বৃষ্টিময় প্রেম
পর্ব ৫৬
লেখনীতে-তাসফিয়া হাসান তুরফা
বাসায় পৌঁছানোর পর থেকেই পূর্ণর আচরণে অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে। আর সবদিনের মতো মুখটা ভার করে ঘুরছেন নাহ, একটু আধটু সূক্ষ্ম হাসির রেখা তার ঠোঁটের কোণে উকি দিয়েই চলেছে কতক্ষণ ধরে! অবশ্য সেটা খুব ভালোভাবে খেয়াল না করলে বুঝা যাবেনা। প্রান্ত ভাইয়াও হয়তো আমার মতো খেয়াল করেছেন ব্যাপারটা, তাইতো রুমে ঢুকার আগেই উনাকে প্রশ্ন করলেন,
—কি ব্যাপার, বড় ভাইয়া? একে তো অসময়ের বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে এসেছো তারপরেও তোমাকে বিরক্ত হওয়ার পরিবর্তে এত খুশি খুশি দেখাচ্ছে? সামথিং সামথিং?
প্রান্ত ভাইয়ার কথায় উনি মুখটা পুনরায় গম্ভীর করে ঠান্ডা গলায় বললেন,
—চুপ থাক।
—আরে বলোনা, আমারও তো জানতে ইচ্ছা হচ্ছে। তুরফাও তো দেখি সাথে। ওকে কখন পেলে? রাস্তায় কি হলো এমন যে এই বৃষ্টিময় দিনেও তোমার মুখে সূর্যোদয়ের মতো হাসির ঝলক দেখা দিচ্ছে?
প্রান্ত ভাইয়ার কথায় পড়ে গেলাম অসস্তিকর পরিস্থিতিতে। এমনিতেই ভিজা শরীরে থাকায় ঠান্ডা লাগছে, তার মধ্যে সকালের ঘটনা ভেবে লজ্জাও লাগছে। থম মেরে দাঁড়িয়ে আছি শুধু। এরই মধ্যে হঠাৎ পূর্ণর চাপা গলার ধমক কানে এলো,
—প্রান্ত, বললাম না চুপ থাক এখন? দেখছিস যে ভিজে এসেছি তাও এখনি সব শুনা লাগবে?
উনার ধমকের সুরে মুখটা কালো করলেন প্রান্ত ভাইয়া। উদাস মুখে চলে যেতে নিলেই তার কাধ চাপড়ে থামালেন পূর্ণ। ভাইয়ের উদাস মুখের দিক চেয়ে আলতো হেসে নিচু গলায় বললেন,
—পরে বলছি। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে তুরফার ঠান্ডা লাগবে। এখন ডিস্টার্ব দিস না।
দু’ভাইয়ের মধ্যে আরও কিছু বার্তালাপ হলো যা তৎক্ষণাৎ কানে এলোনা। তবুও উনাদের চাপা হাসির গুঞ্জনে ভ্রু কুচকে গেলো আমার! সেদিকে তাকাতেই পেছন ফিরলেন পূর্ণ। উনাকে দেখেই উল্টোপথে রুমের দিক হাঁটা শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর পায়ের কদমের আওয়াজে বুঝলাম উনিও চলে এলেন এদিকে! কাছে এসেই আমার কাধে হাত রেখে গুনগুন করতে করতে তালে তাল মিলিয়ে হাটতে লাগলেন! আমি শুধু অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকলাম! সদা গম্ভীরমুখের চুপচাপ মানুষটা আজ মনের কথা প্রকাশ করে হঠাৎ করেই যেন ফুর্তিতে মত্ত আছেন? যেমন বহুদিন পর মনের ভার হালকা হলে মানুষ প্রাণখুলে হাসে? আমার হাস্যোজ্জ্বল চঞ্চল পূর্ণকে দেখতেও আজ ঠিক তেমনই লাগছে!
________________
ফ্রেশ হয়ে এসে বড়াম্মুর রুমে চলে এসেছি সবাই। খাটে হেলান দিয়ে বসে আছেন বড়াম্মু। আমাকে দেখে তিনি খুশি হয়ে গেলেন। খাটে তার পাশে যেয়ে বসতেই আমার হাত ধরে বললেন,
—বড়মার খোঁজ নিতে এসেছিস? খুশি হলাম তোকে দেখে!
—হ্যাঁ, বড়াম্মু। তোমার কথা শুনার পর থেকেই তো টেনশন হচ্ছিলো। আল্লাহর রহমতে এখন তুমি ভালো আছো শুনেই দেখতে চলে এলাম। আন্টিও তোমার সাথে কথা বলতে চাইছিলো। ফোন দিয়ে দিই?
বড়াম্মু “হ্যাঁ-সূচক” মাথা নাড়তেই আন্টির সাথে ফোনে কথা বলিয়ে দিলাম তার। কথাবার্তা শেষ করে বিয়ের ব্যাপারেই অন্যান্য আলাপ-আলোচনা হচ্ছিলো। হঠাৎ বড়াম্মু বললেন,
—তুই কি তাহলে আজ এখানেই থাকবি? নাকি একবারে রাইসার সাথে যাবি ও বাড়ি?
—আমি তো আন্টিকে কিছু বলে আসিনি। এখানেই থাক…
—তুরফা এখানেই থাকবে, মা। ও বাসায় যাবে কেন? বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই থাকবে এটাই কি উচিত না?
আমার কথা শেষ না করতে দিয়েই বলে উঠলেন পূর্ণ। উনার কথায় বড়াব্বু ভ্রু কুচকে বললেন,
—এই সামান্য কথায় এভাবে রাগার কি আছে? দিন দিন তোমার রাগ কিন্তু বেড়ে যাচ্ছে পূর্ণ। আর বাড়ির মেয়ের কথা যখন বলছোই তখন এটাও মাথায় রেখো যে তুরফা কিন্তু অনেক বছর ওই বাসাতেও মেয়ের মতোই ছিলো। রাইসার বোন হিসেবে ওখানে থেকে বিয়ে খাওয়ার অধিকার ওর আছে! এছাড়াও এতে বেয়াইনেরও কাজে উপকার হবে।
—আমি তো তুরফাকে বিয়ে খেতে মানা করিনি, বাবা। তোমরা বুঝছো না কেন? ও বাসায় থেকেও যা না থেকেও যা। বিয়েবাসায় তো লোক আসবেই কাজ করার জন্য, ওর তেমন দরকার নেই। আর তাছাড়াও সামনে ওর পরীক্ষা তোমরা ভুলে যাও কেন? আমি না পড়ালে ও পড়বেনা।
—তবে কি তুমি ওর সাথে রাইসাদের বাসায় যেয়ে থাকতে চাইছো?
বিরক্তিকর কণ্ঠে বললেন বড়াব্বু। বুঝা গেলো পূর্ণর কথায় উনি খুব কনফিউজড। তার কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেললো প্রিয়া। পূর্ণ একপলক সেদিকে তাকাতেই হাত দিয়ে মুখ বন্ধ করে ফেললো। অতঃপর উনি বড়াব্বুর দিকে ফিরে গম্ভীর গলায় বললেন,
—তুমি আমার থেকে সরাসরি শুনতে চাইছো তাই তো? তাহলে ঠিক আছে। আমার বউ এখানেই থাকবে, আমার সাথেই থাকবে। ওকে আমি কোথাও যেতে দিবোনা, বুঝেছো? আর কোন কথা আমি শুনতে চাইনা এ ব্যাপারে।
কথাটি বলেই রুম থেকে চলে গেলেন পূর্ণ। উনার যাওয়ার পর কিছুক্ষণ পরিবেশ নীরব হয়ে গেলো। আমি লজ্জায়, বিস্ময়ে থতমত হয়ে গেলাম! এভাবে কেউ বাবার সামনে বলে? লোকটার কি একটুও লজ্জা নেই নাকি? সবার সামনে এভাবে অসস্তিতে ফেলে আমায়!
হঠাৎই ঘর কাপিয়ে হেসে উঠলো প্রান্ত ভাইয়া, তার দেখাদেখি রাইসা, প্রিয়া এবং অতঃপর বড়াব্বু-বড়াম্মু দুজনেই! সবার জ্বালাময়ী হাসি ও আমার দিকে তাকিয়ে থাকায় লজ্জার মাত্রাটা বেড়ে গেলো যেন! আড়ষ্ট মুখে এদিকে-সেদিক চাইতেই প্রান্ত ভাইয়ার কণ্ঠস্বর,
—দেখেছো, বাবা? বলেছিলাম না তোমার বড় ছেলেকে ট্রি/গা/র করার জন্য এই একটা কথাই যথেষ্ট? যেই মা তুরফার যাওয়ার কথা বললো ওমনি কেমন ক্ষেপে বম্ব হয়ে গেলো!
—বড় ভাইয়ার এক্সপ্রেশনটা কি জোস ছিলো! আমার তো মনে হতেই হাসি পাচ্ছে!
প্রিয়ার কথায় আরেকবার হেসে কুটিকুটি হলো দুই ভাইবোন! রাইসাও চোখের ইশারায় আমাকে ক্ষেপানোর চেস্টা করছে, রক্তিম মুখে এসব শুনেও না শুনার ভান করে চুপ থাকলাম। অপরদিকে বড়াম্মুর উদ্দেশ্যে বড়াব্বু বললেন,
—সে যাই হোক, আমার এই একগুঁয়ে ছেলে যখন বলেছে তুরফাকে যেতে দিবেনা তার মানে ও দিবেনা। এখন বেয়াইনকে কোন একটা বাহানা দিয়ে তুমি বুঝিয়ে দিয়ো, কেমন?
বড়াম্মু মাথা নাড়তেই বড়াব্বুও চলে গেলেন। আমাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখেই প্রিয়া এগিয়ে এসে বললো,
—কি গো ভাবী, এত কান্ড হয়ে গেলো তারপরও তুমি এত চুপচাপ কেন? আমার ভাই তো দেখি তোমায় নিয়ে দারুণ পজেসিভ!
—হ্যাঁ হ্যাঁ, দেখলি না সকাল না হতেই মা কে রেখে কেমন বউয়ের কাছে দৌড় দিলো?
প্রিয়ার সাথে যোগ দিলেন বড়াম্মু।
—ছিহঃ!! চুপ করো তোমরা প্লিজ!
আমার কথায় আরেকদফা সবার হাসির রোল পড়লো। পূর্ণ তো সেই কখন নিজের মতামত জানিয়ে লাপাত্তা! এদিকে সকলের হাসির ভীড়ে পড়ে রইলাম আরক্তিম আমি!
__________________
সারাদিনের কোলাহল শেষে দিন শেষ হয়ে মেঘের আড়ালের সূর্য ঢলে পড়লেও আকাশের অবস্থার তেমন একটা পরিবর্তন দেখা গেলোনা! সন্ধ্যার পর থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে! রাতের আধারে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছাড়াছাড়া বৃষ্টির ছোয়া উপভোগ করছি। পূর্ণ বিকেলের দিকে কোথায় যেন গিয়েছিলেন। একটু আগেই এলেন। ফ্রেশ হয়ে বের হবেন যেকোন সময়! ভাবতে ভাবতেই কোমড়ে ঠান্ডা হাতের স্পর্শে ঠান্ডায় শিহরণে কেপে উঠলাম। উনি বের হয়ে এসেছেন। আধো আধো বৃষ্টির পানি ছুয়ে দিচ্ছে দুজনকেই, খানিকক্ষণ সেভাবেই অতিক্রান্ত হলো! কিছুক্ষণ পর আচমকা পূর্ণ নিজের দিক ঘুরিয়ে নিলেন আমায়, চমকে উঠে তার প্রশস্ত বুকে হাত রাখলাম আলতো করে, উনার হাত এখনো আমার কোমড়ে বিরাজমান! সদ্য পানিতে ভেজা মায়াবী মুখের গভীর নে/শা/তুর দৃষ্টি। যে দৃষ্টিতে একটানা তাকিয়ে থাকা দায়! যেই দৃষ্টি মনের মাঝে কম্পন সৃষ্টি করে, সর্বাঙ্গে দহন লাগিয়ে দেয়! মাথা নিচু করতেই থুতনিতে হাতের স্পর্শে তার দিকে ফিরে তাকাতে বাধ্য হলাম একপ্রকার! উনি ভুবনভুলানো হাসি দিয়ে অত্যন্ত শান্ত গলায় বললেন,
—আমার মনে প্রণয়ের আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে তুমি একা দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করবে, এ অন্যায় তো মেনে নেওয়া যায়না, বৃষ্টিকন্যা!
বৃষ্টিকন্যা? মনের মাঝে স্মৃতিচারণ হলো সেইদিনের কথা! দাদুবাসায় উনি এক বৃষ্টিকন্যার গল্প বলছিলেন? আমার ধারণা তবে ঠিক ছিলো? উনি সেটা আমাদের কাহিনিই শুনাচ্ছিলেন! হালকা হেসে বললাম,
—আপনি সেদিন জ্বরের ঘোরে আপনার জীবনের কাহিনি-ই বলছিলেন, তাই না? এত আগে থেকে ভালোবাসেন আমাকে?
—কবে থেকে ভালোবাসি জানিনা। ছোটবেলায় শুধু ভালো লাগা ছিলো কিন্তু যখন থেকে অনুভব করলাম জীবনে সবকিছু থাকার পরেও তোমাকে ছাড়া আমার জীবন অপূর্ণ লাগছে, তখন থেকে তোমার প্রতি অনুভূতি বদলে গেছে! নিছক ভালো লাগায় সীমাবদ্ধ থাকতে পারিনি আর। না দেখে, না চিনেও ভালোবেসে গিয়েছি তোমায়। অনেক অপেক্ষা করেছি তোমার জন্য, তুর পাখি। আজ তোমার মুখে ভালোবাসি শুনে মনে হলো আমার অপেক্ষা করাটা সার্থক!
প্রগাঢ় কণ্ঠে শান্ত চাহনিতে কথাগুলো বলে দম নিলেন উনি। ঠোঁটে লেগে আছে এক টুকরো নজরকাড়া হাসি! এ মানুষটা আমার জন্য এতদিন অপেক্ষা করেছেন ভাবতেই কান্না পাচ্ছে! করুণ কণ্ঠে বললাম,
—তবে এতদিন আমাকে মুখ ফুটে ভালোবাসি কথাটা বলেন নি কেন? আমি কতদিন এটা শুনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম জানেন?
—মুখ ফুটে ভালোবাসি বলেই কি শুধু ভালোবাসা প্রকাশ করা যায়? এই যে এতদিন ধরে আমি কাজের দ্বারা প্রতিদিন তোমায় শতবার ভালোবাসি বলে গেছি সেটা কি তুমি বুঝোনি?
—বুঝেছি তো। কিন্তু…
—শুস, কোন কিন্তু নয়। আজকে আমার সবচেয়ে খুশির দিন। আজ তোমাকে মন ভরে দেখতে দেও, তুরফা রাণী!
উনার উথাল-পাতাল তীব্র দৃষ্টি গভীর ভাবে ছুয়ে দিচ্ছে আমায় সর্বোচ্চজুড়ে! তার চাহনি অস্থির, এলোমেলো। যেন বহুকালের কাংক্ষিত তৃষ্ণা মেটানোর আপ্রাণ প্রয়াস! মুহুর্তেই লাজরাঙা হলো গাল, হিম হয়ে এলো শরীর! প্রসঙ্গ পাল্টাতে তড়িঘড়ি করে বললাম,
—তুরফা রাণী? আমাকে আর কতকিছু বলে ডাকবেন আপনি?
—কেন তোমার ভালো লাগেনা?
—আপনার বলা সবকিছুই আমার ভালো লাগে শুধু ওই স্টুপিড ডাক টা ছাড়া!
গোমড়া মুখে বললাম। সাথে সাথেই তাড়স্বরে হেসে উঠলেন পূর্ণ, হাসির দমকে মৃদু কেপে উঠলো তার বলিষ্ঠ শরীর! টুপ করে গালে চুমু খেয়ে বললেন,
—আমার বোকা তুর পাখি, ওটা তোমাকে রাগানোর জন্য বলি! মিন করে বলিনা তো! তাও যদি তোমার খারাপ লাগে তবে আর বলবোনা। এখন খুশি তো?
মুচকি হেসে মাথা নাড়তেই আমার দু’গালে হাত রেখে পূর্ণ বললেন,
—আর কি বলছিলে যেন? রাণী কেন বললাম? প্রশ্নটার উত্তর দিচ্ছি, তার আগে তুমি একটা প্রশ্নের উত্তর দেও! তুমি কি জানো আমার প্রথম নাম অর্থাৎ তাজওয়ার মানে কি?
আমি মাথা দুলিয়ে না বললাম। উনি হালকা ঝুকে এসে বললেন,
—তাজওয়ার অর্থ যার মাথায় থাকে তাজ, অর্থাৎ রাজা/সম্রাট! এখন আমি যদি রাজা হই, তবে আমার রাজ্যে বিচরণকারী একমাত্র রাণী তো তুমিই হলে, তাই না? সে হিসেবে তুরফা রাণী নামটা কিন্তু সার্থক!
কথাটা বলেই চোখ টিপ মারলেন। এদিকে উনার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা না করে পারলাম নাহ! কিভাবে মিলিয়ে নিলেন কথাগুলো! মুগ্ধ গলায় বললাম,
—আপনার নামটা কিন্তু খুব সুন্দর!
—তা ঠিক বলেছো! সুন্দর তো হবেই। আমার শশুড়মশাই রেখেছিলেন যে!
—বাবা রেখেছিলো? সত্যিই?
—হ্যাঁ। চমকে গেলেও এটাই সত্যি। তোমার বাবা আমাকে খুব ভালোবাসতো জানো? চাচ্চু-ই শখ করে এ নামটা রেখেছিলেন আমার, ফ্যামিলির মধ্যে একমাত্র তিনিই আমায় তাজওয়ার বলে ডাকতেন। এজন্যই ছোটবেলায় তুমিও আমাকে তাজওয়ার ভাইয়া বলতে! যেহেতু তুমি একমাত্র মেয়ে ছিলে তাই চাচ্চুর খুব চিন্তা হতো তোমাকে নিয়ে। আমাদের সবসময় বলতো “আমার কিছু হলে আমার মেয়েটার খেয়াল রেখো”। এজন্য আমার সবসময় চিন্তা হয় তার আদরের রাজকন্যাকে আমি রাণী করে রাখতে পারছি তো?
একটু থেমে পুনরায় বললেন,
—শুনো তুর পাখি, তোমার যদি কখনো মনে হয় আমার দ্বারা বা যে কারও দ্বারা তোমার কোনোদিক দিয়ে অযত্ন হচ্ছে তাহলে বিনা সংকোচে আমাকে জানাবে ঠিকাছে? মনের ভেতর কিছু রাখবেনা…
উনার কথাকে সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই তার ঠোঁটে আংগুল রেখে থামিয়ে দিলাম! উনার কথাগুলো আর নিতে পাচ্ছিলাম নাহ! এই মানুষটা কি আদৌ বুঝছেন উনি কি বলছেন? তার চেয়ে বেশি সুখী কি আমাকে কেউ রাখতে পারতো কখনো? অনুভূতিমিশ্রিত গলায় বললাম,
—থামবেন আপনি? কিসব বলছেন? কারও সাধ্য আছে আপনি থাকতে আমাকে কোনোরুপ অবহেলা করার? আমি কি জানিনা সেটা?
বিস্মিত নয়নে আমার পানে চেয়ে কিছুক্ষণ পর হালকা হাসলেন পূর্ণ। তার ঠোঁটের উপর রাখা আমার হাতে চুমো খেতেই চমকে উঠে হাত সরিয়ে নিলাম! আড়চোখে সেদিকে তাকাতেই উনি বলছেন,
—যাক! আমার বউ আমার সাথে সুখী! এ চিন্তা তো দূর হলো। এখন শুধু একটাই চিন্তা আমার। অবশ্য সেটা তোমাকে নিয়ে নয়, নিজেকে নিয়ে!
—এখন আবার কিসের চিন্তা আপনার?
ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলাম। বিনিময়ে উনি ঘোর লাগা নজরে চেয়ে নিচু কণ্ঠে বললেন,
—তোমার সামনে অনুভূতি ব্যক্ত করে এখন নিজেকে সামলে রাখা দুষ্কর হয়ে যাচ্ছে, তুরফা। আমি আর পারছিনা নিজেকে সামলাতে! তোমার থেকে দূরে থাকা জাস্ট ইম্পসিবল মনে হচ্ছে!
—আ-আপনি…
—আমি বেসামাল হয়ে পড়ছি, দমবন্ধ হয়ে যাচ্ছে! এ বৃষ্টিময় রাতে প্রকৃতির শীতলতায় নিজেকে আর কন্ট্রোল করা যাচ্ছেনা! তুমি কি আজ রাতে আমার উষ্ণতাকে সঙ্গ দিবে? যদি তোমার আপত্তি না থাকে… আমরা..
তার চোখজোড়া বন্ধ, কণ্ঠস্বর ব্যাকুল। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজের অনুভুতিগুলোকে থামানোর চেস্টা করছেন হয়তোবা! তার ভেতরের অস্থিরতা হালকা লালচে হওয়া চেহারায় স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে। সেভাবেই এক হাত বাড়িয়ে রেখেছেন আমার দিকে, যেন সম্মতির অপেক্ষা করছেন। একরাশ লজ্জা, অসস্তি, দ্বিধাকে পিছু ফেলে জোরে শ্বাস নিলাম। কম্পনরত হাতে তার এগিয়ে রাখা হাতে হাত দিতেই প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠলো এতক্ষণের ম্লান হওয়া চেহারায়! আর কিছু বুঝে উঠার আগেই ওষ্ঠদ্বয় মিলিত হলো , শ্বাসপ্রশ্বাস বিচলিত হলো।
বৃষ্টির বেগ বাড়ছে বাহিরে, সেই সাথে বইছে মাতাল হাওয়া। শীতল অন্ধকার কক্ষের অভ্যন্তরে একে-অপরের মাঝে উষ্ণতার খোঁজে নেমেছে দুটো হৃদয়! আধার রাত্রির কোন এক শেষ প্রহরে ঘুমন্ত কক্ষে গুঞ্জিত হলো শান্ত পূর্ণর তৃপ্ত কণ্ঠস্বর,
—তুমি আমার বহু বছরের নিঃস্বার্থ প্রতীক্ষার প্রাপ্তি! তোমার আমার প্রণয়ের বরাবরই সাক্ষী ছিলো বৃষ্টি। আজকে তো বৃষ্টিকে আসতেই হতো, নয়তো এর ব্যতিক্রম কিভাবে হতো? তাই এ বৃষ্টিকে সাক্ষী রেখেই আমি আবারও বলছি, তোমাকে ছাড়া এ পূর্ণ পুরোপুরি অসম্পূর্ণ, তুর পাখি। তোমায় প্রচন্ড ভালোবাসি!
#চলবে
.
.