গল্প: #দেবদাস
ফোনের স্ক্রিনে দেবুর স্ত্রীর নম্বর দেখে আমি বেশ দ্বিধায় পড়ে গেলাম – কলটা কি ধরবো? ধরা কি ঠিক হবে? দেবু নিশ্চয়ই আবার কোন কেলেঙ্কারি ঘটিয়েছে। ভদ্রমহিলার ফোন এলে আমি খুব আতঙ্কে থাকি। না ধরাই ভাল, দেবুর কাছ থেকে আগে জেনে নিতে হবে কি বৃত্তান্ত।
দেবুর স্ত্রী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, তার আচার-আচরণ, কথা-বার্তার টোন পুরোটাই এজলাসে বসা জাস্টিসদের মত মতো। তার কথাবার্তা শুনে মনে হবে তিনি এজলাসে বসে জেরা করছেন!
দশ মিনিট পর আবার ফোন এলো। এবার সাহস করে ধরেই ফেললাম। ফোনের ওপ্রান্ত থেকে কান্নার শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। কান্না থামার পর দেবুর কথা যা শুনলাম এর জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
ছেলেবেলা থেকেই দেবু বেশ ব্রিলিয়ান্ট। পড়াশুনা, স্পোর্টস এবং প্রেম তিন বিষয়েই দেবু বেশ সিদ্ধহস্ত ছিল। সাধারণত যারা ভাল ছাত্র তারা স্পোর্টস এবং প্রেমে ভাল করতে পারেনা। আবার যারা স্পোর্টসে ভাল তারা প্রেমে সাফল্য দেখালেও পড়াশুনায় ভাল হয় না। কিন্তু দেবু আমাদের আলরাউন্ডার, অল ইন ওয়ান। ভাল ছাত্র, ভাল উইকেটকিপার এবং ভাল প্রেমিক।
ভাল প্রেমিক মানে এক সাথে পাঁচ-সাত জনের সাথে প্রেম করতো। দেবুর প্রেমপত্র লিখতে গিয়েই আমার পড়াশুনা গোল্লায় গেল। লাভের মধ্যে লাভ একটাই হয়েছিল প্রেমপত্র লিখতে গিয়ে আমার সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ জন্মাল।
সবিতা, রেণু, আশালতার পর দেবুর যখন দেবযানীর সংগে প্রেম হল তখন আমার চিঠি লেখার ব্যাপারে খুব আত্ম বিশ্বাস জন্মাল। প্রথম চিঠিতেই দেবযানী ঘায়েল। আমাদের গোটা মহল্লায় দেবযানী ছিল লাস্যময়ী মেয়ে। রেখাজীর কার্বনকপি। ওরকমই টানা চোখ, শার্প নোজ। আর ওর মতো দীঘল চুল খুব কম মেয়ের ছিল। দেবযানীর ঠোঁটগুলো ছিল কমলালেবুর কোয়ার মতো রসে টইটুম্বুর।
দেবযানীর তুলানায় দেবু ছিল ন্যাটা, মিনিমাম ছ’ইঞ্চি খাটো। সেই ন্যাটা দেবুর চিঠি পড়ে দেবযানী যেদিন ওর দিকে গাঢ় চোখে তাকালো, তখন আমি বনে গেলাম অব্যর্থ তীরন্দাজ। দেবু আমাকে সোনাই ঘোষের মিষ্টান্ন ভাণ্ডার থেকে এক কেজি ওজনের একটা চমচম ট্রিট দিল। এত বড় আর সুস্বাদু চমচম সারা শহরে আর কোথাও নেই।
এরপর থেকে দেবুর হয়ে আমি যার দিকেই প্রেমের তীর ছুঁড়েছি সেই ফেঁসে গেছে। ক্লাস এইট থেকে মেট্রিক পর্যন্ত দেবু প্রায় গোটা তিরিশেক প্রেম করেছে। আমার চিঠি আর দেবুর নোট – এ দুটো ছিল দেবুর অস্র। ভাল ছাত্র হিসেবে দেবু ছিল উদাহরণ। বাবার উঁচুপদে সরকারী চাকরির সুবাদে সবার কাছে রেস্পেক্টও পেতো। পাড়ার সব ঘরে ঘরে ছিল দেবুর জামাইআদর।
নিমাই ভট্টাচার্য, বনফুল, বুদ্ধদেব গুহ তখন ভরসা। লাইব্রেরী থেকে তাঁদের বই ইস্যু করার সময় লাইব্রেবিয়ান সরু চোখে তাকায়। বাধ্য হয়ে রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের চিঠিপত্রের শরণাপন্ন হলাম। রবীন্দ্রনাথের চিঠির রসাচ্ছাদন সে বয়সে বেশ দূরহই ছিল। প্রেমপত্র লেখার ব্যাপারে নজরুল আইডল। দেবুর ভাঙ্গা প্রেম জোড়া দিতে নজরুলের একটা চিঠি খুব কাজে লাগতো। চিঠিটা নজরুল লেখেন তার প্রাক্তন প্রেমিকা নার্গিসকে ১ জুলাই ১৯৩৭ সালে
কল্যাণীয়াসু!
তোমার পত্র পেয়েছি সেদিন নববর্ষার নবঘন-সিক্ত প্রভাতে। মেঘ-মেদুর গগনে সেদিন অশান্ত ধারায় বারি ঝরছিল। পনের বছর আগে এমনি এক আষাঢ়ে এমনি বারিধারার প্লাবন নেমেছিল, তা তুমিও হয়তো স্মরণ করতে পারো। আষাঢ়ের নব মেঘপুঞ্জকে আমার নমস্কার। … যাক, তোমার অনুযোগের অভিযোগের উত্তর দিই।… তোমার ওপর আমি কোনো ‘জিঘাংসা’ পোষণ করি না- এ আমি সকল অন্তর দিয়ে বলছি। আমার অন্তর্যামী জানেন, তোমার জন্য আমার হৃদয়ে কী গভীর ক্ষত, কী অসীম বেদনা! কিন্তু সে বেদনার আগুনে আমিই পুড়েছি-তা দিয়ে তোমায় কোনো দিন দগ্ধ করতে চাইনি। তুমি এই আগুনের পরশমানিক না দিলে আমি ‘অগ্নিবীণা’ বাজাতে পারতাম না। আমি ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হতে পারতাম না। তোমার যে কল্যাণস্বরূপ আমি আমার কিশোর বয়সে প্রথম দেখেছিলাম, যে রূপকে আমার জীবনের সর্বপ্রথম ভালোবাসার অঞ্জলি দিয়েছিলাম, সের রূপ আজও স্বর্গের পারিজাত- মন্দারের মতো চির অম্লান হয়েই আছে আমার বক্ষে। অন্তরের আগুন বাইরের সে ফুলহারকে স্পর্শ করতে পারেনি। তুমি ভুলে যেও না, আমি কবি, আমি আঘাত করলেও ফুল দিয়ে আঘাত করি। …আমার অন্তর্যামী জানেন (তুমি কী জানো বা শুনেছ, জানি না) তোমার বিরুদ্ধে আজ আমার কোনো অনুযোগ নেই, অভিযোগ নেই, দাবিও নেই…
দুএকটা শব্দ পাল্টে দিলে এ চিঠিটি হয়ে উঠত দেবুর ভাঙ্গা প্রেম জোড়া লাগাবার বীজমন্ত্র। অবশ্য এ সব মন্ত্রের আয়ু বেশীদিন দীর্ঘস্থায়ী হতো না। এতো কিছুর পরেও নানা কেলেঙ্কারির বোঝা মাথায় নিয়ে দেবু পাঁচটা লেটার সহ প্রথম শ্রেণীতে মেট্রিক পাশ করে সবাইকে চমকে দিল।
পর্ব-২
এত কিছুর পরেও নানা কেলেঙ্কারির বোঝা মাথায় নিয়ে দেবু পাঁচটা স্টারসহ প্রথম শ্রেণিতে মেট্রিক পাশ করে সবাইকে চমকে দিল। আমি ৫৬০ নাম্বার পেয়ে কোন রকমে মান-সম্মান বাঁচাতে পারলাম। কলেজে গিয়ে দেবুর প্রেমের দৌড়াত্ব আরও বেড়ে গেল। নতুন শিং গজানো ছাগলের মত সে প্রায় সব মেয়েদের দ্বারে ঘা দিয়ে বেড়ায়।
বাবা নেই, তাই ফার্স্ট ক্লাস না পাওয়ায় মা খুব কষ্ট পেয়েছে। দেবুর মোহ থেকে আমাকে ছাড়িয়ে আনার জন্য মা নানা রকম দিব্যি দিয়েছিল। কোন দিব্যিই কাজে আসেনি। উল্টো, দেবুর জন্যে কখন কাকে কি চিঠি লেখা হচ্ছে সেসব ভাষা, সম্পর্কের হিসাবপত্র রাখতে রাখতে আমি খেই হারিয়ে ফেলতে লাগলাম। দেবু নির্বিকার, প্রেম করা ছিল দেবুর কাছে ক্রিকেটে উইকেট পাওয়ার মত এক ধরণের উত্তেজনাময় খেলা। হঠাৎ একটি মেয়ে দেবুর এবং আমার জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিল। তার নাম রুবি।
‘রুবি’ বেশ ডাকাবুকো ধরনের মেয়ে, সে আমাদের কলেজেই ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হলো। আমরা তখন সেকেন্ড ইয়ার। রুবির বাবা সরকারি কোন মন্ত্রলায়ের আমলা। রুবিরা উঠলো আমাদের মহল্লায় একটা বড় ফ্ল্যাট বাড়িতে। সেখানে থাকতো পি ডব্লিউ ডি আর ডকইয়ার্ডের মস্ত বড় সব আফিসাররা আর তাদের ফ্যামিলি।
রুবির কথা আর কী বলবো – যেমন তার রূপ তেমন তার গুন, পড়াশুনায়ও ভাল। প্রতি সন্ধ্যায় রুবি কাছের এস ডি ও সাহেবের বাংলোতে ব্যাডমিন্টন খেলতে যায়, এস ডি ও সাহেবের মেয়েও পড়ে রুবির সঙ্গে। সে আমলে টি শার্ট আর টাইলস পড়ে হেঁটে যাওয়া রুবি ছিল অনেকটা হলিউডি কাণ্ড। মনে হত আমাদের বুকের ওপর দিয়ে কেডস পায়ে যেন নীল চোখের ব্রুক শিল্ড হেঁটে যাচ্ছে।
কিশোর মল্লিক কলেজের ফাংশনে – ‘মনে পড়ে রুবি রায়’ গান গেয়ে রুবির খুব কাছাকাছি চলে গেল। আর ডি বর্মণ আর কিশোর মল্লিকের কল্যাণে রুবি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল। ইনফ্যক্ট, তখন রুবিকে দেখলে যার গানের গলা নেই সেও গাইতে চেষ্টা করতো ‘মনে পড়ে রুবি রায়’। অন্যের কথা আর কী বলব আমি নিজেই কয়েকদিন ছোট বোনের হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে বাসার সবার কান ঝালাপালা করে দিয়েছি।
দেবুর ধারণা ছিল রুবি তাকে দেখা মাত্রই প্রেমে পড়ে যাবে, তার ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট আর স্পোর্টস ম্যানের তকমা তাকে হেল্প করবে। কিন্তু যেদিন দেবু প্রেম নিবেদন করতে মেয়েদের কমন রুমে গিয়ে অপমানিত হল সেদিন সে একটা ভাল হোঁচট খেল। আমি মনে মনে খুব খুশি হলাম, এবার বুঝি দেবু ক্ষান্ত হবে। কিন্তু ফল হল উল্টো, বাঁধা পয়ে ওর উৎসাহ আরও বেড়ে গেল।
আমাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বলল – দোস্ত সিরিয়াস একটা চিঠি লিখে দে, তীর ছোড়া মাত্রই যেন কাজ হয়। বিষ মাখানো তীর চাই, প্রেমের বিষ। বিষে বিষে শরীর যেন নীল হয়ে যায়।
আমি বললাম রুবিকে চিঠি লেখা আমার পক্ষে সম্ভব না… এই প্রথম আমি দেবুকে রিফিউজ করলাম।
কেন?
দেখ, রুবি একেবারে আমাদের কাছাকাছি থাকে, তার ওপর এস ডি ও সাহেবের মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব। ধরা পড়লে মান সম্মান তো যাবেই পিঠের ছাল-বাকরা থাকবে না। আমার মা আমাকে মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলবে।
কী বোকার মতো কথা বলিস! চিঠি তো আর তুই লিখছিস না, লিখছি আমি। আর তাছাড়া আমাদের কোন চিঠিতে তো আর আসল নাম দেয়া থাকে না। এটাতে তুই লেখে দে ইতি -তোমার কিশোর কুমার।
কিশোর কুমার?
হ্যাঁ, কিশোর কুমার… শেষ লাইনটা হবে আমার পূজার ফুল ভালবাসা হয়ে গেছে / তুমি যেন ভুল বুঝনা। মালা গেঁথে রেখেছি পড়াব তোমায় / তুমি যেন ছিঁড়ে ফেলনা।
কিশোর কুমার লিখলে রুবি বুঝবে এটি কিশোর মল্লিকের লেখা চিঠি।
তাহলে লিখে দে – ইতি তোমার বাপ্পি লাহিড়ী।
বাপ্পি লাহিড়ী?
আরে দে না। বাপ্পি’দা একটু ন্যাটা মত আছে, আমার সাথে মিলে যাবে।
আমার মনে কু’ডাক দিচ্ছে দেবু, একটা ঝামেলা হবে। রুবিকে তুই ছেড়ে দে।
আরে এখনো তো হাত-টাত ধরিনি, ছাড়ার প্রশ্ন আসছে কেন? দেবুকে তুই এখনো চিনিতে পারিস নি। দেবু যা চায় তা আদায় করে নেয়। এমন একটা চিঠি লিখে দে যাতে রুবি কেন, রুবির পুরো ফ্যামিলি দেবুর প্রেমে পড়ে যায়। রুবির ছোট বোনটা এবার মেট্রিক দেবে, দেখতেও কিন্তু বেশ সুন্দর, তোর সঙ্গে মানাবে। সাহস করে আদা জল খেয়ে লেগে পড়, কাজ হবে। কতদিন আর এরকম প্রেম বর্জিত হয়ে থাকবি। এবার গা ঝাড়া দে।
আমার গা ঝাড়া দেবার দরকার নেই। তবে তোর জন্যে এটাই আমার শেষ চিঠি।
আমার এ কথা যে উপরওয়ালা এত সহজে কবুল করে নেবেন এটা ভাবিনি। কিন্তু এই সহজ কাজটি তিনি করলেন ভিন্ন ভাবে একেবারে তাঁর মত করে। আমি কিছুতেই সাহস করে দেবুকে বলতে পারলাম না রুবিকে আমারও খুব ভাল লাগে।
একদিন সন্ধ্যায় টিউশনি শেষ করে বাসায় আসতেই রুবির ছোটভাই এসে খবর দিল ওর বাবা আমাকে ডাকছেন। আমি মনে মনে খুশিই হলাম – সজ্জন ভদ্রলোক, শুধু বড় চাকুরীই করেন না একটু-আধটু শিল্প-সাহিত্যের চর্চাও করেন। মাঝে মধ্যে দরাজ গলার রবীন্দ্র সংগীতের আওয়াজ ভেসে আসে ওদের বাসা থেকে। রাস্তায় ভদ্রলোকের সংগে দেখা হলে নমস্কার জানিয়ে সসম্ভ্রমে পথে ছেড়ে দিই।
একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানের জন্য আমরা কিছু ডোনেশন চেয়েছিলাম রুবির বাবার কাছে, ভদ্রলোক বলেছিলেন দেখবেন। এর আগে বিজয় দিবসের সময় নিজ থেকেই আমাদের ৫০০ টাকা দিয়েছিলেন। এবার আমরা একুশের অনুষ্ঠানে তাকে বিশেষ অতিথি করার কথা ভাবছি। কথাটা আজকেই তুলতে হবে।
রুবিদের বাসায় ঢুকে আমার পুরু অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল ভয়ে। হলরুম জুড়ে পুরো এক বিচার সভা। আসামী – দেবু আর আমি।
আমাকে দেখেই দেবু চোখ ফিরিয়ে নিল, যেন আমাকে সে চেনে না।
হয়েছিল কী, ইতোমধ্যে একদিন ব্যাডমিন্টন খেলে বাড়ি ফেরার পথে দেবু রুবির হাতে সেই চিঠিটা গুঁজে দিয়েছিল। এরপর দু’দিন সব ঠিকঠাকই চলেছে। রুবি, দেবু আমরা সবাই কলেজে গেছি ক্লাস করেছি। কারো ব্যবহারে কোন উত্তেজনা নেই। আমিও ব্যস্ত থেকেছি টিউশনি নিয়ে। আজ সন্ধ্যায় দেবু আর দেবুর বাবাকে চায়ের দাওয়াত করেছেন রুবির বাবা।
ব্যাপারটা যে অভিভাবক পর্যন্ত গড়াতে পারে এটা আমি কিছুটা আমলে নিলেও দেবু একেবারেই পাত্তা দেয়নি। আমি দাঁড়িয়ে আছি কিন্তু মনে হচ্ছে আমার পায়ের তলায় মাটি নেই। মুখ তুলে কারো দিকে তাকাতে পারছি না। আমি জানি কি হতে যাচ্ছে।
রুবির বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি তোমার হাতের লেখা খোকা?…
পর্ব ৩
রুবির বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কি তোমার হাতের লেখা খোকা?…
হাঁ।
তুমিই কি দেবুকে বলেছিলে এই চিঠিটা রুবির কাছে পৌঁছে দিতে?
না।
দেবু কিন্তু বলছে সে শুধু তোমার অনুরোধ রক্ষা করতেই এই কাজটি করেছে।
দেবুর বাবা শূণ্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। রুবি, রুবির মা নিশ্চয়ই পর্দার আড়াল থেকে এ দৃশ্য দেখছে। লজ্জায়, অভিমানে আমার চোখ বেয়ে টপ টপ করে জল পড়ছে। ইচ্ছে করছে দৌড়ে পালাই এখান থেকে, কিন্তু মনে হচ্ছে আমার পা লোহার শিকল দিয়ে কেউ বেঁধে রেখেছে।
রুবির বাবা একটু থেমে বললেন – যাই হোক, আমি এই চিঠি নিয়ে আর কোন কিছু বলতে চাই না। রুবি, দেবু, তুমি…তোমরা এখন টিনএজার, এ সময় মনের মধ্য নানা রকমের অ্যাডভেঞ্চারের ভূত চাপে। সব ভূতকে প্রশ্রয় দিতে নেই। অবসর সময়গুলো তোমরা ক্রিয়েটিভ কাজকর্ম করে কাটাবে। সংগীত, খেলাধুলা, কিংবা কলেজে নানারকম সাইন্টিফিক গবেষণা করবে। ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত-কাঠামো গড়বার জন্যে এই সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আশা করি তোমরা সেটি বুঝবে। তোমরা এখনো টিনএজের গণ্ডি পেরুওনি। এম্বিশাস হবে, কলেজ শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে যাবে, বিদেশে যাবে, পিএইচডি করবে, প্রফেসর হবে, ডাক্তার হবে, ইঞ্জিনিয়ার হবে। সব চেয়ে বড় কথা ভাল মানুষ হবে। কত কিছু করার আছে এ জীবনে, কত কাজ পড়ে আছে তোমাদের জন্যে, দেশের জন্যে! সে সব দিকে ফোকাস কর। প্রেম করার অনেক সময় পাবে। কিন্তু জীবন গড়ার জন্যে বেশি সময় তোমাদের হাতে নেই।
চোখ বন্ধ করলে রুবির বাবার কথাগুলো এখনো যেন শুনতে পাই। এ ঘটনাটি সত্যিই আমার জীবন পুরোপুরি বদলে দিয়েছিল। প্রায় মাস খানেক আমি আড়ষ্টতায় বাসা থেকে বেরুইনি। টিউশনি, কলেজ কামাই হয়েছে। দেবু ক্ষমা-টমা চেয়ে অনেকগুলো চিরকুট পাঠিয়েছে, মা’কে ধরেছে আমাকে বোঝানোর জন্য। কিন্তু আমি আমার স্থান থেকে এক পাও নড়িনি। মা অবশ্য চিঠির ব্যাপারটা জানতো না। মা হয়তো ভেবেছে কোন কারণে আমাদের মধ্য বুঝি ঝগড়া-ঝাঁটি হয়েছে।
একদিন বিকেলে অনেকক্ষণ ধরে কে যেন কলিং বেল বাজাচ্ছে। দরজা খুলে দেখি রুবি দাঁড়িয়ে আছে। আমি আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়, হাত জোড় করে ক্ষমা চাইবো কি না ভাবছি।
এ সময় রুবি বলল, অনেকদিন হল কলেজে যাচ্ছেন না। ভাবলাম, সেদিন বাবার বকা খেয়ে আপনার অসুখ করল কি না তাই দেখতে এলাম। আমি জানি আপনার কোন অপরাধ নেই!
অপরাধ নিশ্চয়ই হয়েছে!
মোটেই না! আমি জানি দেবুদা জোড় করে আপনাকে দিয়ে চিঠিটা লিখিয়েছে! আসলে ভুলটা আমারই ছিল, আমি অযথা ওটা বাবাকে দেখিয়ে হাঙ্গামা বাঁধিয়েছি।
আই এম সো সরি!
সরি বলার কিছু নেই, আপনি খুব ভালো চিঠি লিখেন! চিঠিটা যদি দেবু‘দার বদলে সরাসরি আপনার হাত থেকে পেতাম তাহলে খুব খুশি হতাম!
ঠিক বুঝলাম না!
সব কিছু বুঝার দরকার নেই আপনার! এখন শুনুন, যা হবার হয়ে গেছে। ওটা নিয়ে আর মন খারাপ করবেন না প্লিজ। নাউ লুক ফরওয়ার্ড। আপনি কলেজে যাচ্ছেন না দেখে ব্যাপারটা নিয়ে আমিও এক ধরণের অপরাধে ভুগছি।
সরি এগেইন!
আরে না না কোন সরি-টরি বলতে হবে না। কাল আমি আপনাকে কলেজে দেখতে চাই। যদি না দেখি তাহলে আমি মাসীমাকে এসে সব বলে দেবো। কাল যেন আসবেন।
কাল যেন আসবেন…এ কথাটা নিয়ে সারাক্ষণ একটা অদ্ভুত ভাললাগা হয়ে ছড়িয়ে গেল মনের প্রতি কোণে। কথাটা বলার সময় রুবির মুখে একটু হাসি, কিছু মিনতি, লজ্জার কিছু রক্তিম আভা যেন লেগে ছিল। যেতে যেতে দরজার কাছে গিয়ে কী মনে করে একটু ফিরে তাকালো! সেই ছবি মনে করে আমার হৃদয়ে রবিঠাকুরের গান রিওয়াইন্ড হয়ে বেজে চলল সারাদিন …
…তুমি সে কি হেসে গেলে আঁখিকোণে
আমি বসে বসে ভাবি নিয়ে কম্পিত হৃদয়খানি
তুমি আছ দূর ভুবনে..
কম্পিত হৃদয়ে, কম্পিত পায়ে পরদিন কলেজে গেলাম। কিছুদিনের মধ্যে রুবির সঙ্গে সহজ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আমি চাইলে রুবির সংগে গাঢ় প্রেমও হতে পারত, কিন্তু আমি চাইনি। দেবুর কাছে প্রেম ছিল এক ধরণের খেলা। কিন্তু রুবির বাবার সেই বক্তৃতার পর আমার কাছে প্রেম মানে এক ধরণের অলিখিত কমিটমেন্ট, দায়িত্ব। আমার ভঙ্গুর ভবিষ্যতর দিকে তাকিয়েই আমি তখন সে দায়িত্ব নিতে পারিনি।
ইন্টারমিডিয়েটের পর জীবন বদলে গেল। রুবির বাবার ছিল বদলির চাকরি, ওরা চলে গেল চিটাগাং। যাবার আগে এক সন্ধ্যায় আমাদের ছাদে এসে রুবি খুব কেঁদেছিল। ভীতু আমি ওর চোখের জলটুকুও মুছিয়ে দিতে পারিনি।
দেবু উচ্চশিক্ষার্থে চলে গেল ইংল্যান্ড, ওর এক মামা ওখানে সেটেল্ড। আমার সংগে দেখা করতে এসেছিল। কাটা কাটা কথা বলে বিদায় করেছি। বিদেশে গিয়েও অনেক চিঠি দিয়েছে। আমি কোনটারই উত্তর দিইনি। জানি না ছেলেবেলায় এরকম উদ্ভট রাগ কোথা থেকে এসেছিল।
বড় হয়ে কোথা গেল সে রাগ! সেই ক্ষোভ। কত কিছু ঝেড়ে ফেলতে হয়েছে স্বভাব থেকে, জীবন থেকে। আবার অনেক নতুন কিছু এডপ্ট করতেও হয়েছে। এখন অনুমান করে দশ পেগ হুইস্কি ঢাললেও কোন গ্লাসে একটুও কম বেশি হয় না। পুলিশ, সচিব, মন্ত্রী কত মানুষের সাথে কত রকম কম্প্রোমাইজ করি এখন! কত স্ববিরোধী জীবনাচরণ! জীবন জেনে গেছে – কেবল সরস্বতী দেবীর দোহাই দিয়ে জীবন চলে না। সব ব্যাপারে চৌকস না হলে জীবনে উন্নতি করা যায় না।
শেষ পর্যন্ত দেবুর সাথে ইংল্যান্ডে দেখা হল প্রায় ২২ বছর পর। এর মধ্যে অফিসের কাজে বহুবার ইংল্যান্ডে গেছি কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা করার কথা একবারও মনে হয়নি। অন্য বন্ধুদের থেকে খবর পেতাম – দেবু পড়াশুনা শেষ করে আর দেশে ফিরতে চায়নি। হিউম্যান রিসোর্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টে পিএইচডি করে ইংল্যান্ডেই নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। অনেক হোয়াইট রমণীর সাথে লিভ টুগেদারের পর্ব শেষ করে নানা ঘাটের পানি খেয়ে দীপালি নামে ভারতীয় এক বাঙালি রমণীকে বিয়ে করে লন্ডনে থিতু হয়ে বসেছে।
সেবার আমি উঠেছিলাম স্ট্যানফোর্ড এলাকায়, সম্ভবত হলিডে ইনে। কাজ শেষে সন্ধ্যায় হোটেলে ঢুকে দেখি লবিতে দেবু বসে আছে। দেবুকে দেবু বলে চেনার কোন উপায় নেই, মাথায় মস্ত টাক আর দশাসই ভুঁড়ির দেবুকে ক্রিকেটার দেবু বলে চিনতে কষ্ট হয়েছে। শীতের দেশে থাকলে মানুষের গায়ের রঙ কিছুটা পিত বর্ণ হয়, কিন্তু দেবু মনে হয় আগের চেয়ে একটু কৃশকায় হয়েছে। অনেক দিন পর দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরলাম। রাগ, মান অভিমান সব এক নিমিষে উবে গেল।
আমাদের মধ্যবয়সী দুই বন্ধুর মিলনপর্ব দেখে লবির লোকজন হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। রুমে গিয়ে ফ্রিজ খুলে দুটো চিল্ড বিয়ার খুললাম তারপর ফ্রেশ হয়ে বের হলাম ডিনারে।
দেবু গাড়ি এনেছিল, …চাবি ভেলেটে দিয়ে বললাম, বেইজমেন্টে পার্ক করতে।
ডিনার শেষে অনেকগুলো বার-পাব ঘুরে দুজনে পার মাতাল হয়ে মধ্যরাতে হোটেলে এসে ঘুম। টুইন বেড থাকায় ঘুমাতে কোন সমস্যা হয়নি।
সকাল ১০টায় দেবু ঘুম থেকে টেনে তুলে বলল, দোস্ত ব্রেকফাস্টটা ধরতে হবে, সাড়ে দশ টায় ক্লোজিং।
সমস্যা নেই, রুম সার্ভিসে অর্ডার দিয়ে আনিয়ে নেব।
ব্রেকফাস্ট তো কমপ্লিমেন্টারি, খামাখা টাকা খরচ করবি কেন? ঠিক মত ব্রেকফাস্ট করলে লাঞ্চ করার আর করার দরকারই পরবেনা
ছুটির দিনগুলোতে একটু বেলা করে ঘুম ভাঙ্গে, কিন্তু দেবুর জন্য পারা গেল না। পড়ি-মড়ি করে উঠে আমরা প্রায় শেষ মুহূর্তে ব্রেকফাস্ট টেবিলে পৌঁছলাম। সব কিছু প্রায় শেষ দিকে। দেবু অর্ডার দিয়ে অমলেট, ফ্রুটস আরও নানা খাবার টপআপ করাল। আমরা বেশ সময় নিয়ে ব্রেকফাস্ট শেষ করলাম।
ইউকএন্ড হওয়াতে সুবিধা হয়েছে, দেবুর অফিসে যাবার তাড়া নেই। আমারও কোন মিটিং-টিটিং নেই। দেবু ওর ওয়াইফকে কি বুঝিয়েছে কে জানে! আমাকে বলল, দোস্ত নেক্সট টু ডেইজ আই ইউল বি উইথ ইউ।
তোর বউ?
বউয়ের গুলি মার দোস্ত।
গুলি মারব মানে?
চলবে না দোস্ত। আমার বউ টেকে না।
দীপালিও টিকবে না। কলকাতার মেয়ে বেশ নাক উঁচু।
নাক উঁচু মানে কী?
নাক উঁচু মানে ভীষণ জেদি আর স্বাধীনচেতা। বাংলাদেশের বাঙালিকে মনে করে বাঙাল। সমস্যা দোস্ত মেয়েদের না। সমস্যা আমার মধ্যে।
তোর মধ্যে?
ইয়েস আমার মধ্যে। আমি কোন নারীকে কেন জানি ভালবাসতে পাড়ি না। আমার ওপর মেয়েদের অভিশাপ আছে।
থাকাটা স্বাভাবিক।
এ জীবনে অনেক নারীকে প্রতারিত করেছি দোস্ত, অনেককে ঠকিয়েছি। তারপরও আমার মোহ কাটে না, আমার শিক্ষা হয় না।
তুই এক কাজ কর, বাসায় চলে যা, উইকএন্ড ফ্যামিলিকে সময় দে। সেটা বরং ভাল হয়।
আরে ফ্যামিলি তো দু’দিনেই আর চলে যাচ্ছে না। তুই আমাকে তাড়াতে চাচ্ছিস কেন? কতদিন পর তোকে পেলাম। একটা কথা বলি?
বল।
তোকে দেখে মনেই হয় না তুই আগের সেই ভীতু, নিরীহ গোছের সমীর।
নেসেসিটি বন্ধু নেসেসিটি, এম্বিশন আর দায়িত্ববোধ আমাদের জীবনকে বদলে দেয়। তোর কি মনে আছে রুবিকে চিঠি লিখে আমার কলেজে যাওয়া প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল? তখন থেকেই প্রতিজ্ঞা করছিলাম আই উইল লিভ মাই ওন লাইফ উইথ ডিগনিটি।
আর আমি উইশ করেছিলাম ভাল রেজাল্ট করার পর গ্রাজুয়েশন করব বিদেশে। পড়াশুনা করতে করতে একসময় ফিল করলাম আমি আস্তে আস্তে এদেশে শেকড় গেড়ে বসেছি। ছুটিছাটায় মাঝে মধ্যে বাংলাদেশে গেছি কিন্তু বেশিদিন থাকতে ইচ্ছে করেনি। মনে হয়েছে বাংলাদেশ আমার জন্য না। বাবা মারা গেল মুখাগ্নি করিনি জানিস? গত বছর মাও চলে গেল। আমি শালা হয়ে গেলাম মাইকেল মধুসূদন।
শুনেছি এর আগে তোর ব্রিটিশ ওয়াইফ ছিল?
তুই তো আমার সবই জানিস, তোর কাছে লুকিয়ে লাভ নেই। ওয়াইফ, গার্লফ্রেন্ড একটা না দোস্ত অনেকগুলো ছিল। ২২ বছর হয়ে এল আমি এই দেশে, সেই স্টুডেন্ট লাইফ থেকেই নারীর নেশা আমাকে ছাড়েনি। জানিস এখানকার সোসাইটিতে আমার খুব দুর্নাম। দেবুকে চেনে না এমন মানুষ খুব কম। বড় একা পড়ে গেছি দোস্ত। ভাবছি, এখানকার পাততাড়ি গুটিয়ে বাংলাদেশে চলে যাব।
সে কি? সবাই বাংলাদেশ থেকে পালাতে চায় আর তুই দেশে ফিরে যাবি?
উপায় নেই দোস্ত। এখানে আমি হাঁপিয়ে উঠেছি।
বাংলাদেশে তো এখন সুরভি’দি ছাড়া আর কেউ নেই?
দিদি আছে, ওর হাজবেন্ড ডিস্ট্রিক কমিশনার। ও ছেলেমেয়েদের নিয়ে ঢাকাতেই থাকে। ধানমণ্ডিতে বাড়ি করেছে। আমাকেও জোর করে কিনিয়েছে ওদের পাশের প্লটে। আমি ডেভলাপারকে দিয়েছিলাম। ওরা চারটা ফ্ল্যাট দিয়েছে, ওগুলো ভাড়া দিয়েছি। দেশে গেলে দিদির বাসাতেই থাকা হয়।
তোর নিশ্চয় বড় কোন সমস্যা হয়েছে, নয়তো হঠাৎ করে দেশে ফিরে যাবার কথা ভাবছিস কেন?
দীপালি আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দোস্ত, ছেলেকে আমার সাথে মিশতে দেয় না। সম্ভবত মামলায় আমি হারবো, বাড়িটা হাতছাড়া হবে। এ অবস্থায় এখানে থাকার কোন মানে হয় না। বয়স বাড়লে শরীর একটু কেয়ারিং চায়, ভালবাসা চায়। দীপালির আছ থেকে এসব পাবার কোন আশা নেই।
নিশ্চয়ই কোন অপকর্ম করেছিস?
ঠিকই ধরেছিস, চ্যাটিং-ফেটিং নিয়ে ধরা খেয়েছি, একবার না কয়েকবার!
টিট ফর ট্যাট। ইউ হ্যাভ টু ফেস দ্যা কন্সিকোয়েন্সেস।
তুই কি দোস্ত দীপালিকে একবার মিট করবি?
অফকোর্স নট। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়ায় তৃতীয় কোন ব্যক্তির প্রবেশাধিকার থাকা উচিত না, এন্ড দেয়ার ইস নো ম্যাজিক টু ফিক্সড ইট। তুই হিউম্যান রিসোর্স এন্ড ম্যানেজমেন্ট নিয়ে পিএইচডি করেছিস তোর তো এসব ভাল বুঝার কথা। বেশি বেশি করে ফ্যামিলিতে সময় দে, একসময় দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে!
ঠিক আর হবে না দোস্ত। তোর তো উইকএন্ডে কোন কাজ নেই?
না।
এখন বাজে প্রায় ১১টা আমরা যদি ১২ টার মধ্যে বের হয়ে পাড়ি তবে ট্রেনে সন্ধ্যা নাগাদ ডান্ডিতে পৌঁছতে পাড়ব।
ডান্ডিতে, সেখানে কেন যাবো?
সাঈদ ডান্ডিতে থাকে। ও প্রায়ই ফোন করে ওর ওখানে যাবার কথা বলে কিন্তু নানা ব্যস্ততায় যাওয়া হয় না। চল সাঈদের ওখানে যাই ও খুব খুশি হবে।
সাঈদ মানে কি বাইক সাঈদ?
ইয়েস, তোর কথা সব সময় বলে। গেলে খুব খুশি হবে।
তোর গাড়ি?
গাড়ি এখানে থাকুক। আমরা রাতভর আড্ডা দিয়ে কাল সন্ধ্যে নাগাদ ফিরে আসবো। ট্রেন হলে ট্রেন নয়তো প্লেনে চলে আসবো।
ডান্ডিতে দুদিন বেড়িয়ে আমি ঢাকায় চলে এলাম!
দেবুর সাথে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো। এর মধ্যে ঝটিকা সফরে লন্ডনে আরও কয়েকবার যাওয়া হয়েছে, কিন্তু সময়াভাবে ওর সাথে দেখা হয়নি। এরপর দীপালির সাথে মামলায় হেরে গিয়ে বছর চারেক পর দেবু পারমানেন্টলি ঢাকাতে চলে এল। পিএইচডি, অভিজ্ঞতা আর ব্রিটিশ পাসপোর্টের সুবাদে সে এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বেশ ভাল বেতনে জবও পেয়ে গেল, সাথে গাড়ি।
ব্যাচেলর দেবদাস বেশি দিন ব্যাচেলর থাকতে পারল না, কয়েকটা প্রেম-ট্রেম করার পর ছ’মাসের মাথায় একটা বিয়েও করে ফেলল। স্ত্রী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। ফেসবুকে পরিচয়। দেবু কীভাবে এক অনুঢ়া জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জুটিয়ে ফেলল আমাদের কাছে সেটা এক বিস্ময়। জুডিশিয়াল লোকজনদের ফেসবুক থাকে এটাই জানতাম না। এজলাসের বাইরে সাধারণত এঁদের খুব একটা দেখা যায় না।
আমার সংগে দেবুর স্ত্রী’র প্রথম ও শেষ দেখা দেবুর বিয়ের সময়। মোটা ফ্রেমের চশমার ভেতরে রাগি বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছে পৃথিবীর সব কিছুর ওপর উনি চরম বিরক্ত। দেবুর হাব ভাব দেখে মনে হল একজন ম্যাজিস্ট্রেট পেয়ে সে বেজায় খুশি। কিন্তু মাত্র চার মাসের মাথায় ওর স্ত্রী যখন বাসায় সি সি ক্যামেরা লাগালো তখন দেবুর খুশির দিন শেষ হয়ে এলো!
বিয়ের পর দেবু আর ওর স্ত্রী ধানমণ্ডিতে ওর ফ্ল্যাটে উঠেছিল। একদিন ক্লাবে বসে আড্ডা দেবার সময় দেবু বলল, দোস্ত বাসায় সি সি টিভি ব্যাপারটা কেমন হল?
আমি বললাম, ঠিকই তো আছে! তুই সারাদিন অফিসে থাকিস আর তোর ওয়াইফ থাকে এজলাসে, খালি বাসায় কত কিছু হতে পারে।
আরে নিচে দারোয়ান আছে, হুট করে তো আর যে কেউ ঢুকতে পারে না। কিন্তু কথা নেই বার্তা নেই বেডরুমে সি সি টিভি!
তুই নিশ্চয়ই বিশ্বাসভঙ্গের মত কাজ করেছিস।
তুই তো জানিস তোর বৌদির পোস্টিং মুন্সিগঞ্জে, প্রতিদিন ধানমণ্ডি থেকে মুন্সীগঞ্জে গিয়ে অফিস করা সম্ভব না। উইকডেতে ম্যাডাম সরকারী কোয়াটারেই থাকে আর উইকএন্ডে হয় আমি চলে যাই মুন্সীগঞ্জ আর নয়তো সে চলে আসে ঢাকায়, বিয়ের পর এই ভাবেই চলছিল।
ঠিকই তো আছে! এতে সমস্যা কোথায়!
পুরোটা শোন! একদিন কী হলো- সন্ধ্যায় খুব সিরিয়াস বৃষ্টি নামায় বাসায় যে ঠিকা ঝিটা কাজ করে সে আর তার বাসায় যায়নি, রাতে আমার বাসাতেই থেকে গেছে। এই নিয়ে আমার সঙ্গে তোর বৌদির তুমুল ঝগড়া। এর পরই বাসায় সি সি লাগানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হল। এসবের কোন মানে হয় বল? এখন আবার বায়না ধরেছে বাচ্চা নেবে।
অসুবিধা কী?
অসুবিধা আছে দোস্ত। আমরা দুজনেই তো চাকরি করি, বাচ্চা পালবে কে? আর এই পঞ্চাশ বছর বয়সে বাবা হওয়া কি মানায় বল? বাচ্চার বয়স যখন ২০ হবে তখন আমি ৭০ বছরের দাদা। দাদার বয়সে বাবা হওয়া কোন কাজের কথা না।
হা হা হা
হাসবি না! বিয়ের আগে তোর বৌদি বলেছিল বাচ্চা-কাচ্চার ব্যাপারে সেও তত আগ্রহী নয়, এখন ছ’মাস না যেতেই বাচ্চার বায়না। লাইফটা মনে হচ্ছে হেল হয়ে যাবে।
দেবুর লাইফ হেল হয়েছিল কি না জানি না। তবে বছর খানেক পর দেবু ছেলের বাবা হলো। ফেসবুক-টেসবুক সব ডিলিট। সে আর এখন ক্লাবে আসে না। উইকএন্ড পুরোটাই ফ্যামিলির সাথে কাটায়। ফোন করলেই বাচ্চার কান্না-কাটির শব্দ পাওয়া যায়। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিনকাল।
আজ হঠাৎ দেবুর স্ত্রীর ফোন এসে আমার সব ধারণা ওলট পালট করে দিল। দেবু নাকি বুকে ব্যথা নিয়ে তিনদিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। দেবুর বোনের ছেলে দিপেন ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। ডাক্তার বলেছে মাইন্ড হার্টঅ্যাটাক, দু-চার দিন অবজারভেশনে থাকতে হবে।
হঠাৎ করেই হাসপাতালে দেবুর শ্বাসকষ্ট শুরু হওয়ায় করোনা রোগী সন্দেহে ওকে এক রকম জোর করে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ করে দেয়া হয়। দেবুর ওয়াইফের পোস্টিং ছিল ময়মনসিংহে। সেখানেই আইসোলেশন সুবিধা থাকা একটা ছোট হাসপাতালে দেবুকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল একটা অ্যাম্বুলেন্সে করে।
ময়মনসিংহ যাবার পথে অ্যাম্বুলেন্সেই দেবু মারা গেছে।
দেবুর মৃত্যু সংবাদ এতই আকস্মিক যে আমি সোফার হাতল ধরে বসে পড়লাম। দেবুর ওয়াইফ ফোনে ক্রমাগত কাঁদছিল, কীভাবে আমি তাকে শান্ত্বনা দেবো বুঝতে পারছি না। সান্ত্বনার কোন ভাষাও আমার জানা নেই। পুরো ব্যাপারটা ঘটেছে মাত্র তিন দিনে, আশ্চর্য আমাকে কেউ একটা কল পর্যন্ত করেনি। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না দেবু এই পৃথিবীতে নেই। এত মানুষ এত ভিড় কিন্তু দেবু নেই। ওর কণ্ঠস্বর যেন আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।
ফোন রাখার একটু পর দেবুর স্ত্রীর ফোন থেকে হোয়াটস আপে একটা একটা মেসেজ এলো, তাতে লেখা – ওর মোবাইলটা হসপিটাল থেকে চুরি গিয়েছিল সম্ভবত সে জন্যেই আপনাকে কল করতে পারেনি। ওর শার্টের পকেটে একটা চিঠি পাওয়া গেছে। চিঠিটা আপনাকে উদ্দেশ্য করে লেখা। আমি ছবি তুলে পাঠালাম। আপনি পড়লে ওর আত্মা হয়তো শান্তি পাবে।
প্রিয় সমীর,
জানিনা শেষ পর্যন্ত এ চিঠিটা তো কাছে পৌঁছাবে কি না। ফোনে কথা বলতে পারলে ভাল হতো। কিন্তু ফোনটা চুরি গেছে। অন্য কোন ফোন থেকে কাউকে যে কল দেব সে উপায়ও নেই, কারো নাম্বার মুখস্থ নেই। এনিওয়ে বন্ধু, তোকে খুব মিস করছি। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমি আর বাঁচবো না।
সেই ছেলেবেলা থেকে তোকে আমি নানাভাবে বিরক্ত করেছি। কিন্তু বিশ্বাস কর তোর কথা আমি কোনদিন ভুলিনি। তুই নিঃসন্দেহে খুব ভাল একজন মানুষ, আই ফিল প্রাউড অফ ইউ। কিন্তু তুই খুব অহংকারি। কত চেষ্টা করেছি তোর সাথে যোগাযোগ রাখতে কিন্তু তুই বরাবরই এভয়েড করছিস। তোর সংস্পর্শে থাকলে আমার জীবনটা হয়তো এতটা দেউলিয়া হতো না।
পৃথিবীটা একটা সুন্দর জায়গা দোস্ত, ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করে না। তোর বৌদি মীরা খুব ভাল একটা মেয়ে। ওর প্রফেশনের কারণে দেখতে খুব রাগি মনে হয় কিন্তু ওর ভেতরটা মোমের মতো নরম। নয়তো আমার মতো স্টুপিডকে সে ভালবাসে কি করে!
তোর সঙ্গে অনেকদিন দেখা হয়নি। আসলে অফিস থেকে এসে বাসায় একবার ঢুকলে ছেলেটাকে কিছুতেই কোল থেকে নামানো যায় না। বাথরুমে গেলেও সঙ্গ যেতে চায়। আমাকে এই দুই দিন না দেখে নিশ্চয়ই সারা বাসায় খুঁজেছে। ছেলেটিকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। ফ্যামিলি, জীবন যে এতো মায়াময় হতে পারে সেটা আগে বুঝতাম না। ‘মায়াময়’ শব্দটা কি ঠিক আছে? এই প্রথম বাংলায় চিঠি লিখছি হয়তো বা এটিই শেষ চিঠি। তুই ছিলি চিঠি লেখার মাস্টার।
মুখের স্বাদ একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে, কোন কিছু খেয়ে স্বাদ পাই না এখন। কেন যেন খুব মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করছে। সোনাই ঘোষের সেই দোকানটা কি এখনো আছে? ওদের রসগোল্লা আর চমচমের কোন তুলনা হয় না। তোকে কিন্তু সোনাই ঘোষের দোকানে একবার আমি স্পেশাল ট্রিট দিয়েছিলাম, মনে আছে তোর?
আমি চলে গেলে তোর বৌদি আর আমার ছেলেটার একটু খোঁজ রাখিস, এটা তোর প্রতি আমার বিশেষ অনুরোধ রইল। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে, নয়তো এখানেই বিদায়। ভাল থাকিস বন্ধু। আর তোর স্ত্রী রুবিকে বলিস আমাকে যেন সে ক্ষমা করে।
ইতি,
তোর দেবদাস
-সমাপ্ত-
শহিদ হোসেন