বৃষ্টিময় প্রেম
পর্ব ১৫
লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
ড্রয়িংরুমে এখন হাসিখুশি পরিবেশ। ডাবল আত্মীয়তার খাতিরে বড়াব্বুদের এক্সট্রা খাতিরযত্ন করছেন আন্টি। সবার হাসিমুখ দেখে আনমনেই হাসির রেখা ধরা দিলো আমার ঠোঁটে। দাদির দিকে তাকিয়ে দেখলাম শুধু উনার মুখ গোমড়া। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন খুব ডিপ্রেশনে চলে গেছেন উনি! হয়তো সারাজীবন আমাকে আশ্রিতা হিসেবে খোটা দিতে দিতে যখন জানতে পারলেন আমি তাদের চেয়েও সম্ভ্রান্ত ঘরের মেয়ে বিষয়টা পছন্দ হলোনা তার!!
কিছু মানুষের মানসিকতা কখনোই পরিবর্তন হবার নয়। মানুষের খুশিতে এরা কখনোই খুশি হতে পারেনা, দাদিও ঠিক তেমনি একজন।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলাম আমি!
—তুরফা মা, তাড়াতাড়ি ব্যাগ গুছানো শুরু করে দে। ও বাসায় শিফট হতে হবে যে।
বড়াব্বুর কথায় উনার দিকে তাকালাম আমি। তার মানে তারা চাচ্ছেন আমি তাদের বাসায় চলে যাই। কিন্তু আমি যে অন্য প্ল্যানে ছিলাম। কোচিং এর বাহানায় এ বাসা ছেড়ে চলে যাবো তারপর স্বাধীনভাবে চলাফেরা করবো। আমার সেই ইচ্ছার কি হবে? তাই ভ্রু কুচকে উনাকে বললাম,
—কিন্তু বড়াব্বু, আমি তো আসলে কোচিং এর জন্য অন্য জায়গায় যাওয়ার প্ল্যানে ছিলাম। খুব শীঘ্রই এইচএসসির রেজাল্ট দিবে। এরপর ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোচিং করতে হবে। আমি এমনিতেও এ বাসা ছেড়ে চলে যাবো। সব মিলিয়ে আমি ভীষণ ব্যস্ত থাকবো তাই আপাতত তোমাদের ওখানে শিফট হয়ে তোমাদের কস্ট দিতে চাচ্ছিনা।
নিচু গলায় বললাম আমি। আমার কথায় চমকে উঠলেন বড়াব্বুর সাথে আন্টিও! যেন উনারা এরকম কিছু শুনবেন আশা করেননি। অবাক গলায় আন্টি বললেন,
—তুই এ বাসা ছেড়ে যাবি এটা তো আমাকে বলিস নি?? কবে এই ডিসিশন নিয়েছিস? একবারো আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলিনা?
—আসলে আন্টি দুইদিন হলো ভেবেছি তাই এখনও তোমাকে বলার সুযোগ হয়ে উঠেনি।
আস্তেধীরে বললাম আমি। জানি উনার শুনে খারাপ লেগেছে কিন্তু আমার হাতেও কিছু করার নেই। এখন নিজে স্বাধীনভাবে ভালোভাবে বেচে থাকাই আমার জীবনের একমাত্র ইচ্ছা। আন্টি কিছু বলার আগেই এবার বড়াব্বু বলে উঠলেন,
—চুপ কর তুই। এত বড়ও হয়ে যাসনি যে নিজের জীবনের এরকম সিদ্ধান্ত তুই একাই নিবি। এতদিন আমরা ছিলাম না তখন আলাদা ব্যাপার ছিলো কিন্তু এখন আমাদের পরিচয় হয়েছে আর তুই আমাদের ঘরের মেয়ে। আমাদের রক্ত। তোকে আমরা এতকস্টে এতদিন পর পেয়েছি, কিভাবে তোকে পেয়েও এখন একা ছেড়ে দিবো? এটা তুই ভাবতে পারলি কীভাবে, তুরফা??
বড়াব্বুর হালকা ধমকে ইষৎ কেপে উঠলাম আমি! মনে হচ্ছে উনি রেগে গেছেন আমার কথা শুনে। কিন্তু আমারই বা কি দোষ? আমি কি জানতাম উনারা এতবছর পর আবার আমার জীবনে আসবেন? জানতাম না বলেই তো এরকম ডিসিশন নিয়েছিলাম। এখন অযথাই বকা খেতে হচ্ছে আমাকে!!
—একদম ঠিক বলেছেন, বেয়াইন সাহেব। আপনি কিছু না বললেও আমি নিজেও যেতে দিতাম না ওকে। কিছু বলিনা দেখে বেশি সাহস হয়ে গেছে মেয়ের। ভেবেছে একা একা সব করতে পারবে!
আন্টির কথায় আরেক দফা চোখ-মুখ কুচকে গেলো আমার! দুইদিক থেকে দুইজন আমার বিপক্ষে কথা বলছে! তার মানে আমার প্ল্যান ফ্লপ!! আর যাওয়া হচ্ছেনা এ বাড়ি ছেড়ে! তবে কি আমাকে বড়াব্বুদের বাসায় যেতে হবে? দমবন্ধ করে ভাবলাম আমি।
—তাহলে আমাকে তোমাদের সাথে নিয়ে যেতে চাচ্ছো, বড়াব্বু? কিন্তু কবে যাবো আমি? কারণ ব্যাগও গুছাতে হবে তো আমার।
মুখ ফুলিয়ে বললাম আমি নিরুপায় হয়ে! আমার কথায় চকচক করে উঠলো বড়াম্মুর চোখ!! খুশিতে গদগদ হয়ে উনি বলে উঠলেন,
—কবে আবার? আজকেই চল না, মা। আমার তো আর তোকে ও বাসায় নিতে যেতে তর সইছেনা!!
বড়াম্মুর কথায় মাথা নাড়লেন বড়াব্বু। সাথে সায় দিলো প্রান্ত ভাইয়া আর রাইসাও। আড়চোখে পূর্ণ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন আমার দিকে। উনার গাঢ় চাহনির দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারলাম না আমি, এক পলক দেখেই চোখ সরিয়ে নিলাম!
এই লোকটা মাঝেমধ্যে এমনভাবে তাকায়! মনের মধ্যে যেন কেমন করে উঠে!!
এতক্ষণ পর দাদির গলা শুনে তার দিকে তাকালাম আমি। যাক অবশেষে উনার মুখ খুললো তবে!!
—আপনারা যদি কিছু মনে না করেন তবে একটা কথা বলার ছিলো বেয়াইন।
দাদির কথায় ভ্রু কুচকে গেলো আমার। সাথে একটু নড়েচড়ে বসলো সবাই। উনার আবার কি বলার থাকতে পারে এখানে এমন সময়? কৌতুহলী হয়ে বড়াব্বু জিজ্ঞেস করলেন,
—বলেন খালাম্মা, কি বলার ছিলো আপনার?
—এতদিন ধরে আমরা তুরফার পরিবার খুজছিলাম। আজ আপনাদের পেয়ে অনেক খুশি হয়েছি সবাই।
দাদির কথায় বিষম খেলাম আমি। আমার পরিবার পাওয়ায় উনি খুশি হয়েছেন? এমন মিথ্যা কথা তিনি বলতে পারলেন? এটাই শুনা বাকি ছিলো জীবনে!! আমি পানি খেতেই পুনরায় বলা শুরু করলেন দাদি,
—তো যা বলছিলাম, সেইদিন রায়হান আর তুরফার ওই ঘটনার পর থেকেই আমি একটা বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম। কিন্তু তুরফার পরিবার না থাকায় কথা এগোতে পারছিলাম নাহ। আজকে আপনাদের পেয়ে ভালোই হলো। কথা বলার সুযোগ পেলাম।
দাদির কথায় আমার মনে অজানা ভয় ঢুকে গেলো। উনার মুখ দিয়ে আমার জন্য ভালো কথা বের হবেনা। নিশ্চয়ই অন্যকিছু ভাবছেন উনি কিন্তু এমন কি সেটা জানার জন্য অস্থিরতা ছেয়ে গেলো আমার অন্তরে! বড়াব্বুও একিভাবে বিভ্রান্ত হয়ে বললেন,
—মানে? আপনি কি বলতে চাইছেন আমি ঠিক বুঝতে পাচ্ছিনা বেয়াইন। একটু পরিষ্কারভাবে বলুন।
—আমি তুরফা আর রায়হানের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলতে চাইছি। আমার মনে হয় ওদের জুটি বেশ মানাবে। বেশ অনেক বছর থেকেই এক ছাদের নিচে মানুষ হয়েছে দুইজন। ওরা একে-অপরকে ভালোভাবেই চিনে। বোঝাপড়ায়ও ঝামেলা হওয়ার কথা না। তাই বাচ্চারা আর আপনারা রাজি থাকলে এই ব্যাপারে অগ্রসর হওয়া যায়।
দাদির কথা শুনে যেন মাথায় বাজ পড়লো আমার!! একি বলছেন উনি? আমি আর রায়হান ভাইয়া? ছিহঃ!! উনাকে তো সবসময় নিজের ভাইয়ের নজরেই দেখেছি আমি। তার সাথে বিয়ে কেন করতে যাবো আমি? আর দাদিও বা এতদিন পর কেন উনার সাথে আমার বিয়ের প্রসঙ্গ তুললেন? তবে কি আমার আসল পরিচয় জেনে? আমার বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির লোভে পড়ে এমন প্রস্তাব দিলেন? দুইদিন আগেই আমি তার নাতিকে রুপের জালে ফাসিয়েছি বলছিলেন আবার এখন সেই আমিই তার কাছে ভালো মেয়ে হয়ে গেছি?! বাহ দাদি বাহ!!
মানুষ এতটাও স্বার্থপর হতে পারে তাই বলে? এমনটা আমার জানা ছিলো না।
তবে দাদির কথা শুনে আমার কপালে জমলো বিন্দু বিন্দু ঘাম। রায়হান ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি উনিও অবাক হয়ে আছেন তবে তাকে নেহাৎ দুঃখি বলে মনে হচ্ছেনা আমার মতো। উনি আবার কোনভাবে হ্যাঁ-ট্যা বলে দেবেন না তো? তাহলেই তো শেষ!
আমি তো কিছুতেই উনাকে বিয়ে করবোনা!!
কেননা উনাকে আমি সর্বদা একজন ভাই হিসেবেই শ্রদ্ধা ও সম্মান করি। তাই দুরুদুরু বুকে বড়াব্বুর উত্তর শুনার অপেক্ষায় রইলাম আমি। দোয়া করলাম উনি যেন এ বিয়ের কথা হেসে উড়িয়ে দেন।
চোখ-মুখ কুচকে আড়চোখে চেয়ে দেখি পূর্ণ ভাইয়াও একিভাবে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন বড়াব্বুর দিকে। হয়তো উনিও তার জবাব শুনার অপেক্ষায়। একটু পর উনার সাথে দৃষ্টি মিলে গেলো আমার। কি এক অদ্ভুত দৃষ্টি-বিনিময় হলো!
চমকে উঠে চোখ ফিরালাম আমি!
রুমে উপস্থিত প্রত্যেকের নজর এখন বড়াব্বুর উপর। উনি কি জবাব দেবেন দাদিকে সকলেই এখন সেই অপেক্ষায়…
#চলবে
.