেয়ে যে রাতে অপারেশন থিয়েটারে মৃত্যুর সাথে লড়াই করেছে সে মেয়ে কীভাবে আরেকজনকে খু*ন করার আগে-পিছে বা কোনো কিছুতে ছিলো?”
বাহারের প্রতিটি কথা যুক্তিসঙ্গত কিন্তু নুরুল সওদাগরও দমে যাওয়ার পাত্র না। সে ইনিয়ে বিনিয়ে আরও কিছু বলার চেষ্টা করতেই থামিয়ে দিলো মুনিয়া বেগম। মহিলাটা কেমন গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
“বড় আইনের কথা বলছো যে! অন্যদের বেলায় তোমার এত আইনের নিয়ম, নিজের বেলা আইন তোমার অন্ধ বুঝি! এ কেমন আইন!”
এবার আর কোনো কথা বলার সুযোগ পেলেন না নুরুল সওদাগর বরং নিজের স্ত্রীর দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রইলেন। এত গুলো বছর পর তার স্ত্রী যে তার দুর্বল জায়গায় হাত দিবে এটা যেন তার ধারণার বাহিরেই ছিলো। অবশ্য কথায় আছে না, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে বিড়ালও সিংহ হয়ে উঠে আর মুনিয়া তো বুদ্ধিমতীই।
চিত্রা নিজের মা-বাবার কথা নীরব থেকে শুনে গেলো। এই ক্ষেত্রেই যেন তার তুমুল নীরবতা। বাবার সামনে তার অনেক কিছু বলার থাকলেও বলা হয়ে উঠে না। কেনো এত সংশয়, দ্বিধা তা জানা নেই চিত্রার। সে কেবল এতটুকুই জানে, বাবা মানেই ধারালো তীর। যা খন্ড-বিখন্ড করে অষ্টাদশীর হৃদয়।
নুরুল সওদাগর যেন চোখ লুকিয়ে বাঁচার জন্য হুট করেই কেবিনের বাহিরে চলে গেলো। মুনিয়া বাঁকা হাসলো। যে মানুষ নিজেদের অতীত ভুলে যায় অতিরিক্ত উড়বার জন্য তার ডানায় অতীতের প্রলেপ লাগিয়ে দিতে হয় নিজ দায়িত্বে। কিছু মানুষকে অতীত ভুলতে দেওয়া যাবে না।
বাবা যেতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো চিত্রা। কেমন ঝিমানো কণ্ঠে বললো,
“আম্মু, আব্বু এমন করে কেনো আমার সাথে? আমার দোষ কোথায়?”
“তোমার দোষ আসলে না। দোষটা হলো গিয়ে আমার। আমি তোমার বাবার স্ত্রী হতে পেরেছি তবে প্রেমিকা না। তাই হয়তো কেবল স্ত্রীর কন্যাকে সে গ্রহণ করতে পারে নি।”
মায়ের কথায় ভ্রু কুঁচকালো চিত্রা। কথাটা যে তার বোধগম্য হয় নি সেটা স্ফূর্তিত হলো তার মুখমণ্ডলে। তবে বাহার বোধহয় আঁচ করলো কিছুটা। তাই তো সে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“আপনার কথা’ই নাহয় মানলাম, আন্টি। স্ত্রীর সন্তান বলে চিত্রাকে আজ মানতে পারছে না চিত্রার বাবা। তবে তুহিনের ক্ষেত্রে তো মেনে নেওয়ার ব্যাপারটা ভীষণ স্বাভাবিক। তখন স্ত্রী-প্রেমিকার ভেদাভেদ হাওয়ায় মিলিয়ে যায় কেনো? এখানে অবশ্য ছেলে-মেয়ের বিভেদের কথাও আমি বলবো না। কারণ মেয়ে অপছন্দ হলে চেরি আর অহির নিয়মের ক্ষেত্রেও একই হতো। হিসেবটা কেমন গোলমেলে না, আন্টি?”
বাহার ভীষণ চতুর ছেলে। তার প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কিঞ্চিৎ হিমশিম খেলো মুনিয়া বেগম। কথা কাটানোর জন্য সে কেবিন ছেড়ে চেরিকে দেখার অজুহাতে বেরিয়ে গেলো। বাহার হাসলো। সে জানতো এমন কিছুই হবে।
(১৮)
কেবিন খালি হতেই বাহার এসে চিত্রার সামনে দাঁড়ালো। চিত্রারও ততক্ষণে দৃষ্টি গেলো বাহারের উপর। বাহারের শরীরে ডালিয়া রঙের টি-শার্ট যেটার বাহুর দিক দিয়ে ঘামে ভিজে আছে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। উচ্চতা অনেক হলেও সুঠাম দেহী বলা যাবে না তাকে। বেশি ছিমছাম গড়ণের। গায়ের রঙও তো আর তত ফর্সা নয়। একদম সাধারণ একজন পুরুষ। অথচ কতটা চুম্বকের মতন আকর্ষণ শক্তি লোকটার ভিতরে!
বাহার গলা পরিষ্কার করার মতন শব্দ করলো। অতঃপর বললো,
“নারী তুমি হও যদি দাস,
উপহাস হবে তোমার ভাগ্যের নির্মম পরিহাস।”
হুট করে এই দু’লাইনের তাৎপর্য টুকু বোধগম্য হলো না চিত্রার। সে ভীষণ অবাক হলো। অবাক মিশ্রিত কণ্ঠেই বললো,
“এটা কী ছিলো!”
“ধরতে পারো সাবধান বাণী। যা তোমার জন্য ছিলো। নিজের বাবাকে দেখে তুমি যখন মুখ চুপসে চুপ করে থাকো, দুনিয়ার সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাক্তি আমার কাছে তখন তোমাকে লাগে। তোমার প্রতি বিরক্তে আমি কত রকমের ঢেঁকুর তুলি। তুমি এত বিরক্তিকর কেনো?”
বাহার ভাইয়ের মুখ-চোখ ভাঁজ করা কথার ধরণে তেতে উঠলো অষ্টাদশীর হৃদয়। অযাচিত আন্দোলন ঘোষণা করলো হৃদয় তোলপাড় করে। সে অসহ্য রকমের রাগ ঝেড়ে বললো,
“আমি বিরক্তকর? আমি? আপনি তো জলজ্যান্ত বিরক্তের কারখানা আবার আসছে আমাকে বলতে। ভূতের মুখে রাম নাম।”
“অথচ এই বিরক্তের কারখানাকে হৃদয় মাঝে পুষে রেখে প্রতিনিয়ত কতই না আনন্দ উৎসব করছো মেয়ে!”
চিত্রার কথা থেমে গেলো। আকাশচুম্বী রাগ ফুড়ুৎ করে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। লোকটা উচিৎ সময়ে এত উচিৎ কথা বলে কীভাবে? অথচ চিত্রা ঝগড়ার সময়ে সঠিক কথা টা ভুলে যাওয়ার কারণে মাঝে মাঝেই ঝগড়ায় হেরে গিয়ে কেঁদে ফেলে।
“চুপ থাকলে তোমাকে খারাপ লাগে না, মেয়ে। তবে তোমার বাবার সামনে চুপ করে থাকাটা ভীষণ বাজে স্বভাব। বাবা-মাকে অবশ্যই সম্মান করা উচিৎ। তবে, যে মানুষ তোমাকে উঠতে-বসতে অসম্মান করে বুকের মাঝে আস্ত একটা রগরগে ঘাঁ তৈরী করে দিচ্ছে, তার সামনে চুপ করে থাকাটা নেহাৎ ই পরাধীনতা। অথচ তোমার এখন মুক্ত হয়ে উড়ার সময়।”
বাবাকে চিত্রা ভীষণ বেশিই ভালোবাসে, তাই হয়তো চেয়েও বাবার সামনে সে কঠিন কিছু বলতে পারে না। অথচ বাবা কত নির্দ্বিধায় না চিত্রাকে ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলে!
বাবার কথা মনে পড়লেই আকাশ-পাতাল আঁধার করে চিত্রার মন খারাপ হয়। তাই কথা ঘুরানোর জন্য চিত্রা বললো,
“আচ্ছা বাহার ভাই, আপনার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছাড়বেন কবে?”
“যেদিন আর ভিতর পুড়বে না, সেদিন আর বাহিরও পুড়াবো না।”
“আপনারও তাহলে ভিতর পুড়ে?”
“কেনো মেয়ে, আমি কী মানুষ না? পৃথিবীর প্রতিটি মানুষেরই ভেতর পুড়ে। কেউ প্রকাশ করে, আর কেউ গোপনে রাখে।”
“বাহার ভাই, আপনি এত জটিল কেনো?”
“তুমি আমায় জটিল ভাবে গ্রহণ করেছো বলে।”
“জানেন বাহার ভাই, আপনি আমার কাছে ক্যাকটাস ফুলের মতন।”
“আর তুমি আমার কাছে অলকানন্দা কিংবা সন্ধ্যার রঙ্গনা।”
ইশ্, লোকটা যেন উত্তর তৈরী করেই এসেছে। এত বিব্রতকর কথা বলেও লোকটাকে বিব্রতবোধ করাতে না পেরে হতাশার শ্বাস ফেললো চিত্রা। হুট করেই তার মাথায় খেলে গেলো দুষ্টবুদ্ধি। কিটকিটে হেসে বললো,
“আপনি কি জানেন, অষ্টাদশী তার বুকের মাঝে আস্ত একটা বাহার ভাই পুষে রেখেছে।”
“ফুল প্রিয় অষ্টাদশীর কাঁটার প্রতি এত ঝোঁক বড়ই আশ্চর্যের। তুমি কি জানো মেয়ে,
চলতি পথে যাদুকর ভালবাসা
প্রেমিক ডাকাতের মত
তোমাকে ছিনিয়ে নেবে
মৌসুমী বাতাসে উড়ে যাবে ভালবাসা
হৃদয়ের চোরা পথে
তুমি হারিয়ে যাবে
তুমি লুটপাট হয়ে যাবে
তুমি চৌচির হয়ে যাবে……
গানটা শুনেছিলে মেয়ে? তুমি আমার মাঝে ডুবতে এসো না, হারিয়ে যাবে। কী লাভ নিজেকে হারানোর, নিষিদ্ধতে আসক্ততা কেনো, মেয়ে?”
চিত্রা উত্তর দিলো না। এই বাহার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকেও যেন বিশ্বযুদ্ধ জয় করার মতন আনন্দ পাওয়া যায়। অনুভূতিরা মাঝে মাঝে এত মিষ্টি হয় কেনো?
বাহার পকেটে দু’হাত গুঁজে বের হতে নিলেই চিত্রা আনমনেই বলে উঠলো,
“আপনি আমার হুট করে বুকের বা’পাশ ব্যাথা, বাহার ভাই। আপনি আমার মন কেমনের রোগ। আপনি আমার বৃষ্টির দিনে ভিজে চুপচুপে সাদা শাড়ি। আপনি আমার শখ বাগানের ক্যাকটাস ফুল। আপনি আমার সহজসরল অংকের স্যারের দেওয়া লাল কালিতে ফুটে উঠা কিঞ্চিৎ ভুল। আপনি খুব খারাপের বহিঃপ্রকাশ, কিন্তু আপনি আমারই কেবল।”
বাহার যেতে নিয়েও ফিরে তাকালো। হাসলো না, মুখ গম্ভীরও করলো না। কেবল ধীর কণ্ঠে বললো,
“আমি তোমার চায়ের কাপের নীল রাঙা বি*ষ। যা পান করলে তোমার মৃ*ত্যু নিশ্চিত, অথচ তুমি পান করতে মরিয়া। শুনো মেয়ে রঙ্গনা, প্রেম ভালো তবে তোমার প্রেমিক না।”
(১৯)
ভাদ্র মাস শেষ। সময়টা ঠিক আশ্বিনের দ্বিতীয় দিন। দীর্ঘ নয় দিন পর চিত্রা পা রাখলো নিজের শখের বাড়িতে। রোগা-সোগা চোখ-মুখ। শরীর শুকিয়ে গেছে। গায়ের রঙটাও কেমন হালকা মেটে রঙ ধরেছে। তবে এখন সে কিছুটা সুস্থ। স্বাভাবিক ভাবেই হাঁটা চলা করতে পারছে। ইতিমধ্যে চেরিকে বাহিরের দেশে নেওয়ার বন্দোবস্ত প্রায় শেষের দিকে। চেরির কোনো উন্নতি দেখা দিচ্ছে না।
চিত্রা বাড়িতে পা রাখতেই থম মেরে থাকা বাড়িটা উৎসবমুখর হয়ে উঠলো। কিঞ্চিৎ হৈচৈ, শোরগোল শোনা গেলো। কিন্তু এরমধ্যেই ছাঁদ থেকে চিত্রাদের বাড়ির কাজের মেয়ে দোয়েলের চিৎকার ভেসে এলো। সবাই হুড়মুড় করে ছাঁদে যেতেই অবাকে হা হয়ে রইলো। চিত্রার রঙ্গনা, মৌসন্ধ্যা, পিচ ফুলসহ আরও অনেক গুলো ফুল গাছ মাটিতে পড়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে ইচ্ছেকৃত ভাবে কেউ এ কাজটা করেছে।
#চলবে…….