করিম মিয়ার শখ করছে পুঁটি মাছ ভাজা দিয়া ভাত খাইবো। বউ হালিমারে কইলো, আমি গন্জে যাইতাছি, তুই মাছ ভাইজ্জা রাখ, আমি আইয়্যা গরম গরম ভাতের লগে পেট ভইরা খামু, কতদিন হইল খাই না।
করিম মিয়া গন্জে চইলা গেল।
রাইতে মাছ ঠান্ডা হইয়া যাইবো তাই সন্ধ্যার পরেই হালিমা মাছ ভাজা শুরু করলো। গাও-গেরামের পাকঘর এরহম খোলামেলাই। খালি দুইকোণা বেড়া আছে। হালিমা মাছে মসল্লা মাখায়তাছে আর বিড়বিড় কইরা কইতাছে, আসমানডা আজ এক্কারে আন্ধার, কিছুই দেহা যায় না। এইহানে আবার কুপিতে তেলও কম, বাতাসে কুপির আগুন কাপঁতাছে দেইখ্যা হালিমা কাঠের পিঁরি দিয়া আড়াল করল।
সারা বাড়িতে করিম আর হালিমাই থাকে। হালিমা মাছ ভাজতে বইসা গেছে। মাছ ভাজার গন্ধে বাড়ির উঠানডা ভইরা উঠল। কুপির আলোডা উঠানে খুব বেশি যায় না। প্রথম বার দশটা ভাজা মাছ নামাইছে। চলা চলা পুঁটি, করিম খাইয়া মজা পাইবো,,হালিমা ভাবে।
২য় বার আবারও দশটা ভাজা মাছ নামাইতে গেছে ওমনি হালিমার বুকে ছ্যাৎ কইরা উঠলো, থালে কেবল চাইরটা মাছ। আর ছয়টা গেল কই! মুখ ফিরাইয়া তাকাইয়া দেখে আন্ধারে দুইডা চোখ জ্বলজ্বল করতেছে। কুঁপি ধরতেই দেখে কালা একটা বিলাই বইস্যা বইস্যা মাছ খাইতাছে। হালিমার খুব রাগ হইলো, লাকড়ি দিয়া জোরে একটা মাটিতে বারি দিল। বিলাইডা দৌড় দিয়া পলাইলো।
হালিমা এইবার থালাডা চুলা ঘেইস্যা রাখল যাতে বিলাই মাছ আর খাইতে না পারে। হালিমা আবারো দশটা মাছ নামাইলো। যাইক, এইবার হইয়া যাইবো, হালিমা ভাবে। ভাজা মাছের থালাডা ঢাকনা দিয়া ঢাইক্যা আগুন ধরানো লাকড়ি পাশে রাইখ্যা হালিমা গেল ভাতের চাইল ধুঁইতে টিউবওয়েলের পাড়ে। ভাতের চাইল ধুইয়্যা নিয়া আইস্যা দেখে বিলাইডা ঢাকনা ফালাইয়্যা মুখ দিবো ওমনেই হালিমা গরম লাকড়ি দিয়া বিলাইডারে জোরে বারি দিল। বিলাইডা হালিমারে খামচি দিয়া পেছনে দাড়াইল। হালিমা ফিরা দেখে বিলাইডার চোখ অনেক বড় বড় হইয়া গেছে আর রাগে গসগস করতাছে। ডরে হালিমার গায়ে কাঁটা দিল। হালিমা বুকে সাহস নিয়া কুঁপিডা হাতে বিলাইরে লাকড়ি নিয়া দৌড়ানি দিল। লাকড়ি থেইক্যা আগুনের একখন্ড বিলাইয়ের গায়ে লাগলে, হালিমা স্পষ্ট শুনলো বিলাইডা কইল, আর আগাইস না, কামডা ভাল করলি না। কেমনে মাছ খাস দেহুম, টের পাবি তখন। হালিমার পা আটকাইয়া গেল। তাড়াতাড়ি পাকঘরে ফেরত আইস্যা আরও চার পাঁচটা লাকড়িতে আগুন দিয়া পুরা উঠানডা আলো কইরা ফালাইলো। হালিমা ডরে কাঁপতেছে। খাঁমচির ব্যাথায় হাতটা জ্বইল্যা যাইতাছে। মুখ থাইক্যা থুথু বাইর কইরা লাগাইল। এর আগে এইরহম কালা বিলাই কখনও দেহে নাই। করিমের উপর রাগ হইতাছে, বেডা আহে না কে?
ভাত হইয়্যা গেছে। হালিমা ভাতের পাতিল আর মাছের থালা নিয়া ঘরে যাইবো, উইঠা খাড়াইল। হঠাৎ বাতাস আইলে উঠানের সব লাকড়ি নিভা গেল। ঘরের দরজার সামনে দেখে ৫ জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করতাছে। আন্ধারে আর কিছুই দেহা যায় না। হালিমার হাত থাইক্যা ভাতের পাতিলডা পইরা গেল, মাছের থালাডাও। হালিমাও ডরে মাটিতে পইরা গেল।
হালিমা দেখতাছে, চোখগুলান ধীরে ধীরে কাছে আসতাছে আর ম্যাও ম্যাও করতাছে। থরথর কইরা শরীরডা কাঁপতাছে। হাত পা ঠান্ডা হইয়্যা শরীর অবশ হইয়্যা যাইতাছে। বিলাইগুলা হালিমার উপর ঝাপাইয়া পড়ল। খাঁমচির পর খাঁমচি মাইরা হালিমারে রক্তাক্ত কইরা ফালাইল। ব্যাথায় হালিমা কোঁকাইতাছে। তারপর বিলাইগুলা সব মাছ খাইয়া হালিমারে ডেঙ্গাইয়া যাইতাছে। কোইথ থাইক্যা যেন হালিমার গায়ে বল ফিরা আইল। মাছ খাইছে আবার খাঁমচাইছে, গেরামের মাইয়া রাগে খুন্তিডা চুলায় পোঁড়া দিল। মুহূর্তেই লোহার খুন্তিটা লাল হইয়া গেল।
‘ঐ খাড়া কইলাম
ম্যাও ম্যাও ম্যাও (বিড়ালগুলা ফিরা তাকাইল)
‘শখ মেটে নাই, আরও খাঁমচি খাবি?
‘সাহস থাকলে কাছে আয়
বড় বিলাইটা ঝাপ দিয়া হালিমারে ধরতে গেলে, হালিমা গরম খুন্তি দিয়া বিলাইডার গলা আটকাইয়া ফালাইল। বিলাইডার গায়ে যে এত শক্তি,,,, হালিমাও কম না, গেরামের মাইয়া। একটু পর বিলাইডা পুঁইড়া গন্ধ বাইর হইলে হালিমা এক হ্যাচকায় বিলাইডারে দূরে ফিইক্যা মারল। এতক্ষনে হালিমা ঘামে ভিজা গেছে। রাগে সারা শরীর কাঁপতাছে। মাটিতে পইরা থাকা বিলাইডা মরল না, ছ্যাঁচরাইতে ছ্যাঁচড়াইতে যাওনের সময় কইল, রাইতে দেইখ্যা নিমু তরে। আজকে তুই শেষ।
করিমের গলার ডাক, ঐ হালিমা তুই কই? দেখ আমি তোর জন্য কি আনছি! টর্চ জ্বালাইতেই করিম দেখল, হালিমা হ্যালান দিয়া ঘরের বারান্দায় ঘুমাইতাছে। করিমের রাগ হইল, এত তাড়াতাড়ি ঘুমাইছে কে? করিমের ডাকে হালিমা উঠল। হালিমা কিছু বুঝবার পারতাছে না। শরীরডা কাঁপতাছে। পুরা উঠানডা জোৎস্নায় ঝলমল করতাছে। হালিমা বুঝল, এতক্ষন তাইলে সব স্বপ্ন ছিল। দেখল, হাতে খাঁমচির দাগ নাই, কোন ব্যাথাও নাই। পাকঘরেও চুলা বন্ধ।
হায় হায়, আমার না খাওন রান্ধনের কথা। উইঠা দাড়াইয়া কইল, তুমি হাত-মুখ ধুইয়া আসো আমি খাওন দিতাছি। মনে মনে চিন্তা করল, হায় হায় কিছুইতো করা হয় নাই, মাছ ভাজি নাই, ভাত রান্ধি নাই। মানুষটা খাইবো কি! ঘরে গিয়া পাতিল হাতে নিয়া দেখে, ভাত, মাছ ভাজা সব রান্ধা আছে। ধোঁয়া উঠতাছে। হালিমা অবাক হইয়া চাইয়া রইছে, কেমনে হইলো এইগুলা! কি হইতাছে আমার লগে!
করিম এতক্ষনে ঘরের বারান্দায় গামছা দিয়া হাত মুখ মুছতে মুছতে পাটিতে বইয়া পড়ল।
‘হালিমা, খাওন দে
‘আইতাছি
‘ও…হ্! মাছের যা ঘেরান ছুটছে না।
হালিমার কাছে সবকিছু অজানাই রয়ে গেল।