এক মুঠো কাঁচের চুরি
পর্ব ৪০
লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
রেস্টুরেন্টে পাশাপাশি বসে আছে চৈতালি আর ফাইয়াজ।গম্ভীর মুখ করে চৈতালির দিকে,তাকিয়ে আছে ফাইয়াজ।চৈতালি শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
–এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেনো?এভাবে আমার দিকে তাকাবেন না।আমার শরম করে।
চৈতালির কথা শুনে,ফাইয়াজ শব্দ করে হেসে ফেলল।চৈতালি অবাক নয়নে ফাইয়াজে’র হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।কি মনোমুগ্ধকর সেই হাসি।ফাইয়াজ’কে খুব স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে।মানুষটা হাসলে,একটু বেশিই সুন্দর লাগে।মানুষটা কি জানে না।তাকে হাসলে কতটা কিউট লাগে।সব সময় গম্ভীর মুখ না করে থেকে,একটু হাসি-খুশি থাকলে-ও তো’ পারে।মানুষটা আমার সামনে আসলে,হৃদপিণ্ডের গতি বেগ দ্রুত গতিতে ছুটে চলে।ভাবি বলেছিল।যাকে দেখলে আমার হৃদপিণ্ডের গতিবেগ বেড়ে যাবে।সেই তোমার প্রয়ি মানুষ।কই আবির স্যার সামনে আসলে কখনো এমন হয় নাই।ফাইয়াজ স্যার আমার সামনে আসলে হৃদপিণ্ডের গতিবেগ বেড়ে যায় কেনো?তবে কি ফাইয়াজ স্যারই আমার প্রিয় মানুষ।বলেই নিজের মাথা নিজেই দু-হাত দিয়ে চেপে ধরলো।মনে মনে হাজার বার নিজেকে ধিক্কার জানালো।
–এসব আমি কি ভাবছি।ছিঃ চৈতালি তোর লজ্জা হওয়া উচিৎ।এক ভুল মানুষ কতবার করে।এসব চিন্তা আর কখনো মাথায় আনবি না।চৈতালির চিন্তার মাঝে,
অনেক গুলো আইসক্রিম এসে চৈতালির সামনে পড়লো।চৈতালি মাথা ছেড়ে পাশে তাকিয়ে লম্বা একটা ছেলেকে দেখে পেল।চৈতালি আইসক্রিমের দিকে চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে,ফাইয়াজের দিকে তাকালো।
–আমার দিকে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই।একটা আইসক্রিমের জন্য নিজের জীবন দিতে যাচ্ছিলে,
চুপচাপ সবগুলো শেষ করবে।না হলে তোমার অবস্থা আমি কি করবো।তুমি নিজে-ও জানো না।
–আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ এতগুলো আইসক্রিম খেতে পারে।ফাইয়াজ কোনো কথা না বলে চৈতালির পায়ের কাছে গিয়ে বসলো।চৈতালির পায়ে হাত দিতে যাবে।তখনই চৈতালি ফাইয়াজের হাত ধরে ফেলে।
–সমস্যা কি?পায়ে হাত দিচ্ছেন কেনো?ফাইয়াজ চৈতালির কথায় পাত্তা না দিয়ে,চৈতালির হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল।চৈতালির একটা পা’ ফাইয়াজের হাঁটুর ওপরে তুলে নিল।একটু সাদা বরফের টুকরো নিয়ে চৈতালির পায়ে দিয়ে দিতে লাগলো।খুব যত্ন সহকারে চৈতালির পায়ে বরফ দিয়ে দিচ্ছে ফাইয়াজ।চৈতালি কেমন উসখুস করছে।একটা ছেলে এসে,একটা স্প্রে দিয়ে গেল।স্প্রেটা চৈতালির পায়ে দিতে-ই চৈতালি শান্ত অনুভব করল।কিছুক্ষণের মধ্যেই চৈতালির পায়ের ব্যথা অর্ধেক কমে গেল।চৈতালি ফাইয়াজ’কে ধন্যবাদ জানালো।
–স্যার আমাদের এবার অফিসে ফিরে যাওয়া উচিৎ।
–আগে সবগুলো আইসক্রিম শেষ করবে।তারপরে এখান থেকে যাবে।তা-না হলে,এখানে থেকে এক-পা ও’ নড়তে দিব না।
–আপনি আমাকে নড়তে না দেওয়ার কে?কোন অধিকারে আপনি আমাকে আটকাবেন।আমার ওপরে নিজের অধিকার ফলাতে আসবেন না।কিছু বলছি না।তাই মানে এই না যে,আমি বলতে জানি না।আমার থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলবেন।বলেই ধীর পায়ে হাঁটা শুরু করল চৈতালি।ফাইয়াজ মলিন হেসে উঠে চলে গেল।
সন্ধ্যা বেলায় তানহা সকলের জন্য নাশতা তৈরি করছে।চৈতালি বাসায় চলে এসেছে,অনেকক্ষণ।ইফাদ তো’ চৈতালির সাথে-ই আসে।আজকে আসতে এত দেরি হচ্ছে কেনো?তানহা’র খুব চিন্তা হচ্ছে,এর মধ্যেই কলিং বেল বেজে উঠলো।তানহা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল।ইফাদ’কে দেখে যেনো নিজের প্রাণ ফিরে পেল।
–এতক্ষণ কোথায় ছিলে?আজকে আসতে এত দেরি হলো কেনো?ইফাদ তানহার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে,সোজা নিজের রুমে চলে গেল।তানহা রেগে ইফাদের দিকে তাকালো।তারপরে রান্না ঘরে গিয়ে,চৈতালি আর রোকেয়া বেগম’কে নাশতা দিয়ে আসলো।ইফাদের জন্য নাশতা নিয়ে নিজের রুমে আসলো।মহারাজ পায়ের ওপরে পা তুলে,ফোনে স্ক্রল করছে।তানহা কোনো কথা না বলে ইফাদে’র পাশে নাশতা রেখে চলে আসতে নিলেই ইফাদ একহাতে তানহা’র হাত ধরে ফেলল।
–তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।তানহা ভ্রু কুঁচকে ইফাদের দিকে তাকালো।তানহা কথা বলছে না দেখে,ইফাদ উঠে দাঁড়ালো।তানহা’কে হাত ধরে রুমের বাহিরে নিয়ে আসলো।দরজার এক কোণে সাদা রংয়ের একটি বিড়ালের বাচ্চা দেখে,খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠলো তানহা।দৌড়ে বিড়ালের বাচ্চার কাছে গেল।
–এটা তুমি আমার জন্য নিয়ে এসেছো।বিড়লটা কতটা কিউট।তুমি কোথায় পেলে,আমার কি যে,খুশি লাগছে।তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না।বলতে বলতে বিড়ালের বাচ্চাটা’কে কোলে তুলে নিল তানহা।একদম শান্ত বিড়ালের বাচ্চাটি।তানহা এক হাতে বিড়ালের নিয়ে,আরেক হাতে ইফাদ’কে জড়িয়ে ধরলো।
–তুমি খুশি হয়েছো?এই বিড়ালের বাচ্চা নিয়ে আসার জন্য আজকে দেরি হয়ে গেছে।
–তুমি আগে ফোন করে বলবে না।তোমার জন্য আমার অনেক চিন্তা হচ্ছিল।সারাদিন কিছু খাওয়া হয় নাই।চলো আগে কিছু খেয়ে নিবে।তানহা ইফাদ’কে খেতে দিয়ে,ইফাদে’র পাশে বসে আছে।বিড়ালের বাচ্চার সাথে খেলা করছে।
–যেভাবে বিড়ালের বাচ্চাকে আদর করছো।এভাবে আমাকে আদর করতে পারো না।
–তোমার শরম করবে না।
–না।
–কেনো?
–বউয়ের কাছে কিসের শরম।
–আগে তো’ কথায় কথায় শরম করছে।এখন শরম সব কোথায় গিয়েছে।
–আমার বউজান সব শরম নিয়ে নিয়েছে।তানহা কিছু বলতে যাবে।তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো।চৈতালি বাহিরে আসছিল।তানহা’কে উঠতে দেখে বলল।
–ভাবি তুমি বসো।আমি দেখছি কে এসেছে।চৈতালি দরজা খুলে ফাইয়াজ’কে দেখে চমকে উঠল।
–রাত করে আমাদের বাসায় কি চাই।দুপুরে আপনাকে এতগুলো কথা বললাম।তারপরে-ও আমার পিছু পিছু আমার বাসা পর্যন্ত চলে এসেছেন।
–জ্বী না আপু,আপনার কোথা-ও ভুল হচ্ছে,আমি আপনার কাছে নয়।আপনার ভাইয়ের কাছে এসেছি।ফাইয়াজে’র মুখে আপু ডাক শুনে,চৈতালি গোল গোল চোখ করে ফাইয়াজের দিকে তাকালো।চৈতালি একটু সরে দাঁড়ালো।ফাইয়াজ আস্তে করে বাসার মধ্যে প্রবেশ করল।তানহা আর ইফাদ ড্রয়িং রুমেই ছিল।ফাইয়াজ বলল।
–ভাইয়া আসবো।ফাইয়াজ’কে দেখেই ইফাদের চোখ-মুখ শক্ত হয়ে এলো।কঠিন কণ্ঠে বলল।
–তুমি কেনো আমাদের বাসায় এসেছো?তোমার বাবা জানে,তুমি আমাদের বাসায় এসেছো?আমার ভাইটা’কে শেষ করে তোমাদের শান্তি হয় নাই।আবার কাকে শেষ করার জন্য এসেছো?
–তুমি আগে আমার সব কথা শুনো?তারপরে না হয় যা বলার বলবে।ইফাদ রেগে রুমে চলে যেতে লাগলো।তখনই ফাইয়াজ বলে উঠল।
–পুতুল আপু-ও মারা গেছে ভাইয়া।ইয়াদ ভাইয়া আত্নহত্যা করেছে শুনে,পরের দিন ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্নহত্যা করেছে।ইফাদ সামনের দিকে এগোতে গিয়ে-ও থেমে গেল।ঘুরে ফাইয়াজের দিকে তাকালো।ফাইয়াজ অভিযোগের কণ্ঠে বলল।
–তোমার ভাইয়া কেনো পুতুল আপুর সাথে পালিয়ে গেল না।পুতুল আপুর কোন দিকে কমতি ছিল।দু’জনেই শেষ হয়ে গিয়েছে।তবে কিসের ভয়ে দু’জন আলাদা ছিল।বাবার ভয়ে।বাবা কি বা করতে পারতো।দু’জনকে মেরে ফেলতে পারতো।তাতে কি হয়েছে।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত দু’জন একসাথে থাকতে পারতো।দোষ শুধু আমার বোনের একার হবে কেনো?তোমার ভাইয়ের কোনো দোষ ছিল না বলছো?তোমার ভাই পুতুল আপুর চিঠিটা হাতে পেয়ে-ও,কেনো আপু’কে নিয়ে পালিয়ে গেল না।উত্তর দাও ইফাদ ভাইয়া।
–সবাই তোমার বোনের মতো বেইমান না।আমার ভাইয়া’কে বললে,ভাইয়া ঠিক পুতুল আপু’কে বিয়ে করতো।কিন্তু তোমার বোন আমার ভাইয়া’কে ঠকিয়ে নিজের বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করেছে।
ফাইয়াজ চিৎকার দিয়ে উঠল।
–পুতুল আপু বিয়ে করে নাই।তোমার ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করেছিল।কিন্তু তোমার ভাইয়া আপুর সাথে বেইমানি করেছে।নিজে-ও চলে গিয়েছে।আমার বোনটাকে-ও নিয়ে গিয়েছে।তোমার ভাই চাইলেই পারতো আমার বোনকে সুন্দর একটা জীবন উপহার দিতে।তোমার ভাই বেইমান।আমার থেকে আমার আপুকে কেঁড়ে নিয়ে চলে গেছে।
–ফাইয়াজ।
চিৎকার চেচামেচি শুনে,রোকেয়া বেগম রুম থেকে বেড়িয়ে আসলেন।তানহা আর চৈতালি নিরব দর্শকের মতো ভূমিকা পালন করছে।রোকেয়া বেগম একবার ছেলের দিকে তাকাচ্ছেন।আরেকবার ফাইয়াজের দিকে তাকাচ্ছেন।দু’জনের চোখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে।হাজারো প্রশ্ন মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।ইফাদ শান্ত হয়ে বলল।
–তুমি কিসের চিঠির কথা বলছো।
–পুতুল আপু তোমাকে যে,চুড়ির ডালাটা দিয়েছিল।সেখানে কিছু চুড়ি কাগজ দিয়ে মোড়ানো ছিল।সেগুলো নিশ্চয়ই ইয়াদ ভাইয়া দেখছে।তবু-ও কেনো আপুকে বিয়ে করল না।ফাইয়াজের কথা শুনে ইফাদ স্তব্ধ হয়ে গেল।ইফাদ ফাইয়াজের হাত ধরে বলল।এসো আমার সাথে,বলেই বাসার মধ্যে ছোট একটা রুমে নিয়ে গেল।দেখেই বোঝা যাচ্ছে,অনেক দিন এই রুমে কেউ প্রবেশ করে না।ইফাদ রুমে প্রবেশ করে,রুম থেকে ছোট একটা বাক্স বের করে নিয়ে আসলো।ফাইয়াজ ইফাদের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।ইফাদের হাত থরথর করে কাঁপছে।ইফাদ কোনো রকম কথা ছাড়াই বাক্সটি নিচে রাখলো।আস্তে করে বাক্সটি খুলল।ফাইয়াজ স্থির দৃষ্টিতে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে।চুড়ির ডালাটা দেখে ফাইয়াজের কথা আটকে গেল।তার পুতুল আপু যেভাবে দিয়েছিল।ঠিক সেভাবই আছে।হয়তো কেউ ছুঁইয়ে দেখে নাই।দু’টো শার্ট আছে,একটা কালো রংয়ের ঘড়ি আছে।একজোড়া নুপুর আছে।
–এই সবগুলো পুতুল আপু ইয়াদ ভাইয়া’কে দিয়েছিল না।ইফাদ ছোট্ট করে বলল হুম’।
–যে,মানুষটা আপুর দেওয়া জিনিস গুলো এতটা যত্ন করে রেখেছে।না জানি আপুকে কতটা যত্নে রাখতো?ইয়াদ ভাইয়া কেনো এমন করল?
–নুপুর জোড়া তোমার বোনের জন্য কিনেছিল।নিজে টিউশনি করিয়ে,টাকা জমিয়ে কিনেছিল।তোমার বোনকে যেদিন দিবে।সেদিন তোমার বোন,তোমার বাবার সামনে ভাইয়া’কে থাপ্পড় মারে এবং বলেছে ভাইয়া যেনো তাকে বিরক্ত না করে,সে তার বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করবে।কথা গুলো শুনে ফাইয়াজের শরীরে কাটা দিয়ে উঠল।ফাইয়াজ দ্রুত নিচে বসে পড়লো।চুড়ি ডালা উলোটপালোট করে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো।কাগজে মোড়ানো চুড়ি গুলো পেয়ে গেল।কাগজের লেখা গুলো পড়ে দু’জনের চোখেই পানি চলে আসলো।
চলবে…..
.