লিখিত পরীক্ষা দিয়ে বিবাহ
৩য় পর্ব
—————————————————
রাত প্রায় এগারোটা বিশ।আমি আমার ডেক্সটপ কম্পিউটারে ঢুকে ইউটিউবে কমেডি শো দেখছি,আর হো হো করে হাসছি।এসময় আপা ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করলেন,
-এই তোর সমস্যা কি ?
-আমার তো কোনো সমস্যা নাই।
-অবশ্যই আছে। একটা ছেলের বিয়ে ভেঙে গেছে,কোথায় মন খারাপ করে বসে থাকবি ,কান্নাকাটি করবি, তা না।তুই কমেডি শো দেখে হা-হা-হি-হি করছিস ?
-কান্না না আসলে কি করব ?
– কান্না না আসলে এটলিস্ট মন খারাপ করে শুয়ে থাক।
-এটা অবশ্য ভালো বলেছিস। আপা এককাজ কর, যা দুলাভাইকে পাঠিয়ে দে।মন খারাপটা আর কিভাবে উদযাপন করা যায়,এ ব্যাপারে উনার একটা পরামর্শ দরকার।আমার ধারণা উনার কাছে,ইউনিক কোনো আইডিয়া পাওয়া যাবে।
-না, তোর দুলাভাইকে ডাকা যাবে না।সমস্যা আছে।
-কি সমস্যা ?
-আমি তাকে রুমের ভেতরে রেখে,বাইরে থেকে তালা মেরে দিয়েছি।
-কেন !
-শোন,আজ এমনিতেই সে অনেক অপমানিত হয়েছে। তোর উপকার করার জন্য বেচারা কত কষ্ট করল।অথচ সবাই তাকে ভুল বুঝল।জানিস মা কি বলেছে ?
-কি বলেছে ?
-মা একটু আগে আমাকে ডেকে বলল,”শোন জামাইরে বলবি,সে যেন আমার ছেলের আশে-পাশে না থাকে।” দেখ, কি অপমান।
একথা বলেই আপা কেঁদে ফেলল।এই মেয়েটার এই এক সমস্যা, কথায় কথায় কাঁদবে।স্বামীকে সব মেয়েই ভালোবাসে।কিন্তু আমার বোনের মতো এমন স্বামী পাগলা মেয়ে,এ দুনিয়ায় কমই আছে।আমি আপাকে নরম ভাবে বললাম,
-তুই যা, দুলাভাই কে পাঠিয়ে দে।মাকে আমি সামাল দেব।
আমার কথায় আপার মুখে এক অনাবিল হাসি ফুটে উঠল। উনি অনেকটা দৌড়ে চলে গেলেন।একটু পর দুলাভাই ধীর পদক্ষেপে আমার রুমে ঢুকলেন।দুলাভাই রুমে ঢুকেই একটু ভাব নিয়ে বললেন,
-তোমার আপার কাছে শুনলাম, তোমার নাকি কিছু বিষয়ে পরামর্শ দরকার ?
-জি,আপনি ঠিক শুনেছেন।
-ঠিক আছে বলো,আমি কিভাবে তোমাকে সাহায্য করতে পারি।
-দুলাভাই,বিয়ে ভাঙার দু:খে কি করা যায় বলেন তো।আমি তো আর মদ-গাঁজা খাইনা।কিন্তু আবার কিছু একটা না খেলেও তো, চেহারাতে দু:খ দু:খ ভাবটা আসবে না,তাই না ? এখন আমাকে ভালো একটা পরামর্শ দেন।
দুলাভাই কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন,ভাবলেন,তারপর বিজ্ঞের মতো গাম্ভীর্যতা নিয়ে বললেন,
-এক কাজ করো।একসাথে কয়েকটি ঘুমের বড়ি খেয়ে ফেলো।
-কি বললেন !
-অবাক হচ্ছো কেন ? আমি তো তোমাকে বিষ খেতে বলিনি।ঘুমের বড়ি খেতে বলেছি।শোনো,ঘুমের বড়ি খাবে,তারপর মরার মতো দুদিন ঘুমাবে।
-তা না হয় ঘুমালাম।কিন্তু বেহুদা খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে দুই দিন ঘুমিয়ে আমার লাভ কি ?
-এতে দুই ধরণের লাভ।এক,লিমার পরিবার যখন তোমার ঘুমের বড়ি খাওয়ার কথা শুনবে, তখন ওদের মনে তোমার জন্য একটা সিমপ্যাথি জাগবে।আর দুই নম্বর হলো,মনের কষ্টে ঘুমের বড়ি খাওয়ার ফলে,তোমার মধ্যে দেবদাস দেবদাস একটা ফিলিংস আসবে।যেটা একটা সিনেমাটিক বিষয় হবে।
-এটা অবশ্য ভালো বলেছেন।
ঠিক এসময় আপা রুমে ঢুকলেন। আমি আপাকে বললাম,
-আপা তোর কাছে ঘুমের ঔষধ হবে ? থাকলে নিয়ে আয় তো।
-কেন ? ঘুমের ঔষধ দিয়ে তুই কি করবি ?
– বিয়ে ভাঙার দু:খে,ঘুমের ঔষধ খেয়ে মরার মতো ঘুমাব।দুলাভাই বলেছে এটা নাকি খুবই সিনেমাটিক ব্যাপার।আপা তোর স্বামী আসলেই একটা জিনিয়াস।
আপা ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ দুলাভাই এর দিকে তাকিয়ে রইলেন।তারপর দুলাভাই কে বললেন,
-তুমি এই রুমে আসছো দুই মিনিটও হয়নি,এরমধ্যে ওরে কুবুদ্ধি দেওয়া শেষ ! আসলে কি জানো, মা ঠিকই বলেন, তোমারে মতো মানুষকে সব সময় ঘরে তালা মেরে রাখা উচিত।
-আপা,তুই দুলাভাইকে বকছিস কেন ? আমি তোকে বললাম তোর কাছে ঘুমের বড়ি আছে কিনা ? থাকলে দে, না থাকলে বল নাই।
-না,নাই।আমার কাছে ঘুমের বড়ি নাই।আমি কি ফার্মেসি ?
দুলাভাই বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন।তারপর বললেন,
-তোমরা একটু বসো,আমি এক্ষুনি আসছি।
কিছুক্ষণ পর দুলাভাই এক পাতা ঔষধ নিয়ে রুমে ঢুকলেন।তারপর হতাশ ভঙ্গিতে বললেন,
-সরি ইমু,তোমার আপার ব্যাগ,আমার ব্যাগ খুঁজলাম। কিন্তু ঘুমের ঔষধ পেলাম না।
-তাহলে আপনার হাতে ওটা কি ?
-ঘুমের বড়ির বিকল্প একটা ঔষধ।খুবই কার্যকরী।
এই কথা বলে দুলাভাই তার হাতে থাকা এক পাতা ঔষধ আমাকে দেখালেন।আমি ঔষধটি দেখে চিনতে না পেরে বললাম,
-দুলাভাই কি ওটা ?
-বার্থ কন্ট্রোল পিল।খাও, এটাতেও কাজ হবে।
-এটাতে কাজ হবে মানে ! দুলাভাই আপনার সমস্যা কি ? আপনি কি মানুষকে কোনো ভালো বুদ্ধি দিতে পারেন না ? ঘুমের বড়ি আর বার্থ কন্ট্রোল পিল কি এক ?
-শোনো তোমাকে একটা কাহিনি বলি,আমি একবার তোমার আপার সাথে রাগ করে ঘুমের ঔষুধ খাওয়ার প্লান করলাম।কিন্তু বাসায় ঐ মুহূর্তে কোনো ঘুমের ঔষধ ছিল না।তখন কি আর করা,বুদ্ধি করে তোমার আপার বার্থ কন্ট্রোল পিল নিয়ে খেয়ে ফেললাম।ওটা যে ঘুমের বড়ি ছিল না, সেটা তোমার আপা বুঝতেও পারেনি।
-মাইগড,কোনো সমস্যা হয়নি ?
-তা একটু হয়েছে।প্রচুর বমি হয়েছে।বমি করে পুরো ঘর ভাসিয়ে দিয়েছিলাম।বমি করতে করতে শরীর দূর্বল হয়ে এক সময় বাথরুমের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।শোনো সব কিছু মনের ব্যাপার।তুমি যদি এটাকে ঘুমের বড়ি মনে করে খাও,দেখবে ঠিকই কাজ হবে।প্রচুর ঘুম হবে।
-দুলাভাই আপনি সত্যি একটা জিনিয়াস।দেন ঔষধটা দেন,খেয়ে বমি করতে করতে দূর্বল হয়ে ঘুমাই।
ঠিক এ সময় মা আমার রুমে ঢুকলেন।ঢুকেই বললেন,
-কিরে তুই কি ফোন বন্ধ করে রাখছিস ? তোকে নাকি রিমা সেই বিকাল থেকে ফোন দিয়ে পাচ্ছে না।
-মা,বিয়ে তো অলরেডি ভেঙে গেছে।এখন মেয়ের ছোট বোন কেন খামাকা আমারে ফোন দিচ্ছে ? এটা তো এক ধরণের ফাজলামি।
এসময় আপা বললেন,
-ইমু শোন,লিমা তো হাত ছাড়া হয়ে গেছে।এখন এক কাজ কর, চেষ্টা করে দেখ রিমাকে কোনোভাবে পটাতে পারিস কিনা ? শোন আমার কিন্তু লিমার থেকে রিমাকেই বেশি ভালো লেগেছে।কি সুন্দর মেয়েটা !
আমি আপার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
-তুই এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন ? আমি তো একটা সম্ভাবনার কথা বললাম।শোন আমেরিকান পাত্রী বলে কথা।
-আপা শোন,আমার সাথে লিমার বিয়ের কথা হচ্ছিল, রিমার না। ওটা একটা পিচ্চি মেয়ে।আমি ওকে কেন বিয়ে করব ?
এতক্ষন দুলাভাই চুপচাপ ছিলেন। মা এর ভয়ে কোনো কথা বলেন নি।এবার তিনি সাহস করে মুখ খুললেন,
-ইমু শোনো, আমার ধারণা ওরা লিমা-রিমা কাউকেই তোমার সাথে আপসে বিয়ে দেবে না।একটা কাজ অবশ্য করা যায়।চল আমরা বরং লিমা বা রিমা, যে কোনো একজনকে তুলে নিয়ে আসি।
দুলাভাই এর কথা শুনে মা আর আপা দুজনেরই মুখ হা হয়ে গেল।আমি অবাক হয়ে বললাম,
-তুলে আনবেন মানে কি !
-আরে অবাক হচ্ছো কেন ? শোনো আমাদের এলাকায় একটা গ্রুপ আছে।ওরা চুরি-ডাকাতি, কিডন্যাপ ,ছিনতাই সবই করে।ওদের কাছে এটা পানি ভাত।ওরা আমার বন্ধু মানুষ।ফোন দিলেই চলে আসবে।ওদের রেট একটু বেশি। তবে আমি বললে ওরা ফ্রি তে কাজটা করে দেবে।আসলে ওরা আমাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে।কারণ ওরা বিভিন্ন বিষয়ে আমার কাছ থেকেই বুদ্ধি পরামর্শ নেয়।
মা এবার খুব জোরে দুলাভাইকে একটা ধমক দিয়ে বললেন,
-এই ছেলে, তুমি কি স্বাভাবিকভাবে কোনো কিছু চিন্তা করতে পারো না ? তোমার চিন্তাধারা এতোটা উদ্ভট কেন ?
এরপর মা আমার বোনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-তোরে আমি কি বলেছিলাম ?
আপা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন।মা আবার দুলাভাইকে বললেন,
-শোনো, তোমাকে একটা কথা বলি।তুমি এ মুহূর্ত থেকে,ইমুর বিয়ে নিয়ে তোমার মাথা আর খাটাবে না।তুমি ইমুকে আর কোনো উদ্ভট বুদ্ধি-পরামর্শ দেবে না।বুঝেছ আমি কি বলেছি ? যাও,এখন নিজের রুমে যাও। যেয়ে একটা ঘুম দাও।তোমার ঘুম দরকার।
-আম্মা আসলে আপনি ঠিক বলেছেন।আমার ভালো ঘুম দরকার।আসলে বেশ কিছুদিন থেকে কেন জানি ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না।
-এক কাজ করো, একটা ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে নাও। তোমার কাছে ঘুমের ট্যাবলেট আছে ?
-না,তা নেই। তবে সমস্যা হবে না।আমার কাছে ঘুমের ঔষধের বিকল্প একটা ঔষধ আছে।এটা খেয়ে নেব।ইমু বলেছে সেও খাবে। কারণ ওর ও ঘুম দরকার।
একথা বলে দুলাভাই মা কে উনার হাতের ঔষধটা দেখালেন।মা ঔষধের পাতাটি দেখেই চিনতে পারলেন।বিস্ময়ে তার মুখ হা হয়ে গেল।তিনি কয়েক সেকেন্ড কোনো কথাই বলতে পারলেন না।তিনি দাঁড়ানো অবস্থা থেকে হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়লেন।তারপর হতাশ কন্ঠে বললেন,
-মাইগড , এই পাগলের বংশ আমার পরিবারে এসে ঢুকছে কিভাবে ?
-আম্মা আপনার ধারণা ভুল।আমরা পাগল বংশ না।আমাদের বংশে কোনো পাগল নেই।অবশ্য আমার দাদার মাথায় একটু সমস্যা ছিল।তবে সেটাও সব সময় না। শুধু মাত্র জোছনা রাতে উনার এই সমস্যা দেখা দিত।উনি ভরা জোছনায় লেংটা হয়ে পুকুরের চারদিকে দৌড়াতেন আর মাঝে মাঝে পুকুরের পানিতে ঝাঁপ দিতেন।বিষয়টাকে সবাই পাগলামি মনে করলেও আমার কাছে এটাকে পাগলামি মনে হতো না।আসলে বিষয়টা হচ্ছে,দাদা ভেজা শরীরে চাঁদের আলো গায়ে মাখতেন, আর চাঁদ থেকে শক্তি নিতেন।মাঝে মধ্যে জোছনা রাতে আমারও ইচ্ছে হয়,দাদার মতো দৌড় দেই আর পুকুরে ঝাপ দেই।সমস্যা হচ্ছে শহরে দৌড়ানোর মতো পুকুর নাই।
মা এবার আসলেই রেগে গেলেন।তিনি চিৎকার করে আমার বোনকে বললেন,
-তোরে না বলছি এই বলদটারে ঘরে আটকায়ে রাখতে ? তুই ওরে আমার সামনে থেকে যেতে বল।আর শোন,ওরে যেন আমার ছেলের আশে-পাশে আমি না দেখি।
আপা মন খারাপ করে দুলাভাই এর হাত ধরে টানতে টানতে রুম থেকে নিয়ে গেলেন।দুলাভাই চলে যাওয়ার পরও বেশ কিছুক্ষণ মা কোনো কথা বললেন না।চুপ করে বসে থাকলেন। আসলে উনি প্রচণ্ড রেগে গেছেন।কিছুক্ষণ পর মা একটু শান্ত হয়ে,আমার হাতে একটা কাগজ দিয়ে বললেন,
-একটু আগে ফোন করে তোর খালা এই ঠিকানাটা দিয়েছেন।বলেছেন কাল দুপুর একটায় এই ঠিকানায় তোকে উপস্থিত থাকতে।লিমা ওখানে থাকবে।
-বুঝলাম না,আমার ওখানে কাজ কি ? বিয়ে তো ভেঙে দিয়েছে।
-আমি নিজেও জানিনা।তোর খালা যেতে বলেছে, যা। গেলেই তো জানতে পারবি।
-মা শোনো,আমি কোথাও যাচ্ছি না।আমি আর তোমার বোনের কোনো বিষয়ে নাই।
-শোন, তোর খালা তোর জন্য অলরেডি অনেক অপমানিত হয়েছেন।আমি চাই না,আমার বোন তোর জন্য আরও অপমানিত হোক।তোকে যেতে বলেছে যা, যেয়ে দেখ ঘটনা কি ? আর শোন খবরদার জামাইরে সাথে নিবি না।
বলেই মা রুম থেকে চলে গেলেন।আমি কাগজটি খুলে দেখলাম ঠিকানাটা নিউ মার্কেটে এলাকার একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টের।
এখন বেলা একটা চল্লিশ মিনিট।রেস্টুরেন্টে ঢুকে দেখলাম,কোনার একটি টেবিলে লিমা-রিমার সাথে অপরিচিত একটা মেয়ে ও ছেলে বসে আছে। তারা সবাই কথা বলছে। আমাকে দেখেই রিমা দৌড়ে এলো।আমার কাছে এসে বলল,
-আপনার সমস্যা কি ? কাল আমার ফোন কেটে দিলেন কেন ? আর তারপর থেকে আপনার ফোন বন্ধ কেন ? আপনাকে বলা হয়েছে ঠিক একটায় আসতে,এখন কটা বাজে ? এতক্ষণ কি করেছেন ? নাকি এতক্ষণ “হিপ ডোন্ট লাই” গানের ভিডিও দেখছিলেন ? চুপ করে আছেন কেন ? কথা বলছেন না কেন ?
-আপনি থামলে তো বলব ? আপনি এইমাত্র একসাথে কয়টা প্রশ্ন করেছেন বলতে পারবেন ?
-আচ্ছা এসব কথা পরে হবে। আগে চলেন সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।
রিমা আমাকে এক প্রকার টেনে টেবিলের সামনে নিয়ে গেলেন।তারপর সবার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন।
-ইমু ভাই, ইনি হচ্ছে শামীম ভাই।
শামীম ভাই দাঁড়িয়ে আমার সাথে হাত মেলালেন।
-ইমু ভাই সরি,আপনার জন্য একটা দু:খের সংবাদ আছে।শামীম ভাই এর সাথে আপার বিয়ের কথা ফাইনাল হয়ে গেছে।একটু আগে আপা আর শামীম ভাই দুজনেই সম্মতি দিয়েছেন।আমি অলরেডি তা বাসায় জানিয়ে দিয়েছি।সম্ভবত আগামী পাঁচ দিন পর বিয়ে।আর ইনি হচ্ছেন শামীম ভাই এর ছোট বোন।ওর নাম পিয়া, ও কলেজে পড়ে।ইমু ভাই,মেয়েটা অনেক সুন্দর না ? শামীম ভাই বললেন,উনারা নাকি পিয়ার বিয়ের জন্য ছেলে খুঁজছেন।
বলেই রিমা আমাকে চোখ টিপ মারলেন।
-আর শামীম ভাই, ইনি হচ্ছেন ইমু ভাই।জানেন,আপার বিয়ের জন্য যে দশটি ছেলের তালিকা করা হয়েছিল, সেই তালিকায় উনার নাম ছিল এক নম্বরে।কিন্তু গতকাল উনাকে সরাসরি রিজেক্ট করা হয়েছে।কারণ উনার ক্যারেক্টারে বেশ ঝামেলা আছে।শামীম ভাই,আপনি কি জানতে চান ইমু ভাই বাসর রাতে স্ত্রীকে কি করতে বলবেন ?
-বলো শুনি।
-উনি ঠিক করেছেন,বাসর রাতে উনি উনার স্ত্রীকে “হিপ ডোন্ট লাই” গান গেয়ে নাচতে বলবেন।সমস্যা হচ্ছে আপা আবার নাচ জানেনা।বিয়ে বাতিল হওয়ার এটাও একটা কারণ।পিয়া তুমি কি এই গানটা দেখেছ ? তুমি কি ওরকম করে নাচতে পারবে ?
পিয়া লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেলল। আমি অবাক হয়ে রিমার দিকে তাকিয়ে রইলাম।মাইগড,এ মেয়ে তো আসলেই ডেঞ্জারাস।
একটু পর লিমা আর শামীম ভাইকে একাকী সময় কাটানোর সুযোগ করে দিয়ে আমরা অপর কোনায় একটি টেবিল নিয়ে বসলাম।খাওয়ার অর্ডার দিয়েছেন শামীম ভাই।যে মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ভেঙে গেছে,সে মেয়ের হবু জামাই এর টাকায় এখন আমি চাইনিজ খাবার খাচ্ছি।বুঝতে পারছি না,বিষয়টা কি দু:খজনক নাকি আনন্দদায়ক।খেতে খেতে রিমা বললেন,
-ইমু ভাই দেখেন,ওদের দুজনকে কেমন মানিয়েছে ? আসলে কি জানেন, আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে। লিমা আপার পাশে আপনাকে একটুও মানাতো না।
এতক্ষণ চুপ করে খাচ্ছিলাম। কিছুই বলিনি। এবার মনে হলো কিছু একটা বলা দরকার।
-রিমা আপনারা কি আমাকে অপমান করার জন্য বা লজ্জা দেওয়ার জন্য কিম্বা কষ্ট দেওয়ার জন্য এখানে ডেকে এনেছেন।যদি সেটা করে থাকেন,তাহলে বিনয়ের সাথে বলছি,আপনাদের নিরাশ হতে হবে।আপনি হয়তো জানেন না,আমার বাসায় সবাই আমাকে গন্ডার বলে। কারণ দু:খ,কষ্ট,লজ্জা,অপমান এগুলো আমাকে খুব একটা স্পর্শ করে না।
-তাই! ঠিক আছে তাহলে একটা পরীক্ষা হয়ে যাক।
-আবার পরীক্ষা !
-জি স্যার,আবার পরীক্ষা।শোনেন আগামী পাঁচ দিন আপনি আমার সাথে সাথে থাকবেন। আর লিমা আপার বিয়ের সব আয়োজন কাছ থেকে দেখবেন।আমি দেখতে চাই, লিমা আপাকে যখন শামীম ভাই নিয়ে যাবে,তখন আপনার চেহারায় কষ্টের কোনো ছাপ পড়ে কিনা।আমি শিওর তখন আপনি অবশ্যই কষ্ট পাবেন।বলা যায় না, চোখে পানিও চলে আসতে পারে।আর যদি দেখি আপনি নরমাল,তাহলে বুঝব আপনি আসলেই গন্ডার। হা হা হা..।
-আমি কেন আগামী পাঁচ দিন আপনার বোনের বিয়েতে থাকব ?
-কারণ আপনার সাহায্য আমার দরকার।
-কিসের সাহায্য ?
-শোনেন আমি তো ঢাকার সব কিছু চিনি না।বিয়ের বিভিন্ন কেনা-কাটায় হয়ত আমাকে বিভিন্ন জায়গায় যেতে হবে।অবশ্য আমি চাইলে আমার যে কোনো কাজিনকে নিয়ে যেতে পারি।কিন্তু আমি আসলে দায়িত্বটা আপনাকে দিতে চাচ্ছি।
-তারমানে আপনি আমাকে শ্রমিকের মতো খাটাতে চাচ্ছেন ?
-ছি,আপনি এভাবে ভাবতে পারলেন ? শোনেন আজ যদি আমার একটা ভাই থাকত,তাহলে হয়তো আপনার সাহায্য চাইতাম না।
-তারমানে আপনারা আমাকে এখন ভাই বানাচ্ছেন !
-হা । তবে আপন ভাই না। খালাত ভাই। হা হা হা..। ও আর একটা কথা,আপনি যদি আমার সাথে আপার বিয়ে পর্যন্ত থাকেন, তো আমি আপনার জন্য একটা পুরস্কারের ব্যবস্থা করব।
-কি সেটা ?
রিমা আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন,
-শামীম ভাই এর বোন,পিয়ার সাথে আপনার বিয়ের ব্যবস্থা করে দেব।মেয়েটা সহজ-সরল আছে।এই মেয়ে দেখবেন ঠিকই বাসর রাতে আপনাকে “হিপ ডোন্ট লাই” গান গেয়ে এবং নেচে দেখাবে।কি,প্রস্তাবটি সেই রকম না !
আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই রিমা পিয়াকে বলল,
-পিয়া শোনো,তুমি আজকে বাসায় ফিরেই ইউটিউব থেকে “হিপ ডোন্ট লাই” গানটি বের করবে। গানটি মুখস্থ করবে এবং নাচটা দেখে ভালো করে প্রাকটিস করবে।তোমাকে পাঁচ দিন সময় দিলাম।পাঁচদিন পর আমি তোমার পরীক্ষা নেব।পরীক্ষায় পাশ করলেই ইমু ভাই এর সাথে তোমার বিয়ে।কি পাত্র পছন্দ হয়েছে ?
পিয়া লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। আমি অবাক হয়ে রিমা নামের বিচ্ছু মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম।এই মেয়েটিকে আমি যতই দেখছি,ততই অবাক হচ্ছি।
রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে শামীম ভাই তার গাড়িতে সবাইকে উঠতে বললেন। কিন্তু রিমা রাজি হলো না। সে শামীম ভাইকে বললেন, লিমাকে নিয়ে লং ড্রাইভে যেতে। শামীম ভাই আর লিমা চলে গেলেন।রিমা আবার আমার কানের কাছে মুখে এনে বললেন,
-সত্যি বলেন,শামীম ভাই যে আপাকে নিয়ে লং ড্রাইভে গেল, আপনি কষ্ট পাননি ?
আমি কোনো উত্তর দিলাম না।একটু পর আমাদের জন্য উবার কল করলাম।আমি ড্রাইভারের পাশের আসনে বসতে গেলাম।কিন্তু রিমা তা করতে দিলেন না।সে নিজে সামনের সিটে বসলেন।আমি আর পিয়া পিছনের সিটে বসলাম।গাড়ি চলতে লাগল। রিমা ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন,
-ইমু ভাই শোনেন,আমার কারণে আপনার বিয়ে ভেঙেছে। আমি যদি পরীক্ষাটা না নিতাম,তা হলে তো ভেজালটা লাগত না।তাই আমি ঠিক করেছি আমি যাওয়ার আগে আপনার বিয়েটা দিয়ে যাবো।আমিই হয়ত আপনাকে বিয়ে করতাম।আপনি দেখতে খারাপ না।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমিও আপার মতো নাচ জানিনা।সুতারাং আমাকে বিয়ে করলে আপনার বাসর রাতে বৌয়ের নাচ দেখার স্বপ্ন অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।আপনার এতো বড় একটা শখ তো আমার জন্য নষ্ট হতে পারে না, তাই না ? তবে সমস্যা নাই আমি পিয়াকে নাচটা শিখতে বলেছি।এ মেয়ে যে পারবে,সেটা আমি শতভাগ নিশ্চিত। কি পিয়া পারবে না ?
পিয়া লাজুক একটা হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।
-ইমু ভাই দেখেন মেয়েটার লজ্জা পাওয়া চেহারাটা কত কিউট না ?
আমি কিছুই বললাম না। অবাক হয়ে রিমার কথা শুনলাম।হঠাৎ করে অনুভব করলাম বিচ্ছু এই মেয়েটার পাগলামি কেন জানি এখন আমার ভাল লাগছে।
রিমা ড্রাইভারকে বলল,
-ভাই আপনার কাছে “হিপ ডোন্ট লাই” গানটি আছে ?
ড্রাইভার সাহেব নেতিবাচক ভাবে মাথা নাড়ল ।
-ওকে সমস্যা নাই। আপনি গাড়ি চালান। আমি আমার ফোন থেকে গানটি ছাড়ছি।
রিমা তার ফোন থেকে গানটি ব্লুটুথ কানেকশনে গাড়ির স্পিকারে ছাড়ল।
Oh, baby, when you talk like that
You make a woman go mad
……………………………………..
………………………………………
……………………………………..
You know my hip don’t lie..
পিছন থেকে দেখলাম বিচ্ছু মেয়েটা গানের তালে তালে মাথা নাড়ছে।আর পিয়া পাশ থেকে লজ্জা মিশ্রিত রোমান্টিক ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমিও পিয়ার দিকে একবার তাকালাম।ঠিক এসময় হঠাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে রিমা দেখল আমি আর পিয়া একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছি।রিমা বলল,
-ইমু ভাই,প্রেম তো মনে হয় জমে উঠেছে।শোনেন আপনারা চাইলে দুজনে হাত ধরে বসতে পারেন।আমরা মাইন্ড করব না। কি ড্রাইভার ভাই ওরা হাত ধরে বসলে আপনি কি মাইন্ড করবেন ?
ড্রাইভার সাহেব কিছুই বললেন না।আমি সরাসরি রিমার চোখের দিকে গভীর ভাবে তাকালাম।মনে হলো মেয়েটির মুখ হাসলেও এ মুহূর্তে মেয়েটির চোখ দুটো হাসছে না।চকিতে দেখলাম,রিমার চোখের কোনায় পানির মতো কি যেন চিকচিক করে উঠল।রিমা সেটা আড়াল করতে দ্রুত ঘুরে সোজা হয়ে বসল।
রিমার জন্য কেন জানি বুকের মধ্যে একটা কিছু অনুভব করলাম।
পরক্ষণে নিজেই নিজেকে বললাম,ছি আমি এসব কি ভাবছি।হঠাৎ করে অনুভব করলাম গাড়ীর সিটের উপর রাখা আমার হাতের উপর কোমল এক ছোঁয়া। তাকিয়ে দেখলাম পিয়া আমার হাতের উপর হাতটা রেখে গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।
(চলবে)
.