শেষ পেইজ
পর্ব ২
দুপুর তিনটার দিকে কথা নেই বার্তা নেই ধুম করে বৃষ্টি। তোদের পুলিশ স্টেশনের সামনে পানি জমে আছে কেন? সাদা জামা পুরো শেষ৷ মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে গেলাম পুরো রাস্তা জ্যাম। শেষ মেষ ওকে ড্রাইভারের সাথে পাঠিয়ে আমি রিক্সা করে এলাম।
ডিউটি থেকে ছুটি নিই, একটু রেস্ট করব তা না। ছুটিতে কাজ বেড়ে যায়। তাই মনে হয় আমার হসপিটালেই ভালো আমার জন্য৷
উড়না টা খুলে আমার ফাইলে ঠাসা ডেস্কের উপর শুকাতে দিতে দিতে এক নাগারে কথা গুলো বলে যাচ্ছে অঙ্কিতা।
ডাক্তাররা মোস্ট অফ দ্যা টাইম চুপচাপ থাকে দশটা বললে একটা উত্তর দেয়৷ এই মেয়ে কীভাবে রোগী সামলায় আমি সেটায় বুঝি না।
কাঁচের কাপের গাঢ় মেরুন রং লেবু চা টা সামনে টেনে নিয়ে এক চুমুক দিলো সে।
-এইবার বল কেন ডেকেছিস? সেইবার তোর ছেলের বার্থডে পার্টিতে দেখা আর তো যোগাযোগেই নেই। হঠাৎ এমন তলব?
যাই বলিস, তুমি কপাল করে একটা জামাই পেয়েছিস। তোর ছেলেকে যে কীভাবে সামলায়।
আমার ডাক্তার বর তো এখনো মেয়েকে ড্রেসেই পরাতে পারে না৷
আমি চুপচাপ শুনে যাচ্ছি। ও হচ্ছে ঝাকানো কোকের বোতল। যতই চেষ্টা কর মুখ খুলেই উতরিয়ে পড়বেই। থামানোর উপায় নেই।
এইবার সোজা হয়ে বসে পায়ের উপর পা তুলে চায়ের কাপ টা সামনে নিয়ে বলল-
– তোদের থানার চা গুলো জোস৷ আর আমাদের হসপিটালের গুলো চিনিতে ভরা। কি একটা বিশ্রি ব্যাপার। আর ডাক্তাররা সুগার ওয়ালা কফিই খায় বেশি।
মাথা ধরে আছে। দুই দিকে বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ধরে আছি মাথা। পুলিশের চাকরি করতে করতে কান্না কি জিনিস ভুলেই গিয়েছিলাম। কত কিছু সহ্য করা শিখে গিয়েছি। আজ বন্যা আপুকে দেখে কান্না করায় ভীষণ মাথা ধরে আছে৷ তারপর ও সমানে বকবক করে যাচ্ছে।
বাম হাতে কাপ ধরে ডান হাতে তুড়ি বাজিয়ে বলল-
– এই লাবনী, কি হয়েছে? কোথায় হারালি?
-তোর কথা শেষ হতে দিচ্ছি আর কি। এত কথা কেমনে বলিস? মাঝেমধ্যে মেডিটেশনে যাস না কেন?
রাগী চোখ করে তাকিয়ে আছে ও।
– হয়েছে এইবার?
মুখ বেকিয়ে বলল- হয়েছে। বল, কি হয়েছে?
– আমার রুম মেট বন্যা আপুকে মনে আছে তোর। আমার রুমে যখন মাঝেমধ্যে আসতি তখন আমার সাথে থাকতো।
আলতো হাসলো সে৷ কাপ টা টেবিলে নামিয়ে রেখে বলল,
– কেন মনে থাকবে না? বন্যা আপু আর আবীর ভাইয়ের প্রেমের গল্প আমাদের মেডিক্যাল ক্যাম্পাস অবধি ছড়িয়ে ছিলো।
সে যে পালালো আপু বিয়ের দিন, আমিও তো ছিলাম, ভুলে গেছিস?
কি প্রেম না? এইসব শোনাই এখনো মাঝেমধ্যে শরিফ কে৷
কি খরব উনাদের? কোন ঠিকানা পেয়েছিস? আরেক বার দেখার খুব ইচ্ছে হয় মাঝেমধ্যে। নিশ্চয়ই আমেরিকার আস্ট্রেলিয়া গিয়ে সেটেল হয়েছে। যা ব্রিলিয়ান্ট ছিলো দুজন৷
আবার হেসে বলল-
– মনে আছে তোর? আমার একবার তোর রুমে এসে জ্বর হয়েছিল। বন্যা আপু ক্লাস বাদ দিয়ে আমার সেবা করেছিল দুদিন।
আমার চোখে আবার পানি জমতে শুরু করলো।
তা খেয়াল করে অঙ্কিতা বলল,
– কি রে কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন?
আমি আবার নিঃশব্দে কাদতে লাগলাম, অঙ্কিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আমাকে ধরে বলল,
– কি হয়েছে? পাগলের মতো কাঁদছিস কেন?
-বন্যা আপু-
– কি হয়েছে বন্যা আপুর?
– লকাপে!
আমার কথাটা যেন বুঝতে পারলো না সে, মনে হলো সে মনে করছে সে ভুল শুনেছে।ধমক দিয়ে বলল-
– কি বলছিস? কান্না থামিয়ে বল।
আমি নিজেকে সামলে বললাম,
– বন্যা আপু আবীর ভাইয়াকে এটেম্প টু মার্ডারের কেইসে জেলে।
– কি? কি যা তা বলছিস?
– হ্যাঁ রে। বন্যা আপু পুরো মানসিক রোগী হয়ে গিয়েছে৷ সারা গায়ে মারের দাগ। রোজ অত্যাচার করতো নাকি তাকে-
কথাটা বলতে গিয়ে আটকে যাচ্ছে আমার স্বর, ঠোঁট গুলো কাঁপছে।
-আমাকেও চিনতে পারছে না। ধরতে গেলে চেচিয়ে উঠছে,মেরো না মেরো না করে। তাই তোকে ডেকেছি, –
ঠিক আমার মতো ও দৃষ্টিও যেন শূন্য।
কিছুক্ষনের জন্য সে বিশ্বাসেই করলো না আমার কথা। বুঝতে পারছে না কি উত্তর দেবে।
চেয়ারে গিয়ে বসলো৷ ভয়ংকর এক নিরবতা৷ জানলা দিয়ে ঢুকতে চাচ্ছে জবা গাছে ভেজা পাতা গুলো আলতো বাতাসে যেন। পট পট আওয়াজ হচ্ছে। আবার মিলিয়ে যাচ্ছে বড় রাস্তার কোন গাড়ির হর্নের শব্দে।
অনেকক্ষন পর সে গলা খাকিয়ে বলল,
– কোথায় আপু?
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে, নারী সেলের দিকে গেলাম৷
একটা চাদরের উপর দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে উনি। দুপুরে দেওয়া খাবার গুলো ওখানেই পড়ে আছে।
আমাকে দেখে স্যালুট দিয়ে দরজা খুলে দিলো নারী কনেস্টেবল হেমা।
আমি আর অঙ্কিতা আস্তে আস্তে ঢুকলাম, আর কেউ নেই এই সেলে।
অঙ্কিতা এখনো বিশ্বাস করছে না। চুল গুলো ছড়িয়ে আছে উপরের দিয়ে। ধুলো লাগছে ওতে৷ দেওয়াল ঘেঁষে উঠা কাটা তারের মতো পিঠের জামার ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে যেন দগদগে দাগ গুলো।
অঙ্কিতা উপর হয়ে বসে আলতো হাত লাগালো কেঁপে উঠলো শরীর টা।
অঙ্কিতা আমার দিকে তাকিয়ে বলল-
-লোহার মতো শক্ত কিছু দিয়ে মারার দাগ এই গুলো।
বৃষ্টির পর বাতাসে যেমন পাতা গুলো কেঁপে উঠে তেমন করে কেঁপে উঠলো আমার ভেতর টা।
অঙ্কিতা আলতো করে হাত দিলো উনার গায়ের উপর। হাত ধরে ডাকতে চাইলেই ধুম করে সোজা হয়ে গেল উনি। যেন কোন লাশ সে।
আমি আর অঙ্কিতা চমকে উঠলাম। অঙ্কিতা চুল সড়িয়ে বন্যা আপুর মুখ টা দেখলো। ওর চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো বন্যা আপুর গালে। উনি চোখ খুললেন না।
অঙ্কিতা আলতো করে কপালে হাত দিয়ে বলল,
– উনার তো ভয়াবহ জ্বর৷
হাত টা ধরে বলল,
– সেন্সলেস হয়ে আছে। তোরা দেখিস নি?
আমি কি বলব বুঝতে পারছি না। অবাক চোখে তাকিয়ে আছি।
অঙ্কিতা উঠে তাড়াতাড়ি ওর মোবাইল বের করে ফোন দিতে দিতে বলল-
– উনাকে এখনিই হসপিটালাইজ করতে হবে। এম্বুলেন্স পাঠাতে বলছি আমি।
আমি তখনো দাঁড়িয়ে আছি দেখে, ও আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল,
– যা কি কি ফরমালিটি আছে কর৷ এক্ষুনি নিতে হবে উনাকে।
আমি দ্রুত বের হলাম। অঙ্কিতা ফোন করছে।
– হ্যাঁ। এক্ষুনি আসুন আপনারা। হু থানায়।
কিছুক্ষণের মধ্যে এম্বুলেন্স এর লোকজন এসে গেল। ওরা স্ট্রাচারে বন্যা আপুকে তুলে নিলো, বের করতে যাবে তখন মহিম এসে বলল-
– লাবণী কি করছো তুমি? এই কেইসের ইনচার্জ আমি৷ তুমি এইভাবে একটা খুনের আসামীকে এত ভালো ট্রিট দিতে পারো না নিয়মের বাইরে গিয়ে। যত তোমার আপণ হোক না কেন?
– উনি সেন্সলেস হয়ে আছেন। এখন যদি মারা যায় দোষ টা তোমার উপরেই পড়বে। আর আমি তোমার জুনিয়র নয়। যতো তুমি ইনচার্জ হও। মনে রাখ আমিও ইন্সপেক্টর। সড়।
উনাকে নিয়ে এম্বুলেন্সে তুলে দিলো অঙ্কিতা। গড়িয়ে পড়ছিলো উনার দুই হাত। আর কনুই গুলো লাগছিলো কোন মাকড়শার জাল।
এম্বুল্যান্স বেড়িয়ে যেতেই অঙ্কিতা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল-
– উনাকে রোজ ড্রাগ দেওয়া হতো। এবং সেটা লং টাইম ধরে।
আমি তাকিয়ে আছি অঙ্কিতার দিকে। আমি যতটা অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছি তারচেয়ে বেশি অবিশ্বাস ওর নিজের কন্ঠে।
ঢাকার বৃষ্টির পর কাঁদা মাখা রাস্তায় কাঁদা ছিটিয়ে সাদা এম্বুলেন্স টা ছুটে যাচ্ছে। আর আমাদের মন ছুটে যাচ্ছে এই গল্পের মাঝের পেইজ গুলো দিকে। কি হচ্ছিলো বন্যা আপুর সাথে?
#দোলনা_বড়ুয়া_তৃষা