মানুষের বিচিত্র শখ থাকে। আমার বউয়ের শখ হচ্ছে বোরকা কালেকশন করা।
আজকাল নতুন নতুন বোরকা কেনা বহু মেয়ের ট্রেন্ড হয়ে গেছে। এটা যতোটা না ধর্ম পালনের জন্য, তারচে বেশি ফ্যাশনের জন্য।
মার্কেটে নতুন বোরকা এলে সেটা তার কেনা চাই-ই চাই । জামা কাপড়ের প্রতি তার তেমন আকর্ষণ নাই। তার কথা হচ্ছে, ভিতরে ছেঁড়া কাপড় পরলেও সমস্যা নাই, বোরকা নতুন হতে হবে।
মাঝে মাঝেই বউ আমার সাথে পূরনো জামা কাপড় পরে বের হয়, উপরে সুন্দর ফ্যাশনেবল বোরকা। এ যেন উপরে ফিটফাট, ভিতরে লালমনিরহাট!
মার্কেটে গেলে আমি যদি বলি, আস, সুন্দর দেখে একটা ড্রেস কিনে দেই, সে মিষ্টি করে হেসে দিয়ে বলে, ড্রেসের দরকার নাই, পারলে একটা বোরকা কিনে দাও!
বোরকার নীচে ন্যাতান্যাতা তেনা পরতেও তার আপত্তি নাই। বোরকা চাই গর্জিয়াস!
শীত চলে এসেছে।
নারায়নগঞ্জের এক আত্মীয় বাড়িতে যেতে হয়েছিল। ফিরে আসার সময় মার্কেটে ঢুকলাম একটা সোয়েটার কেনার জন্য।
আমরা টপ ওয়ানে ঢুকলাম। আমার সোয়েটার পছন্দ হলো না, কিন্তু বউয়ের একটা বোরকা পছন্দ হয়ে গেল। দাম লিখে রেখেছে আটাইশ,শো টাকা।
আমি বললাম, পছন্দ হলে নিয়ে নাও।
বউ নিজের জন্য আমার চয়েজে কিছুই কিনে না। তার ধারণা আমার চয়েজ ভয়াবহ রকমের খারাপ। অনেকটা ফকিরা টাইপ। তার চয়েজ যদি হয় সিঙ্গাপুর, আমার চয়েজ বড়জোর রংপুর!
আমি একদিন মিনমিনে গলায় বলেছিলাম, এই যে আমি তোমাকে পছন্দ করে বিয়ে করলাম,,,
কথা শেষ করার আগেই সে তাচ্ছিল্যের সুরে বলেছিল, জীবনে ঐ একটা কাজই ঠিকঠাক করতো পারছো।
এরপর আর তাকে ঘাঁটাতে সাহস করি নাই। আমি ভালো করেই জানি, মাছি হয়ে মৌমাছির সাথে ঝগড়া করে জেতা যায় না।
বউ বললো, টপ ওয়ানে জিনিসপত্রের মূল্য বেশি। ওরা দোকানে এসি লাগিয়ে, কয়েকজন সুন্দর সুন্দর ছেলেমেয়ে রেখেছে। সেইসব ছেলেমেয়ে আসেন স্যার,বসেন স্যার বললেই তোমরা গলে যাও। এই বোরকা যদি ‘কালি বাজার’ থেকে কিনি তাহলে অর্ধেক দামে কিনতে পারবো।
আমি কালি বাজার সাধারণত যেতে চাই না, ওখানে জিনিস পত্র তুলনামূলক সস্তা তবে সব সময় প্রচন্ড ভীড় থাকে। পুরো মার্কেট মহিলারা গিজগিজ করছে।
বউ আমাকে জোর করে কালি বাজার নিয়ে গেলে।
দোতালায় বোরকা মার্কেট। পা ফেলবার জায়গা নাই। লোকজন গিজগিজ করছে। বেশির ভাগ মহিলা। মহিলাদের পছন্দের জায়গা হচ্ছে এই মার্কেট। ভিতরে প্রচন্ড গরম। শীতের মৌসুমেও এই মার্কেটে ফ্যান ছেড়ে রাখতে হয়। এসি নাই।
বউ এই দোকানে সেই দোকানে ঘুরতে লাগলো। টপ ওয়ানে দেখা বোরকা পাওয়া যাচ্ছে না। সেই ডিজাইন পাওয়া গেছে, কালার পাওয়া যায় না। আমি বউয়ের পিছনে কিছুক্ষণ ঘুরেই ক্লান্ত হয়ে গেলাম, বউয়ের ক্লান্ত হওয়ার বিন্দুমাত্র লক্ষণ নাই। সে বীরবিক্রমে ভীড় ঠেলে গুতাগুতি করে এগিয়ে যাচ্ছে!
আমি লক্ষ করে দেখেছি, পৃথিবীতে মার্কেট একমাত্র জায়গা যেখানে গেলে মহিলারা কখনোই ক্লান্ত হয় না। তারা একটানা একমাস ওখানে ঘোরাঘুরি করলেও ক্লান্ত হবে না, বরং মনে করবে,আহা! আরেকটু ঘুরতে পারলে ভালো হতো!
‘পিছে চলে দাসীবাঁদী আগে সখিনা’ টাইপ হয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে বউকে বললাম, এবার ক্ষমা দাও। আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলে আমি নির্ঘাত হার্টফেল করবো। জামাই রে বাঁচিয়ে রাখতে চাইলে এই মার্কেট থেকে বেরিয়ে আস। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব না। গরমে আলুসিদ্ধ হয়ে গেছি! তুমি তো অল্প বয়সেই বিধবা হয়ে যাবা!!
বউ তেরছা চোখে আমার দিকে এমন অদ্ভুত ভাবে তাকালো, যার মানে হচ্ছে, এতো সহজে হার স্বীকার করবো? প্রেস্টিজ থাকবে? তুমি মরলে মর,আমি বোরকা না কিনে ফিরছি না। জামাই মরলে জামাই পাওয়া যাবে, কিন্তু বোরকা আমার ওটাই চাই!
বউয়ের চোখ দেখে আমি আর কিছু বলতে সাহস পেলাম না। আল্লাহ তায়ালা পুরুষকে সেই ক্ষমতা দেন নাই,বউয়ের গরম চোখ উপেক্ষা করবে।
উপেক্ষা করে ঘরে এসে বউয়ের সাথে ইউক্রেন রাশিয়ার মতো চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে চাই না। বউ হল সংসারে প্রধানমন্ত্রী, আমরা দারোয়ান। দারোয়ান হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে টেক্কা দেওয়া কাজের কথা না।
আমি হিসাব করে দেখেছি, বউ’রা সবসময় তাদের জামাইকে পারসোনাল পিএ মনে করে। তারা মার্কেটে ড্যাংড্যাং করে ঘুরবে,পিএ পিছনে পিছনে ব্যাগ হাতে দৌড়াবে,এতে তাদের বেজায় সুখ। এতে বস বস ফিলিং হয়।
যেন ছুটির দরখাস্ত করছি এমন করে বললাম, কিছুক্ষণের জন্য আমাকে ছুটি দেও, আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই, তুমি বোরকা কিনে আন। বারান্দায় বাতাস আছে। ওখানে আরাম লাগবে।
বউ বিরক্ত চোখে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল, তারপর তার সেই বিখ্যাত ডায়লগটা,যেটা সে আমার উপর প্রায়ই প্রয়োগ করে, বলল, আল্লাহ তায়ালা কেন যে তোমার মতো কুঁড়ে বাদশাহকে আমার কপালে ফালাইলো! শুধু আমি বলেই তোমার সংসার করে গেলাম, অন্য কেউ হলে,,,,
কথা শেষ না করেই সে রাগ করে চলে গেল।
বউ চলে গেলে আমি বারান্দায় দাঁড়ালাম। টাইম পাস করার জন্য পকেট থেকে মোবাইল বের করে ফেসবুকে ঢুকে পড়লাম। আমার আশেপাশে আরও কয়েকজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। সম্ভবত তাদেরও একই সমস্যা।
আমি মনোযোগ দিয়ে টাইমলাইনে একটা গল্প পড়তে লাগলাম। গল্পটা বেশ মজার। কিছুক্ষণ পরই শুনলাম বউয়ের গলা, এই বোরকা পাওয়া গেছে। পনেরশো টাকা। তাড়াতাড়ি দাও।
আমি ফেসবুক থেকে মুখ না সরিয়ে মানিব্যাগ বের করে দুই আঙুলে টাকা বের করে বউয়ের হাতে দিলাম।
এই সময় পাশ থেকে একজন ভদ্রলোক বললেন, ভাই এইটা কী করছেন?
আমি চোখ তুলে তাকালাম। মানিব্যাগ হাতে এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। আমি যদি পাতলু হই তিনি তবে মটু। ইয়া বড়ো ভুঁড়ি।
ভদ্রলোক আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বেশ স্বাস্থ্যের অধিকারী। চোখে মুখে রাগ স্পষ্ট। কিন্তু কথা বলছেন মিনমিনে গলায়। যেন তিনি বাঘ, কথা বলছেন বিড়ালের গলায়!
ভাই, এইটা কী করছেন?
আমি গল্প পড়তে পড়তে বললাম, টাকা দিচ্ছি।
কাকে টাকা দিচ্ছেন?
মর জ্বালা! কাকে টাকা দিচ্ছি মানে? বউকে টাকা দিচ্ছি।
কার বউকে টাকা দিচ্ছেন?
আমি আমার বউকে টাকা দিচ্ছি, আর কাকে দিবো?
এইটা আপনার বউ?
অবশ্যই। কলেমা পড়েই তো বিয়ে করছি, ভাই। কোন সন্দেহ আছে? আপনি ডিস্টার্ব করছেন কেন? সমস্যা কী?
এইটা আপনার বউ হলে আমার বউ কে?
লে হালুয়া! আপনার বউ কে সেটা আমি কীভাবে বলবো । আপনি বিয়ে করছেন তো? বিরক্ত করবেন না তো ভাই। যান,ফোটেন!
ভদ্রলোক রাগে কাঁপছেন। মনে হচ্ছে তিনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। তিনি আবারও বললেন, এইটা আপনার বউ?
আমি বললাম, জ্বি ভাইসাব!বহু বছর যাবৎ আমরা সংসার করছি। আপনি একে চিনেন নাকি?
ভদ্রলোক কিছু বলতে যাবেন, তক্ষুনি এক মহিলা হনহন করে হেঁটে এসে সামনে থেকে আমার শার্ট টেনে ধরে বলল, এই, কী হয়েছে?
আমি সামনে তাকিয়ে দেখি, যিনি শার্ট ধরেছেন তিনি আমার বউ! হায় আল্লাহ! তাহলে আমার পিছনে কে? আমি টাকা দিলাম কাকে?
আমার পিছনে এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। তার হাতে পনেরশো টাকা। সে কঠিন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কী করে আমার বউ হলো সেটা হয়তো বুঝার চেষ্টা করছে!
আমি ছোঁ মেরে টাকা ছিনিয়ে নিলাম।
আমার পিছনে যে মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন, তার বোরকার কালার এবং আমার বউয়ের বোরকার কালার কাছাকাছি । মার্কেটে বেশ হৈচৈ হচ্ছে তাই গলা বুঝতে পারিনি। আড়চোখে বোরকার কালার দেখেই টাকা বের করে দিয়েছি। সেই মহিলা আমার পাশে দাঁড়ানো তার স্বামীর কাছে টাকা চেয়েছিল কিন্তু তার আগেই আমি মানিব্যাগ বের করে টাকা দিয়ে ফেলেছি!
ভদ্রলোক যেভাবে টেনে হিঁচড়ে হিড়হিড় করে তার বউকে নিয়ে গেল,আমি নিশ্চিত বাসায় গিয়ে বলবে, এই সত্যি করে বল,ঐ ভদ্রলোক কে? তোমার স্বামী না তো? আমাকে ফাঁকি দিয়ে আরেকটা বিয়া কর নাই তো!!
আর আমার বউ?
যেভাবে রক্তচক্ষু নিয়ে আমার দিকে তাকালো,বুঝে গেলাম, ইসরায়েল যেমন নিরীহ ফিলিস্তিনের উপর যখনতখন গোলা বারুদ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেও তাই করতে চাইছে।
শুধু বাসায় যাওয়ার অপেক্ষা।
আমি চোখ বুঝে যত দোয়া দুরুদ জানি, সব পড়তে শুরু করলাম।
#হানিফ_ওয়াহিদ