অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ২
লেখিকা: অনিমা কোতয়াল
আমি কাঠবাগান থেকে বাড়ি চলে আসার পর একেবারে মামাতো ভাইবোনেদের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। কোন কারণ ছাড়াই ছোটবেলা থেকে লোকটার প্রতি এতো বিরক্তি পুষে রেখেছিলাম যে নামটা অবধি সহ্য হচ্ছিল না। সেখানে চেহারা তো বিশাল কিছু। আমি চলে আসার বেশ অনেকটা সময় পর মানে সোহেল ভাইয়ের আংটি বদলের আগ মুহূর্তে ওনার দেখা পেয়েছিলাম। বেশ ভালোয় ভালোয় এনগেইজমেন্ট সম্পূর্ণ হল। তবে পুরোটা সময় আমার কাছে একটা জিনিসই অসহ্য লেগেছে সেটা হল ওনার চেহারা। এতো এটিটিউড, এতো ভাব যেনো কোথাকার কোন রাজপুত্র সে। বিরক্তি নিয়ে বারবার আড়চোখে দূর থেকে দেখছিলাম সেই অসহ্য মানবকে। দু’বার চোখাচোখিও হয়ে গেছিল ওনার সাথে। আমি সাথেসাথেই চোখ সরিয়ে নিয়েছি। আমার পুরো এনগেইজমেন্টের মুডটাই খারাপ করে দিল এই নিয়ে বেশ আফসোস করতে করতে তার মুন্ডপাত করতে বিন্দুমাত্র ভুলিনি।
বিকেল হতে হতে আড়ালে আবডালে দেখে আর সবার মুখে ওনার এতো এতো প্রশংসা শুনে শুনে পুরোপুরিভাবে নিশ্চিত হলাম যে ইনিই হলেন আদ্রিয়ান ভাই। যার সাথে ছোটবেলায় কাটানো কিছু কিছু ঘটনা আমার আবছা মনে আছে। এবং এরই ট্যালেন্টের চর্চা আমাদের বাড়িতে প্রায়ই হতো আর আমায় কথা শুনতে হতো। তবে একটা ব্যাপারে খুব অবাক হয়েছিলাম আমি। সেটা হল আমার কল্পনায় এঁকে রাখা আদ্রিয়ান ভাইয়ের সাথে বাস্তব আদ্রিয়ান ভাইয়ের কোন মিল ছিলোনা। আমি ভেবেছিলাম এতো পড়াকু ছেলে, এতো ট্যালেন্টেড তাহলে নিশ্চয়ই উনি স্বাভাবিকের চেয়ে খানিকটা বেশি ওজনওয়ালা হবে, চোখে মোটা ফ্রেমের হাই পাওয়ারের চশমা থাকবে, দেখতে গুলুমুলু কিংবা বোকাসোকা টাইপ হবে। কিন্তু উনি ছিলেন তার পুরোই উল্টো। শরীর দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এই ছেলে ব্যায়াম করতে ভীষণ ভালোবাসে। তারওপর বাদামি লেন্সের চোখজোড়া দেখে বোঝার উপায় নেই যে এই চোখ দিয়ে সে সাইন্সের এতো বিশাল বিশাল ম্যাথের ফর্মুলা, ইক্যুয়েশন দেখে, এতো এতো এক্সপিরিমেন্ট সহ্য করে। সেইদিন আমার বহুদিন ধরে পুষে রাখা ভ্রান্ত ধারণা ভেঙ্গে গিয়েছিল। খুব ভালোভাবেই আবিষ্কার করেছিলাম যে রূপ আর মেধা দুটোই যথেষ্ট আছে এমন মানুষজন অবশ্যই এক্সিস্ট করে, এরা এলিয়েন নয়। যদিও তখন আমার বয়সই ছিল প্রায় ষোল। আর গোটা পৃথিবী আর পৃথিবীর সবরকম মানুষ সম্পর্কে ধারণা রাখা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা।
তো এনগেইজমেন্টের সমস্ত ঝামেলা মিটিয়ে সন্ধ্যার পর ওনারা বাড়ি চলে গিয়েছিল। আমরাও রাতেই বাড়ি চলে এসেছিলাম। বাড়ি ফেরার পর আবার শুরু হল আমার বাবা-মায়ের ‘আদ্রিয়ান প্রশংসা’। যেটা আমায় বরাবরই বিরক্ত করে। তাই সেদিকে ধ্যান না দিয়ে রুমে এসে কোনরকমে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। সারাদিনের ধকল, আর ঘুমোতে না পারার কারণে কয়েকমিনিটের মধ্যেই শান্তির এক ঘুম চলে এলো।
এরপর কেটে গেল আরও একটা সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহে আদ্রিয়ান ভাইয়ার সাথে আমার কোনভাবে দেখা হয়নি। শুধু দুবার নামই শুনেছি বাড়িতে। কিন্তু ভাগ্যে হয়তো আবার আমাদের সাক্ষাৎ লেখা ছিল। তাইতো এরমধ্যেই মানিক আঙ্কেল আর রিমা আন্টি আমাদের স্বপরিবারে ডেকে নিলেন তাদের বাসায় দাওয়াত করে। কারণ আদ্রিয়ান ভাই দেশে আসার পর আমাদের ঐ বাড়িতে যাওয়া হয়নি। আর মানিক আঙ্কেলের দাওয়াত আব্বু ফেলবেন না। যার অর্থ হচ্ছে আমাকেও যেতে হবে ঐ বাড়ি। যেটা আমি মোটেও চাইছিলাম না। কিন্তু সবসময় তো আর চাইলেই হয়না। তাই আমাকেও আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঐ বাড়ি যেতে হয়েছিল সেদিন। আমাদের বাড়ি শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলাতে আর ওনাদের বাড়ি শরীয়তপুর সদরে। গাড়ি করে যেতে মিনিমাম পয়তাল্লিশ মিনিটের মতই লাগে। রিমা আন্টির কড়া নির্দেশ ছিল সকালের নাস্তা ঐ বাড়ি গিয়েই খেতে হবে। তাই আমরা বেশ সকাল সকাল পৌঁছে গিয়েছিলাম ওখানে। ওই বাড়িতে পৌঁছুতেই মানিক আঙ্কেল আর আন্টি আমাদের এগিয়ে ভেতরে নিয়ে গিয়েছিলেন। আগেই বলেছি মানিক আঙ্কেলের আরও দুটো মেয়ে আছে জাবিন আর সারা। জাবিন তখন ক্লাস এইটে ছিল, আর সারা ক্লাস সিক্সে। আঙ্কেল শরীয়তপুর আসার পর ওদের দুজনের সাথে মোটামুটি একটা বন্ডিং হয়ে গেছে। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন জাবিন প্রাইভেট পড়তে গেছে তাই বাড়িতে ছিলোনা। সারা আমাকে দেখেই ছুটে এলো। ওর সাথে একসঙ্গে বসে কিছুক্ষণ কথা বললাম। বাচ্চা মেয়ের সাথে যেরকম টুকটাক কথা বলা যায় আরকি। কিছুক্ষণ রেস্ট করার পর আমাদের নাস্তা খেতে ডাকা হলো। সকলে মিলে একসাথে নাস্তা খেতে বসে বুঝতে পারলাম যে আদ্রিয়ান ভাই এখনো ঘুম থেকে ওঠেন নি। কেউ ডাকছেওনা। অনেক রাত অবধি জেগে কীসব করেছেন না-কি। আমিও তেমন গুরুত্ব দেই নি।
সকালের নাস্তা খাওয়ার পর বাবা আর আঙ্কেল কথা বলতে বলতে বাইরে চলে গিয়েছিলেন। মা আর আন্টিও গল্প জুড়ে দিয়েছিলেন। পড়েছিলাম আমি আর সারা। কী আর করার! আমি আর সারা মিলে ঐ বাড়ির ছাদে চলে গিয়েছিলাম। ছাদে খুব সুন্দর একটা পাটি বিছানো ছিল। আমরা দুজন মিলে ওটাতে বসে বেশ অনেকক্ষণই গল্প করেছি। নানারকম বাচ্চা বাচ্চা কথাই বলতে হয়েছিল ওর সাথে আমার। তবে সেটা আমার খারাপ লাগেনি ভালোই লেগেছিল। কিন্তু একটু পরে সারার এক বান্ধবী তাসলিমা নামের একটা মেয়ে নিচ থেকে ওকে ডেকেছিল। সারা আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ‘অনিপু তুমি একটু বসো। আমি এক্ষুনি আসছি।’
আমিও উঠে ছাদের এদিক ওদিক হাঁটছিলাম। আকাশটাও মেঘলা বেশ। মেঘ ভারী হয়ে কারো রঙ ধারণ করছে। মনে হচ্ছে শীঘ্রই বৃষ্টি হবে। প্রায় পাঁচ-সাত মিনিট কেটে যাওয়ার পরেও সারা এলোনা। কিন্তু ঠিক তখনই ছাদে আদ্রিয়ান ভাইয়ের আগমন ঘটেছিল। আমি তাকিয়ে দেখলাম একদম অগোছালো এলোমেলো চুল, থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট, আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে আছে, হাই তুলতে তুলতে চারপাশটা দেখছিলেন উনি। দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে ঘুম থেকে উঠে সোজা ছাদে এসছেন। আমার দিকে ওনার চোখ পড়তে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, ‘সকাল সকাল বাড়ি এসে ছাদ দখল করে নিয়েছিস অলরেডি। কী ব্যাপার? বাড়ি দখলের পরিকল্পনা করছিস নাকি?’
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলাম ওনার দিকে। বাড়ি ডেকে এনে এরকম অপমান? সেরকম পরিচিত হলে দিতাম অবস্থা খারাপ করে। আমায় এখনো চেনেই না। হুহ! আমাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি আবার ওনার সেই বিখ্যাত স্টাইলে ভ্রু বাঁকিয়ে বলেছিলেন, ‘কী? এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? ‘তুই’ করে বলি বলে মাইন্ড করিস নাকি? করলেও আমার কিছু করার নেই। সেই তোর জন্ম থেকে তুই করেই বলি। হঠাৎ করে এখন তুমি বললে হাস্যকর লাগবে। তাছাড়াও তোর মতো পুচকি মেয়েকে তুমি বলব কোন দুঃখে?’
আমি ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে বলেছিলাম,
‘ আমি কী আপনাকে বারণ করেছি?’
‘ না তা করিস নি।’
‘ তাহলে?’
উনি কিছু বলবেন তার আগেই বৃষ্টি নামতে শুরু করে দিয়েছিল। ভিজে যাবো তাই আমি দৌড়ে নিচে যেতে নেব উনি ঝট করেই আমার হাত ধরে ফেললেন। আমি চোখ মুখ কুঁচকে ওনার দিকে তাকাতেই উনি বলেছিলেন, ‘কতদিন যাবত গোসল করিস না তার ঠিক নেই। এই বাহানায় গোসল সেরে নে। একদম প্রাকৃতিক শাওয়ার। ওয়াশরুমে পাবিনা।’
উনি কথা শেষ করতে করতে ইতিমধ্যে আমরা দুজনেই ভিজে গেছিলাম। আমি কটমটে চোখে তাকিয়ে ছিলাম ওনার দিকে। পুরো ভিজিয়ে ছেড়েছিল আমাকে। উনি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে হেসে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার ইচ্ছে করছিল তার দাঁতগুলোই ভেঙ্গে দেই। আমি আগেই বলেছি আমি বৃষ্টিবিলাসী। তাই একটুপর আমারও ভলোলাগছিল এই বৃষ্টি। সব ভুলে নিজের মতো করে বৃষ্টি উপভোগ করতে শুরু করে দিয়েছিলাম। কিন্তু কে জানতো সেটাও উনি মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। বেশ অনেকটা সময় পর ওনার দিকে চোখ পড়তেই বুঝতে পেরেছিলাম উনি হাত ভাঁজ করে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। অদ্ভুত সেই দৃষ্টি। হঠাৎই প্রবল অস্বস্তি ভর করেছিল আমার ভেতরে। এমন অনুভূতি আমার কোনদিনও হয়নি। তাই আর এক মিনিটও না দাঁড়িয়ে নিচে চলে এসেছিলাম। আমার সাথেসাথে উনিও নিচে চলে এসেছিলেন। সবচেয়ে অস্বস্তিকর অবস্থাতো তখন হয়েছিল যখন বাড়ির সবাই আমাদের দুজনকে এরকম একসাথে ভেজা অবস্থায় দেখে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। যেন এলিয়েন দেখছে। রিমা আন্টি মানে আমি যাকে মামণি ডাকি। সে হেসে দিয়ে বলেছিলেন,
‘কীরে দুজন এমন কাকভেজা হলি কীকরে?’
আমি কোনকিছু না ভেবেই বলে ফেলেছিলাম, ‘মামণি তোমার ছেলে আমাকে জোর করে ছাদে আটকে রেখেছিল। তাই ভিজে গেছি।’
উনি হালকা রাগী চোখে তাকিয়েছিলেন আমার দিকে। মামণি ওনার পিঠে হালকা করে একটা থাপ্পড় মেরে বলেছিলেন,
‘এভাবে ভিজিয়েছিস কেন মেয়েটাকে? সবাই কি তোর মত পাগল সময় অসময়ে বৃষ্টিতে ভিজবে? ওর জ্বর আসলে?’
উনি ইনোসেন্ট চেহারা করে আন্টির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে আমার দিকে আবারও রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে চলে গিয়েছিলেন নিজের রুমে। আমাকেও যেতে হয়েছিলো চেঞ্জ করার জন্য। সেদিন জাবিনের একটা জামা পরেই কাটিয়েছিলাম। সেসব দিনের কথা মনে পড়লে আজও কেমন একটা লাগে। কীসব উদ্ভট কান্ড করেছিলাম দুজনে। কী লজ্জার ব্যপার!
[ দু-একজন অনি আর আদ্রিয়ানের বর্তমানে কী হচ্ছে জানতে বেশি আগ্রহী। কিন্তু বর্তমানে যা হচ্ছে সেটা জানতে হলে আগে অতীত জেনে নেওয়াটা ভালো। তাহলে বর্তমানটা আরও ভালোভাবে অনুভব করতে পারবেন। দ্রুতই অতীত শেষ করে বর্তমানে চলে আসব। একটু ধৈর্য্য রাখুন! আর হ্যাঁ সবাই অবশ্যই রেসপন্স করে যাবেন। ]