#যেদিন তুমি এসেছিলে.
#সিজন_টু
#পর্ব ১২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
দিন চারেক অতিক্রম হওয়ার পর বাড়ির অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। বলা বাহুল্য বাড়ির মানুষজন নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। ভেতরে ভেতরে যেই তুষের আগুন জ্বলছে তার মাত্রা কমেনি এতটুকু পর্যন্ত। বিশেষ করে ওমর রহমান এবং সেলিনা বেগম রুহুলের দেওয়া আঘাত মেনে নিতে পারেননি। মেনে নিতে না পারাটাও অস্বাভাবিক নয়। যাকে নিজেদের ছেলের মতো আদর-স্নেহ দিয়ে বড়ো করেছেন তার থেকে এমন আচরণ প্রত্যাশিত নয়। তবুও তাদের রুহুলের জন্য মন পোড়ে। মাঝে মাঝেই একে, ওকে ধরে রুহুলের খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেন। অর্ষার অগোচরে বেশ কয়েকবার করে রুহুলের নাম্বারে ফোন করেনও ওমর রহমান। কিন্তু প্রতিটাবার সেই একই কথা শুনতে হয়,’আপনার কাঙ্ক্ষিত নম্বরটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ প্রদান করা সম্ভব হচ্ছে না। অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন। ধন্যবাদ।’
দিনের মধ্যে কতবার এই বাক্যটি শোনেন তার কোনো ইয়ত্তা নেই। তবুও তিনি ত্যক্ত হোন না। অশান্ত মনটা একবার রুহুলের কণ্ঠস্বর শুনতে চায়। জানতে চায় ছেলেটা দূরে থাকলেও ভালো আছে।
সকাল আর অর্ষা পাশাপাশি হাঁটছে। সকালের গন্তব্য ওর কলেজ আর অর্ষার গন্তব্য ভার্সিটি। অফিস থেকে আজ ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য সে ছুটি নিয়েছে। মিজানের কাছে ছুটি চাওয়া মাত্রই সে রাজি হয়েছে। কোনো রকম দ্বিমত করেনি ছুটি দেওয়ার ব্যাপারে। ছেলেটা বেশ আন্তরিক। অফিসে তার স্যার হলেও ব্যবহার আন্তরিকতার সাথেই করে। এ ক’দিন তার মনটন খারাপ দেখেও অনেকবার কারণ জানতে চেয়েছিল। অর্ষা অবশ্য জানায়নি। সে পারিবারিক বিষয়টাকে ব্যক্তিগত রাখতেই পছন্দ করে। এমনকি এ ক’দিন সে রাফিকেও পড়াতে যায়নি। আহনাফও ফোন করে যাওয়ার ব্যাপারে কিছু বলেনি। অফিসে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। চোখাচোখি ও সামান্য পরিমাণ হাসি বিনিময় হয়েছে। অল্প কথার মাঝে আহনাফ সর্বদাই জানতে চেয়েছে,
‘মন ভালো?’
আর অর্ষা প্রত্যুত্তরে মাথা নাড়িয়েছে। এই মাথা নাড়ানোর উদ্দেশ্য তার নিজের কাছেও পরিষ্কার নয়। আদতে সে ভালো আছে নাকি নেই সেটা সে নিজেও জানে না।
“আপু কথা বলছিস না?”
সকালের প্রশ্নে সম্বিৎ ফেরে অর্ষা। মৃদু সহাস্যে বলে,
“কী কথা বলব?”
“যা ইচ্ছে বল। চুপচাপ হাঁটতে আমার ভালো লাগে না। পেট ব্যথা করে।”
“তুই বল তাহলে। আমি শুনি।”
“আজকে ফুসকা খেতে যাবি?”
“কলেজে খাস না?”
“খাই। সে তো বন্ধু-বান্ধবদের সাথে খাই। তোর সাথে অনেকদিন হয়েছে ফুসকা খাওয়া হয় না। ঐদিক দিয়ে মুন আপুর বাসায়ও যাব। আপুর সাথেও তো অনেকদিন হয়েছে দেখা হয় না।”
“আচ্ছা ভার্সিটি থেকে ফিরি আগে। আজ রাফিকে পড়াতে যেতে হবে।”
“এতদিন যাও নি?”
অর্ষার উত্তর দেওয়ার আগে তোফায়েলের সঙ্গে দেখা হয় দু’বোনের। ওদেরকে দেখেই হয়তো তোফায়েল মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। তার মুখটা হাসিহাসি। দুজনের দিকেই একবারটি তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“কেমন আছো তোমরা?”
উত্তর দেয় সকাল। সে বলে,
“ভালো আছি ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?”
“আমিও ভালো আছি। কলেজে যাচ্ছ?”
“হুম।”
“তুমিও?” অর্ষাকে এবার প্রশ্নটি করল তোফায়েল।
অর্ষা কিছুটা গম্ভীর হয়েই বলল,
“জি।”
“আজ অফিস নেই?”
“আছে। ছুটি নিয়েছি।”
“জব, পড়াশোনা, পরিবার সব একসাথে সামলাও কীভাবে? কষ্ট হয় না?”
মলিন হাসে অর্ষা। শ্লেষেরসুরে বলে,
“বড়ো ভাই যদি তার দায়িত্ব পালনে অনিহা প্রকাশ করে তখন বাড়ির মেয়েকেই তো সেই দায়িত্ব পালন করতে হবে তাই না?”
“রুহুলকে একটা বিয়ে করানো উচিত ছিল অর্ষা।”
“পাগল নাকি! ওর মতো ছেলের জন্য অন্য মেয়ের জীবন নষ্ট করতে যাব কেন?”
“নিজের ভাইকে নিয়ে এসব কী বলো!”
“নিজের ভাই বলেই বলছি। কারণ অন্যদের চেয়ে আমি ও-কে ভালো চিনি।”
“ও কিন্তু তোমাকে অসম্ভব ভালোবাসে।”
অর্ষা এবারও বিদ্রুপ করে হাসে। তোফায়েল বলে,
“হাসছ যে? বিশ্বাস হচ্ছে না?”
“ওর ব্যাপারে কথা বলতে ভালো লাগছে না তোফায়েল ভাই। আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমরা বরং এখন যাই।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। সাবধানে যেও।”
“শুনুন?”
“বলো।”
“আমি যদি ভুল না হই আব্বু-আম্মু আপনাকেও ভাইয়ার খোঁজ নিতে বলেছে?”
তোফায়েল কিছুটা কাচুমুচু ভঙ্গিতে বলল,
“হ্যাঁ। তোমার আব্বুর সঙ্গে দেখা হলেই বলে।”
“পাত্তা দিবেন না। যখন বলবে চুপচাপ শুনবেন শুধু। ভাইয়াকে খুঁজে বের করে খোঁজ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।”
“তুমি ভীষণ কঠিন মনের মেয়ে অর্ষা!”
অর্ষা এই প্রশ্নের কোনো জবাব দিল না। সে আর এই প্রসঙ্গে কোনো কথাও বাড়াল না। সকালকে নিয়ে একটা খালি রিকশায় উঠে পড়ে।
ভার্সিটিতে পৌঁছানোর পর ফ্রেন্ডদের মধ্যে আজ আনন্দের ধুম পড়ে গেছে। সবাই অর্ষাকে পেয়ে ভীষণ খুশি। আজ কতদিন বাদে সকলে একত্রিত হয়েছে। এই আনন্দে ক্লাস করার কথাই বেমালুম ভুলতে বসেছে সকলে। হৈ-চৈ লেগে গেছে। ছোটখাটো একটা জটলাও বেঁধে গেছে। দূর থেকে দেখলে যে কেউ ভাববে ঝগড়া লেগেছে বোধ হয়। অথচ ওরা লাফালাফি, ঝাপাঝাপি করে নিজেদের খুশি উদযাপন করছে।
আশিক তো তার বিখ্যাত কবিতা শুরু করে দিয়েছে,
“অর্ষা পড়েছে আসিয়া,
আজকে দিন কাটিবে হাসিয়া হাসিয়া।”
“তুই আবার কান্নাকাটি করে দিন পার করলি কবে?” বলল রেশমি।
“এই মেয়ে কাঁদব কেন? যার জীবনে এতগুলো গার্লফ্রেন্ড রয়েছে সে আবার কাঁদে নাকি?”
লামিয়া বলল,”তাহলে অর্ষার সামনে এমন ঢং করছিস কেন?”
চোখ টিপল আশিক। বলল,
“ও-কে ইম্প্রেস করছি!”
জুঁই বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে বলে,
“তার মানে এখন তুঁই অর্ষাকেও পটানোর চেষ্টা করতেছিস?”
আশিক খ্যাঁক করে ওঠে। কোমরে হাত রেখে বলে,
“এই জুঁইয়ের বাচ্চার কুইকুই করার স্বভাব জিন্দেগীতে যাবে না। মেয়েরা এক, দুই লাইন বেশি বুঝে মানলাম। বাট এই মাইয়া সবসময় চার লাইন বেশি বোঝে।”
আহিল সবাইকে শান্ত করে বলল,
“হয়েছে, হয়েছে। এবার তো থাম তোরা।”
অর্ষা মাথা ধরে ঘাসের ওপর বসে পড়েছে অলরেডি। ওদের সঙ্গে থাকলে পাগল হওয়া সহজ কিন্তু ডিপ্রেশনে থাকা সম্ভব নয়। আশিক ব্যস্ত হয়ে বলল,
“হায়, হায়! অর্ষাকে কিডন্যাপ করল কে? কে কোথায় আছো, আমার বান্ধবীকে কিডন্যাপ করা হয়েছে। হেল্প, হেল্প!”
রেশমি আশিকের মুখ চেপে ধরে বলল,
“গাধা থাম। চেঁচাইস না আর। অর্ষা নিচে বসে আছে।”
আশিক নিচে তাকিয়ে হাসল। সেও অর্ষার পাশে নিচে বসে পড়ল। মুচকি হেসে ফিসফিস করে বলে,
“এখন হাতে শুধু দুটো ভাঙা থালা থাকলেই হতো বুঝলি। একদম ভরপুর ইনকাম হতো তাহলে।”
অর্ষার প্রথম দিকটায় বুঝতে একটু সময় লাগল যে আশিক কোন ইঙ্গিত দিয়েছে। আর যখন বুঝতে পেরেছে ততক্ষণে আশিক উঠে-পড়ে দৌঁড় দিয়েছে। হাল ছাড়েনি অর্ষাও। সেও পিছু পিছু দৌঁড়াচ্ছে। পুরো ভার্সিটি মাতিয়ে তুলেছে এই সদস্যগুলো। সারাদিন একসাথে থেকে হৈ-হুল্লোড় করে অর্ষা পারিবারিক যন্ত্রণার কথা বেমালুম ভুলে গেছে। এক টুকরো স্বর্গীয় সুখ যেন সে বন্ধুদের মাঝে থেকে উপভোগ করতে পেরেছে। বিদায় বেলা কারও-ই মন ভালো নেই। আবার কবে দেখা হবে, একসাথে আড্ডা দেওয়া হবে এই চিন্তায় মশগুল প্রত্যেকে। অর্ষা সবাইকে আশ্বস্ত করে বলে,
“আমার অফিসের স্যার, বস ভালো আছে। আমি চেষ্টা করব প্রতি সপ্তাহে একদিন হলেও ক্লাস করার। এছাড়া ক্লাসে না হলেও ছুটির পর একসঙ্গে সন্ধ্যায় আড্ডা দেবো।”
দিদার বলে,
“এটা দারুণ আইডিয়া। সন্ধ্যায় ভালো ভালো স্ট্রিট ফুড পাওয়া যায়। দারুণ টেস্ট।”
অর্ষা হেসে বলে,
“ঠিক আছে। নেক্সট টাইম আমরা সবাই স্ট্রিট ফুড খাব।”
বিকেলের দিকে ক্লাস শেষ করে, ঘুরে-ফিরে সবাই বাসায় যাওয়ার জন্য রওনা হয়। আহিল আছে অর্ষার সাথে। দুজনে ফুটপাত ধরে হাঁটছে। অর্ষা দুঃখীস্বরে বলে,
“স্যরি রে, পরে আর যোগাযোগ করতে পারিনি।”
“বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়েছিল?”
অর্ষা নিশ্চুপ। আহিল একবার পাশ ফিরে তাকাল অর্ষার দিকে। দীর্ঘকায় শ্বাস নিয়ে বলল,
“বলবি না?”
অর্ষার কেন জানি আহিলের কাছে প্রথম নিজেকে ভেঙেচূড়ে উপস্থাপন করতে ইচ্ছে করছে। সে লুকায় না কিছু। বাড়ির খুঁটিনাটি বিষয়গুলোও সে আহিলকে জানায়। আহিল এতদিন নিজেকে যেই শক্ত খোলসের মাঝে আটকে রেখেছিল, সেই শক্ত খোলসটাও সে অর্ষার সামনে ভেঙে ফেলে। নিজের নিদারুণ জীবনের প্রতিটা ঘটনা সে অর্ষার সামনে তুলে ধরে। অর্ষা একই সাথে ব্যথিত হয় এবং অবাকও হয়। সে ক্ষুণাক্ষরেও টের পায়নি আহিলের মাঝে এতটা দুঃখের বসবাস। তবুও আহিল কতটা সুন্দর করে হাসছে! এই হাসির মাঝেও যে জাগতিক দুঃখ-কষ্টের বসবাস তা এখন আর অর্ষার অজানা নয়।
আহিল যথাসম্ভব নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“একটা চাকরির ভীষণ প্রয়োজন রে! এজন্যই সেদিন আমি তোদের বাসায় গিয়েছিলাম।”
অর্ষা অভয় দিল। বলল,
“তুই কোনো চিন্তা করিস না। আমি অফিসে গিয়ে স্যারের সাথে কথা বলব। একটা না একটা ব্যবস্থা হবেই।”
আহিল প্রসন্নতার হাসি দিয়ে বলল,
“থ্যাঙ্কিউ রে।”
“রাখ তোর থ্যাঙ্কিউ! এত ফর্মালিটি দেখাতে হবে না। আচ্ছা শোন, এখন তোকে বাসায় নিতে পারছি না। কারণ আমি এখন একজনকে পড়াতে যাব।”
আহিল হেসে বলে,
“তোর মধ্যে কোনো ফর্মালিটি নাই। অন্য একদিন যাব।”
“অবশ্যই আসবি। আমার হাতের চা খেয়ে যাবি। আমি চা খুব ভালো বানাই।”
“নিজের প্রসংশা নিজেই করছিস?”
“বদনাম করার লোকের তো অভাব নেই।” বলেই চোখ টিপল অর্ষা।
আহিল হেসে বলল,”ফাজিল!”
এরপর সে নিজেই অর্ষাকে একটা রিকশা ঠিক করে দিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা শুরু করে। রিকশায় উঠে আনমনে হাসে অর্ষা। মনটা আজ তার ভীষণ ফুরফুরে লাগছে। আনন্দিত মন প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। হাত ঘড়িতে একবার সময় দেখে নিল। সাড়ে ছ’টা পার হয়েছে। রাফি আজ কেমন গম্ভীর হয়ে থাকবে কে জানে!
বাড়িতে গিয়ে কলিংবেল বাজানোর পর দরজা খুলে দিল অসম্ভব রূপবতী এক মেয়ে। তার পরণে অফ হোয়াইট রঙের একটা শাড়ি। শাড়ির ওপরে গোলাপী রঙের সুতার কাজ। মেয়েটির সৌন্দর্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে তুলেছে। মেয়েটা হাসিহাসি মুখ করে জানতে চাইল,
“আপনি?”
অর্ষা কয়েক মুহূর্তের জন্য যেন বোবা বনে গেছিল। নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
“আমি অর্ষা। রাফির প্রাইভেট টিচার।”
মেয়েটি এবার উল্লাসিত ভঙ্গিতে বলল,
“ওহ আচ্ছা! আপনিই অর্ষা? আসুন ভেতরে আসুন।”
মেয়েটির এত আনন্দের কিংবা উল্লাসের কারণ কোনোটাই অর্ষার নিকট স্পষ্ট নয়। বরঞ্চ সে বিব্রতবোধ করছে। সে সহজ গলায় বলার চেষ্টা করল,
“আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না।”
অর্ষার মুখোমুখি সোফায় বসেছে মেয়েটি। সে হাত নেড়ে নেড়ে হেসে বলে,
“আমি শশী। আমাকে আপনার চেনার কথা নয় কারণ আপনি রাফিকে পড়ানোর দু’মাস আগে থেকেই বাবাকে নিয়ে ইন্ডিয়ায় ছিলাম। বাবার একটা অপারেশন ছিল তো তাই। এখন আলহামদুলিল্লাহ্ বাবা সুস্থ আছে। আমি দেশে ফিরেছি পাঁচদিন হবে। রেণু আপা আর রাফির কাছে আপনার এত গল্প শুনেছি যে অনেক এক্সাইটেড ছিলাম আপনাকে সরাসরি দেখার জন্য।”
অর্ষার কথা আটকে গেছে। শশীর কথাটা তার মাথা থেকে সম্পূর্ণ বের হয়ে গেছিল। একটাবারের জন্যও তার শশীর কথা মনে হয়নি। কে এই মেয়ে, কী তার পরিচয় যাবতীয় সকল প্রশ্ন তার মস্তিষ্ক থেকে মুছে গেছিল। আজ হঠাৎ করে যে সেই মুছে যাওয়া প্রশ্নগুলো ডালপালা নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াবে অর্ষা ভাবতে পারেনি। তার বুক কাঁপছে দুরুদুরু। মনের ভেতর অজস্র প্রশ্ন। কিন্তু প্রশ্নগুলো করার অধিকার তার নেই। সে এই বাড়ির কে হয় এই প্রশ্নটি করতে গিয়েও জিজ্ঞেস করে ফেলল,
“রাফি কোথায়?”
শশী তার স্বভাবসুলভ হাসি প্রদান করে বলল,
“ওর ঘরেই আছে। আপনি যান। আজ আমি আপনার জন্য চা করে আনছি।”
মৃদু হাসার চেষ্টা করল অর্ষা। তার কেন জানি অসহনীয় কষ্ট হচ্ছে। রাফির রুমে যাওয়ার সময় আহনাফের সঙ্গে দেখা হয় তার। বুকের ভেতরে যেই অল্পটুকু অনল মিটিমিটি জ্বলছিল আহনাফকে দেখা মাত্রই দাউদাউ করে জ্বলতে শুরু করল। মলিন ও করুণ দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে আহনাফের দিকে। কণ্ঠস্বর থেকে কথা বের হতে চায় না। অদৃশ্য এক হাত যেন তার গলা টি’পে ধরে রেখেছে। কী অসহনীয় কষ্ট!
আহনাফ প্যান্টের পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অর্ষাকে পাগল করা, নজর কাড়া হাসিটা দিয়ে সে জিজ্ঞেস করে,
“ভালো আছেন আপনি?”
অর্ষা মাথা দোলায়। অস্পষ্ট স্বরে বলে,
“ভালো। আপনি?”
“আমিও ভালো আছি।”
অর্ষা বলার মতো আর কিছুই খুঁজে পেল না। অথচ বলার জন্য তার ভেতর জমে রয়েছে হাজার হাজার কথা। আহনাফ কি সেগুলি বুঝতে পারে? হয়তো না। বোঝার কথাও নয়। আজকাল তো মানুষ মুখের বুলি শুনেও বোঝে না; সেখানে না বলা কথাগুলো বুঝবে কী করে? সে বেখেয়ালি নিরুদ্বেগ পায়ে রাফির রুমে যায়। বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাফি ফোনে গেইম খেলছিল। অর্ষাকে দেখেই খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। কাছে এসে বলে,
“ম্যাম তুমি এসেছ? জানো, আমি তোমাকে অনেক মিস করেছি।”
অর্ষা হাসল। রাফির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“তাই? আমিও তো তোমাকে মিস করেছি।”
“তাহলে এতদিন তুমি আসোনি কেন?”
“একটু ব্যস্ত ছিলাম।”
“এখন থেকে রোজ আসবে তো?”
“আসব।”
রাফি আজ লক্ষী ছেলের মতো পড়তে বসেছে। অর্ষার কেন জানি মনে হচ্ছে, এই বাড়ির প্রতিটা আনাচে-কানাচে খুশির আলাপন। হঠাৎ এত খুশিতে খুশিতে বাড়িটি আমোদিত হয়ে কেন উঠল? শশীর পদার্পণে? অর্ষা খুব সঙ্গোপনে রাফিকে জিজ্ঞেস করল,
“শশী নামের মেয়েটা তোমার কী হয় রাফি?”
রাফি না তাকিয়েই বলল,”আন্টি।”
এই উত্তর অর্ষার মনঃপুত হলো না। সে স্পষ্ট উত্তর চায়। যেই উত্তরে সবটা পরিষ্কারভাবে জানা যাবে। কিন্তু সেটাই বা কীভাবে সম্ভব? কাকে জিজ্ঞেস করবে সে?
এর মাঝে শশী এসে চা দিয়ে গেল। প্রতিদিন রাফিকে যতটুকু পড়ায় আজ এরচেয়েও বেশি সময় নিয়ে পড়িয়েছে অর্ষা। তবুও সে তার সঙ্কোচ থেকে বের হয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারেনি শশীর কথা। রাফিকে পড়ানো শেষ করে চলে যাওয়ার সময় আহনাফ পেছন থেকে ডাকে।
“অর্ষা।”
অর্ষা সচকিত হয়ে তাকায়। চোখে-মুখে প্রশ্নের বাণ। সে সকল প্রশ্ন উপেক্ষা করে আহনাফ বলল,
“আমিও বের হচ্ছি। আপনাদের বাড়ির ওদিক দিয়েই যাব। একটু ওয়েট করুন আমি গাড়ি নিয়ে আসছি।”
অর্ষা দাঁড়াল। কিছু সময়ের মধ্যেই আহনাফ গাড়ি এনে দাঁড় করাল অর্ষার পাশে। আজ আহনাফই ড্রাইভ করছে। সে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বলল,
“উঠুন।”
অর্ষা বিনাবাক্যে উঠে বসল। বারবার প্রশ্ন করতে গিয়েও আটকে যাচ্ছে। নিজে নিজে আর টিকতে না পেরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলে,
“আচ্ছা একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি?”
আহনাফ গাড়ির আয়নায় একবার অর্ষার দিকে তাকাল। তবে সরাসরি নয়। বলল,
“জি।”
“কিছু মনে করবেন না তো?”
“কিছু মনে করলে কি জিজ্ঞেস করবেন না?”
অর্ষা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আহনাফ হেসে বলে,
“মজা করলাম। বলুন কী জানতে চান?”
“আপনার আর কোনো ভাই আছে?”
“না। কেন?”
“এমনি।”
“এটা তো কোনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন হলো না। আপনি অন্যকিছু জানতে চান।”
অর্ষা নিশ্চুপ। জড়তা কাটিয়ে বলে,
“আপনি কখনও কাউকে ভালোবাসেননি?”
এবার আহনাফ নিশ্চুপ হয়ে যায়। কোনো কথা বলছে না। নিরবে গাড়ি ড্রাইভ করছে। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে রয়েছে অর্ষা। একসময় সে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। তখন আহনাফ বলে,
“একটা কথা বলব?”
চকিতে ফিরে তাকায় অর্ষা। কিছুটা উচ্ছ্বাসের সাথে বলে,
“জি।”
“আমার আসলে এখন কোনো কাজই ছিল না আপনার বাড়ির ওদিকে।”
“তাহলে আসলেন কেন?”
আহনাফ আবারও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,
“আপনাকে কিছু কথা বলতে।”
অর্ষার হৃদস্পন্দন বাড়ছে। আহনাফ তাকে কী কথা বলতে চায়?
“আমি আপনার দৃষ্টির ভাষা বুঝি।” বলল আহনাফ।
সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় অর্ষা। আহনাফ এটাও আয়নায় লক্ষ্য করে। এরপর বলে,
“আপনি আমাকে ভালোবাসেন।”
অর্ষা এবার মুষড়ে যায়। দারুণ বিপাকে পড়ে গেছে সে। আহনাফ কেন তাকে এসব বলছে? তাও আবার সরাসরি!
“আমার ভুল হলে সেটাও আমায় জানাবেন।”
অর্ষা নিরুত্তর।
আহনাফ বলল,”আমি কি এই পর্যন্ত ভুল বললাম?”
“এসব কথা কেন বলছেন এখন?”
“যাতে জল বেশিদূর আর না আগায়।”
“মানে!”
“ভালোবাসা অন্যায় কিংবা দোষের নয়। তবে ভুল মানুষকে ভালোবাসা অন্যায়।”
চাপা আঘাত বুকে অনুভব করে অর্ষা। আহনাফ তাকে কী বলতে চাচ্ছে বা কী বোঝাতে চাচ্ছে সেটা সে এখনও বুঝতে পারছে না। আহনাফ নিজে থেকেই বলল,
“আমি আপনার জীবনে ভুল মানুষ। আমাকে ভালোবেসে আপনার ভালোবাসা কিংবা সময়ের অপচয় করবেন না। আমি বললাম না আপনার চোখের ভাষা আমি পড়তে পারি? শশীকে নিয়ে আপনার সংশয়ও আমার দৃষ্টি এড়ায়নি এবং আপনার সংশয়ই ঠিক।”
“এর মানে? সে আপনার স্ত্রী!”
“নাহ্! তবে হবু স্ত্রী।”
একটা সূক্ষ্ম তীর যেন অর্ষার বুকটাকে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিল তৎক্ষণাৎ। ব্যথায়, অবহেলা ও অপমানে জর্জরিত অর্ষা মূর্ছা যাচ্ছে ভীষণভাবে! এ আঘাত প্রবল অসহনীয় কষ্টের।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]