নবনী পর্ব ৩
গ্রামের বাড়ি এত চারিদিকে সুনসান নীরবতা! নিশ্চয় বাড়ির সবাই ওর চিৎকার শুনেছে! কী ভাববে সবাই?আমার কী যে লজ্জা লাগছে! মনে হচ্ছে মাটির নিচে ঢুকে যেতে পারতাম। এ কি করল নবনী!
আমি বারান্দায় গিয়ে বসে রইলাম। আমার মাথা ভনভন করছে! ইচ্ছে করছে এখনি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। এদের বারান্দায় কোনো চেয়ার নাই। ফ্লোরে বসে আছি দেয়ালে হেলান দিয়ে। মনে হয় প্রচন্ড ঝড় আসবে। কেমন একটা শীতল হাওয়া বইছে!
আমি এখন কী করব ঠিক বুঝতে পারছি না। একবার মনে হচ্ছে বের হয়ে সোজা বাড়ি চলে যাই। এত অপমান সহ্য হচ্ছিল না! কেমন সারা দেহ শুধু জ্বলছে!
বাহিরে প্রচন্ড ঝড় শুরু হয়েছে। মনে হচ্ছে সব কিছু উড়িয়ে নিয়ে যাবে। অনেক সময় ধরে আমি বারান্দায় বসে আছি। বাহিরে ঝড় শুরু হয়েছে কিন্তু নবনী একবারো আসেনি!
খুব ভোরে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। ভাবির সাথে দেখা হয়ে গেল। “কী ব্যপার জামাই বাবু এত ভোরে?”
“আমার খুব জরুরি একটা কাজ পড়ে গেছে আমাকে যেতে হবে।” বলেই দ্রুত বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলাম। পিছনে ফিরে তাকাইনি। রাতের ঘটনা নিশ্চয়ই ভাবি শুনেছেন তাই আমাকে বাধা দেয়নি।
ওদের বাড়ি থেকে বের হয়ে আমাদের বাড়িতে গেলাম না। বাড়িতে যেতেও কেমন লজ্জা লাগছে! মা কী মনে করবে জানি না। আমার মা আমাদের কে একটা কঠিন নিয়মের মধ্যে বড়ো করেছেন। কোনো মেয়েকে আমি অপমান করতে পারি তা আমার মা কল্পনাও করতে পারে না।
বিয়ে উপলক্ষে সাতদিন ছুটি নিয়েছিলাম চারদিন গেছে হাতে আর তিন দিন আছে। অন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসি। আপাতত বাড়িতে যাব না। তাহলে সবাই বুঝবে সত্যি কোনো কাজের জন্যই আমি চলে এসেছি।
নবনীদের বাড়ি থেকে বের হয়ে বাজারে গেলাম। আমার খুব খারাপ লাগছে! মনে হচ্ছে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়বে! ভাবতেই গা জ্বলে যাচ্ছে! বিয়ে করা বউয়ের হাত ধরে আমার এ অবস্থা! আমি কি এমন অপরাধ করলাম ঠিক বুঝতে পারছি না! মানুষ কি বউয়ের গায়ে হাত দেয় না?
ওর যদি এতই আপত্তি থাকত আমাকে বলতে পারত। আমি তো ওকে জোর করে কিছু করতাম না। কী করল! সবার কাছে আমাকে কতটা ছোটো করে দিলো!
ওদের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়ি থেকে সোজা রওয়ানা দিলাম সিলেট। হযরত শাহজালাল এর মাজার থেকে একটু ঘুরে আসি। এরচেয়ে বেশি দূরে এখন যাওয়া যাবে না।
বিশ্বরোড থেকে হানিফ বাসে চড়ে বসলাম সিলেট যাব বলে। বাসে উঠে বসেছি এর মধ্যেই ছোটো বোনটা কল দিয়েছে। উত্তেজনায় ভুলেই গিয়েছিল আমার সাথে ছোটো বোনও এসেছে! কল ধরার সাথে সাথে ও জিজ্ঞেস করছে, “ভাইয়া তুমি কোথায়?”
“আমি একটা জরুরি কাজে এসেছি। তোরা এককাজ কর নিজেদের মতো করে চলে যা কেমন।”
“কী বলো এ সব! এমন সময় তোমার কাজটা বড়ো হলো?”
ছোটো বোন কে তো আর বলা যায় না লজ্জায় পালিয়ে এসেছি!
“কী করবো বল। কাজটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তাই এমন সময় আসতে হলো।” কলটা রেখে দিলাম।
সিলেটে এসে নুরজাহান নামে একটা হোটেলে উঠেছি। এটা শাহজালাল এর মাজারের সাথে। হোটেলের রুমে শুয়ে শুয়ে ভাবছি মানুষ বিয়ের পর হানিমুনে যায়। আমি এ কেমন হানিমুনে আসলাম!
সিলেটে এসে তো হোটেলে বসে থাকা যায় না। তাই ঘুরতে বের হতে হবে। হোটেলে জিজ্ঞেস করলাম,”কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায় বলেন তো?”
“স্যার সিলেটে ঘুরার জায়গার অভাব নাই। আপনি এক কাজ করেন রাতাগুল আর সাদা পাথর দেখে আসেন।”
হোটেল থেকে বের হবো এমন সময় একটা মেয়ে পিছন থেকে ডাকল, ” এই যে ভাইয়া শুনেন।”
আমি তাকালাম না। আমাকে এখানে কোন মেয়ে ডাকতে যাবে! জীবনে কোনো আসেনি সিলেটে। ডাকতে ডাকতে মেয়েটা আমার সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়াল! আমি খুব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। হালকা পাতলা গড়নের শ্যামলা একটা মেয়ে। বয়স মনে হয় পঁচিশ ছাব্বিশ হবে মনে হয়। অবশ্য মেয়েদের বয়স বুঝা খুব কঠিন কাজ।
“আমি আপন।”
জীবনে প্রথম কোনো মেয়ে সেচ্ছায় আমার সাথে পরিচিত হতে আসল। নিজেকে কেমন স্টার স্টার লাগছে!
“জি, আমি রুয়েল।”
“আপনি তো রাতারগুল যাবেন? “
“হ্যাঁ, কেন বলুন তো?”
“আমিও যাব ভাবছি। আমিও নুরজাহানে উঠেছি ৩০২ নাম্বার রুমে।”
“আচ্ছা চলুন।” যাত্রা পথে একজন সঙ্গী হলে খারাপ হয় না। আবার একটু ভয় লাগছে! কোনো ঝামেলায় পড়ব না তো? মেয়ে মানুষ বড়ো ভয়ংকর জিনিস! কী করে এড়ানো যায় বুঝতে পারছি না। ভাবলাম দেখা যাক কী হয়?
একটা কার ভাড়া করলাম সারাদিনের জন্য। প্রথমে রাতারগুল যাব ওখান থেকে ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর। মাঝে যদি কোনো দেখার মতো কিছু থাকে দেখব। এমন একটা পরিকল্পনা করে রওয়ানা দিলাম।
আমাদের গাড়ির ড্রাইভারটার বয়স খুব কম মনে হচ্ছে। বিশ-বাইশ বছরের একটা ছেলে। জিজ্ঞেস করলাম,” নাম কী তোমার? “
“আকাশ।”
গাড়ির পিছনে আপন বসল। আমি সামনে বসতে যাচ্ছিলাম আপন আমাকে পিছনে বসতে বলল। আমি পিছনে এসে আপনের পাশে বসলাম। আপন একটা জিন্স প্যান্ট আর টি-শার্ট পরেছে। চুলগুলো ছোটো করে ছাঁটা! প্রথম দেখলে ছেলে মনে হয়!
গাড়ি চলছে মৃদু গতিতে। আপন বেশি গতি পছন্দ করে না। খুব বেশি দূরের পথ না। আম্বর খানা থেকে রাতারগুল যেতে ঘন্টাখানিক সময় লাগে।
“আপনি কী একা একা ঘুরতে বের হন?”
আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, “কেন মেয়ে বলে একা বের হওয়া যায় না?”
“যাবে না কেন। এখন তো মেয়েরা অনেকটা স্বাধীন বলা যায়। “
“একটা মেয়ে একা বের হলে কত ঝামেলা পোহাতে তা আপনারা বুঝবেন না। হোটেলে উঠতে কত যে সমস্যা! “
“হ্যাঁ, এটা ঠিক। এখনো মেয়েদের জন্য কয়টা শহর নিরাপদ বলেন।”
আমাদের গাড়ি সাহেব বাজার চলে এসেছে। ছোট একটা বাজার। বাজার থেকে কাছেই রাতারগুল। বাজার দেখে আপন গাড়ি থামাতে বলল।” চলেন চা খাই।”
একটা টিনের দোকানে চা খেতে গেলাম। এখানকার মানুষ আপনের দিকে গ্রামের মানুষের মতো অবাক হয়ে তাকাচ্ছে না। এমন প্যান্ট পরা মেয়ে দেখতে এরা অভ্যস্ত। দোকানী আমাদের দুই কাপ চা দিলো। এরা সিলেটি ভাষায় কথা বলে যার সামান্যই আমি বুঝতে পারলাম।
আপন বলল,” চাটা ভালো হয়েছে। আমাকে আরেক কাপ দেন তো।”
আমার কাছে চাটা খুব একটা ভালো লাগেনি! আপন কে আরেক কাপ চা দিলো। চায়ের দাম পরিশোধ করে আবার উঠে পড়লাম গাড়িতে।
রাতারগুল জায়গাটা দেখতে অসম্ভব সুন্দর! গাছে ঘেরা বিশাল একটা জায়গা। নৌকায় চড়ে জঙ্গলের মাঝে ঘুরতে দারুণ লাগছে! জঙ্গলের মধ্যে একটা টাওয়ার আছে এখানে দাঁড়িয়ে পুরো জঙলটা দেখা যায়।
টাওয়ারের উপরে দাঁড়িয়ে আছি এ সময় মায়ের ফোন আসল। কল ধরলাম,
“হ্যালো মা কেমন আছ?”
“তুই কোথায় রুয়েল?”
“মা আমি সিলেট আসছি একটা কাজে।”
মা রেগে আছে তার কন্ঠ শুনে বুঝতে পারছি। ” তুই নতুন বউ রেখে কাজে বের হয়েছিস!”
মা কে কী ঘটনা খুলে বলব। কেমন জানি লাগছে বলতে।” মা শোন কাজটা খুব জরুরি তাই আসতে হয়েছে। আমি বাড়িতে এসে তোমাকে সব খুলে বলব এখন রাখি।”
“কী মাকে খুব ভয় পান নাকি?” আপন মিটমিট করে হাসছে।
আসল ঘটবা জানলে মেয়েটা কী করবে? খিলখিল করে হাসবে না-কি দুঃখী দুঃখী ভাব করবে। বলে দেখব কি? না থাক। অপমানের কথা বলতে ভালো লাগে না!
আপন মেয়েটা অনেকটা বাচ্চাদের মতো। টাওয়ারে দাঁড়িয়ে খুশিতে নাচছে! এ বয়সের মেয়েরা এতটা আবেগী হওয়ার কথা না। তবে মেয়েটাকে ভালো লাগছে দেখতে।
রাতারগুল থেকে আবার সাহেব বাজার হয়ে ভোলাগঞ্জের দিকে রওয়ানা দিলাম। আকাশ বলল, “স্যার শহরে যাবেন? এখানে ভালো খাবার হোটেল নাই।”
“ভোলাগঞ্জ যাওয়ার জন্য কি শহর হয়ে যেতে হয়?”
“না স্যার। সাহেব বাজার থেকে বের হয়ে ধুপারগুল দিয়ে সোজা। শহর উল্টা দিকে।”
আপন বলল,” শহর গিয়ে কাজ নাই। আমরা রাস্তার পাশে কোনো হোটেলে লাঞ্চ করে নিবো।”
একটা ব্যাপার বড্ড খারাপ লাগছে! নবনীদের বাড়ি থেকে এমন করে চলে আসলাম। এতটা সময় কেটে গেছে। নবনী একবারও কল করেনি! এর সাথে সম্পর্ক জড়িয়ে বড়ে ভুল হয়ে গেছে! কী করে যে বের হবো বুঝতে পারছি না।
চলবে–
® নাবিল মাহমুদ