#চিত্ত চিরে চৈত্রমাস
#মম_সাহা
পর্বঃ সাতাশ
(৭৩)
পুরো শহর জুড়ে ছেপে গিয়েছে বাহার ভাইয়ের নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি। যে যেখানেই তাকে দেখবে সাথে সাথে যেন খোঁজ দেয় ভার্সিটির নেতা সাহেব কিংবা পুলিশকে। কৃতজ্ঞতায় বিরাট পাবলিক ভার্সিটির একজন ক্ষমতাশালী নেতা। পোস্টার গুলো তাহলে সেই নেতাই ছাপিয়েছে। মানবতা আজকাল বেঁচে আছে কিনা, তাই তো নেতারাসহ একজন খু* নিকে খোঁজার জন্য সাহায্য করছে আইনজীবীদের।
কোচিং থেকে ফেরার সময় বড় বড় পোস্টার গুলোতে চোখ বুলিয়ে বুলিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে যায় চিত্রা। রাস্তাটা খালি পেলেই ছুঁয়ে দেয় পোস্টারের মাঝে থাকা বাহার ভাইয়ের সাদা-কালো মুখমন্ডলকে। কেবল পুরো শহর না, পুরো পৃথিবীও যদি বাহার ভাইয়ের বিপরীতে চলে যায় তবুও বাহার ভাইয়ের পক্ষে কেবল একজন মানুষ থাকবে, সে হলো চিত্রা। পুরো দুনিয়া তার কাছে মিথ্যে, কারণ সে জানে, তার বাহার ভাই একমাত্র সত্য। তন্মধ্যেই চিত্রার কাছে থাকা তার স্মার্ট ফোন খানা সশব্দে বেজে উঠলো। চিত্রা রয়েসয়ে কল তুলতেই অহির চিন্তিত কণ্ঠ ভেসে এলো,
“কই তুই? সবাইকে বললি একত্রিত করতে, এখন দেখি তোরই খবর নেই!”
চিত্রা ক্ষীণ কণ্ঠে জবাব দিলো,
“এইতো রাস্তায়, আসছি।”
চিত্রার কাছ থেকে উত্তর পাওয়ার পরও অহি ফোনটা কাটলো না। তখনও ফোনে হুড়মুড় করে বাড়ছে সেকেন্ডের হিসাব। চিত্রাও কাটলো না ফোন। কারণ সে জানে, অহি আপা কিছু বলার জন্য সময় নিচ্ছে। সেও চুপ থেকে সময় দিলো। সেকেন্ডের কাটা পেরিয়ে যখন মিনিটে গেলো, তখন অহি ধীর কণ্ঠে বললো,
“তুইও কী বিশ্বাস করিস, বাহার ভাই এমন কাজ করেছে?”
“রাতের আকাশে কখনো সূর্য উঠে, আপা?”
চিত্রার অদ্ভুত প্রশ্নে হয়তো থতমত খেলো অহি। তাইতো বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কী বলছিস?”
“উত্তর দেও আগে। রাতের আকাশে কখনো সূর্য উঠে?”
“না।”
“কেনো উঠে না?”
এমন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে চিত্রার এহন কথায় বিরক্ত হলো অহি। অধৈর্য কণ্ঠে বললো,
“এটা অসম্ভব, তাই উঠে না।”
“তেমনই অসম্ভব আমার বাহার ভাইয়ের নামে ছড়ানো কলঙ্কের সেই কাজটা।”
চিত্রার উত্তরে হয়তো তাজ্জব বনে গেলো অহি। এই মেয়েটাও যে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে এমন জবাব দিবে তা যেন তার ধারণার বাহিরে ছিল। তবে মনে মনে বেশ খুশি হলো সে। প্রশান্তি মাখানো কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসের সাথে বললো,
“কেবল এই মনোভাব টা নিজের মাঝে রাখবি, তবেই হবে।”
“তুমি রেখেছো তা, আপা? তুমিও নিশ্চয় এমন বিশ্বাস পুষে রেখেছো তাই না?”
চিত্রার প্রশ্নে আবারও হোঁচট খেলো অহি। আমতা-আমতা করে বললো,
“বাহার ভাই বিশ্বাসযোগ্য মানুষই। তাই এটা ভাবাও স্বাভাবিক।”
“বাহার ভাই তো ভালোবাসার যোগ্য মানুষও, তবে ভালোবাসলে না কেন?”
চিত্রার প্রশ্নে কেঁপে উঠলো অহি। মেয়েটা আজ কথায় জব্দ করার খেলায় নেমেছে। কী সুন্দর সহজ, সরল ভাবে কঠিণ একটা প্রশ্ন করে ফেললো! কিন্তু অহিও কম বুদ্ধিমতী না, তার উপর সাইকোলজির ছাত্রী। চিত্রার যে মতিগতি চলছে বর্তমানে, তা বুঝতে খুব একটা বাকি রইলো না তার। তবে সে চিত্রার মনমতন উত্তর দিলো না, বরং ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বললো,
“সবাই যোগ্যতার মূল্য দিতে পারে না। তাই হয়তো বাহার ভাই ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য হয়েও ভালোবাসা পায় নি।”
চিত্রা হাসলো। অহি আপা যে খুব চালাক তা সে ভালো করেই জানে, তবুও আরেকটু বুদ্ধির পরীক্ষা করে নিলো। সে জানতো, অহি আপা কখনো ভালোবাসা স্বীকার করবে না। যা পায় নি, যা পাবে না, তা পাওয়ার আকাঙ্খা প্রকাশ করাও এক ধরণের বোকামি। আর অহি আপা বোকামি খুব কমই করেন।
(৭৪)
সওদাগর বাড়ির ড্রয়িং রুমে গভীর নিস্তব্ধতা। আজ বাড়ির মধ্যমণি হলো চিত্রা। এই মেয়েটার চোখে-মুখে আজ কেমন উপচে পড়া রহস্য। কিছু অদ্ভুত ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা। সোফায় যার যার মতন অবস্থানরত আছে সওদাগর বাড়ির সদস্যরা। রোজা সওদাগরের মুখ আগের মতনই ভার ভার। চিত্রা সোফার খালি জায়গাটাতে এসে বসলো। তুহিন, মাহতাবও আছেন এখানে উপস্থিত। চিত্রার এমন রহস্যময় নিশ্চুপতায় বিরক্ত হলেন নুরুল সওদাগর। তার গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“কী সমস্যা তোমার? আমাদের সময়ের কী কোনো দাম নেই তোমার কাছে? হেয়ালি করছো কেন?”
চিত্রা বাবার কথাকে তেমন পাত্তা না দিয়ে সোফায় আয়েশ করে হেলান দিয়ে বসলো, তারপর অদ্ভুত কণ্ঠে বললো,
“আব্বু, আপনি কখনো আমায় ভালোবাসেন নি কেন?”
এমন সময়ে চিত্রার এমন প্রশ্নের জন্য সবাই হয়তো প্রস্তুত ছিলো না। নুরুল সওদাগরও ক্ষাণিক থতমত খেয়ে গেলো। বি* স্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে রইলো মেয়ের পানে। সে হয়তো বুঝার চেষ্টা করছে তার মেয়ে কী বলতে চাচ্ছে। কিন্তু বুঝতে সক্ষম হলো না কেউ। সবারই হতভম্ব অবস্থা দেখে ক্ষীণ হাসলো চিত্রা, কেমন গুমোট পরিস্থিতি তৈরি করে বললো,
“জানেন আব্বু, আমিই হয়তো একমাত্র মেয়ে যে আব্বুর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য নিঃসন্দেহে জান কোরবানি দিয়ে দিতাম। কিন্তু আপনি তো ভীষণ শক্ত পাথর। আমার জানও আপনার দম্ভের কাছে খুবই তুচ্ছ। আমাকে অপছন্দের কারণ কী কেবল মাত্রই আমার জন্ম পরিচয়?”
“চিত্রা!”
মায়ের কণ্ঠে বিস্ময়, ডাকের মাঝে ধমক। চিত্রা তাকালো মায়ের দিকে, মুচকি হেসে বললো,
“আজ আমি নাহয় একটু বলি, আম্মু? জানো আম্মু, আব্বু আমায় একটুও ভালোবাসে নি। আমার কত খারাপ লাগতো, কত কান্না করতাম, কত আল্লাহের দরবারে দোয়া করতাম, কেবল আব্বু যেন আমায় একটু ভালোবাসে, কিন্তু আব্বু আমায় ভালোবাসে নি, আম্মু। আল্লাহ্ এর পর যদি কাউকে সিজদাহ্ দিতে বলতো তাহলে সেই সিজদাহ্ টা আমি আব্বুকে দিতাম। অথচ সেই আব্বুই কি-না আমায় ভালোবাসলো না? আমার এক জীবনে এমন বিশাল আফসোস পুষে বাঁচতে হবে ভাবিই নি। তুমি আমায় তো কত সুন্দর জীবন দিলে আম্মু, একটু আব্বুর ভালোবাসা তো দিলে না?”
মুনিয়া বেগম টলমলে অশ্রু নিয়ে মেয়ের পানে তাকিয়ে আছেন, চোখে মুখে তার অবিশ্বাসের ছাপ। চিত্রা চঞ্চল হলেও কখনো আবদার, অভিযোগ, অভিমান কিংবা বায়না করে নি মায়ের কাছে। কিন্তু আজ যখন সবকিছুই মায়ের পায়ের কাছে ঢেলে দিলো, তখন মায়েরই বা কী বলার থাকতে পারে!
নুরুল সওদাগরের কথা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। আজ যেন নতুন চিত্রাকে দেখছে সে। মেয়েটার এমন পরিবর্তন ভাবিয়ে তুললো সবাইকে।
বা’চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রুকণাকে ভীষণ অবহেলায় মুছে ফেললো চিত্রা। তাচ্ছিল্য করে বললো,
“আজ এমন কথা কেনো বলছি সেটাই ভাবছো তাই না? কারণ আছে দেখেই বলছি। যখন বা’হাতটা ঝলসে গেলো, হসপিটালের বিছানায় বেঁচে থাকার যু* দ্ধে আমি অনবরত ছুটে যাচ্ছি তখন আপনি আব্বু আমার ছায়া নাহয়ে আমার দিকে ছুঁড়ে মারলেন অবিশ্বাসের তীর। আমি সেদিন কতটা ব্যাথা পেয়েছি তা আপনাকে বুঝাতে পারবো না, আব্বু। সেদিনেই ঠিক করেছিলাম, আপনার অবিশ্বাসের তীর আমি ভেঙে দিবো। আর আজই সেই দিন।”
চিত্রার শেষ কথায় অবাক হলো সবাই। কিন্তু বুঝে উঠতে পারলো না কথাটির সারাংশ। ঘেমে-নেয়ে একাকার মাহতাব। শার্টের বাহুতে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে কেমন বোকা বোকা কণ্ঠে বললো,
“কী বলছো এসব!”
মাহতাবের অবস্থা দেখে খিল খিল করে হেসে উঠলো চিত্রা সেকেন্ডে মাঝে বার বার তার পরিবর্তন ভাবিয়ে তুলছে সবাইকে। অনাকাঙ্খিত ঝরের আভাসও যে পাচ্ছে সবাই। অহি অধৈর্য কণ্ঠে বললো,
“কী বলছিস তুই?”
“তোমরা জানতে চাও না আমাদের এই ঝলসানোর কারণ কে?”
“কে আবার? মহিন?”
চিত্রার প্রশ্নে অহির সহজ-সরল উত্তর। চিত্রা হাসলো, ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“ভুল উত্তর।”
এতক্ষণে ড্রয়িংরুমে অবস্থানরত প্রত্যেকের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছে। অবাক প্রত্যেকটা মানুষ। চিত্রার কথার অর্থ যেন বুজছে না কেউ। ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো এবার তুহিনের। উৎকণ্ঠিত হয়ে বললো,
“তবে কে করেছে তোদের সাথে এমন?”
চিত্রা হেলতে দুলতে মাহতাবের কাছে এসে বসলো। ফিচলে কণ্ঠে বললো,
“কী দুলাভাই, আপনি বলবেন না আমি বলবো?”
মাহতাবের অবস্থা তখন বেহাল। মুখের মাঝে কৃত্রিম হাসি আঁকার মিছে চেষ্টাও করলো। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,
“কি, কিসব বলছো শালীকা? আমি জানবো কীভাবে?”
“জানবেন না কেন? আপনি নিজে করলেন সেই কাজ অথচ বলছেন অন্য কথা, ইট’স নট ফেয়ার।”
বড়সড় একটা বি* স্ফোরণ হয়ে গেলো ড্রয়িংরুমে। সমস্বরে সবাই চেঁচিয়ে উঠে বললো,
“কী?”
চিত্রার চোখ-মুখে এতক্ষণের ঠাট্টার জায়গায় ছড়িয়ে গেলো কাঠিন্যতা। দৃঢ় কণ্ঠে মাহতাবের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আপনি আমাদের সাথে এমনটা কেনো করেছেন, দুলাভাই!”
মাহতাব ততক্ষণে ঘেমে-নেয়ে একাকার। উপস্থিত মানুষ গুলোও প্রতিক্রিয়া দেখাতে ভুলে গেলো। একবার মাহতাব, আরেকবার চিত্রার দিকে তাকালো তারা। তন্মধ্যেই চাঁদনী সোফা ছেড়ে ধপ করে উঠে এলো। মুখ-চোখ তার লাল। রাগে দিশেহারা হয়ে সে চিত্রার গালে চ* ড় বসানোর জন্য হাত তুলতেই তার হাত ধরে থামিয়ে দেয় চিত্রা। মুখে আগের ন্যায় হাসি বজায় রেখে বলে,
“আরে আপা থামো। এত তাড়াতাড়ি চ* ড়টা ওয়েস্ট করো না। বলা তো যায় না, অন্য কারোরও প্রয়োজন হতে পারে।”
চাঁদনী ফুঁসে উঠলো। ধমক দিয়ে বললো,
“তুই কেমন মেয়ে রে, চিত্রা? তোকে এত আদর করেছি আমি, অথচ তুই কিনা আমার মায়ের আচরণের রাগ আমার আর আমার স্বামীর উপর উঠাচ্ছিস এসব মিথ্যে বলে? এই তোর আচরণ?”
চিত্রার হাসি হাসি মুখ থমথমে হলো। শক্ত কণ্ঠে বললো,
“তোমার মায়ের প্রতি বা তোমার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই। একটা সময় এই বাড়ির নুন খেয়েছি, তাই এর গুণ গাইতেই হবে। আমি যা বলছি তা এক বিন্দুও মিথ্যে না। আগে শুনবে তারপর যা বলার বলবে।”
চিত্রার মুখে চিলিক দেওয়া আত্মবিশ্বাস দেখে চাঁদনীর তরতাজা, টগবগে রাগটা মিইয়ে এলো। ধীর কণ্ঠে বললো,
“আচ্ছা বল, কী বলবি?”
চিত্রা ছোটো শ্বাস ফেলে। মাহতাবের দিকে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসি দেয়, অতঃপর নিজের বড় চাচা আফজাল সওদাগরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“চাচা, তুমি কী রফিক মোহাম্মদ নামে কাউকে চেনো?”
আফজাল সওদাগর কপাল কুঁচকালেন, কতক্ষণ মনে করার চেষ্টা করলেন এমন নামে কাউকে চেনেন কি-না। অতঃপর ব্যর্থ হয়ে হতাশ স্বরে বললেন,
“না আম্মু, মনে পড়ছে না।”
“আমি মনে করাচ্ছি। আজ থেকে বিশ কিংবা একুশ বছর আগে তোমার কোম্পানিতে একজন শ্রমিককে চু* রির দায়ে ফাঁসানো হয়। তা নিয়ে অনেক গন্ডগোল চলে কয়েকদিন, অতঃপর সেই ভদ্রলোক তার গায়ে লাগানো তকমা সইতে না পেরে আ* ত্মহ* ত্যা করে। মনে পড়লো এবার?”
আফজাল সওদাগরের কুঁচকানো ভ্রু সোজা হয়। ঘটনা মনে পড়তেই সে অনবরত মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললেন,
“হ্যাঁ, হ্যাঁ। মনে পড়েছে। সে অনেক আগের কাহিনী। বেচারা নির্দোষ ছিলো কিন্তু ভুল তথ্যের কারণে তাকে হেনস্তা পোহাতে হয় এবং সে এটা মানতে না পেরে আ* ত্মহ* ত্যা করে। কিন্তু এটার সাথে ওটার কী সম্পর্ক?”
“সম্পর্ক আছে, চাচা। সেই রফিক মোহাম্মদের ছেলেই মাহতাব দুলাভাই।”
আফজাল সওদাগর হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠলো,
“কী? পা* গল হলে নাকি? মাহতাবের বাবা মা* রা গেছে তিন বছর আগে। তুমি কী বলছো এসব?”
“আমি মোটেও ভুল বলছি না, চাচা। দুলাভাই ই সে লোকের ছেলে। আর তিন বছর আগে যে লোকটা মারা যায় তিনি কেবল আর কেবল মাত্র মহিনের বাবা।”
চিত্রার রহস্য নামা গোলকধাঁধায় ফেঁসে সবাই হতভম্ব। অহি হতভম্ব কণ্ঠে বললো,
“মানে!”
“মানে হলো, লতা আন্টি, মানে মাহতাব দুলাভাইয়ের মা, রফিক আঙ্কেল মা* রা যাওয়ার পর আবার দ্বিতীয় বিয়ে করেন এবং সেই ঘরের সন্তানই হলো মহিন। তাই না আন্টি?”
শেষের প্রশ্নটা লতা বেগমের দিকে তাকিয়ে করলো চিত্রা। মহিলা রীতিমতো তাজ্জব বনে রইলেন। প্রশ্নটা করলেই উপর-নীচ মাথা নাড়িয়ে ক্ষীণ স্বরে বললো,
“হ্যাঁ।”
উপস্থিত সবার মাঝে অবিশ্বাস্যকর পরিস্থিতি। একজন আরেকজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। এমন কিছুও যে থাকতে পারে তা কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি। চাঁদনী আপা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো মাহতাবের দিকে। বিবশ কণ্ঠে বললো,
“তারপর বল চিত্রা।”
চিত্রাও দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুরু করলো,
“খুব সম্ভবত রফিক আঙ্কেল মারা যাওয়ার সময় দুলাভাই এর বয়স ছয়-সাত ছিলো। তার বাবার এমন মৃ* ত্যু মানতে পারে নি সে। মনের মাঝে পুষিয়ে রেখে ছিলেন ভীষণ ক্ষোভ। উপর উপর সে যতটা ভালো মানুষ ছিলেন, ভেতর ভেতর তার প্রতিহিংসা তাকে এর চেয়ে বেশিই অন্ধ করে দিয়েছিল। যার ফলস্বরূপ বড়ো হওয়ার পর সেই প্রতিহিংসাপরায়ণের জন্য সে বিয়ে করেছে চাঁদনী আপাকে। চেয়েছিল এ বাড়ির ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরে সবাইকে নিঃশেষ করে দিতে। তাই না দুলাভাই?”
মাহতাব জবাব দিলো না। মাথা নিচু করে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো ড্রয়িংরুমের মেঝেতে। সবার নিস্তব্ধতা ঠেলে চিত্রাই আবার বলে উঠলো,
“দুলাভাই সম্ভবত তার মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে এবং সে ঘরের সন্তান মহিনকেও মানতে পারে নি কিন্তু সময় ও পরিস্থিতির কারণে সে বলতে পারে নি সেটা। তাই তো সবার প্রতি ক্ষোভ মিটানোর সুযোগ পেলো আপার সাত মাসের সেই অনুষ্ঠানে। চেরির ভাষ্যমতে চেরির শরীরে হাত দিয়েছিল মহিন যা পরবর্তীতে অহি আপা নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছিল তোমাদের সাথে। আমরাও ঘৃণা করেছি মহিনকে। চেরির কথাকেই সত্যতা ধরেছি আর তার কারণও আছে। কিন্তু পরপর আমাদের উপর এ* সিড নিক্ষেপ এবং মহিনের মৃ* ত্যু সব ধোঁয়াশা করে রেখে দিল। অতঃপর সেদিন বড় আপার সিঁড়ি থেকে পড়ে যাওয়া আমার কলঙ্কের কালি হলো। কিন্তু এখানে এত মানুষকে বিভিন্ন ঘটনা সাপেক্ষে দোষী মনে হলেও দোষ গুলো করেছে একজন, সে হলো মাহতাব।
প্রথমে আসি চেরির ঘটনায়। চেরিকে আঁধার ঘরে ডেকে নিয়ে মহিন বিশ্রী কাজ করেছে আমরা জানতাম এবং মেনেও ছিলাম কিন্তু সেদিন চেরির সাথে দুষ্টুমি করার ছলে জিজ্ঞেস করতেই চেরি বললো সে মহিনের মুখ দেখে নি পাঞ্জাবি দেখেছিল। সেই অনুষ্ঠানে দুলাভাই এবং মহিন একই পাঞ্জাবি পড়ে ছিলো, তাই দোষটা দু’জনের একজনই করতে পারে। সন্দেহের তালিকায় পড়ে গেল দু’জনের নাম। অতঃপর কিছুদিন আগে কোচিং থেকে আসার সময় আমি মাহতাব দুলাভাইকে দেখি পতি* তালয়ের একটা গলিতে যেতে। প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিলো না, কিন্তু আমি নিজে সাথে সাথে তার পিছে গিয়ে নিজের চোখকে বিশ্বাস করিয়েছি। সব ঘটনা গুলো কেমন আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগলো। আব্বু বলেছিল মহিন মা* রা যাওয়ার আগে আমার ফোন দিয়ে তার সাথে কেউ কথা বলেছে। আমি চট করে রেকর্ডিং লিস্টে ঢুকে যাই আর সৌভাগ্যক্রমে সেদিনের রেকর্ডিং পেয়ে যাই যেখানে কণ্ঠ একজন ছিলো মহিন আর একজন ছিল দুলাভাই। তারা কী নিয়ে যেন তুমুল কথা কাটাকাটি করছে। স্পষ্ট ভাবে বুঝার পর বুঝলাম মহিন প্রচুর ভয় পেয়ে ছিল। সে বুঝতে পেরেছিল আমাদের এ* সিডের ঘটনা সম্পূর্ণ রূপে তার ঘাড়ে গিয়ে পরবে তাই সে দুলাভাইকে হুমকি দিচ্ছিল সব বলে দিবে। আর দুলাভাই আমার ফোন দিয়ে কল দিয়েছিল হয়তো ধরা না পড়ার জন্য। হয়তো সে মহিনের হুমকি তে ভয় পেয়েই খু* ন করেছে নিজের ভাইকে। কেবল তাই ই না, দুলাভাই মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত। তার নারী দোষ আছে। পতি* তালয়ে তার প্রায়ই আসা-যাওয়া।”
ড্রয়িং রুম জুড়ে নিস্তব্ধতা। সকলের চোখে অবিশ্বাস্যতা। স্বয়ং লতা বেগম তার ছেলের দিকে সেই অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন। কণ্ঠ ধ্বনির মাঝেই আটকে রইলো শব্দরা৷ বহু কষ্টে সে উচ্চারণ করলো,
“এসব মিথ্যে, তাই না আব্বা?”
মাহতাব আগের ন্যায় মাথা নিচু করেই রইলো। সবাই মাহতাবের উত্তরের আশায় উন্মুখ হয়ে রইলো। এই বুঝি মাহতাব বলবে সব মিথ্যে। কিন্তু সবাইকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“সবই সত্যি। একটা শব্দও মিথ্যে না। আমাকে যা ভাবেন সবাই তা আমার ভালো মানুষির আদল কেবল, আমি ভালো মানুষ নই। আর চিত্রাদের এ* সিড নিক্ষেপ করার কাজটাও আমি করিয়েছি। উদ্দেশ্য ছিল চেরি আর অহিকে ঝলসানোর, চিত্রাকে না। আর মহিনকেও খু* ন করেছি অনিচ্ছাকৃত। আমি ওকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ও বুঝে নি। আমি নিজের রাগ সংবরন করতে না পেরে মে* রে ফেলি। এ* সিড নিক্ষেপ করা ঐ দুই ছেলেকেও আমিই মে* রেছি যেন ওরা আমার বিপদ আনতে না পারে। চেরির সাথেও ওটা আমি করেছি।”
শেষ কথাটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই সশব্দে চ* ড় পড়ে মাহতাবের গালে। চ* ড়টা মেরেছে চাঁদনী। রাগে তার মুখ লাল হয়ে গিয়েছে, হাত-পা কাঁপছে। এক দলা থু থু মাহতাবের উপরে ফেলে ঘৃণা ছুঁড়ে বললো,
“পি* চাশ।”
চিত্রা চাঁদনীকে শক্ত করে ধরলো। কম্পিত কণ্ঠে বললো,
“আপনিই সেদিন চাঁদনী আপাকে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছেন তাই না? আমি হাতটা কেবল ধীরে ঝারা দিয়ে ছিলাম। কিন্তু আপা বললো আমি নাকি ধাক্কা দিয়েছি। তখন উপরে আমি আর আপনি ছিলাম, আমি যেহেতু করি নি তার মানে,,, “
চিত্রার বাকি কথা বলতে হয় না। মাহতাবই গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“আমিই করেছি সে কাজটা। আর এই যে এত দ্রুত সবটা স্বীকার করে নিলাম কেন জানো? কারণ এতশত বাহানার মাঝেও আমি তোমায় ভালোবেসে ফেলেছি।”
আবারও চ* ড় পড়লো মাহতাবের গালে। এবার চ* ড়টা দিলেন আফজাল সওদাগর। রাগে সে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো। তুমুল এক ধাক্কা দিয়ে বললো,
“তোর সাহস কী করে হলো আমার মেয়েদের দিকে তাকানোর? তোর চোখ উঠিয়ে ফেলবো।”
মাহতাব কথা বললো না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো। আরও কয়েক ঘাঁ প্রহার হলো। হৈচৈ ভরে গেলো সওদাগর বাড়ি। পুলিশ কল দেওয়া হলো। লতা বেগম জ্ঞান হারালেন। চাঁদনী কথার বলার শক্তি না পেয়ে ধপ করে বসে পড়লো। তুমুল বিশৃঙ্খলা পড়লো বাড়ি জুড়ে। চিত্রা সেই বিশৃঙ্খলা ঠেলে বেরিয়ে গেলো রাস্তায়। রাত এগারোটার ব্যস্ত শহরে একা পায়ে হাঁটা শুরু করলো। অনেকটা পথ যাওয়ার পর পুলিশের একটা গাড়ি তার পাশ দিয়ে চলে গেলো সওদাগর বাড়ির দিকে। চিত্রা তাচ্ছিল্য হাসলো ক্ষাণিক। গতপরশু রাতে সে মাহতাব দুলাভাইদের বাড়িতে প্রবেশ করেছিল পাইপ বেয়ে। ভীতু চিত্রা হুট করেই কেমন সাহসী হয়ে গেলো।
তৃপ্তি ভরে সে দেখে নিলো শহরের রাজপথ। আর তো থাকা হবে না এই শহরে। সে আর বাহার ভাইতো অনেকদূর চলে যাবে সংসার করতে। কালই তারা শহর ছাড়বে। বাহার ভাই আরেকটা চিঠি পাঠিয়ে নির্দিষ্ট ঠিকানা দিয়ে দিয়েছে। সেখানে গেলেই দু’জনের দেখা হবে, তারপর চিরতরে বাহার ভাই চিত্রার। খুব দূরে চলে যাবে তারা। কিন্তু বাহার ভাই বেছে বেছে কবরস্থানের ঠিকানায় কেন দিলো!
#চলবে….