November 21, 2024

শিশির বিন্দু” পর্ব- ৫

“শিশির বিন্দু”
পর্ব- ৫
(নূর নাফিসা)
.
.
চিঠিটা পড়ার পর না চাইতেও কেন জানি ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে! হাত কাপছে, পা আর দাঁড়িয়ে থাকতে সমর্থ হচ্ছে না! বিন্দু সেখানেই মেঝেতে বসে পড়লো! চোখ থেকে টুপটাপ শব্দ করে অশ্রুবিন্দু চিঠির উপর পড়ছে! হামাগুড়ি দিয়ে চিৎকার করে কাদতে পারলে হয়তো মনের ভেতরে অবস্থিত ভারি পাথরটা তুলোর মতো হালকা হয়ে যেতো! কিন্তু তা করতে যে সক্ষম নয় সে! কঠিন পাথর সরু ও আঁকাবাঁকা রেখায় ফেটে মুখ থেকে বেরিয়ে এলো কিছু শব্দ,
“তোমার কথা অমান্য করেনি তোমার শিশিরবিন্দু। এক ফোটা অশ্রুবিন্দুও মাটিতে লুটিয়ে পড়তে দেইনি আমি। সবটা তোমার ভালোবাসায় লিখিত পত্রে জমা করে রেখেছি! তুমি আমাকে এভাবে না জানিয়ে চলে গেলে কেন! একটা বার প্রাণ ভরে দেখার সুযোগটাও কেন আমি পেলাম না! আবার কবে আসবে তুমি! আবার কবে দেখবো তোমায়! এভাবে হঠাৎ করে এতোটা রিক্ততা কেন আমাকে দিয়ে গেলে! তোমার শিশিরবিন্দু রাগ না করলেও যে খুব অভিমান করে ফেললো তোমার উপর! জানিয়ে গেলে যতটা না কষ্ট পেতাম তার চেয়েও শতগুণে কষ্ট দিয়েছো এভাবে লুকিয়ে গিয়ে! এক পলক দেখার সুযোগ দিলে কি এমন হয়ে যেতো শিশির!”
বিন্দু নিশব্দে কাদতে লাগলো! চিঠিটা আবারও পড়ার চেষ্টা করছে কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না! বারবার চোখ ঝাপসাই হয়ে যাচ্ছে! বিন্দু গলায় হাত দিয়ে দেখলো একটা উপহার ঝুলিয়ে গেছে শিশির! নিশ্চয়ই রাতে ঘুমের মাঝে পড়িয়ে দিয়েছে লকেটটা! বিন্দু সেটাতে তার ঠোঁট স্পর্শ করলো! চোখ ভালোভাবে মুছে লকেটটা খুলে দেখলো একপাশে সিলেটে তোলা তাদের কাপল ছবি। আর অন্যপাশ খালি। শিশিরের ইচ্ছে, অতি শীঘ্রই এপাশটা দখল হয়ে যাবে!
বিন্দু শিশিরের রেখে যাওয়া স্মৃতি ও তার সাথে কাটানো মুহুর্তগুলোকে নিয়ে ভাবনায় বিলীন হয়ে গেছে! বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর সে উঠে বাথরুমে গেলো৷ চোখেমুখে পানি ছিটকে নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে সে রুম থেকে বের হলো। ড্রয়িং রুমে সমাগম শুনতে পেয়ে বিন্দু এদিকেই এলো৷ দেখলো বিভোর বসে আছে শিশিরের বাবা মায়ের সাথে। বিন্দুকে দেখে শিশিরের মা উঠে এসে বললো,
– চোখেমুখের এ কি হাল! কান্না করেছো তুমি! আমি না দেখে এলাম ঘুমাচ্ছো!
– মা, আমি কি ভাইয়ার সাথে এখনই বাড়িতে যেতে পারি?
– হ্যাঁ। তোমার ভাইয়া তোমাকে নিয়ে যেতেই এসেছে। এসো, নাস্তা করবো সবাই মিলে।
– আমি খাবো না মা। ভালো লাগছে না আমার।
– শরীর খারাপ?
– না। ঠিক আছি আমি। খেতে ইচ্ছে করছে না এখন।
– অল্প খেয়ে নাও। তা না হলে অসুস্থ হয়ে পড়বে। কাল তো আবার পরীক্ষা। মন খারাপ করো না। শিশির কিছুদিন পরই চলে আসবে। এখন পড়াশোনায় একটু মনযোগ দাও। ভালোমতো এক্সাম দাও। এক্সামের পরপরই আবার নিয়ে আসবো। কেমন?
– আচ্ছা।
বিন্দু রুমে এসে ব্যাগ গুছাতে লাগলো। শীতুল এসে বললো,
– ভাবি, তুমি চলে যাচ্ছো! বাড়িটা পুরো ফাকা ফাকা লাগবে!
– এক্সাম শেষ হলে চলে আসবো।
– তোমার এক্সাম কবে শেষ হবে?
– প্রায় এক মাস।
– ওফ্ফ! কত্তোদিন! এতোদিন আমাকে মিস করতে হবে!
– মিস কেন করবে! বাসা তো দূরে না। যখন ইচ্ছে হবে, চলে যাবে।
– আমার ইচ্ছে হলেই যেতে পারবো নাকি! তুমি ডাকলে না মায়ের কাছে একটু বাহানা দিতে পারবো।
– আচ্ছা, যখন ইচ্ছে হবে কল করে জানিও। আমি ডেকে নিবো।
– ওকে।
বিভোর নাস্তার পরপরই বিন্দুকে নিয়ে চলে এলো। বিন্দু কিছু খেলো না সেই বাড়িতে৷ নিজ বাড়িতে আসার পরও তার মা খেতে বলেছে কিন্তু সে খায়নি! পড়াও হয়নি একটু! সারাক্ষণ মাথায় ছিলো শিশির আর চোখে ছিলো অভিমানী অশ্রু! বিকেলের অগ্রভাগে ফোন বেজে উঠলো! বিন্দু হাতে নিয়ে দেখলো অচেনা নম্বর! তাছাড়া এটা বাংলাদেশী নম্বর না! সে নিশ্চিত শিশির কল করেছে। তাই সে রিসিভ করলো না। ফোনটা একবার বেজে বন্ধ হয়ে আবার বাজতে শুরু করল৷ এবার বিন্দু কেটে দিলো। পরপর আরও চারবার কল এলো কিন্তু বিন্দু রিসিভ না করে বারবার কেটে দিয়েছে। এরপর মেসেজ এলো, “কল রিসিভ করছো না কেন?” এক মিনিট পর আবার মেসেজ, “রাগ করেছে আমার শিশিরবিন্দু?” তারও রিপ্লাই না পেয়ে আবার কল করে দু মিনিট পর মেসেজ দিলো, “সুইটহার্ট, একবার রিসিভ করো কলটা। আমার টেনশন হচ্ছে।” পরপর আরও দুইবার কল এলো। কিন্তু রিসিভ হলো না। এদিকে তাকে উপেক্ষা করে বিন্দুর ভেতরে ভাংচুর হচ্ছে! পাচ সাত মিনিটের মতো পাড় হতেই বিন্দুর ফোনে কল এলো তার শ্বশুর রায়হান মোল্লার নম্বর থেকে। বিন্দু নিজেকে স্বাভাবিক করে পানি পান করে গলা পরিষ্কার করে নিলো। দ্বিতীয়বার কল আসতেই সে রিসিভ করে সালাম দিলো৷ তিনি সালাম নিয়ে জানালেন শিশির তার ফোনে কল করছে। সে যেন রিসিভ করে। উনি নম্বরসহ টেক্সট করে দিলেন চিনে নেওয়ার জন্য। বিন্দু বেশ বুঝতে পারছে শিশির তার বাবার সাথে কথা বলে কৌশলে বলেছে তাকে জানিয়ে দিতে যাতে সে কল রিসিভ করে। শ্বশুরের কথা তো আর ফেলে দেওয়া যাবে না। তাই বিন্দু ঠিক করলো এবার রিসিভ করবে। ফোন হাতে নিয়েই বসে আছে সে। তিন চার মিনিটের মতো অতিক্রান্ত হতেই আবার কল এলো। বিন্দু রিসিভ করে কানে ধরে রাখলো কিন্তু কোনো কথা বললো না। শিশির ওপাশ থেকে প্রথমেই বললো,
– সরি, শিশিরবিন্দু।
-…..
– কথা বলবে না?
-…….
– ইচ্ছে করছিলো না আসতে। বের হওয়ার পূর্বে বারবার শুধু দরজা থেকে বিছানা পর্যন্ত পায়চারি করতে হয়েছে। যেখানে আমি নিজেই এতোটা শূন্যতা অনুভব করছিলাম সেখানে তুমি কি করতে! তোমাকে শান্ত দেখেও আসতে পারছিলাম না, যদি জাগ্রত থেকে অশান্ত হয়ে থাকতে তাহলে কিভাবে আসতাম আমি!
-…….
– একটু কথা বলো। টেনশন হচ্ছে আমার।
– এভাবে রেখে না গেলে মোটেও শূন্যতা অনুভব হতো না!
– এই, তুমি কাদছো কেন! আমি ফিরে আসবো কিছুদিন পরই।
– আমি কেন কাদতে যাবো! আমার কান্নায়ই বা কার কি আসে যায়!
– এই, পাগলী! এভাবে বলতে নেই! শিশিরের কষ্ট হয়। ভিডিও কল দেই, রিসিভ করো। একবার দেখি আমার শিশিরবিন্দুকে।
– শিশিরবিন্দুকে যেখানে প্রত্যক্ষ দেখারই সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাহলে এই কৃত্রিম দেখাতে কি হবে! দেখবো না আমি কাউকে।
শিশির প্রায় একমিনিট চুপ থেকে আবার বললো,
– স্যরি।
বিন্দু কিছু বলছে না কিন্তু তার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দে সে বুঝতে পারছে বিন্দু কাদছে। তাই বললো,
– আচ্ছা, দিব না ভিডিও কল। তুমি যা চাও সেটাই হবে। কাদবে না একটুও। আমার সহ্য হচ্ছে না। কাল তোমার এক্সাম আর তুমি! শিশিরবিন্দু! স্টপ ক্রায়িং!
বিন্দু বিছানায় ফোন রেখে বাথরুমে চলে গেলো। শিশির তার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ না পেয়ে বুঝতে পারছে সে কাছে নেই। তবুও কল কাটেনি, বিন্দুর অপেক্ষায় আছে। বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে এবার স্বাভাবিকভাবে কথা বললো একটু। শিশিরের সাথে কথা বলার পরপরই তার মা এসে জোর করে গেলো কিন্তু সে একটুও খেলো না! সন্ধ্যায় আবার কল এসেছে। বিন্দু রিসিভ করতেই শিশিরের কন্ঠে ভেসে এলো,
– তুমি সারাদিন না খেয়ে আছো! এ কোন পাগলামি শুরু করেছো!
– কিভাবে খাবো! আমার অন্ন, রুচি, স্বাদ সব চুরি করে বিলেতে পাড়ি জমিয়েছে কেউ!
– শিশিরবিন্দু, আমাকে মেরে ফেলবে তুমি! এতোবড় অভিমানে কেন স্থির হয়ে আছো! ভুলে যাও না সবকিছু!
– জীবনটাকে ভিন্ন পৃথিবীর সাথে পরিচিত করে তুলতে একটা মানুষ এসেছিলো তাকে কি করে ভুলে যাই! গতদিনগুলো একটাও ভুলবার নয়!
– আমি সেগুলোর কথা বলছি না।
– সবকিছুর সাথে সেগুলো আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে।
– এখন আর কোনো কথা নয়। এই মুহূর্তে তুমি খেতে যাবে। পেটের এক কোনাও যেন খালি না থাকে। তোমার স্বামীর আদেশ। আমি দশ মিনিট অপেক্ষা করবো। এর মাঝে তুমি খাওয়া শেষ করবে। যাও।
ইচ্ছে নেই, তবুও তিন-চার লোকমা পানির সাহায্যে গিলে নিলো বিন্দু। শিশিরের আদেশে বইও নিয়েছে হাতে কিন্তু খাবার তো পানির সাহায্যে পেটে পৌছে গেছে, এখন পড়া কিভাবে মগজে পৌছাবে! এটা গিলে ফেলার জন্য তো কোনো পানি নেই! রাতে ঘুমাতেও পারলো না বিন্দু! সে শিশিরের না জানিয়ে চলে যাওয়ার শোকেই সারাদিন আহত হয়ে রইলো। শেষ রাতে একটু ঘুমাতে পেরেছে সে। ঘুম থেকে উঠে একটু রিভিশন দিতে পেরেছে বইটা। তারপর ভাইয়ের সাথে এক্সাম হলে গিয়েছে।
সময় যাচ্ছে আর তার শোক কাটছে। কিন্তু শিশিরের সাথে আগের মতো স্বাভাবিক হয়নি। প্রয়োজনে দু চারটা কথা বলে রেখে দেয়। সেদিনের কথা মনে হলে মাঝে মাঝে ফোন রিসিভও করে না। তখন শুধু নিরবে ফেলে চোখের জল। এক্সাম শেষ হতেই আফসানা ফেরদৌসি এসে নিয়ে গেছেন। পড়াশোনা শেষ সুতরাং এখন বিন্দু সংসারে মনযোগ দিবে। সংসারের কাজের জন্য তার রুটিন প্রস্তুত।
সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায়। তারপর রুম গুলো ঝেড়ে পরিষ্কার করা। আফসানা ফেরদৌসির সাথে রান্নার আয়োজন। রান্না শেষ হতেই শীতুলের হাক, “ভাবি? কলেজের সময় হয়ে যাচ্ছে। আমার খাবার দাও।” তা গুছিয়ে দিতেই আফসানার হাক, “বিন্দু, তোমার বাবা স্কুলে যাবে। নাস্তা রেডি করে টেবিলে দাও।” তা সম্পাদিত হতেই আবার শিশিরের কল। রুমে পা দিতে না দিতেই আবার হাক, “বিন্দু, একদিনও নাস্তা সময়মতো করো না। আলসেমি করে করে শরীর রোগা বানিয়ে ফেলছো! তোমার মা বলবে আমি একটুও কেয়ার করি না তোমার! এদিকে এসো। নাস্তা করে তারপর বাকিসব।” ফোন সাইলেন্ট করে আবার খাবার টেবিলে! শ্বাশুড়ির সাথে গল্প করতে করতে নাস্তা শেষ করে শিশিরের কথা মনে পড়তেই হাড়িপাতিল দ্রুত মেজে গুছিয়ে রেখে ফোন হাতে নিয়ে দেখে এতো এতো মিসড কল আর মেসেজ, “রেগে আছো?”, “আমার অপরাধ?”, “কল রিসিভ করছো না কেন?”
বিন্দু কল করতেই কেটে গেলো, শিশির আবার কলব্যাক করলো। রিসিভ করে সালাম দিতেই সালামের জবাব দিয়ে শিশিরের উক্তি,
“কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ। তুমি? ”
“আলহামদুলিল্লাহ। রেগে আছো আমার উপর?”
” না।”
” তাহলে কল রিসিভ করছো না কেন?”
“একটু ব্যস্ত ছিলাম। ফোন পাশে ছিলো না।”
“আচ্ছা, যাও কাজ করো। নিজের খেয়াল রেখো।”
” এখন তো ফ্রি!”
” এখন যে আমি ব্যস্ত হয়ে গেলাম!”
“অহ, আচ্ছা।”
বিকেলে রায়হান মোল্লা বাড়িতে ফিরে আফসানা ফেরদৌসির সাথে গল্প করছে। তার হাই স্কুলে তিন চারজন শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়োগ দেওয়া হবে। একজনের ব্যবস্থা হয়েছে। আরও লাগবে। কেমন প্রচারণার মাধ্যমে নিবে তা নিয়েই পরামর্শ চলছে। আফসানা ফেরদৌসি বললো, “বিন্দুকেও তো নিয়োগ দেওয়া যায়। সে বাসায় বসেই থাকে। পড়াশোনা করে কি লাভ হলো যদি কাজেই না লাগাতে পারে!” তাই রায়হান মোল্লা বিন্দুকে ডেকে মতামত চাইলো। সংসারের কাজকর্ম সেড়ে দুপুরটা বিন্দুর অবসর কাটে তাই রাজি হয়ে গেলো তার শ্বশুরের স্কুলে শিক্ষকতা করবে। রায়হান মোল্লা আরও একজনের ব্যবস্থা করে ফেললেন। বাকি দুজন বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সংগ্রহ করবেন।
শুরু হয়ে গেছে বিন্দুর সংসার জীবনের পাশাপাশি পেশাগত জীবন। সংসারে আদর্শ বউ হয়ে থাকার পাশাপাশি বসে গেছে সে এক মর্যাদার পরিপূর্ণ এক স্থানে! শ্বশুরবাড়ির সাপোর্টে শিক্ষকের আসন পেয়ে নিজ অর্জিত জ্ঞান ছোট মগজে বিস্তীর্ণভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি সেও অর্জন করছে অতিরিক্ত শিক্ষা। মজবুত ও পূর্ণ করে তুলছে তার জ্ঞানের ভান্ডার। কেননা জ্ঞান বিতরণ করলে কমে না বরং আরও বেড়ে যায়!
চলছে শীতকালীন ছুটি। শিশিরের মামাতো বোনের বিয়ে উপলক্ষে তারা পঞ্চগড় যাচ্ছে। রাতেই সব গুছিয়ে রেখেছিলো। সকাল সকাল তারা বেরিয়ে গেলো। সাথে মুগ্ধকে নিয়েছে রায়হান মোল্লা ও আফসানা ফেরদৌসি। বাসে গেলে জ্যামে আটকে যেতে পারে তাই ট্রেনের টিকেট কেটেছে। শীতুল, বিন্দু ও মুগ্ধ একসাথে বসেছে আর শিশিরের বাবা-মা পাশের সিটে। ট্রেনে যেতে যেতে রায়হান মোল্লা বিন্দুকে এটা সেটা দেখিয়ে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে পথে ফেলে আসা জায়গা গুলোর সাথে। ট্রেন ভ্রমণে ভালোই লাগছে বিন্দুর। শীতুল শিশিরকে ভিডিও কল করেছে ট্রেনে থাকাকালীন। বিন্দু ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। শিশির দেখেছে তাকে পেছন থেকে। আর সে যে ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে সেটাও বুঝতে পেরেছে। শীতুল বিন্দুর কাছে দিতে চাইলে শিশিরই নিষেধ করলো। অত:পর শীতুল ও মুগ্ধই তার সাথে কথা বললো। বিন্দু বাইরে তাকিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলেও তাদের কথাবার্তা সবই শুনছে চুপচাপ। শিশিরের সাথে কথা শেষ হলে তারা নিজেদের মধ্যে গল্প করতে লাগলো। ওদিকে শিশির বিন্দুর ফোনে টেক্সট করলো, “হ্যাপি জার্নি শিশিরবিন্দু।” মেসেজটা পড়ার পর বিন্দুর মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। সাথে সাথেই আবার মেসেজ এলো, “ইশ! কবে যে একসাথে ট্রেন ভ্রমণ করবো!” বিন্দু কোনো রিপ্লাই করে না। পরপরই আবার মেসেজ এলো, “বাবামায়ের সামনে কথা বলতে তুমি লজ্জা পাবে তাই কল করলাম না। কিন্তু মেসেজ তো করতে পারো। এটাতেও কি তোমার লজ্জা লাগছে!” দুতিন মিনিট পার হতেই আবার মেসেজ এলো, “এতো লজ্জা পাও কেন লজ্জাবতী! আমি তোমার কাছে থাকলে এতোদিনে তোমার মধ্যে লজ্জার রেশটুকুও রাখতাম না আমার জন্য! সাবধানে যেও। নিজের খেয়াল রেখো। আর প্রকৃতির মাঝে দেখো আমি আছি। দৃষ্টিতে না হয় খেলা করো আমার সাথে। আল্লাহ হাফেজ।”
বিন্দু মুচকি হেসে প্রকৃতিতে উপস্থিত শিশিরের সাথে খেলতে লাগলো। যদিও এখন প্রকৃতির শিশির অনুপস্থিত! কিন্তু তার মনের শিশির সবসময়ই উপস্থিত। বিয়ের আড়াই মাস চলে। এর মাঝে একমুহূর্তেও শিশিরের অনুপস্থিতি অনুভব করেনি সে। আর এখন তো অন্যরকম ভাবে তাকে অনুভব করতে শুরু করেছে! শুধু না বলে চলে যাওয়ার দিনটাই অতি বেদনাদায়ক ছিল!
পথ দেখতে দেখতে ও প্রহর গুনতে গুনতে একসময় তারা পঞ্চগড় চলে এলো। বিয়ে বাড়িতে মেহমানদের সমাগম। ঢাকার অনুষ্ঠানগুলোতে এতোটা সমাগম থাকে না কিন্তু এখানে কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ! আফসানা ফেরদৌসি এ বাড়ির সকলের সাথে বিন্দুকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। কেননা তাদের বিয়েতে উপস্থিত কয়েকজন ছাড়া কেউই চিনে না শিশিরের বউ। আর বিন্দু তো কাউকেই চিনে না! সাক্ষাৎ করার পর শীতুলের সাথে বিন্দু তার নানুর রুমে এলো। পিচ্চি মামাতো ভাইবোনগুলো শীতুলের পিছু পিছু ঘুরছে আর যারতার নামে বিচার, গল্পসল্পসহ নানান কথা বলে যাচ্ছে! বিন্দু ফ্রেশ হয়ে নিলে তাদের খেতে দেওয়া হলো। বিন্দু বললো তার এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। আফসানা ফেরদৌসির ধারণা এখানে এসে বিন্দু লজ্জা পাচ্ছে তাই খেতে পারছে না। তাই তিনি আলাদা এক রুমে শীতুলকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দিলেন। শীতুল বিন্দু ও মুগ্ধ এখানে খেতে বসেছে। বিন্দু অল্প খেয়েই উঠে পড়লো। বাড়ির লোকজন একের পর এক দেখতে আসছে শিশিরের বউ। তাদের জুটি নিয়ে এক একজনের মুখে নানান প্রশংসা! সাথে শিশিরের আচরণ ও স্বভাব তুলে ধরছে! বিন্দুর লজ্জা ও অসস্তি দুটোই অনুভূত হচ্ছে! যেন এ বাড়ির মেয়ের বিয়ে নয়। সে-ই নতুন বউ! যার ফলে দেখার জন্য মানুষের লাইন পড়ছে!