নবনী পর্ব ৯
রুজিনা আপা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। টেবিলের পাশে রাখা ছোটে ফ্রিজ থেকে একটা পানির বোতল বের করলেন। কাঁচের গ্লাসে পানি ঢাললেন। ঢকঢক করে পানি খেলেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে।
“রুয়েল তুমি প্রথম এসে যখন আমাকে নবীনর ঘটনাটা বলেছিলে সেদিন আমি একটা জিনিস ভেবেছিলাম। আজ সব শুনে বুঝতে পারলাম আমার ধারণা ঠিক।”
“আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আপা।”
“আমি জানি তুমি কতটা আন্তরিক নবনীর ব্যাপারে। ওকে অনেক ভালোবাসো। না হলে এতকিছু করতে না। অন্যদের মতো সরাসরি ডিভোর্সের চিন্তা করতা! একটা সম্পর্ক ভেঙে ফেলা তো সহজ! সবাই সহজ পথটাই বেছে নেয়।”
আমিও তো সহজ পথটাই ভেবেছিলাম। অবশ্য আপা কে সে সব কথা বললাম না। নীরব হয়ে আপার দিকে চেয়ে রইলাম।
“রুয়েল, নবনীর সাথে খুব বাজে একটা কাজ হয়েছে। ও যখন খুব ছোটো, বয়স কত ওর ঠিক মতো মনে নেই আট বা সাত বছর হতে পারে। একদিন রাতের আঁধারে ওকে একটা রুমে জোর করে নিয়ে যায়। আঁধারে লোকটা কে ছিলো ও বুঝতে পারেনি! একটা ঘরে নিয়ে ওকে ধর্ষণ করে ঘরে ফেলে চলে যায়! নবনী জ্ঞান হারিয়ে ফেলে! সারারাত ওই অন্ধকার ঘরে পড়ে থাকে!”
আমার এত খারাপ লাগছে! চোখ দুটি কেমন ঝাপসা হয়ে গেছে! ঝিম ধরে আপার দিকে চেয়ে আছি।
আপার গলাও ধরে এসেছে! ভারি গলায় বললেন, “পরেরদিন যখন সবাই ওকে খুঁজে পেল। ও ঠিক বুঝতে পারছিল না! ওর সাথে কী হয়েছে! বাড়ির কেউ কিছু বুঝতে পারেনি! ওর অবচেতন মনে ভয়টা রয়ে গেছে!
ধীরে ধীরে ও বড়ো হতে লাগল। ভয়ংকর একটা ভয় নিয়ে! এই ভয় আবার যখন তখন আসে না! বিশেষ পরিস্থিতিতে আসে! এই জন্যই তোমার সাথে ওই রাতে সামান্য হাত ধরাতে ওমন আচরণ করেছিল! এ সব কিন্তু স্বাভাবিক নবনীর মনে নেই! “
আমি কী বলব ঠিক বুঝতে পারছি না! বুকের ভিতরটা কেমন ভারি হয়ে গেছে! “এখন কী করব আপা?”
“তোমাকে খুব ধর্য ধরতে হবে রুয়েল। নবনীর বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। ওকে ভালোবাসে ভয়টা কাটাতে হবে। মাসে একবার আমার সাথে দেখা করবা।”
রিকশায় বসে আছি দু’জন পাশাপাশি। কেউ কোনো কথা বলছি না। আমার খুব ইচ্ছে করছে নবনীর হাতটা ধরে ওকে বুকে টেনে নিই। ধরতে কেমন ভয় লাগছে!
নবনীর দিকে আড় চোখে তাকালাম কেমন গম্ভীর হয়ে বসে আছে! আমি ভয়ে ভয়ে আলত করে নবনীর হাতে হাত রাখলাম। ও আমার দিকে কেমন করে একবার তাকাল! কিছু বলল না। কিছুটা সময় আমি নবনীর হাত ধরে বসে রইলাম। রিকশা চলছে ভালো গতিতে।
আচমকা নবনী আমাকে জড়িয়ে ধরল। আলত করে আমার কাঁধে মাথা রাখল। নবনী কি কাঁদছে? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না! আমি কিছু বলছি না। আর কিছু সময় পরে আমি বললাম, “বাড়ি যাবে? নাকি কোথাও ঘুরতে যাবা?”
নবনী চুপ করে আছ। আমি যা করি তাতেই রাজি এমন মনে হচ্ছে। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, “ঘুরতে যাবা?”
এবার বলল,” হুঁ।”
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না রাতের বেলা কোথায় ঘুরতে যাব? হঠাৎ কেন জানি ঘুরার কথা মাথায় এলো! রাত্রিবেলা ঘুরার মতো নিরাপদ শহর কি আমরা পেয়েছি?
মেয়েটারও মনে হয় ঘুরতে ইচ্ছে করছে। বলার সাথে সাথে কেমন রাজি হয়ে গেল। কিন্তু যাব কোথায়? বেইলি রোডে কি কোনো ভালো নাটক চলছে? জানি না। আমি কখনো নাটক দেখিনি! এত রাতে আর কোথায় যাওয়া যায়? আচ্ছা জাতীয় জাদুঘর কি রাতের বেলা খুলা থাকে? মনে হয় না। এদেশে রাত হলো ঘুমের জন্য। তাই রাতেরবেলা সব কিছু বন্ধ থাকে।
শাহবাগ এসে নেমে পড়লাম রিকশা থেকে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ঘুরা যায়।” ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এসেছে কখনো নবনী?”
“হুঁ, এসেছি তো।” আসারেই তো কথা এ মেয়ে নিশ্চয়ই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে। আমি কিছুই বললাম না। দুইজন টি,এস,সির দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। পাবলিক লাইব্রেরির সামনে গেছি আচমকা পিছন থেকে কেউ বোধহয় আমার নাম ধরে ডাকছে! মেয়েলি কন্ঠ! এখনে কে আমাকে ডাকবে? পিছনে ঘুরে দেখি আপন আসছে আমার দিকে।
অনেকটা দ্রুত গতিতে হেঁটে এসে সামনে দাঁড়িয়ে একটা হাসি দিয়ে জিজ্ঞেস করল,” কেমন আছ?”
“ভালো। “আমার চোখেমুখে এখনো বিস্ময়!
“তুমি এখানে?” নবনীর দিকে চোখ ইশারা করল।
“এ হলো নবনী আমার স্ত্রী। নবনী ও আপন আমার বন্ধু। “
আপন নবনীর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলল, “কেমন আছেন ভাবি? “
” ভালো, আপনি? “
“আমি সবসময় ভালো থাকি। এ দিকে কোথায় যাবা রুয়েল?”
“নবনী কে নিয়ে একটু ঘুরব ভাবছি।”
নবনী এখন স্বাভাবিক। আপন ওর সাথে টুকটাক গল্প করছে। মেয়েরা মেয়েদের সাথে দ্রুত মিশতে পারে।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে মধুর ক্যান্টিনে আসলাম। নবনী আপনের সাথে ভালোই গল্প করছে। ওকে এখন বেশ হাসি-খুশি লাগছে। হাসলে ওকে কী সুন্দর লাগে! আপনের ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছি না। নবনী কে দেখে ও কি খুশি হয়েছে?
রাতের বেলায় ক্যান্টিনে অনেকেই বসে আছে। এরা মনে হয় ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট হবে। এখানের চাটা খুব ভালো লাগল। আপন আমাদের ক্যান্টিনে খাওয়াল। নবনী ওকে বাড়িতে আসার দাওয়াত দিলো।
নবনীর বাড়ির সবাই চলে এসেছে। ও সবাইকে দেখে খুব খুশি! মামা সবাইকে দাওয়াত দিয়ে এনেছেন। আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়নি। মামা আবার অনুষ্ঠান করবেন। আমি কিছু বলিনি। অবশ্য আমার এখন কোনো আপত্তি নাই।
সকাল থেকে সবাই খুব ব্যস্ত আজ আমাদের বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। অফিসের সবাইকে দাওয়াত করা হয়েছে। বড়ো স্যার মনে হয় আসতে পারবেন না। অবশ্য বলা যায় না স্যার আসতেও পারেন। আমি ঘরে বসে আছি। নবনী ঘরটা গুছাতে গিয়ে একটা খাম হাতে পেয়ে আমায় বলল, “এটা কীসের খাম?”
আমি তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম আরে এটা তো স্যার আমায় দিয়েছিল। পরে খুলে দেখব বলে ভুলে গিয়েছিলাম। “এ দিকে দাও তো দেখি।”
নবনীর হাত থেকে খামটা নিয়ে খুললাম। বাংলাদেশ -ভারত-নেপাল ভ্রমনের প্যাকেজের গিফট ভাওচার। সাথে একটা চেক আছে পঞ্চাশ হাজার টাকার। যাক ভালো হলো নবনীকে নিয়ে একটা টুর দেয়া যাবে।
নবনী এসে বলল, “কী এটা?”
“নেপাল যাবা নাকি?”
নবনী কিছু বলল না হালকা একটা হাসি দিলো। এ মেয়ে হাসি দিয়ে সব কথা বলে! তাহলে বিপদ হয়ে যাবে। এর হাসি নিয়ে আমার গবেষণা করতে হবে। কোন হাসির কি মানে হয়। নেপাল যাবা? উত্তর হ্যা হলে এক ধরনের হাসি। আবার উত্তর না হলে ভিন্ন হাসি!
নবনীর ভাইকে আজ খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে। আমাকে একবার এসে বলেছেন, “আমার খুব ভালো লাগছে রুয়েল তুমি আমার বোনটাকে বুঝতে পেরেছ।”
আমি অবশ্য কিছু বলিনি। নবনীর মতো হাসি দিয়ে উত্তর দিয়েছি। উনি এখন মামার সাথে যোগ দিয়েছেন দুইজন মিলে সব কাজের তদারকি করছেন।
অফিসের সবাই এসেছে। কাজল মেয়েটা আজ খুব সেজেগুজে এসেছে। দেখতে খুব সুন্দর লাগছে! আমাকে বলল, “রুয়েল ভাবি তো হেভি সুন্দর! “
“তাই বুঝি?”
“আপনি জানেন না বুঝি! এমন সুন্দর বউ পেয়ে এতদিন লুকিয়ে রেখেছেন। “
“আমার তো এত সুন্দর লাগল না। আপনার থেকে সুন্দর মনে হয় একটু কমই হবে।”
কেমন একটা হাসি দিয়ে বলল, “রুয়েল ভাই আপনি! ” বলে হাসতে হাসতে চলে গেল।
এ মেয়েটা কি এখন সারাদিন হাসতে থাকবে নাকি?
বড়ো স্যার আসলেন চারটার দিকে। অফিসের কলিগরা বেশিরভাগ খেয়ে চলে গেছে। স্যার একটা কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সামান্য খাওয়া-দাওয়া করলেন। যাওয়ার সময় বললেন, “রুয়েল তোমার পনেরো দিনের ছুটি দিলাম। বউমা কে নিয়ে ঘুরে এসে কেমন।”
অনেকদিন পরে নবনীদের বাড়িতে এসেছি। বাড়ির সবার ব্যবহার মনে হয় আমি এখনো নতুন জামাই। কত ধরনের খাবার আয়োজন করেছে! নবনী একটু একটু পর একটা করে জিনিস এনে সামনে রাখে আর মিষ্টি করে হাসি দেয়।
রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি শেষ। প্রথমবার এসে যে রুমটাতে ছিলাম আজও সে ঘরে শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নবনী বলল, ” শুয়ে পড়ো। “
আমি নবনীর দিকে একটু দুষ্ট দৃষ্টিতে তাকালাম। ও কেমন করে একটা হাসি দিলো। এ সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। নবনী একটু বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলল। নবনীর ভাবি এসেছে। ঘরের ভিতরে এসে বললেন, “কী খবর জামাই বাবু?”
“ভালো ভাবি।”
ভাবি হাসি দিয়ে বললেন, ” প্রস্তুতি নেয়া শেষ! আজ সব কিছু ধীরেসুস্থে করো। সকালে যেন আবার পালাতে না হয়! “
THE END
৷৷৷৷৷ সমাপ্ত