আক্কাসের সংসার চলে মাছ ধরে।
গ্রামের নির্ভীক জেলে নামে বেশ সুনাম ওর। কিছুদিন হলো বিয়ে করেছে। নতুন বউয়ের শ্বশুরবাড়ি মন টিকছিলোনা। আর টিকবেই বা কিভাবে একে তো বয়স কম তারউপর আবার অপরিচিত পরিবেশ।
আক্কাসের মা আক্কাসকে ডেকে বললো, বাপরে মাইয়াডা ছোট, সব কিছু মানায় নিতে সময় লাগবো, যা কয়েকদিনের জন্য ওরে
বাপের বাড়িত রাইখা আয়। মনডা ভালা হইলে আবার নিয়া আসিস।
দুপুরে খেয়েই রওনা হলো আক্কাস নতুন বউ নিয়ে। নিজের নৌকায় বউরে তুলে নিজেই বৈঠা হাতে ছলাৎছলাৎ নৌকা বাইতে লাগলো। তিন চার টা গ্রামের পরেই ওর শ্বশুরের গ্রাম। কিন্তু সমস্যা হলো গ্রামের অনেক ভেতরে আক্কাসের শ্বশুরবাড়ি। নৌকা থেকে নেমে প্রায় তিন কিলোমিটার পথ হাটতে হয়। তবে দিনের বেলায় ভাগ্য ভালো থাকলে মাঝে মাঝে ভ্যান পাওয়া যায়। বিয়ের পর এর আগে মাত্র দুবার এসেছে। দিনে এসেছে দিনেই ফিরে গেছে, কখনো রাত করেনি। কিন্তু আজ পৌঁছাইতেই সন্ধ্যে নেমে এলো। নতুন জামাই এসেছে বলে শ্বাশুরি কিছুতেই না খেয়ে যেতে দেবেনা। রান্নাবান্না খাওয়াদাওয়া ও খোশ গল্পেই কেটে গেলো অনেক সময়। এশার আযান দিয়েছে তাও প্রায় ঘন্টা তিনেক হবে। আক্কাস উঠলো ফিরবে বলে কিন্তু আক্কাসের শ্বশুর কিছুতেই ছাড়বেনা। মাঝখানের এক কিলোমিটার পথ নাকি খুব খারাপ। ভূতের নাকি খুব উপদ্রব। রাতে কোন পথিক একা সেই রাস্তা দিয়ে গেলে সকালে তার লাশ হয় বটগাছে ঝুলতে দেখা যায় নয়তো ক্ষেতের কিনারায় পাওয়া যায়। তাই কিছুতেই তিনি জামাইকে রাতে ছাড়তে রাজি নন। এদিকে আক্কাস নাছোড়বান্দা, ও যাবেই।
হাতে যা টাকা ছিলো তা দিয়ে কিছু মিষ্টিমন্ডাই নিয়ে শ্বশুর বাড়ি এসেছে। আজ রাতে মাছ না ধরলে হয়তো কাল বাড়িতে চুলা জ্বলবেনা। বাড়িতে মা আর ছোটবোনের উপোষ কাটাতে হবে। যা হবার হবে তবুও আজ রাতেই ওকে ফিরতে হবে। শ্বশুরকে বুঝিয়ে বললো যে, ভূত ওর কিছুই করতে পারবেনা কারন ভূত তাড়ানোর উপায় ওর জানা আছে। আক্কাসের শ্বশুর বুঝতে পারলো, জামাইকে আটকানো যাবেনা তাই বলে দিলেন প্রায় এক কিলোমিটার পথ পার হতেই যে বট গাছের মোড় আছে তার থেকে বেলগাছ অব্দি প্রায় এক কিলোমিটার পথ খুব খারাপ। বেল গাছটি পার হতে পারলেই আর কোন চিন্তা নেই।
আক্কাস শ্বশুরবাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।
বটগাছের মোড়ের বেশ কিছুটা দূরে থেকেই থমকে দাঁড়ালো, আকাশে রুপালি চাঁদটি তার আলো ছড়াচ্ছে তবুও বিশাল বটগাছটির আশপাশ ঘোর অন্ধকার । লুঙ্গির গাটিতে গুজে রাখা দিয়াশলাই বাক্স আর বিড়ি বের করে হাতে নিয়ে দেখলো মাত্র তিনটা বিড়ি অবশিষ্ট আছে। এই তিনটা বিড়ি ধরিয়েই এই এক কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। একটা বিড়ি ধরিয়ে বাকি দুইটা আর দিয়াশলাই আবার লুঙ্গির গাটে গুজে রেখে পা চালালো। বটগাছটি পার হতেই পেছন থেকে খনখনে গলায় কে জেনো ওর নাম ধরে ডেকে উঠলো – আক্কাইসা, ও আক্কাইসা!
আক্কাস থমকে দাঁড়িয়ে যেই ঘাড় ঘুরাবে অমনি শ্বশুরের সতর্কবাণী মনে পড়ে গেলো, খবরদার বাজান যেই ডাকুক না কেন পিছে ফিইরা তাকাইবানা। ওরা বড়ই বজ্জাত, আপন মানুষের গলায়েও ডাইকা উঠে।
আক্কাস আর পিছন ফিরে তাকায়না। বরং হাটার গতি আরো বারিয়ে দেয়। হাটতে হাটতে একসময় মনে হলো ওর পাশের গাছপালাগুলির ডাল দুমড়েমুচড়ে কেউ ওর সাথে সাথেই এগিয়ে চলছে।
এবার কেউ একজন ওর পাশ থেকেই ডেকে উঠলো — আক্কাইসা, ওই আক্কাইসা হুনসনা?
এবার আক্কাস চলতে চলতেই গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলো — ওই কেডারে? সাহস থাকলে সামনে আইসা খাড়া। পেছনের থেইকা ডাকস ক্যান।
— তুই হাতের আগুনডা ফালায় দে, তোর লগে কথা আছে।
— এহ বললেই হইলো আগুনডা ফালাইদে, কিনতে বুঝি পয়সা লাগেনা? আমি ফালামুনা, বিড়ির তেষ্টা মিটেনাই।
— আক্কাইসা আগুনডা ফালা ভাই, তোর লগে একটু গল্প করি। সবাই আমারে ডরায়, ডাক দিলে উত্তর তো দেয়ইনা উল্টো পড়িমরি কইরা দৌড় মারে। তুই কি সোন্দর আমার লগে কথা কইতাছিস। আগুনডা ফালায়দে ভাই, তোর কাছে আইসা একটু গল্প করি।
অদৃশ্য কারো কথা শুনতে শুনতে আক্কাস প্রায় ভুলতে বসেছিলো যে হাতের ধরানো বিড়ি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। হুট করে খেয়াল হতেই দেখলো প্রায় শেষের দিকে, থমকে দাঁড়িয়ে লুঙ্গির গাটি থেকে আরেকটি বিড়ি বের করে ধরালো। বিড়ি ধরাতেই পাশ থেকে কেউ যেন ঘোঁৎ করে বিরক্তি প্রকাশ করলো। — এইডা কি করলি তুই, আবার ক্যান ধরাইলি, তোরে কইলাম কথা কমু, তুই কথাই হুনলিনা।
— আমার তেষ্টা মিটেনাই। একটায় হয়না, কি বলবি বল।
— আগুনডা ফালায়দেনা ভাই!
— আহ! জ্বালাইছ না তো। যা দূর হ!
— তুই কামডা কিন্তু ভালা করতোছোস না আক্কাইসা। আমার কথা হুনলে তোরে বড়লোক বানাই দিমু। বাড়িত দালান তুইলা দিমু। আগুনডা ফালায়দে।
— হ’ আমারে বোকা পাইছো, আমি জানিনা তুমি কি জিনিষ, বিড়িডা ফালাই আর তুমি আইসা আমার ঘাড় মটকাইয়া বট গাছে ঝুলাও। হইছে অনেক এইবার যা, তোর দালানের আমার কোন দরকার নাই।
…
আক্কাস এমনি সময় খুব দ্রুত হাটতে পারে। এক কিলোমিটার ওর কাছে কিছুইনা কিন্তু আজকে এতো জোরে হেটেও ওর কেন জানি মনে হচ্ছে পথ শেষ হচ্ছেনা। এদিকে হাতের দ্বিতীয় বিড়িটাও প্রায় শেষের পথে।
হাতের জ্বলন্ত বিড়ির দিকে তাকিয়ে কিছুটা বিরক্ত প্রকাশ করলো, ধ্যাত আইজকা বিড়িগুলানও যেন তাড়াতাড়ি পুইড়া যাইতাছে।
তিন নম্বর বিড়ি জ্বালিয়ে আক্কাস আরো জোড়ে পা চালালো। ওর চোখের সামনে বুড়ি মা আর ছোট বোনটার অসহায় ক্ষুধার্থ চেহারা ভেসে উঠলো। ও ছাড়া ওদের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার যে কেউ নাই। আজ ওর কিছু হয়ে গেলে মা বোনের না খেয়েই মরতে হবে। না যে করেই হোক ওকে বাঁচতে হবেই। আরো জোড়ে পা চালালো।
ওইতো দূরে বোধহয় বেলগাছটি দেখা যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় পথ চলতে তেমন সমস্যা হয়না ওর। আর রাতে চলাচলের অভ্যাস আছে। আরো জোরে পা চালালো এদিকে হাতের শেষ বিড়িটিও প্রায় শেষের পথে। ওর পা চালানোর সাথে পাল্লাদিয়ে পাশের গাছপালাগুলিও দ্বিগুণ জোরে আলোড়িত হচ্ছে।
বেল গাছটি পেরিয়ে আসতেই মনে হলো বেল গাছে বিশাল ঝড় উঠেছে। ডালপালা গুলি মরমর করে কেউ যেন ভেঙে ফেলছে তার সাথে কেউ যেন প্রচন্ড ক্রোধে ফেটে পড়ে বলে উঠলো — আইজকার মতো বাইচা গেলি আক্কাইসা। আর যদি কোনদিন তোরে বাগে পাই তো জানে মাইরাফালাইমু।
..
আক্কাস বড় করে শ্বাস নিয়ে এবার ঘাটের পথে চলতে লাগলো। বুঝতে পারলো বড় বাঁচা বেঁচে গেছে। জিনিষটা আর যাই হোক সুবিধার ছিলোনা এটা তার হুমকি থেকেই বেশ বুঝতে পেরেছিলো আক্কাস।
সেদিন মাছ ধরে বাড়িতে পৌছে আক্কাস সিদ্ধান্ত নিলো আর রাতের বেলায় কোনদিন শ্বশুর বাড়ির ওই পথে পা দেবেনা। দিনে যাবে আর দিনেই ফিরে আসবে।
সমাপ্ত,,,,
ঘটনাটা কেমন লাগলো সবাই জানাবেন।
ধন্যবাদ,,,,,,,,