যেদিন তুমি এসেছিলে
সিজন ২ পর্ব ৩৪
মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
বিনা বার্তায় হঠাৎ বৃষ্টির আগমন বিরক্তের বদলে আনন্দিত করে তুলল এক ঝাঁক তরুণ-তরুণীকে। বৃষ্টির কোনো পূর্বাভাস ছিল না, আকাশ মেঘলা ছিল না। তবুও বলা নেই, কওয়া নেই এক পশলা বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে পুরো শহর। শহরের সঙ্গে যোগ দিয়েছে গ্যাঞ্জাম পার্টি। বৃষ্টিতে ভিজে রীতিমতো কাঁপছে একেকজন তবুও উঠে যাওয়ার নাম নেই। আজ যতক্ষণ বৃষ্টি হবে ততক্ষণই সকলে ভিজবে এমনটাই যেন পণ করেছে। যদি সারাদিন, সারা রাত বৃষ্টি হয় তাহলে তা-ই সই। শুনে পাগলের প্রলাপ মনে হতে পারে। হতেই পারে! আনন্দে সকলে এতটাই আত্মহারা যে কী রেখে কী করবে তা ভেবেই পাচ্ছিল না একেকজন। এত আনন্দের কারণ হলো অর্ষার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। খুব শীঘ্রই দুটি ভালোবাসার মানুষ এক হতে চলেছে। বৃষ্টির পানিতে লাফাতে লাফাতে আশিক বলে,
“ঝমঝম বৃষ্টিতে রমরমা মন আমার।”
দিদার বলে,
“এটা কী ছিল?”
“কবির কবিতার লাইন।”
“ট্রাস্ট মি! তোর সাথে পরিচয় হওয়ার আগ অব্দি এত বাজে কবিতা আমি কখনও শুনিনি।” বলল জুঁই।
উত্তরে আশিক মুখ ভেংচি কেটে বলল,
“ভালোর কদর একদিন বুঝবি। কিন্তু সেদিন অনেক দেরি হয়ে যাবে।”
রেশমি বলল,
“ফর গড সেইক, তোর এই ফা’উ’ল সেন্টিমেন্টাল ডায়ালগ আমাদের দিস না। আমরা এসবে গলব না।”
“তোদের তো ভালো কথাও বলা যায় না।”
লামিয়া বলল,
“থাম তোরা! অ্যাই অর্ষা, তুই কি বিয়ের পর আমাদের ভুলে যাবি?”
অর্ষা ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বলল,
“যাহ্! ভুলব কেন?”
“বিয়ের পর অনেকেই ভুলে যায়। কত দেখলাম!”
“ওমা! তুমি কি আমায় দেখোনি? আমি তো অর্ষাকে বিয়ের পরও ভুলে যাইনি।” বলল মুন।
“তোমার টপিক তো আলাদা। বিয়ের পর তো আহিলের সাথেও ওর রোজ দেখা হবে। দুজনে একই বাড়িতে থাকবে। আর বন্ধুর প্রয়োজন না-ও থাকতে পারে।”
অর্ষা বলল,
“আচ্ছা বেশ! তাহলে বরং আমি বিয়েটা না করি?”
আহিল বেশ অবাক হয়ে বলল,
“তোরা কী শুরু করলি! মাঝখান থেকে আমার ভাইয়ের আনন্দ নিয়ে ছিনিমিনি খেলছিস!”
“ওহহো! এখন তো তুই দুলাভাইয়ের দলে।”
“ভালো কথা! তুই কোন পক্ষ থাকবি আহিল? বরপক্ষ নাকি কনেপক্ষ?” জিজ্ঞেস করল দিদার।
আহিল কনফিডেন্সের সঙ্গে বলল,
“অবশ্যই বরপক্ষ। এমনকি তুই আর আশিকও আমাদের দলে থাকবি।”
“বাঃ, বাঃ! এখন সে সব হয়ে গেল? আমি তো বানের জলে ভেসে এসেছি।” অর্ষার কণ্ঠে অভিমান।
জুঁই অর্ষার কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
“তুই কেন আপসেট হচ্ছিস? ওরা তো মাত্র তিনজন! আর আমরা চারজনই তোর দলে আছি। আমরা হব কনেপক্ষ। এছাড়া সকাল তো আছেই আমাদের দলে। পাঁচজন হয়ে গেলাম না? শুধু বরযাত্রী আসুক না আগে। পকেট থেকে সব টাকা যদি না খসিয়েছি তারপর বলিস!”
আশিক বিড়বিড় করে বলল,
“ডা’কা’তের বংশধর!”
.
.
মুনের বাড়ি থেকে অর্ষা বাসায় ফিরেছে দুপুরে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি তখনও হচ্ছিল। পরনের জামা-কাপড় ভিজে যাওয়ায় অর্ষা, লামিয়া, জুঁই আর রেশমি প্রত্যেকেই মুনের থ্রি-পিস নয়তো শাড়ি পরেছে। ওদের মধ্যে অর্ষাও পড়েছে লেমন কালারের সুতি শাড়ি। সাথে কালো ব্লাউজ। অর্ষা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছাতা বন্ধ করছিল তখন পেছন থেকে সেলিনা বেগম মুগ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন,
“তোকে কী দারুণ লাগছে রে অর্ষা!”
অর্ষা সলজ্জিত হেসে বলল,
“মুনের শাড়ি। সুন্দর না?”
“শাড়ি তো অবশ্যই সুন্দর। তারচেয়েও বেশি সুন্দর আমার মেয়ে। আমাদের রাজকন্যা।”
হাসি প্রশস্ত হলো অর্ষার। ছাতা বারান্দায় রেখে নিজের রুমে চলে গেল। হাত-পা ধুয়ে বিছানায় বসতেই আহনাফের কল আসে। ফোন রিসিভ করে অর্ষা।
“বৃষ্টিবিলাস কেমন করলেন আমার প্রজাপতি?” বলল আহনাফ।
অর্ষা ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
“ভালো। এই খবরও আপনার কাছে পৌঁছে গেছে?”
“তোমার সব খবরই আমার কাছে থাকে।”
“তো এই খবরটা কে দিল? মুন?”
“নাহ্। সবসময় বেচারিকে দোষ দাও কেন? আহিল বলেছে।”
“ওহ আচ্ছা। আপনার দল তো এখন আরও ভারী হয়েছে। আমার সব বন্ধু-বান্ধবকে নিজের দলে টেনে নিচ্ছেন।”
“তুমি টেনশন করছ কেন? ওরা আমার দলে। কিন্তু আমি তো তোমার দলে। ঘুরে-ফিরে হিসাব করলে কিন্তু, তোমার জোর-ই বেশি বুঝেছ?”
অর্ষা হেসে বলল,
“বুঝেছি।”
“চলো দেখা করি।”
“না। বাসা থেকে নিষেধ করেছে। আর মাত্র চারদিন পর বিয়ে। এখন কোনো দেখাদেখি হবে না।”
“আশ্চর্য! চারদিন এখনও অনেক সময়। অফিসে আসো না, রাফিকে পড়াতে আসো না। দেখাও করবে না। তাহলে আমি থাকব কীভাবে?”
“জানি না তো আমি।”
“এসব বললে আমি শুনব কেন? একবার হলেও দিনে তোমার দেখা চাই।”
“বাড়ি থেকে কী বলে বের হব তাও এই বৃষ্টির মধ্যে?”
“সকালে যেভাবে বের হয়েছিলে।”
“তখন তো বৃষ্টি ছিল না।”
“আমি এতকিছু জানিনা। দেখা করব মানে করবই। তুমি আসতে না পারলে আমি চলে আসি?”
“খবরদার না! মান-সম্মানের কি আর কিছুই বাকি রাখবেন না? আচ্ছা শুনেন, বিকেলে মুনের বাসায় চলে আসেন।”
“ওর বাসায় কেন? কোনো রেস্টুরেন্টে বসি?”
“না। যদি কেউ দেখে বাড়িতে জানায়?”
“জানালে জানাবে। আমরা তো আর লুকিয়ে প্রেম করছি না। দু’দিন পর আমাদের বিয়ে হবে।”
“আপনি কি আমার কথা শুনবেন?”
“না শুনে কি আর উপায় আছে? কয়টায় যাব বলো।”
“সাড়ে তিনটায়।”
“ঠিক আছে।”
“এখন রাখি। আমি একটু ঘুমাব।”
“ঠিক আছে। হ্যাভ অ্যা সুইট ড্রিম উইথ মি।”
“ফাজিল!” বলে ফোন রেখে দিল অর্ষা। তার দু’চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে। বৃষ্টিতে ভিজলেই সে ঘুমে আর তাকিয়ে থাকতে পারে না। শাড়ি না পালটেই ওভাবে শুয়ে পড়ল। ঘুম আসতেও কাল বিলম্ব হলো না। শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে ঘুমিয়ে পড়ল।
চারটা নাগাদ অর্ষার ঘুম ভাঙে তাও সকালের ডাকে। ঘুমঘুম দৃষ্টিতে তাকিয়ে অর্ষা মৃদু চিৎকার করে বলে,
“ডাকছিস কেন?”
অর্ষা কলেজের ইউনিফর্ম খুলতে খুলতে বলল,
“কখন থেকে আহনাফ ভাইয়া ফোন করছে। রিসিভ করছিস না কেন?”
ঘুম কেটে যায় অর্ষার। দেখা করার কথা বেমালুম ভুলে গেছিল। ঘুমে কাতর হয়ে ফোনের রিংটোনও শোনেনি। সে তড়াক করেই শোয়া থেকে উঠে বসল। আহনাফ তখনও ক্রমাগত ফোন করছে। অর্ষা ফোন রিসিভ করে বলল,
“আমি সত্যিই অনেক দুঃখিত! ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই ফোনের রিংটোনও শুনিনি। আমি এক্ষুণী আসছি।”
ওপাশ থেকে আহনাফ শান্তকণ্ঠে বলল,
“এত তাড়াহুড়া করতে হবে না। তুমি ফ্রেশ হয়ে সাবধানে আসো। আমি মুনের বাসার সামনেই আছি।”
“আপনি ভেতরে যান।”
“না। তুমি আসলেই যাব।”
“আচ্ছা রাখছি।”
ফোন রেখে ওয়াশরুমে গিয়ে চটজলদি ফ্রেশ হয়ে আসে অর্ষা। মুখ মুছে টেবিলের ওপর থেকে পার্স নিয়ে সকালের উদ্দেশ্যে বলল,
“মাকে বলিস আমি মুনের বাসায় যাচ্ছি। সন্ধ্যার আগেই চলে আসব।”
বাইরে বেরিয়ে দেখল এখনও বৃষ্টির ফোটা পড়ছে। তাই বারান্দা থেকে ছাতা নিয়ে সে লুকিয়ে বেরিয়ে পড়ে। মা দেখলেই নয়তো হাজারটা প্রশ্ন করবে এখন। বের হতে দেবে কিনা তাতেও রয়েছে প্রবল সন্দেহ। তাই উপায় না পেয়ে শুধু সকালকে বলে এসেছে। বাজার থেকে রিকশা নেওয়ার জন্য সে একটা দোকানের সামনে দাঁড়ায়। কয়েক সেকেণ্ড বাদে পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পায় সে।
“কে? অর্ষা নাকি?”
অর্ষা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। দোকান থেকে তোফায়েল বেরিয়ে আসল। আপাদ-মস্তক অর্ষাকে স্ক্যান করে বলল,
“তোমায় সুন্দর লাগছে।”
অর্ষা নিশ্চুপ।
“শুনলাম তোমার নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে অফিসের স্যারের সঙ্গে?”
তোফায়েলের অযথা কথাবার্তা শোনার ইচ্ছে নেই অর্ষার। তাই সে রিকশার জন্য আর অপেক্ষা না করেই হাঁটা শুরু করে। সামনে গিয়ে তখন পথরোধ করে দাঁড়ায় তোফায়েল। মুচকি হেসে বলে,
“আরে দাঁড়াও! কতদিন পর দেখা হলো। দুইটা কথা বললে কী হয়?”
“আমার তাড়া আছে।”
“তাড়া তো সবসময়ই থাকে। একদিন তাড়াকে উপেক্ষা করো।”
অর্ষা এবারও কোনো প্রত্যুত্তর না করে চলে যেতে চাইল। তোফায়েলও পূণরায় পথরোধ করে দাঁড়াল অর্ষার।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]