বৃষ্টিময় প্রেম
পর্ব ৪৫
লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
রেস্টুরেন্টের বাহিরে ঠাই দাঁড়িয়ে আছি। ভেতরে গিয়ে সময় জিজ্ঞেস করলাম এক স্টাফের কাছে থেকে। রাত প্রায় ১০.৩০ টা বাজে। এ অসময়ে সবাই আমাকে রেখে চলে গেলো বিষয়টা বিশ্বাস করতে পাচ্ছিনা আমি! আর কেউ না খেয়াল করলেও এটলিস্ট পূর্ণর তো আমার কথা মনে রাখা উচিত ছিলো নাকি? উনিও আমায় ভুলে গেলেন? এটা কিভাবে হলো! এই তার ভালোবাসা? তাচ্ছিল্যের সাথে ভাবলাম আমি। রাগ হলো সবার উপর। কিন্তু এখন আর উপায় নেই, বাসায় তো যেতে হবে কোনভাবে। একটা রিক্সা বা সিএনজি খুজে পেলেও হয়! বাসায় যেয়ে না হয় ভাড়া দিবো। কিন্তু রেস্টুরেন্টের বাহিরে বের হতেই আমার আক্কেলগুড়ুম! বাহিরে জোরে হাওয়া বইছে, আকাশের চাঁদটাও কালোমেঘের আড়ালে মুখ লুকিয়েছে এতক্ষণে! বৃষ্টি হবে নাকি আবার? ভয়-দুশ্চিন্তায় ঘাম ছুটে গেলো আমার।
ভীত পায়ে বৃষ্টি আসার আগেই সিএনজি খুজতে বের হয়ে সামনের রাস্তায় এগোলাম আমি, কিন্তু এ গুমোট আবহাওয়ায় সব চেস্টা ব্যর্থ হলো আমার! কোন রিকশা বা সিএনজি কিছুই খুজে পেলাম নাহ! এমন বাজে পরিস্থিতিতে এর আগে পড়তে হয়নি কখনো তাই রাগে-দুঃখে অভিমানে চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়লো আমার! ওরা কিভাবে পারলো আমায় রেখে যেতে? কান্নার বেগ আরেকটু বাড়তেই কাধে হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। ভয়ে চমকে উঠলাম আমি! ফাঁকা মস্তিষ্কে বাজে চিন্তা এলো! এ সময় কে স্পর্শ করবে আমায়? নিশ্চয়ই কোন ভালো উদ্দেশ্যে নয়? পেছন না ঘুরেই চোখ-মুখ খিচে দৌড়াতে আরম্ভ করলাম। কয়েক কদম এগোতেই আমার নামের ডাক পড়লো। সেই চিরচেনা আওয়াজ কানে বাজতেই নিজ হতেই থেমে গেলো পা-জোড়া!
—দাঁড়াও, তুরফা।
পেছনে ফিরতেই চোখে পড়লো পূর্ণর ক্লান্ত-শ্রান্ত মুখশ্রী৷ উনাকে দেখে আমার চোখমুখের অন্ধকার দূর হয়ে গেলো! এতক্ষণের ভয় যেন নিমিষেই কেটে গেলো! অথচ আমাকে ডেকে ওখানেই ঠাই দাঁড়িয়ে আছেন পূর্ণ। তার উষ্কখুষ্ক চুলগুলো বাতাসে উড়ছে, গভীর চোখজোড়া অদ্ভুতরকমের শান্ত, জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে যেন নিজেকে শান্ত করার চেস্টা করছেন উনি। কি হয়েছে উনার? উনি না চলে গিয়েছিলেন? এখানেই হঠাৎ কিভাবে এলেন? প্রশ্ন এলো বিস্মিত মনে! ভাবতে ভাবতেই ধীর পায়ে এগোতে লাগলাম উনার দিকে। ঠিক এমন সময় আধার রাত্রিকে আলোকিত করে গুরুগম্ভীর বজ্রপাতের ধ্বনি শুনা গেলো! সেই সাথে বেড়ে গেলো আমার পায়ের গতি। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম উনাকে। আচমকা আমার এহেন আক্রমণে পূর্ণ খানিকটা পিছিয়ে গেলেন। তবুও হাতের বন্ধন ছাড়লেন না, নিজেকে সামলিয়ে শক্তহাতে জড়িয়ে ধরলেন আমায়! যেন ছেড়ে দিলেই আমি হারিয়ে যাবো। কিছুক্ষণ কোন কথা বললাম না দুজনেই। উনার বুকে মাথা ঠেকিয়ে শুধু অনুভব করলাম মুহুর্তটাকে। মিনিট কয়েক বাদে আমি পূর্ণকে ছাড়লেও উনি ছাড়ছেন না আমায়, তার হৃদপিন্ড প্রচন্ড জোরে ধুকধুক করছে। যেন ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছেন বা ভয় পেয়েছেন। অথচ ভয় তো আমার পাওয়ার কথা! উনার এমন আচরণ দেখে আমি নিজের ভয়ের কথা ভুলে গেলাম। তার বুক থেকে মাথা তুলে মুখের দিক চেয়ে বললাম,
—কি হয়েছে আপনার? এমন অস্থির হচ্ছেন কেন? প্লিজ শান্ত হোন।
—কোথায় যাচ্ছিলে তুমি?
আমায় হঠাৎ ছেড়ে দিয়ে থমকে উঠলেন পূর্ণ। যে ধমকে হতবাক হয়ে গেলাম আমি! অবাক গলায় বললাম,
—কোথায় যাচ্ছিলাম মানে? আপনারা সবাই তো আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন। বাসায় যাওয়ার জন্য সিএনজি খুজতে এসেছিলাম এদিকে!
—হোয়াট? তোমার কি মাথা খারাপ, তুরফা? তুমি এটা ভাবলে কি করে যে তোমাকে একা রেখে চলে যাবো আমি?
রেগে বললেন পূর্ণ। রাগের শিখায় উনার চোখজোড়া খানিকটা লালচে হয়ে গেছে। আমার ভ্রুদ্বয় কুঞ্চিত হয়ে গেলো উনার কথায়। উনি আমাকে রেখে না গেলে তাকে দেখলাম না কেন ভেতরে? বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করলাম,
—আপনি তাহলে কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? আমি তো গাড়িতে আপনার হাতঘড়িই তো দেখেছি আমার স্পষ্ট মনে আছে! ওটা আপনি ছিলেন নাহ?
বলতে বলতেই পূর্ণর হাত টেনে নিলাম আমি। উনার হাত ফাঁকা দেখে গোলগোল চোখে তার মুখের দিক তাকালাম। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে পূর্ণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
—আকাশ দেখে মনে হচ্ছিলো বৃষ্টি আসতে পারে তাই হাতঘড়ি আর ফোন প্রান্তের কাছে দিয়ে এসেছি আমি। সব বন্ধুরা গাড়িতে গেলে লিমনের বাইকটা থেকে যেতো তাই আমি পরে ভাবলাম তোমাকে নিয়ে বাইকে বাসায় যাই। এজন্যই ওদের গাড়িতে তুলে দিয়ে বাইক নিতে গিয়েছিলাম পার্কিং থেকে। ভেবেছিলাম বাইক রেস্টুরেন্টের সামনে এনে তারপর তোমাকে নিয়ে আসবো ভেতর থেকে কিন্তু এরই মাঝে যে তুমি রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে এসব কান্ড করবে তা তো আমি জানতাম না!
পূর্ণর কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লাম আমি। উনি এতকিছু ভেবে রেখেছিলেন আমাকে বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আর আমি ভাবলাম উনি আমাকে রেখেই চলে গেছেন? নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হলাম, উনার ভালোবাসাকে সন্দেহ করছিলাম আমি! কাচুমাচু মুখে তার পানে চেয়ে বললাম,
—সরি। আসলে রাইসাদের চলে যাওয়ার পর আমি না প্রান্ত ভাইয়ার হাত দেখে আপনি মনে করে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম! ভয়েচিন্তায় মাথা কাজ করছিলোনা আমার তাই কি করবো না করবো ভাবতে ভাবতেই…
—কি করবে না করবে ভাবতে ভাবতেই বেকুবের মতো এত রাতে মাঝরাস্তায় সিএনজি খুজতে বেরিয়ে পড়লে তুমি তাই তো? আবহাওয়ার ভাবসাব দেখেছো তুমি? আর রাস্তাঘাটে এমন রাতে কেমন বিপদ হতে পারে তোমার আইডিয়া নেই? এতটা কেয়ারলেস কেন তুমি, তুরফা? আমাকে কি তুমি শান্তিতে থাকতে দিবেনা?
আমার কথা শেষ না করতেই চেচিয়ে উঠলেন পূর্ণ। যদিও উনার কথায় যুক্তি আছে, আমার বোকামির জন্য এটুক কথা প্রাপ্য আমার তবুও হঠাৎ উনার এত বকা খেয়ে মুখটা ভার হয়ে গেলো আমার! চোখের কোঠায় জমা হলো বিন্দু বিন্দু অভিমানী জল। যেগুলোকে কোনমতে সামলিয়ে মাথা নিচু করে ছোট গলায় বললাম,
—আমি কি করবো বুঝতে পারিনি। ভয়ে টেনশনে মাথা কাজ করছিলোনা আমার। আমি..
কথার মাঝখানে আচমকা দুইগালে পূর্ণর হাতের স্পর্শ পেয়ে কেপে উঠলাম আমি। চোখ তুলে উনার দিকে তাকাতেই দুজনের অক্ষিদ্বয় মিলিত হলো! পূর্ণর চোখে আকুলতা। নরম সুরে বললেন,
—তুমি এমন করো কেন, তুর পাখি? আমার কথা কি একবারো ভাবোনা? আজ যদি তোমাকে আমি ঠিকসময়ে খুজে না পেতাম তবে আমার কি হতো বলো?
উনার কোমলকন্ঠের এমন কথা শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না আমি। ঝাপিয়ে পড়লাম তার বুকের মধ্যিখানে! চোখের পানিগুলো বাধ ভেঙে গড়িয়ে পড়লো আরও একবার। কাদতে কাদতেই বললাম,
—আমি সত্যিই সরি। আমি ভেবেছিলাম সবার মতো আপনিও হয়তো আমায় ভুলে রেখে চলে গিয়েছেন এখানে।
—তোমার অনুপস্থিতিতেই তোমাকে ভুলতে পারিনি আমি। আর এখন তুমি আমার জীবনের অর্ধাংশ। তোমাকে কি ভুলে যাওয়ার সাধ্য আছে আমার?
পূর্ণর মুখে এমন প্রণয়বার্তা শুনে কি বলবো খুজে পেলাম না আমি! আজ উনার কথায়, আচরণে আমি ক্ষণে ক্ষণেই স্পষ্ট প্রমাণ পাচ্ছি উনি আমায় ঠিক কতোটা ভালোবাসেন! আনমনে প্রশ্ন এলো আমি কি সত্যিই তার এত ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য? মনের প্রশ্ন মনেই থেকে গেলো, উত্তরটা পেলাম নাহ। শুধু দৃঢ় করলাম হাতের বন্ধন, আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। এতে পূর্ণ মৃদু হাসলেন যেন, বুকটা হালকা কেপে উঠলো উনার! আমার মুখটা হঠাৎ টেনে তুলে কপালে ভালোবাসার স্নিগ্ধ স্পর্শ একে দিলেন উনি, যে স্পর্শের উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়লো আমার সমগ্র চেতনাজুড়ে!
—তোমাকে একবার হারিয়ে বিরহের দাবানলে পুড়েছি আমি, পুনরায় হারানোর সামর্থ্য নেই আমার। কবে বুঝবে তুমি, তুর পাখি?
পূর্ণর কথায় আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললাম আমি! মনে মনে উচ্চারিত হলো স্বীকারোক্তি “আমি আপনার ভালোবাসা বুঝেছি, পূর্ণ। দেরিতে হলেও আমি আপনার চোখের ভাষা পড়তে শিখেছি!”
চোখ খুলে পূর্ণর দিক তাকিয়ে নিঃশব্দে হাসলাম আমি! উনি কি বুঝলেন কে জানে? তবে বিনিময়ে তিনিও মৃদু হাসলেন! প্রায় সাথে সাথেই আকাশের বুক চিড়ে নেমে এলো এক পশলা স্নিগ্ধকায় বৃষ্টি!
বৃষ্টি নামতে দেখে আমি তড়িঘড়ি করে উনার হাত টেনে ধরলাম। আগেরবার বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাধিয়েছিলেন, এবারও যদি হয়? রিস্ক নেওয়া যাবেনা তো! আমাকে ব্যাকুল হতে দেখে পূর্ণ দুস্টু হেসে বললেন,
—এত ব্যাকুল হয়োনা, বৃষ্টিকন্যা! এ বৃষ্টি তো প্রেমের বৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর হয়না! এ বৃষ্টিতে শুধু প্রেম হয়! তোমার আমার বৃষ্টিময় প্রেম!
পূর্ণর কথায় লজ্জা পেলেও উনার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকালাম আমি। হুট করেই যেন বেখেয়ালি মন বলে উঠলো আমাদের দুজনের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে বৃষ্টি! আমাদের প্রণয়ের সূচনাও যেমন বৃষ্টিতে হয়েছিলো, আমাদের প্রণয়ের পরিণতিও যেন বৃষ্টিময় দিনেই হবে!
#চলবে
.
.