বৃষ্টিময় প্রেম পর্ব ৫১
লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
মুখের উপর গরম নিঃশ্বাস পড়তেই ঘুমের মাঝে ভ্রু কুচকে গেলো আমার! নিভু নিভু চোখ কোনমতে খুলে তাকালাম কি হচ্ছে বুঝার জন্য! চোখ খুলতেই নিজের দিকে ঝুকে থাকা পূর্ণর ভেজা মুখ চোখে পড়লো, মিস্টি হাসি ঝুলিয়ে রেখেছেন ঠোঁটে। উনাকে এভাবে দেখে চমকে উঠলেও পরক্ষণেই সেটাকে নিজের স্বপ্ন মনে করে মুচকি হেসে নরম বালিশে মাথা দিয়ে পুনরায় ঘুমানোয় মনোযোগ দিচ্ছিলাম। ঠিক তখনি যেন জোরে জোরে কেপে উঠলাম আমি, আমার বাহু ঝাকিয়ে পূর্ণ বলছেন,
—আর কত ঘুমাবে, ঘুমের রানী? উঠো এখন!
পূর্ণর আওয়াজ শুনে ঘুমগুলো জানালা দিয়ে পালিয়ে গেলো যেন। চোখ পিটপিট করে উঠে বসলাম কোনরকম। উঠে বসতেই নিজের অবস্থান স্পষ্ট হলো আমার কাছে! উনার কোলে বসে আছি আমি, যেটাকে নরম বালিশ ভাবছিলাম সেটা ছিলো তার প্রশস্ত বুক। তার চোখ-মুখ সত্যিই ভেজা, চুলের মাঝেও জমে আছে বিন্দু বিন্দু জল! ফ্রেশ হয়ে এসেছেন নিশ্চিত। বিস্মিত চোখে সোজা হয়ে বসার চেস্টা করতেই পূর্ণ থামিয়ে দিলেন আমায়। বিরক্তিকর মুখে বললেন,
—কি সমস্যা? এরকম মোচড়ামুচড়ি করছো কেন? চুপচাপ বসে থাকতে পারোনা? এতক্ষণ ঘুমিয়েই তো শান্ত ছিলে৷
—আপনি কখন এলেন? আমি না আপনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম? আর আমি আপনার কোলে এলাম কখন?
—কিছুক্ষণ আগেই এসেছি৷ এসে দেখি আমার রুম আলোকিত করে এক নীলপরী সোফায় বসে ঘুমোচ্ছে। তাকে খাটে শুয়ে দেওয়ার জন্য কোলে নিতেই সে আমার গলা জড়িয়ে ধরে তাই অগত্যা তাকে কোলে নিয়ে আমিও সোফায় বসে রইলাম। তার ঘুম ভাঙতে মন সায় দেয়না বুঝেছো? তাইতো চুপচাপ বসে দুচোখ ভরে তাকে দেখছিলাম।
পূর্ণের কথায় লজ্জায় গালদুটো রক্তিম আভা ধারণ করলো আমার। হালকা হেসে জড়িয়ে ধরলাম উনাকে। উনি মুখ আমার কানের কাছে এনে ফিসফিসিয়ে বললেন,
—আমার জন্য সেজেছো, বউ?
আমি তার বুকে মাথা রেখেই ছোট্ট শব্দে “হুম” বললাম শুধু। উনি হালকা হেসে আমাকে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী গলায় বললেন,
—তোমাকে নীল রঙে এত্ত সুন্দর লাগবে জানলে তো আরও কত আগেই নীলশাড়িতে আলমারি ভরিয়ে ফেলতাম! থ্যাংকস ফর দ্যা সারপ্রাইজ।
কথাটি বলেই নিচু হয়ে আমার গালে চুমো দিলেন পূর্ণ। তার স্পর্শে শিউরে উঠলাম আমি। পরক্ষণেই মনে হলো উনি এখন ভালো মুডে আছেন। এটাই সময় তাকে সবকিছু বলার!
তাই প্রসঙ্গ ঘুরাতে মিস্টি গলায় বললাম,
—শুনুন না।
—বলো না?
কৌতুহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন পূর্ণ। উনার এত মনোযোগ দেখে খানিকটা নার্ভাস হয়ে গেলাম আমি। শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে বললাম,
—আপনাকে একটা ইম্পর্ট্যান্ট কথা বলার ছিলো।
—কি কথা? বলো শুনছি।
—আগে প্রমিস করুন আপনি রাগ করবেন নাহ।
—আগে কথা শুনবো তারপর ভেবে দেখবো। এমন হুটহাট প্রমিস আমি করিনা। বলো জলদি কি বলার!
ভ্রু কুচকে গম্ভীর মুখে বললেন পূর্ণ। উনার কথায় একটা ঢোক গিলে চোখ-মুখ কুচকে এক শ্বাসে বলে ফেললাম,
—আ-আসলে প্রিয়া একজনকে পছন্দ করে।
কিছুক্ষণ পূর্ণর পক্ষ থেকে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে চোখ খুলে দেখি উনি গম্ভীরভাবে চেয়ে আছেন আমার দিকে। উনাকে এমন স্থিরভাবে চেয়ে থাকতে দেখে আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
—আপনি অবাক হন নি?
—এ বয়সে প্রেম-ভালোবাসা আসতেই পারে জীবনে। প্রিয়ার উদ্ভট আচরণে কিছুটা আন্দাজ আমি নিজেই করেছিলাম তাই এটায় বিশেষ অবাক হওয়ার কিছু নেই। তবে আমি জানতে চাইছি ও কাকে পছন্দ করে, ছেলেটার ব্যাপারে তুমি কিছু জানো? সম্পর্ক কতদূর এগিয়েছে? আমার একটাই চিন্তা ও যেন খারাপ কারও খপ্পরে না পড়ে!
পূর্ণর কথায় বিস্ময়ের সহিত কিছুটা সাহস পেলাম আমি। উনার চিন্তা প্রিয়া যেন খারাপ ছেলের চক্করে না পড়ে কিন্তু রায়হান ভাইয়া তো অনেক ভালো! তার মানে উনি রায়হান ভাইয়ার কথা জানলে অতটা রাগ করবেন না নিশ্চয়ই? এ তো যেন মেঘ না চাইতেই জল টাইপ ব্যাপার হয়ে গেলো! গদগদ মনে ভাবতে থাকলাম আমি! আমাকে খুশি-খুশি দেখে উনি ভ্রু তুলে বললেন,
—তোমার মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে তুমি সবই জানো ওর কার সাথে কি আছে না আছে! এগুলো নিয়েই দুজনে এত খুসুরফুসুর করো সারাদিন, তাই না? এখন বলো ছেলেটা কে।
পূর্ণর শান্ত গলার কথায় মনে এক বালতি সাহস জুগিয়ে হাসিমুখে বললাম,
—ছেলেটাকে আপনি চিনেন। আমাদের বেশ পরিচিত একজন। রায়হান ভাইয়া!
রায়হান ভাইয়ের নাম শুনে যেন এতক্ষণের শান্তরুপ নিমিষেই অশান্ত হয়ে গেলো পূর্ণর। আমায় এতক্ষণ আগলে ধরে রাখা হাতটি সরিয়ে নিলেন কোমড় থেকে, ঘটনার আকস্মিকতায় টাল সামলাতে না পেরে সোফায় পড়ে গেলাম আমি। বিশেষ ব্যাথা না পেলেও উনার চেহারা দেখে ভয়ে অবস্থা খারাপ হয়ে গেলো আমার! এতক্ষণের গম্ভীর চোখেমুখে ভর করলো ব্যাপক রাগ। ফুলে যাওয়া নাক বলছে উনি বেজায় রেগে গেছেন। তিনি যে হঠাৎ করেই এভাবে রেগে যাবেন আমি ভাবিনি। ভয়ে ভয়ে কোনোমতে বললাম,
—আ-আপনি এমন রাগ করছেন কেন? রায়হান ভাইয়া তো ভালো মানু….
—রায়হান ভালো মানুষ তাই না? ওকে প্রিয়া পছন্দ করবে আর তুমি ওর সম্পর্কে সব জেনেশুনেও ওকে সাপোর্ট করবে। তোমার থেকে আমি মোটেও এটা আশা করিনি, তুরফা।
তেজী আওয়াজে বললেন পূর্ণ। উনার আচরণে হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। কিছু বলার ভাষাই হারিয়ে ফেললাম একরকম। যা ভয় ছিলো মনে সেটাই হচ্ছে আজ। কিন্তু উনাকে আমার বুঝাতেই হবে রায়হান ভাইয়া প্রিয়ার জন্য ঠিক, তাই মনে জোর এনে শান্ত গলায় বললাম,
—দেখুন, আমি জানি আপনি রেগে আছেন। আপনার রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্বাস করুন রায়হান ভাইয়া প্রিয়ার জন্য খারাপ না…
—কোন যুক্তিতে তুমি এটা বলছো, তুরফা? প্রিয়া আমার বোন। ছোট থেকে অনেক যত্নে ওকে মানুষ করেছি আমরা, ভালোবাসাই বলো আর যাই বলো কোনোদিন কোনকিছুর কমতি করিনি। আর সেখানে ও কি না এমন কাউকে পছন্দ করে যে ওর পূর্বে অন্য কাউকে ভালোবেসেছে? তাও সেটা তোমাকে! এসব জেনেবুঝেও তুমি কিভাবে রায়হানের পক্ষ নিয়ে আমার সাথে কথা বলছো? এন্সার মি!
রাগের একপ্রকার হুংকার দিয়ে উঠলেন পূর্ণ। উনার রাগ দেখে মনে মনে ভয় পেলেও আমাকে ঘাবড়ানো চলবেনা, তাহলে কিছুই ঠিকমতো বুঝাতে পারবোনা উনি শুনবেনও নাহ। তাই দ্বিগুন তেজ নিয়ে উনাকে উত্তর দিলাম,
—তার মানে আপনি কি বলতে চাইছেন কাউকে আগে থেকে ভালোবাসা অপরাধ? আপনার কথা অনুযায়ী তো তাহলে কাউকে ভালোবেসে তাকে না পেলে সারাজীবন একাই থাকা উচিত সেই মানুষের। এভাবে হলে দুনিয়ার অর্ধেক মানুষ একাই থাকতো এতদিন, বুঝেছেন মিস্টার তাজওয়ার পূর্ণ?
আমার যুক্তিতে পূর্ণ কিছুটা থেমে গেলেন যেন। তবুও মুখের থমথমে ভাবের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হলোনা তার। স্বরের গাম্ভীর্য বজায় রেখে একিভাবে বললেন,
—আমি সেটা বলিনি, তুরফা। তোমার কথায় যুক্তি থাকলেও তুমি আমার দিক থেকে ব্যাপারটা বুঝছো না। একবার একটা ভাইয়ের নজর থেকে ব্যাপারটা ভেবে দেখো তাহলেই স্পষ্ট বুঝবে আমি কিসের ভয় পাচ্ছি! রায়হান আগে তোমাকে ভালোবাসতো সেটা ওর অপরাধ নয়, ভালো লাগতেই পারে কাউকে এটা স্বাভাবিক। তাই এ নিয়ে কিছু বলবোনা আমি। কিন্তু একতরফা ভালোবাসার অনুভূতি কতটা প্রখর হয় তা আমি জানি, খুব ভালো করেই জানি। প্রথম ভালোবাসা ভুলা যায়না! আর এজন্যই আমার ভয় হচ্ছে রায়হান যদি তোমাকে ভুলতে না পারে? ও যদি প্রিয়াকে পুরোপুরি ভালোবাসতে না পারে? তবে তো আমার বোনকে যদি ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হতে হবে! আর এই ভয়টাই আমাকে ওদের সম্পর্ক মেনে নিতে দিবেনা।
পূর্ণর কথায় বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম আমি। উনি উনার দৃষ্টিকোণ থেকে যথার্থ ভাবছেন। কিন্তু রায়হান ভাইয়া যে নিজে থেকে জীবনে মুভ অন করতে চাইছেন এটা তাকে কিভাবে বুঝাই? কিছুক্ষণ চুপ থেকে বড়সড় শ্বাস নিয়ে বলতে আরম্ভ করলাম,
—রায়হান ভাইয়া নিজে থেকেই মুভ অন করতে চাচ্ছেন। বিশ্বাস করুন উনি নিজেই প্রিয়াকে এ কথা বলেছেন এবং সেভাবে চেস্টাও করছেন। যদি উনার আমাকে ভুলে যাওয়ার ইচ্ছে না থাকতো তবে এতদিনে উনি অবশ্যই আমাদের মধ্যেও ঝামেলা লাগানোর চেস্টা করতেন তাই না? কিন্তু আপনি তো জানেন তিনি এমন নয়। সেদিন বাইকে আপনি নিজেই তো এটা বলেছিলেন যে আপনি রায়হান ভাইয়ের মাঝে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন। একটা মানুষ যদি অতীতকে ভুলে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছু চিন্তা করে এটা নিশ্চয়ই দোষের কিছু নয়? বরং নিঃসন্দেহে অনেক ভালো কাজ। তাই আপনার উচিত রায়হান ভাইয়াকে মেনে নেওয়ার চেস্টা করা কারণ প্রিয়া নিজেই উনাকে ভালোবাসে। আর প্রিয়া অন্য কারও সাথে অতটা খুশি থাকতে পারবেনা যতটা না রায়হান ভাইয়ার সাথে থাকবে। নিজের ভালোবাসার মানুষ কে পেয়ে গেলে জীবনটা কিভাবে সম্পূর্ণ হয়ে যায় এই অনুভূতির সাথেও নিশ্চয়ই আপনার পরিচয় হয়েছে? তাই না?
শেষের কথাটা ইচ্ছে করেই বললাম আমি। আমার কথায় বিস্ময়ে নিজের রাগ ভুলে গেলেন যেন পূর্ণ। কয়েক মুহুর্ত সেভাবেই তাকিয়ে থেকে রাশভারি কণ্ঠে বললেন,
—অতকিছু আমি বুঝিনা। আমি এখনো রায়হানকে মেনে নিতে পাচ্ছিনা প্রিয়ার জন্য। এ বিষয়ে তুমি আমার সাথে আর কথা বলবেনা। আর প্রিয়ার সাহস বেড়ে গেছে, এতটা বড় ও হয়নি যে নিজের জীবনের এমন ডিসিশন একাই নিবে। ওকে আমি পরে দেখে নিবো।
পূর্ণর শেষের কথাগুলো শুনে হকচকিয়ে গেলাম আমি। তড়িঘড়ি করে বললাম,
—এই না, আপনি প্লিজ প্রিয়াকে বলবেন না যে আমি আপনাকে সব বলে দিয়েছি। ও আমাকে বলতে মানা করেছিলো কিন্তু আমি চাইনি কথাটা লুকিয়ে আপনার আমার মধ্যেকার সম্পর্কে কোন প্রভাব পড়ুক তাই আপনাকে বলে দিয়েছি। আপনি ওকে এ ব্যাপারে কিছু জানাবেন না প্রমিস করুন আমায়?
আমার কথায় পূর্ণ শীতল দৃষ্টিতে তাকালেন শুধু। উনার চাহনি দেখেই ভয়ে ঘাম ছুটে গেলো আমার। মাথা নিচু করে চুপচাপ নিচের দিক চেয়ে রইলাম। পূর্ণ আর কিছু না বলে হনহন করে চলে গেলেন রুমের বাহিরে। উনার যাওয়ার দিকে উদাস চোখে চেয়ে রইলাম আমি। কোথায় ভেবেছিলাম তাকে মানাতে পারবো কিন্তু উনি যেভাবে চলে গেলেন তাতে মনে হচ্ছে উনার রাগ কমেনি।
আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে আরেকবার দেখলাম। কোথায় ভেবেছিলাম এমন সেজেগুজে উনাকে আজ আমার ভালোবাসার কথা জানাবো কিন্তু এখন উলটো রাগিয়ে দিলাম। উনার যে রাগ! না জানি কতদিন আবার আমার সাথে কথা না বলেন! তবে পরমুহূর্তেই ভাবলাম যা হওয়ার একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, বেশিদিন এ কথাটা চেপে রাখতে পারতাম নাহ আমি। তার চেয়ে বরং এখন জানিয়েই ভালো করেছি। যতই রাগ করুক কিন্তু তবুও সবকিছু আমার থেকেই জানলেন তো?
#চলবে
.
.