বিয়ের আগে হবু শ্বশুরের ফোন ‘বৌমা! তোমার সাথে একটু কথা আছে। তুমি কি কাল আমার সাথে একটু দেখা করতে পারবে?’
হবু শ্বশুর যেভাবে বৌমা বললেন আমি এখন ওনাকে কি বলে সম্বোধন করবো তাই ভাবছি ‘আংকেল নাকি আব্বা?’ বলেই ফেললাম ‘জি আব্বা, পারবো। কখন দেখা করতে চান বলেন আমি চলে আসবো।’
‘কাল সকাল ৭ টায় আসো। আমরা একসাথে নাশতা করবো।’
সকাল ৭ টা?! সকালে আমার অফিস আছে! ভেবেছিলাম অফিস থেকে ফিরে সোজা হবু শ্বশুরের সাথে দেখা করতে যাবো। এখন কি করি! সাত-পাঁচ না ভেবেই রাজী হয়ে গেলাম।
‘ঠিক আছে। সকালে আমরা একসাথে নাশতা করবো।’
ভিতরে ভিতরে টেনশন হচ্ছে। চাকরির ইন্টারভিউয়েও এত টেনশন হয়না! আমি তখনো আমার হবু বরকে দেখিনি। না জানি কি কথা বলবেন,আমার হবু শ্বশুর আব্বার আর্জেন্ট তলব!
২)
আমার হবু শ্বশুর আর আমি উত্তরার একটা বড় রেস্টুরেন্টে বসে আছি। এই প্রথম উনি আমাকে সরাসরি দেখলেন। আমিও প্রথম দেখলাম। ভদ্রলোক পোশাকে আশাকে বেশ ফিটফাট। প্রায় ৬ ফিট লম্বা সাদা ধবধবে হ্যান্ডসাম হবু শ্বশুর আব্বা! কথাবার্তায় ভীষণ আদুরে এবং আবেগপ্রবণ।
খাবারের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। খেতে পছন্দ করেন এবং বেশ চুজি বোঝা যাচ্ছে। প্রতিটা খাবার অর্ডারের আগে উনি আমার দিকে মেনু এগিয়ে দিচ্ছেন। আমিও ভদ্রতা করে ‘না না আপনি দিন!” বলে ওনার দিকে ঠেলে দিচ্ছি। অফিস যাওয়ার আগে কোনদিন নাশতা করিনি। শ্বশুড় আব্বার সাথে যাই খাওয়া হবে তাই আমার বোনাস!
যাইহোক, ওয়েটার ভাই একবার আমার দিকে আরেকবার হবু আব্বার দিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাকাচ্ছেন! কী একটা অবস্থা!
আগেই বলেছি উনি ভীষণ আবেগপ্রবণ। এরই মধ্যে কথায় কথায় কয়েকবার কেঁদে ফেলেছেন। আমি পড়েছি বিপদে! ওনার কান্নার সময় আমার কি করা উচিৎ? কাছে যাবো? টিস্যুটা কি হাতে ধরিয়ে দিব চোখ মুছতে? নাকি আমি নিজেই মুছে দিবো?! আশেপাশের লোকজনও তাকাচ্ছে!
আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি ওনার গুরুত্বপূর্ণ কথাটি শোনার জন্য। ভিতরে ভিতরে যে আমিও শেষ!
‘বুঝচ্ছ মা! জীবনে অনেক স্ট্রাগল করেছি। অনেক কষ্ট করে ছেলেমেয়ে বড় করেছি… ‘ কথা শেষ করার আগেই কান্না! আমি
বুঝতে পারছি তিনি ভালোই সংগ্রাম করেছেন।
আবার বলা শুরু করলেন ‘ আমার ছেলের জন্য কত মেয়ে খুঁজচ্ছি। মনের মতো মেয়ে পাইনা… তোমার কথা শুনে আমি ছুটে এসেছি…..’ বলে আবার কান্না…..!
আমি শ্বশুর আব্বার হাত ধরলাম
‘আব্বা, যেসব কথা আপনার মন খারাপ করে দেয়, সেগুলো থাক।”
‘মা, আমার একটাই ছেলে, আমার প্রথম সন্তান। আমার ছেলেটা কম বোঝে… তোমাকে গড়ে নিতে হবে……!’
এই কথা বলার সাথে সাথে আব্বা আপনার না কাঁদলে কি হতো না!? আমি তো সেটাই জানতে চাই আপনি কি বলতে চাচ্ছেন! মনে মনে বললাম।
এরমধ্যে খাবার চলে এসেছে। ওয়েটার বাঁকা চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে ভাবখানা এমন ” মুরুব্বি একটা মানুষরে তখন থেকে কাঁদাচ্ছেন, বিয়ের পর না জানি কি করবেন!”
“বৌমা, আমার ছেলেটাকে তুমি দেখো নাই। আমার ছেলেটা কাইল্ল্যা, বাইট্টা, টাকলা, তুমি তাও ওরে বিয়ে করবা?! দেখার পর যদি ভালো না লাগে?!”
এটাই ছিল শ্বশুর আব্বার গুরুত্বপূর্ণ কথা! আমি পড়লাম মহাবিপদে! আপনার ছেলে কাইল্লা হোক, বাইট্টা হোক, টাকলা হোক, ফোকলা হোক, ট্যারা-কানা-খোঁড়া যাইহোক তাও আমি তাকে বিয়ে করবো- এটা বললে ভাববেন আমি বিশ্ব বেহায়া আবার যদি বলি ‘তাইলে থাক, বিয়ে করবো না’ তাহলেও সমস্যা! তাই কিছু না বলেই স্মিত হাসলাম। শ্বশুর আব্বা কি বুঝলেন জানিনা!
টেবিল ভর্তি খাবার অথচ আমি কিছুই খেতে পারছিনা। হঠাৎ
আমার হবু আব্বা, নিজের প্লেট থেকে পরোটা নেহারীর সাথে মিলিয়ে আমাকে সাধলেন ‘মা, আমি কি তোমাকে একটু খাওয়ায় দিতে পারি?!’
‘জি অবশ্যই ‘ বলে আমিও হা করলাম! গপ গপ করে খেয়ে নিলাম! এই ২/৩ সেকেন্ড পুরো ব্যাপারটা আমাকে চমকে দিয়েছে… শুধু এটাই ভেবেছি আপনার মতো বাবা পাওয়ার জন্য হলেও আমি আপনার ছেলেকে বিয়ে করবো!… মনটা কেন জানি নরম হয়ে গেলো…
কে জানতো ৯ দিন পর সেই ভদ্রলোকের ছেলের সাথেই আমার বিয়ে হয়ে যাবে!
৩)
আমার শ্বশুর প্রায়ই আমাকে খাইয়ে দেন। আব্বা খাওয়ার সময় আমি পাশে বসে থাকি। পাশে বসে থাকা মানেই উনি আমাকে খাইয়ে দিবেন। এটা ওনার অভ্যাস হয়ে গেছে। আমি, আমার ছেলে-মেয়ে যেই থাকিনা কেন উনি এক লোকমা হলেও খাইয়ে দিবেন। শুধু তাই-ই নয় সুযোগ পেলে আমাকে এখনো জিজ্ঞেস করেন ‘মা রে, আমার কাইল্লা, বাইট্টা, টাকলা ছেলেটারে তুমি বিয়া করলা কেন?!”
আমার এখন অনেক সাহস! আমিও বলি ‘ওনারে আমার ভালো লাগছে, তাই!!!’ আমার উত্তর শুনে উনি আবার কেঁদে ফেলেন। আমার ধারনা আমার এই উত্তরটা শোনার জন্যই আব্বা আমাকে বার বার এই প্রশ্নটা করেন আর যতবার উত্তর শুনেন ততবারই কাঁদেন! আমি এখন আর কান্না থামাতে যাইনা। আমি বুঝে গেছি আব্বার এই কান্না আদরের, ভালোবাসার, পরম সুখের !
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ আমার শ্বশুরের ছেলেটা বাবার মতো এত লম্বা, ফর্সা না হলেও তিনি দেখতে অনেক সুন্দর, আলহামদুলিল্লাহ!
(গল্প নয় সত্যি!)