নবনী পর্ব ৮
অফিস থেকে বেরিয়ে এসেছি পুরান ঢাকায়। পকেটে রাখা স্যারের খামটা। খামটা খুলে দেখতে ইচ্ছে করছে কিন্তু খুলছি না। বাড়িতে গিয়ে খুলব।
জয়নাল রাজনের ঠিকানা বের করেছে। যার সাথে নবনীর স্কুলে সম্পর্ক জড়িয়ে ছিল। এখনো সম্পর্ক আছে কি-না জানি না। ছেলটার সাথে কথা বলে যদি কিছু জানা যায়।
পুরান ঢাকায় আসলে আমার কেমন জানি ভয় লাগে! মনে হয় বাড়িগুলো যে কোনো সময় ভেঙে পড়বে। সবগুলো গলি একইরকম লাগে। আস্তর খসে পড়া, একটা পাঁচ তলা বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। রাজন নামের ছেলেটা এই বাড়িতে থাকে।
খবর পাঠানোর পর বাড়ির সামনে বিশ মিনিট দাঁড়িয়ে আছি। একটা ছোট ছেলে এসে বলল, “রাজন ভাই আসতাছে।”
পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের একটা ছেলে বেরিয়ে আসল। একটা সাদা টি-শার্ট আর জিন্সের প্যান্ট পরা। হালকা পাতলা দেহের গড়ন। আমার সামনে এসে সালাম দিলো। আমি জবাব দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কেমন আছেন?”
“ভালো। আপনি আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন? কিন্তু আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না।”
আপনি আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন? আপনাকে আমি ঠিক চিনতে পারছি না!
“আমি রুয়েল মাহমুদ। চলুন কোথাও বসি। যদি আপনার ব্যস্ততা না থাকে।”
“না, না সমস্যা নাই। চলুন”
আমরা হাঁটতে হাঁটতে মূল রাস্তায় আসলাম। দুইজনে নীরবে হাঁটছি। আমি মূলত রাজন কে অনুসরণ করছি। এ এলাকাটা আমার ভালো চেনা-জানা নাই। রাজন ছেলেটা দারুণ স্মার্ট। কথা বলে খুব গুছিয়ে। আমি মনে মনে সাজিয়ে নিলাম কী বলব।
কিছুক্ষণ হাঁটার পরে একটা রেস্টুরেন্ট দেখতে পেলাম। ঠিক রেস্টুরেন্ট না কফিশপ বলা যায়। ভিতরে ঢুকে একটা টেবিলে মুখোমুখি বসলাম। আমার দিকে তাকিয়ে রাজন বলল, “এবার বলুন তো কী জানতে চান বা আপনিই বা কে?”
আমি ওয়েটার কে দুই কাপ কফি দিতে বললাম। রাজন আমার দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। আপনার স্কুল বন্ধু নবনীর চিকিৎসক।
“কার কথা বললেন? ” হতবাক হয়ে চেয়ে আছে।
“নবনী।” আপনারা একসাথে স্কুলে পড়তেন।
“এ মেয়েকে ভুলে যাব? কিন্তু ওর সাথে তো আমার কোনো যোগাযোগ নেই বহুবছর। কী হয়েছে ওর?”
“ওর কিছু মানসিক সমস্যা হয়েছে! আমি ওর চিকিৎসার দায়িত্বে আছি। এ সব রোগীদের অতীত জানাটা খুব জরুরি। তাই আপনার কাছে আসা।”
“দেখুন নবনী সম্পর্কে আমি তেমন কিছু জানি না। স্কুলে আমরা একসাথে তিনবছর পড়েছি ব্যস। তারপর একটা দূর্ঘটনার পর আমি অন্য স্কুলে চলে যাই।”
“আসলে কী হয়েছিল বলা যাবে?”
“তেমন কিছু না সামান্য ব্যাপার। নবনী ছিলো আমাদের স্কুলের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে। ওকে প্রথমদিন থেকেই আমার খুব ভালো লাগত। ধীরে ধীরে ওর সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করলাম। আমাদের মাঝে ভালো একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। না ভালোবাসার কথাটা তখনো বলা হয়নি।
সুযোগ পেলেই ওর সাথে সময় কাটাতাম।
রাজন ছেলেটার মুখে কেমন একটা ভালো লাগার ছাপ দেখতে পাচ্ছি! আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি।”
একটা ছোট শ্বাস ছেড়ে বলা শুরু করল, “সে দিন আমাদের স্কুলে একটা প্রোগ্রাম ছিল। কীসের প্রোগ্রাম মনে নেই। নবনী সেদিন স্কুলে শাড়ি পড়ে এসেছিল। ও কী যে সুন্দর লাগছিল! “
ওর মুখে নবনী কে ভালো লাগার কথা শুনে আমার একটু খারাপ লাগছিল! হালকা একটা হাসি দিয়ে ওর কথায় মন দিলাম।
কী যেন আনতে নবনী কমন রুমে গিয়েছিল। আমিও ওর পিছু নিলাম। সবাই তখন স্কুলের প্রােগামে।
কমন ঢুকে নবনী কী যেন খুঁচ্ছিল। আচমকা আমাকে দেখে চমকে উঠে। “কী ব্যপার রাজন তুমি এখানে?”
“হ্যাঁ, তোমার সাথে কথা বলতে এসেছি। “
“বলো কী বলবা।”
আমি কিছুক্ষন ওর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ও মনে হয় একটু লজ্জা পেল। “তোমাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে! “
“তুমি কী এটা বলতেই এসেছ? ঠিক আছে আমি তাহলে যাই।”
বলেই নবনী বাহিরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। আমি ওর হাত ধরে টান দিলাম। বিশ্বাস করেন আমার অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। শুধু ওর সাথে আর কিছুক্ষন কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। হাত ধরায় এমন করে চিৎকার করে উঠল।
আমার কেমন জানি রাগ লাগছিল! মন চাচ্ছে রাজন ছেলেটাকে একটা কষে চড় মারি! একটা মেয়ের সাথে এমন ব্যবহার করে! রাগ গিলে ফেলে মুখে হালকা হাসি ধরে রাখলাম।
রাজন বলল, অনেকে ছুটে আসল নবনীর চিৎকার শুনে। এরপর স্যারেরা আমার কোনো কথাই শুনেনি। নবনী কে একটা রুমে নিয়ে কী বলেছে আমি জানি না!
পরেরদিনই আমাকে স্কুল থেকে টিসি দিয়ে দেয়।
রাজন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমার বাবা খুব ভালো ছিলেন। আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। না হলে আমি হয়ত নষ্ট হয়ে যেতাম। সবাই আমাকে খারাপ বলেছে! বাবা বন্ধুর মতো আমার সব কথা শুনেছিলেন।
বাবার মতে আমার ভুল হয়েছে। অভাবে মেয়েটার হাত ধরা ঠিক হয়নি! মেয়েটা হয়ত ভয় পেয়ে গেছিল।
আমি বললাম, ” এখনো কী নবনী কে ভালোবাসেন?”
“না, আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। আপনি জিজ্ঞেস করায় মনে পড়ে গেল। মিলির সাথে আমার খুব শীগ্রই বিয়ে হবে। মিলি আমার প্রেমিকা। আমাদের সম্পর্ক তিন বছরের। তা নবনীর অবস্থা কী খুব খারাপ? “
“অনেকটা খারাপ। এবার হয়ত সুস্থ হয়ে যাবে আশা করি।”
বেশকিছু দিন হয়েছে নবনীর সাথে কথা বলা হয় না! দুইজন এক রুমে ঘুমালেও আমাদের মাঝে যোজন দূরত্ব! ছুটির নাস্তা করে রুমে এসে বসে আছি। দেখলাম নবনী আমার জন্য চা নিয়ে এসেছে। আজ ওকে একটু ভালো করে খেয়াল করলাম। একটা শাড়ি পরেছে আকাশি রংয়া। দেখতে বেশ ভালো লাগছে!
আমার সামনে এসে বলল, “আপনার চা।”
চায়ের কাপটা নিয়ে বললাম,” বসো। তোমার সাথে কথা আছে।”
নবনী প্রচন্ড রকমের অবাক হয়েছে! এতদিন ধরে আমি ওকে আপনি করেই বলতাম। আমার পাশের চেয়ার বসল। এখনো ওর ঘোর কাটেনি!
“আমরা তো এখন স্বামী -স্ত্রী তা-ই না?”
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল। কোনো কথা বলল না।
“আজ থেকে তুমিও আমাকে তুমি করে বলবা কেমন?”
আবার মাথা দুলাল।
“আর শোন আজ বিকালে তোমাকে নিয়ে একটা জায়গায় যাব রেডি থাকবা।”
মাথা দুলাল এবারও।
“কথা বলো না কেন?”
“ঠিক আছে। আমি এখন যাই।”
বলেই উঠে দাঁড়াল। হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
নবনী কে নিয়ে এসেছি রুজিনা আপার কাছে। রুজিনা আপা একজন বড়ো মানের সাইকিয়াট্রিস্ট। নবনী কে অবশ্য বলা হয়নি ওকে নিয়ে কোথায় এসেছি। কী সুন্দর করে সেজেছে মেয়েটা! আমার একটু মন খারাপ হয়ে গেল ওকে দেখে। মেয়েটা বোধহয় ভেবেছে কোথাও দাওয়াত খেতে যাব। আসলে রাজন ছেলেটার সাথে কথা বলার পর আমার মন বলছে ওর মানসিক কোনো সমস্যা আছে। আমি জানি আমার ধারনা ভুল কি-না?
আমাদের কে খুব আন্তরিকতা নিয়ে একটা রুমে এনে বসাল রুজিনা আপা। বিশাল সাইজের রুমটা খুব সুন্দর করে সাজানো! একটা টেবিল, তিনটা চেয়ার। দেয়ালে একটা পেইন্টিং লাগান। নবনী এখনো মনে হয় বুঝতে পারেনি আমরা কোথায় এসেছি নাকি বুঝেছে জানি না।
রুজিনা আপা খুব সুন্দর একটা হাসি দিয়ে বললেন, “কেমন আছ রুয়েল?”
“ভালো, আপনি?”
“ভালোই আছি।”
“আপ এ হলো নবনী আমার স্ত্রী। “
নবনী আপাকে সালাম দিয়ে মিষ্টি করে একটা হাসি দিলো।
“ভালোই হয়েছে তোমরা এসেছে জমিয়ে আড্ডা দেয়া যাবে।”
একটা মেয়ে তিনকাপ কফি আর কিছু বিস্কুট এনে টেবিলে রাখল। রুজিনা আপা বললেন, “নেও কফি নেও।”
আমি কফির কাপটা হাতে নিলাম। আপা নবনীর সাথে টুকটাক গল্প করছেন। বাড়ি কোথায়? পড়াশোনা কোথায় করেছে, এ সব।
আপা আমায় ইশারা করল বাহিরে চলে যেতে। “আপা আপনরা গল্প করেন আমি একটু আসছি। ” নবনী কিছু বলল না। আমি বাহিরে এসে বসে আছি। আপার এ ঘরটাও বেশ বড়সড়। একটা ছোট টেবিলে অনেকগুলো ম্যাগাজিন রাখা। একটা নিয়ে পাতা উল্টাতে লাগলাম। বিদেশি সব নায়িকাদের ছবি দিয়ে ভরা ম্যাগাজিনটা।
আধ ঘন্টা ধরে বসে আছি। মনে হচ্ছে কত সময় কেটে গেছে!
এক ঘন্টা পরে আপা আমায় ডাকলেন। ভিতরে ঢুকলাম। নবনী বসে আছে। ওর চোখ কেমন লাল হয়ে গেছে! দেখেই বুঝা যাচ্ছে কেঁদেছে! আমার দিকে তাকাচ্ছে না! আমি ওর পাশের চেয়ারে বসলাম।
রুজিনা আপা বললেন , “নবনী তুমি একটু বাহিরে গিয়ে বসো।”
নবনী উঠে বাহিরে গেল। আমি হতবাক হয়ে আপার দিকে তাকিয়ে আছি। কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছি না!
চলবে —
® নাবিল মাহমুদ