#যেদিন তুমি এসেছিলে
পর্ব ১১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
অর্ষার ফোনটি বেজে ওঠে হঠাৎ। ফোন রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে সকালের ব্যস্ত কণ্ঠ ভেসে ওঠে,
“আপু তুই কোথায় এখন? জলদি বাসায় আয়।”
হতবিহ্বল অর্ষা চমকে যায়। ব্যতিব্যস্ত হয়ে জানতে চায়,
“কী হয়েছে?”
“ভাইয়া বাসায় কী যে শুরু করেছে! তুই এখনই আয়।”
“আচ্ছা আমি আসছি।”
অর্ষার ব্যস্ততা দৃষ্টি এড়ায় না আহনাফ, রেণু এবং রাশেদের। তারা প্রত্যেকেই অর্ষার মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। ফোন রেখেই অর্ষা আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমায় এখনই বাসায় যেতে হবে।”
“কোনো সমস্যা?” জিজ্ঞেস করল আহনাফ।
অর্ষা আ’ত’ঙ্কিত মুখে বলল,
“হ্যাঁ।”
আহনাফ দ্বিতীয় আর কোনো প্রশ্ন না করে রাশেদকে বলল,
“উনাকে পৌঁছে দিয়ে আসো।”
রাশেদ সম্মতিপূর্বক মাথা নাড়াল। মুহূর্তেই যেন পরিস্থিতিটা বদলে গেল। এতক্ষণ অর্ষার মনে যেই উথালপাতাল ঢেউ বয়ে যাচ্ছিল; এখন তা ছাপিয়ে গেছে পারিবারিক সমস্যা। মাথার ভেতর একগাদা দুশ্চিন্তা নিয়ে সে অপেক্ষা করছে কতক্ষণে বাড়িতে পৌঁছাবে।
অর্ষা যখন বাড়িতে পৌঁছায় রুহুল তখন বাড়িতে নেই। বাড়ির বেহাল অবস্থা। জিনিসপত্র ভেঙেচূড়ে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সকাল। দাওয়ায় বসে শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন মা। বাবা খাটের ওপর নির্জীব, পাথরের ন্যায় বসে আছেন। প্রথম দিকটায় অর্ষা কথা বলার মতোন কোনো ভাষা খুঁজে পেল না। সে নিঃশব্দে ভেজা পায়ে আগে এগিয়ে গেল সকালের কাছে। সকালের ফরসা গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ। বোনের চোখে চোখ পড়তেই সকাল এবার বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। অর্ষার বুঝতে বাকি নেই রুহুল তার রাগের অবশিষ্ট অংশ সকালের ওপরও প্রয়োগ করেছে। সকালের চেয়ে বেশি ব্যথা যেন এখন অর্ষাই পাচ্ছে। বুকটা কষ্টে ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। সকাল ভরসার স্থান পেয়ে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরল। টলমল অশ্রুসজল নয়ন অর্ষার। সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সকালের পিঠে।
সকাল কিছুটা ধাতস্থ হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে,
“ভাইয়া একেবারে চলে গেছে আপু। আর আসবে না।”
অর্ষা কঠিনস্বরে বলল,
“না আসুক। ওর এই বাড়িতে না আসাই উত্তম।”
সেই রাতে ঘুম হলো না কারও-ই। জীবনে যত ধরণের সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে বোধ হয় পারিবারিক সমস্যা অন্যতম। যার জীবনে ফ্যামিলি প্রবলেম থাকে তার আলাদা করে কোনো শত্রুর প্রয়োজন হয় না। জীবনটাকে একটু একটু করে শেষ করতে, ডিপ্রেশনে ফেলতে এই সমস্যাই যথেষ্ট।
সকালবেলা অর্ষা অফিসে গেল না খেয়েই। বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকানোর উপায় নেই। কেঁদে কেঁদে মায়ের চোখ ফুলে লাল হয়ে আছে। মাকে বোঝাবে নাকি সান্ত্বনা দেবে সেটাও তার জানা নেই। সে নীরব ভূমিকা পালন করছে। অথচ ভেতরে ভেতরে প্রকাশ পাচ্ছে তার অসহায়ত্ব। কার কাছে সে নিজেকে ভেঙেচূড়ে বলবে? এমন কেউ যে নেই তার!
.
অফিসে এসে অন্যমনস্ক হয়ে বসে থাকে। কম্পিউটারে টাইপ করছে রোবটের মতো। মন তার কাজে নেই। শুধু দৃষ্টি আর হাতটাই চলছে। যাওয়ার পথে তার এই অন্যমনস্কতা লক্ষ্য করে আহনাফ। অর্ষার ভ্রুক্ষেপ নেই কোনোদিকে। সে ভাবে তার অতীতের কথা। সেই অতীত সুখকর নাকি বেদনাদায়ক সেটা সে এত বছরেও ঠাওর করতে পারেনি।
.
রুহুল এবং অর্ষা ওমর বাস্তবিক অর্থে অনাথ। ওরা ওমর রহমানের পালক সন্তান। ওমর রহমানের প্রথম স্ত্রী গত হয়েছেন রুহুল এবং অর্ষাকে দত্তক নেওয়ার এক বছর বাদেই। অর্ষা আর রুহুল থাকত এতিম খানায়। বয়সের ব্যবধান দুজনের তিন বছরের। বাবা-মা নেই তাই চাচারা এতিমখানায় দিয়ে গেছিল। এতিমখানায় রাখা পর্যন্তই তাদের দায়িত্ব শেষ। এরপর আর কোনো খোঁজ-খবরও রাখেনি।
ওমর রহমান নিঃসন্তান ছিলেন। কত ওঝা, কবিরাজ, ডাক্তার কত কিছুই না দেখিয়েছিলেন! কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। তার স্ত্রী মা হতে পারেননি। তাই তারা একসময় সিদ্ধান্ত নিলেন বাচ্চা দত্তক নেবে। একদিন এতিমখানায় গেলেন বাচ্চা দত্তক নিতে। তারা সেখানে গিয়ে দেখতে পায় দুই বছরের একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে এতিমখানার বারান্দায় বসে খেলছে। হাতে একটা লাল রঙের পুতুল। মেয়েটার গায়েও লাল ফ্রক। ওমর রহমানের স্ত্রী অপলা বেগমের দেখেই ভালো লেগে যায়। তিনি কোলে তুলে নেন বাচ্চাটিকে। যখন ও-কে দত্তক নিতে যায় তখন রুহুল ছুটে আসে। সে কিছুতেই তার বোনকে নিয়ে যেতে দেবে না। অপলার কোল থেকে কেড়ে নিয়েছে। ছাড়ছেই না। বাধ্য হয়ে ওরা রুহুলকেও দত্তক নিয়ে নেয়। দুজনকে নিয়ে তাদের সংসার নতুন করে শুরু হয়। এতদিন বাদে সাদাকালো জীবনে যেন রঙের দেখা পেয়েছেন তারা। মানুষমুখে অপলা শুনতেন, অন্য বাচ্চা পাললে ঐ বাচ্চার উসিলায় নাকি আল্লাহ্ তাকেও বাচ্চা দেয়। সত্যি সত্যিই এক বছর বাদে সে কনসিভ করে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বাচ্চা হওয়ার সময় বাচ্চাসহ-ই সে মারা যান। ভেঙে পড়েন ওমর রহমান। আত্মীয়-স্বজনেরা সবাই রুহুল আর অর্ষাকে আবার এতিমখানায় ফিরিয়ে দিয়ে আসতে বলে। নতুন করে বিয়ে করতে বলে। তিনি বিয়ে করতে রাজি না হলেও ওদেরকে ফিরিয়ে দিতে রাজি হয়েছিলেন কারণ ছোটো অর্ষাকে দেখাশোনা করতে পারছিলেন না চাকরির জন্য।
তবে এই এক বছরে তিনি ছেলে-মেয়ে দুটোর মায়ায় পড়ে গেছেন। আধো আধো বুলিতে মেয়েটা যখন বাবা বাবা বলে ডাকে, তার বুক শান্তিতে জুড়িয়ে যায়। এক রাতে তার ভীষণ জ্বর হয়। সারা রাত জেগে মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিয়েছে রুহুল। ওমর রহমান সিদ্ধান্ত বদলানেন। যত কষ্ট-ই হোক ওদেরকে কাছ ছাড়া করবে না। তবে মা ছাড়া অর্ষাকে রাখতে তার বেশ কষ্ট হতো। তাই বাধ্য হয়েই তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন। যেই বছরে বিয়ে করলেন সেই বছরেই তার স্ত্রী কনসিভ করে। ওমর রহমান ভয় পেলেন, পাছে স্ত্রী ছেলে-মেয়ে দুটোকে দেখতে না পারে! তবে এমনটা হলো না। সকাল জন্মের পরও সবকিছু আগের মতোই চলতে লাগল। কেউ বলতেই পারবে না রুহুল, অর্ষা দত্তক আনা। তবে সময়ের পরিক্রমায়, ভুল বন্ধুদের সংস্পর্শে গিয়ে রুহুল উচ্ছন্নে চলে যায়। ক্লাস এইট অব্দি পড়ে আর পড়াশোনাও করেনি। আজ সে বেপরোয়া, ভবঘুরে, বখাটেপনা করে বেড়ায়। নেশা হয়েছে তার নিত্যসঙ্গী। পরিবার কিংবা বোন কারও প্রতিই নেই কোনো টান। সৎ সঙ্গ মানুষকে যতটা ভালো পথে আনতে পারে, অসৎ সঙ্গ তারচেয়েও অধিক অন্ধকার গহ্বরে নিয়ে যেতে পারে; যা ব্যক্তির ধারণারও বাইরে।
বড়ো হওয়ার সাথে সাথে মানুষের মুখে মুখে ওরা শুনেছে ওমর রহমান আর সেলিনা বেগমের আপন সন্তান নয় ওরা। প্রথমে কষ্ট পেলেও পরে নিজেদের মানিয়ে নিয়েছিল অর্ষা এবং রুহুল। এসব আর আমলে নেয়নি। কত সুন্দর ছিল তাদের ছোট্ট সংসার। দমকা হাওয়ায় সব কেমন নড়চড় হয়ে গেল। অর্ষা নিজেকে আর সামলাতে না পেরে করিডোরে গিয়ে দাঁড়াল। এখানে এখন লোকজন নেই। সবাই সবার কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছে। তার কান্না দেখে ফেলার মতো কেউ নেই এখানে।
“এত স্ট্রং মেয়েটাও কাঁদতে পারে?”
অর্ষা চমকে পেছনে তাকায়। তার থেকে কিছুটা দূরে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আহনাফ। তার চোখে-মুখে বিস্ময়। দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে চোখের পানি মুছে নেয় অর্ষা। আহনাফ এগিয়ে আসে কথা বলতে বলতে,
“দুঃখিত এখানে আসার জন্য। আমার কেবিন থেকেই দেখলাম আপনি কাঁদছেন। গতকাল রাতে বললেন বাড়িতে নাকি সমস্যা হয়েছে। তাই কৌতুহল আটকে রাখতে পারলাম না। কী হয়েছে আমাকে বলুন।”
অর্ষা থমথমে কণ্ঠস্বরে বলল,
“কিছু হয়নি।”
কথা বলতে গিয়েই যেন তার কান্না আরও বেশি উপচে পড়ছে। প্রাণপণে চেষ্টা করেও চোখের পানি আটকাতে পারছে না।
আহনাফ বলল,
“আমাকে একবার বলুন, কী হয়েছে? আমি কোনোভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি না?”
অর্ষা নিরুত্তর। আহনাফ নিজেও কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে। পরক্ষণে আরেকটু এগিয়ে যায়। ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলে,
“পারিবারিক সমস্যা নাকি ব্যক্তিগত সমস্যা আমি জানিনা। যদি আমায় বলা না যায়, তাহলে বলতে হবে না। শুধু আমি নিজে থেকে এতটুকুই বলব, ভেঙে পড়বেন না। আপনার নিরুত্তেজ রূপটা নয় বরঞ্চ তেজী রূপটাই আপনার ব্যক্তিত্বকে বহন করে।”
অর্ষা মুখ ফিরিয়ে তখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আহনাফের উপস্থিতি, তার বাক্যালাপ কান্নার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আহনাফ এবার মুখোমুখি দাঁড়াল অর্ষার। দৃষ্টি নত করে অর্ষা দাঁড়িয়ে রয়েছে। আহনাফ বলল,
“জানেন, আমাদের প্রতিটা মানুষের মাঝেই কোনো না কোনো দুঃখ থাকে, কষ্ট থাকে। আমরা সবটা সবাইকে জানাই না। কখনও কিছুটা জানাই আবার কখনও ঐ অল্পকিছুও জানাই না। কিছু কষ্ট শুধু আমরা নিজের মধ্যে রাখতেই পছন্দ করি। কিছু কষ্ট আবার আমরা অতি যত্নে মনের মাঝে পুষি। ভেতরে ভেঙেচূড়ে গুড়িয়ে যাই। কিন্তু বাইরে প্রতিটা মানুষকে দেখাই আমরা এত সহজে ভাঙি না। দুঃখ, কষ্ট এত সহজে আমাকে কাবু করতে পারে না।”
এতটুকু বলে থামল আহনাফ। কয়েক সেকেণ্ড মৌনতা পালন করে সে অবিশ্বাস্যভাবে অর্ষার মাথায় আলতো করে হাত রেখে বলল,
“আপনি হচ্ছেন সেই ধরণের মেয়ে, যাকে বাহির থেকে কখনও ভাঙা সম্ভব নয়। আপনি এভাবে কাঁদবেন না বাচ্চা প্লিজ!”
অর্ষা আরক্তিম দৃষ্টি মেলে আহনাফের মুখের দিকে তাকায়। কী মায়া সেই মুখে!
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।
বিঃদ্রঃ ব্যস্ততার জন্য লেখালেখি ঠিকমতো হচ্ছে না। তাও যা লিখি বা লেখার চেষ্টা করি, এক পর্বে সবাইকে রাখতে পারি না। মানে সময়টাই হয় না যে বেশি বেশি লিখব! যে কারণে গ্যাঞ্জাম পার্টিকেও আনতে পারছি না। তবে অতি অবশ্যই সামনের পর্বগুলোতে ওরা থাকবে। আর আমিও চেষ্টা করছি গল্পটা তাড়াতাড়ি শেষ করার।]