কাল ডেল কার্নেগীর একটা বই পড়ে শেষ করলাম যার নাম “How to win friends and influence people”.
অনেক দিন থেকেই বইটা পড়ার ইচ্ছে ছিল। Spotify-তে ফ্রি অডিওবুক থাকায় এক সপ্তাহেই শেষ করতে পেরেছি। কোন বই পড়লে আমি স্বাধারণত সেটার রিভিউ লেখি বা সারাংশ তুলে ধরি। বইটা পড়লে লাভ বৈ লস হবেনা আপনার। অনেক কিছুই জানবেন আর যা জানবেন সেটা মাস্টার করতে পারলে তো কথাই নেই!
যাইহোক, বইয়ের নাম দেখেই হয়তো বোঝা যাচ্ছে এটা একটা হিউম্যান রিলেশনশিপ আর লীডারশিপ ডেভলেপমেন্ট সংক্রান্ত বই । মানুষের সাথে কীভাবে চললে , কথা বললে তাদের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন করা যাবে আর প্রয়োজনে প্রভাবিত করা যাবে, সেসব নিয়েই আলোচনা।
বইটা শুনতে শুনতে লেখার মূলশিক্ষাগুলো পয়েন্ট আকারে লিখে রেখেছিলাম , সেটাই এখানে তুলে ধরছি নিজের ভাষায়।
——————————————————-
১) কাউকে ভুল কিছু করতে দেখলে জাজমেন্টাল না হয়ে জিজ্ঞাসা করুন সব ঠিক আছে কিনা। সমালোচনা এড়িয়ে বরং প্রশংসা করুন, পুরস্কৃত করুন। আপনি আরেকজনের কাছ থেকে যেমনটা আশা করেন, তাদের সাথে সেভাবেই ব্যবহার করুন।
২) কারো কাছে কিছু পেতে চাইলে আগে তাকে সেই ব্যপারে ইন্টারেস্টেড করে তুলুন। বেশিরভাগ মানুষই নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে পছন্দ করে এটা সেই সৃষ্টির শুরু থেকেই অব্যাহত আছে এবং সামনেও থাকবে। প্রত্যেকের মনের এই সুপ্ত ইচ্ছাটাকে জাগিয়ে তুলুন , তাদেরকে গুরুত্তপূর্ণ অনুভব করান, আপনার কাজ হয়ে যাবে।
৩) কেউ খারাপ কিছু করলে সেটা চেপে যান কিন্তু ভাল কিছু করলে সেটার দ্বিগুণ প্রশংসা করুন। প্রশংসার অভাব মানুষের আনুগত্য নষ্ট করে দেয় । তবে এই প্রশংসাটা মন থেকে আসতে হবে , তোষামোদি করা যাবেনা। মানুষ সহজেই দুটোর পার্থক্য বুঝতে পারে আর এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
“তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে” না বলে বরং কেন সুন্দর লাগছে সেটা বললে বেশি বিশ্বাসযোগ্য হবে।
৪) মানুষকে প্রভাবিত করার একটাই উপায়: আপনি কী চান সেটা না বলে বরং তার সামনে তুলে ধরুন সে কী পাবে , তার সুবিধা অসুবিধা কী। কেউ যখন নিজে থেকেই কোন ব্যাপারে আগ্রহী হবে তখন সে সবকিছুই করবে। অন্যদের মধ্যে সেই আগ্রহটা তৈরি করুন। যেকোনো কিছুকে আরেকজনের জায়গা থেকেও দেখার চেষ্টা করুন।
৫) মানুষের কাছে কান্নাকাটি করে সহানুভূতি পাবার চাইতে তাদের ব্যাপারে সত্যি সত্যি আগ্রহী হলে আপনি অনেক সহজে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবেন। আপনি কারো ব্যপারে আগ্রহী হলেই কেবল তাদেরকে আপনার ব্যপারে আগ্রহী করতে পারবেন।
৬) প্রথম দেখায় কারো মধ্যে আপনার ব্যপারে ভালো ধারনা তৈরি করতে চাইলে হাসি দিয়ে চোখে চোখ রেখে কথা বলুন। মানুষ নিজেদের ব্যাপারে বেশি বলতে পছন্দ করে তাই একজন ভাল শ্রোতা হবার চেষ্টা করুন। অন্যদের সম্পর্কে আসলেই আগ্রহী হয়ে তাদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করুন দেখবেন তারাও আপনার ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছে।
৭) মানুষের নাম, সেইসাথে তাদের ছোটখাট ডিটেইলস মনে রাখার চেষ্টা করুন আর কথা বলার সময় সেটা উল্লেখ করুন। আপনি কারো নাম বা তার ব্যাপারে ছোট একটা কিছু মনে রেখেছেন, এই জিনিসটা মানুষ খুবই পছন্দ করে। কারো জন্মদিনে তাকে একটা শুভেচ্ছা জানিয়ে দেখুন, সে শুভেচ্ছার চাইতে আপনি দিনটা মনে রেখেছেন তাতেই বেশি খুশি হবে।
৮) সবসময় তর্ক এড়িয়ে চলুন, এমনকি অন্যজন যদি ভুল হয় তাও। নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে গিয়ে আপনি বন্ধু হারাবেন কারণ কেউই নিজেকে ভুল হতে দেখতে পছন্দ করেনা। কেউ ভুল করলে সেটা সরাসরি তর্কে না গিয়ে ভিন্নভাবে আগান যাতে সে নিজেই ভুলটা বুঝতে পারে। বেশিরভাগ মানুষই যা বিশ্বাস করে সেটা, তর্কে হারুক বা জিতুক খুব একটা পরিবর্তন হয়না তাই আপনি তর্কে হারলেও হারবেন, জিতলেও হারবেন।
ফুটবলে ব্রাজিল না আর্জেন্টিনা সেরা, সেটা যত তথ্য উপাত্ত দিয়েই বুঝান না কেন , লাভ তো হবেই না বরং তর্ক করে বন্ধুত্ব নষ্ট হবে।
৯) আপনি কোন ভুল করে থাকলে সেটা খুব দ্রুত এবং নির্দ্বিধায় স্বীকার করুন। এতে করে অন্যেরা আপনার ব্যাপারে নরম থাকবে, বিশ্বাস তৈরি হবে।
১০) কারো কাছে কিছু পেতে চাইলে চিল্লাফাল্লা না করে বরং বন্ধুসুলভ পথে আগান, আপনার কাজটা হবার চান্স অনেক বেড়ে যাবে। বাসা ভাড়া নিতে গিয়ে, ” আপনার বাড়ীর এই-সেই ভালনা, তাই ভাড়াটা কম দিব” না বলে বরং সেই বাড়ীর পেছনে বাড়ীওয়ালার যেই টাকা, শ্রম আর স্বপ্ন ব্যয় হয়েছে সেটার প্রশংসা করলে ভাড়া কমার চান্স আছে।
১১) কথা বলার সময় অন্যের কথা বেশি শুনুন, নিজে কম বলুন। নিজের অর্জনের ব্যাপারে গর্জন না করে অন্যদের অর্জন শুনুন। আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলে তবেই নিজের সম্পর্কে বলুন।
১২) মানুষ ভাবতে পছন্দ করে সে নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। কেউ তার কাছে কিছু গছিয়ে দিচ্ছে এটার চাইতে সে নিজেই আগ্রহী হয়ে সেটা নিচ্ছে এরকম বুঝতে পছন্দ করে। তাই অন্যদের নেতৃত্ব দেবার সময় চেষ্টা করুন তাদেরকে বোঝাতে যে এটা তাদেরই চাওয়া।
১৩) কারো কোন আচরণ ভাল না লাগলে বা সেখানে পরিবর্তন আনতে চাইলে সমালোচনা না করে প্রশংসা দিয়ে শুরু করুন। প্রশংসার পরে “কিন্তু” না বলে “এবং” দিয়ে বাকি যেই পরিবর্তনটা চান সেটা তুলে ধরুন। যেই মুহুর্তে আপনি “কিন্তু” বলবেন, তারা ধরে নেবে আপনার প্রশংসাটা মন থেকে ছিলনা বরং সমালোচনা করার আগে একটু সুগারকোট করেছেন।
১৪) কেউ ভুল কিছু করলে অন্যদের সামনে সেটা না ধরিয়ে একা বলুন আর পারলে সরাসরি না বলে একটু ঘুরিয়ে বলুন যাতে কেউ মনে না করে এটা তাকেই বলা হচ্ছে। আমাদের ভুল ধরা হলে আমরা সেটা ঠিক করার চাইতে বরং আত্মপক্ষ সমর্থনে চলে যাই। অন্যের ভুল ধরার আগে নিজের ভুল নিয়েও আলোচনা করুন।
১৫) মানুষজন স্বাভাবিকভাবেই আদেশ নিতে পছন্দ করেনা তাই কাউকে কিছু বলতে চাইলে উপদেশ বা জিজ্ঞাসার ভঙ্গিতে বলুন।
“এক কাপ চা দাও” না বলে ” তুমি কি এক কাপ চা করে দিতে পারবে” বললেও আপনার চা পেয়ে যাবেন।
১৬) কেউ যদি ন্যুনতম উন্নতিও করে তবে সেটার প্রশংসা করুন। কাউকে পরিবর্তন করতে সমালোচনার চেয়ে প্রশংসা অনেক বেশি কার্যকরী। ভুল করলে বোঝান যে এটা সহজেই ঠিক করে নেয়া যাবে।
” তোকে দিয়ে এটা হচ্ছেনা” বলার চেয়ে ” তুই আগের চেয়ে অনেক ভাল করছিস ” বললে একসময় সে হয়তো কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছে যাবে।
—————————————————–
এই ছিল সারাংশ। সময় পেলে বইটা পড়তে বা শুনতে ভুলবেন না। Spotify এর অডিওবুকের লিংক গুগল করলেই পেয়ে যাবেন।