গল্পঃ বউ পালিয়েছে
বিয়ের আসর থেকে রুবেলের বউ রুমানা পালিয়েছে। এটা নিয়ে চারদিকে হুলুস্থুল লেগে গেছে। এক নিমিষেই বিয়ে বাড়িতে আনন্দের পরিবর্তে অপমান আর লজ্জার আঁধার নেমে এসেছে।
রুবেলের স্বর্গীয় সুখের স্বপ্ন ধূলিসাৎ! ব্যাপারটা তারজন্য যেমন বিব্রতকর তারচেয়ে অনেক বেশি অপমানের। এখন হবু শ্বশুর বাড়ি থেকে সে বিদায় নেবে কেমনে সেটা ভাবতেই কাঁপুনি দিয়ে জ্বর ছাড়লে যেমন ঘাম ছুটে সেরকম ঘাম ছুটছে!
বর আসনে কনে পক্ষের কেউ নেই। একটা বোনজামাই আর এক বন্ধু তার দু’পাশে বসে আছে। নিজেদের কিছু আত্মীয়স্বজন সেখানে উপস্থিত আছে। কারোর মুখে কথা নেই। যেনো মৃত্যুর নিরবতা নেমে এসেছে।
কনে যেমন পরিবারের একমাত্র মেয়ে বরও তেমন পরিবারের একমাত্র ছেলে; তাই দু পরিবার তাদের আত্মীয়স্বজন দাওয়াত দিতে কার্পন্য করেনি। কিন্তু সকলের সামনে মেয়েটা এমন অঘটন ঘটাবে কেউ ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি।
এটা অপেক্ষাকৃত উদার মধ্যবিত্ত পরিবারের বিয়ে। পাত্র-পাত্রী শিক্ষিত। তাদের জোর করা হয়নি, কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়নি বরং তাদের মতামতের ভিত্তিতেই বিয়ের দিনতারিখ ঠিক করা হয়েছে। এমনকি পাত্র-পাত্রী একে অন্যের সঙ্গে কথা বলেছে, দেখা করেছে। নিজেরা পছন্দমতো কেনাকাটা করেছে। অথচ সেই মেয়ে এভাবে সবার মুখে চুনকালি মেখে চলে যাবে কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না।
বিয়ে শুধু দুজন নর-নারীর মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে না দুটি পরিবারের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করে। কোনো ঘটকের মাধ্যমে নয় পাত্র-পাত্রীর বাবা-মা সরাসরি কথা বলে বিয়ে ঠিক করেছে। অল্প দিনই এই দুই পরিবারের মধ্যে ভালো একটা বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল। এমনও নয় এরা পূর্ব পরিচিত তবে পরিবার দুটির মানুষিকতা প্রায় একই রকম।
ছেলের বাবা হোসেন আলী বিয়ের আগে মেয়ের বাবাকে বলেছিলেন, বেয়াই সাহেব আমি আপনার কাছে থেকে সবচেয়ে দামি সম্পদ নিয়ে যাব তাই আমরা কিন্তু দুটি পক্ষ না যে দরকষাকষি করবো। আমরা এখন এক এবং অভিন্ন পক্ষ আর আপনার- আমার সকল আত্মীয়স্বজন আরেক পক্ষ। কারণ দু’টো কথা হলে আমাদের কাছে থেকে তারা সেই তিক্ততার রেশ নিয়ে ফিরে যাবে। আমাদের উচিত হবে সেরকম কিছু যেনো না হয় সে চেষ্টা করা।
এমন কথা শুনে মেয়ের বাবা জহির শেখের ভালো লেগেছিলো। এখন সে বেয়াই সাহেবকে কী জবাব দেবে, সেটা ভেবে পাচ্ছে না। রাগারাগি, মারামারি, ঝগড়াঝাটি করে কাউকে বঞ্চিত করা যায়। তখন দোষারোপ করে নিজের মধ্যে যুক্তি দাঁড় করানো যায়। কিন্তু নির্দোষীকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার ঘোষণা কেউ দিতে পারে না।
জহির শেখের আয়োজনের কমতি ছিল না। আমন্ত্রিত অতিথিরা খাওয়া শেষে পান চিবিয়ে মুখ রঙিন করে চলে গেছে। বিয়েবাড়ির নিজেদের লোকজনের খাওয়া দাওয়া চলছে। ছেলে পক্ষের অনেকে এখনো রয়েছে, এরা বউ নিয়ে বাড়ি ফিরবে। তখনও এশার আযান হয়নি এমন সময় বাড়ির ইলেক্ট্রিসিটি বন্ধ হয়ে যায়। এই সুযোগে রুমানা বাড়ির পেছন দিয়ে চলে যায়। এখন কানাঘুঁষা চলছে, বাড়ির ভেতর থেকে তাকে কেউ তাকে সহযোগিতা করেছে। আর পিছনে একটা মোটরসাইকেল অপেক্ষা করছিলো সেই মোটরসাইকেলে কেউ তাকে লিফট দিয়েছে। ইলেক্ট্রিসিটি যাওয়া যেমন স্বভাবিক আবার মোটরসাইকেলে বিয়ে বাড়িতে বিভিন্ন মানুষের যাওয়াআসা স্বাভাবিক, তাই কেউ খেয়াল করেনি। প্রায় পনেরো মিনিট পরেও যখন রুমানাকে পাওয়া যাচ্ছিল না তখন সবার টনক নড়ে কিন্তু ততক্ষণে অনেক সময় চলে গেছে।
শুধু একজন ছাড়া পাত্রপক্ষ -পাত্রীপক্ষ নির্বিশেষে সবাই রুমানার মুন্ডুপাত করছে, চরিত্র নিয়ে কথা বলছে। সে হচ্ছে বর রুবেল হোসেন। যে মনে মনে বলছে, মেয়েটার সাহস আছে বটে। সে নিজেও কখনো এরকম পরিস্থিতি থেকে পালানোর সাহস পেতো না। অথচ এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না রুমানা চলে গেছে। কয়েক দিন সে বেশ ঘুরাঘুরি করেছে রুমানার সঙ্গে, বিয়ের কেনাকাটা করেছে, রাস্তায় ফুসকা খেয়েছে, পাশাপাশি হেঁটেছে কিন্তু কখনো মনে হয়নি মেয়েটা নিজের অনিচ্ছায় এগুলো করছে। তবে বারবার সে এক খালাতো ভাইয়ের কথা বলেছে। এখন মনে হচ্ছে সম্ভবত তারা পরস্পরকে ভালোবাসে।
মেয়েটা যে দেখতে আহামরি সুন্দরী তা নয় তবে অদ্ভুত মায়াবী দু-চোখ আর নিষ্পাপ হাসির প্রেমে একেবারে ডুবে গিয়েছে রুবেল। ঐ চোখে তাকালে চোখ ফেরানো যায় না।
তার খারাপ লাগছে এই ভেবে; সে সারাজীবন মেয়েদের স্বাধীনতার কথা বলেছে, শিক্ষার কথা বলেছে, অধিকারের কথা বলেছে অথচ তার বউ বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে গেছে! মানুষ এটা সবসময়ই নেগেটিভ ভাবে দেখবে। রুবেল তার বোনজামাইকে বলে, দুলাভাই মানুষের কাছে আর মুখ দেখাতে পারবো না। একটাবার রুমানা আমাকে বলতে পারতো তার নিজস্ব পছন্দ আছে। আমি নিজে থেকেই এ বিয়ে বন্ধ করে দিতাম। পছন্দ থাকাটা স্বভাবিক। মন তো ফিজিক্সের সুত্র মেনে চলে না! আসলে মানুষের মন অদ্ভুত, বিচিত্র আর বেখেয়ালি; সে জাত-বেজাত মানে না, ধর্ম -বর্ণ বোঝে না, ধনী- দরিদ্র বিচার করে না। মন শুধু মন বোঝে আর কিছু না।
রুবেল হোসেন তার বাবা এবং বোনজামাইকে ডেকে বলে এখানে থেকে লাভ কী, চলেন আমরা চলে যাই। আর কাজীসাহেব, বাড়ির মুরুব্বি এবং ইমাম সাহেবকে ডাকেন; যেহেতু বিয়ের রেজিষ্ট্রেশন হয়েছে কবুল বলা হয়েছে সেক্ষেত্রে আইনগত ও ধর্মীয় জটিলতা কী আছে সেটা জেনে নেই। এসব ঝামেলা থেকে এখনই মুক্ত হওয়াই ভালো। যদিও নর-নারীর পরস্পরকে স্বীকৃতি দেওয়াকেই সবচেয়ে বড় আইন মনে করে রুবেল।
ইমাম সাহেব কয়েকজন মুরুব্বি এবং কাজীসাহেবকে নিয়ে আসে। ইমাম সাহেব বলে, যেহেতু দুপক্ষের সম্মতিতে ছেলে মেয়ে কবুল বলেছে সেহেতু শরিয়া মতে বিয়ে হয়ে গেছে। এখন তালাক ছাড়া বিকল্প কিছু নেই। আর ঘটনা প্রেক্ষাপট বিবেচনা নিয়ে আমি কাজী সাহেবকে অনুরোধ করেছি বিয়ের রেজিষ্ট্রেশন না দেখাতে। তবে সে কিছু বলেনি, এ বিষয়ে বিস্তারিত জেনে আপনাদের জানাবে। ফুলসজ্জার রাতে তালাক আর ডিভোর্স নিয়ে কথা শুনতে রুবেলের কষ্ট হচ্ছে। দিন শেষে এই তার তকদিরে ছিল!
জহির শেখ এসে রুবেলকে জড়িয়ে ধরে বাচ্চা ছেলের মতো হাউমাউ করে কান্না শুরু করে; কিছু বলতে পারে না। রুবেল তাকে আস্বস্ত করে বলে, বাবা আমি আপনার যায়গায় নিজেকে রেখে পরিস্থিতি বিবেচনা করেছি। আপনার কোনো দোষ নেই। আপনাদের কারোর প্রতি আমার কিংবা আমাদের অনুযোগ নেই। আম্মাকে ডাকেন তাকে সালাম করে যাই। লজ্জায় অপমানে তার শ্বাশুড়ি সেন্সলেস হয়ে গেছে। তবু রুবেল তার শ্বাশুড়িকে এক নজর দেখে আসে। তারপর বাড়ির সবাইকে সালাম দিয়ে বিদায় নেয় সে। বাড়ির লোকজন বলাবলি করে, এরকম ছেলেকে রেখে যে মেয়ে পালিয়ে যায় তার কপালে কখনো সুখ আসবে না!
গাড়িতে উঠে ফেসবুক অন করতেই দেখে তার বিয়ের ঘটনা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ইনবক্সে অনেক মেসেজ, রুমানাকে নিয়ে হাস্যকর আর নোংরা স্ট্যাটাসে নিউজফিড ভোরে গেছে। ইতোমধ্যে ভূঁইফোড় কিছু লোকাল অনলাইন মিডিয়া এটা নিয়ে নিউজ করে ফেলেছে। সেসব নিউজের নিচে মানুষ অসভ্যের মতো নোংরা মন্তব্যে করতেছে। এসব রুবেল নিতে পারছে না, এসির ভেতরেও দরদর করে ঘামছে সে।
সে ভাবতে থাকে মাকে কী বলবে। গোপনে মাকে রুবেল দুটো স্টাইলিশ গোল্ডের বালি কিনে দিয়েছে যা দিয়ে সে পুত্রবধূকে গ্রহণ করবে। মা চেইন বানিয়েছে, এছাড়া আরো প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে তার ঘরের লক্ষ্মীকে বরন করে নিতে।
সকালে পাড়া-প্রতিবেশিদের কী বলবে সে! ব্যাপারটা এমন নয় যে ঘটনা এখানে শেষ হলেই শেষ; এর রেশ টানতে হবে সারাজীবন!
সবচেয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি হবে অফিসে। কলিগরা গাড়ি ভাড়া করেছে, তারা আগামীকাল সকালেই চলে আসবে। তাছাড়া অফিসে গিয়ে সে কেমনে মুখ দেখাবে, কাজেই বা কেমনে মন বসাবে। আর মানুষের মুখ কখনো বন্ধ করা যায় না, সুযোগ পেলেই দূর্বল যায়গায় আঘাত করবে। রুবেল চোখ বন্ধ করে ইশ্বরের কাছে প্রশ্ন করে, ইশ্বর আমার কী অপরাধ ছিল যে তুমি আমাকে ধূলোয় মিশিয়ে দিলে!
ইতোমধ্যে গাড়ি বাড়িতে চলে আসে। বাড়িতে লাইটিং নেই, গান নেই এবং মানুষের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। সবাই বুঝি চলে গেছে। স্বস্তি পায় রুবেল। এরকম পরিস্থিতিতে কারোর সঙ্গে চোখাচোখি না হওয়াটা অনেক স্বস্তির। গেটে শুধু মাকে দেখতে পায় কিন্তু তাকে কিছু না বলে দ্রুত নিজের রুমের চলে যায় সে। রুমের দরজা খুলে লাইট অন করে দেখে বিছানায় অজস্র ফুলের মধ্যে একটা অপূর্ব ফুল ঘোমটা দিয়ে বসে আছে! পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর আর লাজুক সে ফুল! এতো সুন্দর প্রস্ফুটিত সতেজ ফুল রুবেল জীবনে দেখেনি। চারদিকে ম-ম করছে!
সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের লাইট জ্বলে উঠে, আতসবাজির আলোয় আলোকিত হয়ে যায় পুরো এলাকা। স্পিকার আর আতশবাজির শব্দে গমগম করতে থাকে বিয়ে বাড়ি!
পুনশ্চঃ
রুবেলের বোন, ভাগ্নে আর রুমানার ভাই সুন্দর নির্ভূল ভাবে প্লট সাজিয়েছিলো। সবাইকে বোকা বানিয়েছিলো। পরে অবশ্য এর জন্য মুরুব্বিদের কাছে থেকে প্রচন্ড বোকা শুনতে হয়েছে তাদের।
রূপক
মিরপুর, ঢাকা!
বউ নিয়ে হাসির কবিতা
বাসর রাত—
রুমে ঢুকে আমার মাথায় হাত।
দেখলাম, বউ একেবারে ঘুমে কাত।
স/ র্ব/ নাশ—
কেবল বাজে দশটা পঞ্চাশ,
মধুর রাতের এ কি পূর্বাভাস!
গায়ে হাত দিয়ে ডাক দিলাম—
ওঠো বউ। বাসর রাতে ঘুমায় কেউ?
চলো আমরা প্রেম-সাগরে তুলি ঢেউ!
উঠে বসে বউ ধড়ফড়িয়ে
বললো আমায় ঠোঁট ফুলিয়ে—
‘খবরদার! স্প/ র্শ করবেন না আমাকে।
আমার একজন প্রেমিক আছে।’