অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ১৮
সূর্য এখনো দিগন্তের নিচে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যের দেখা পাওয়া যাবে। ধূসর রঙের আকাশে মৃদু লালচে আভা ছড়িয়ে পড়েছে। কেটে যাচ্ছে সব অন্ধকার। শুনেছি ভোর হতে দেখলে না-কি মন ভালো হয়ে যায়। রাতের আঁধারের সাথে সাথে মনের সমস্ত আঁধারও দূর হয়ে যায়। কিন্তু আমার মন ভালো হলোনা। আঁধারও কাটল না। আদ্রিয়ান ভাইয়ের করা অপমানগুলো হজম করতে করতেই ছাদ থেকে নেমে এসেছি। অন্যমনস্কভাবে হেঁটে জাবিনদের ঘরের বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়ালাম। ভোর দেখতে দেখতে নিজের মনেই অসংখ্য সমীকরণ মেলানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু কিছুই মিলল না। সকল সুত্রই নাকোচ ঘোষিত হলো। অমীমাংসিত সেই সমীকরণ মেলাতে গিয়ে সব অনুভূতিগুলো ভোতা মনে হচ্ছে। মস্তিষ্ক ঠিকভাবে কাজ করছে না। আদ্রিয়ান ভাইয়ের বলা প্রতিটা কথা এখনো কানে বাজছে। প্রতিটা শব্দের ধার অনুভব করে কেমন ঝিম ধরে যাচ্ছে সারা শরীর। অদ্ভুত অনুভূতি।
সূর্য উঁকি দিতে শুরু করেছে। কেন জানি সূর্যদয় সহ্য হলোনা। আর বারান্দায় থাকতে ইচ্ছা করল না। রুমে গিয়ে দেখলাম জাবিন, সারা এখনো ঘুমোচ্ছে। আমি ধীর পায়ে হেঁটে বসার ঘরে চলে গেলাম। জানালা সব বন্ধ। ঘরটা অন্ধকার। আমি সোফায় গিয়ে বসলাম। নিজের অজান্তেই চোখ চলে গেল ছাদের সিঁড়ির দিকে। আলোর উপস্থিতি জানান দিচ্ছে ছাদের দরজা খোলা। তারমানে এখনো ছাদেই আছেন উনি। একটাবারও ওনার মনে হলোনা, গিয়ে দেখি মেয়েটা কেমন আছে। সত্যিই মনে হলোনা! উনিতো জানতেন উনি আমার কাছে কী। সবাই জানে আমাকে কাঁদানো সহজ না। কিন্তু এটা খুব কম লোকই জানে যে, ওনার সেই ক্ষমতা আছে। খুব অল্পেই কাঁদিয়ে ফেলতে পারেন উনি আমায়। আর সেটা ওনার অজানা নয়। ওনার বলা প্রতিটা শব্দ যে আমাকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে সেটা আমার চেয়েও ভালো উনি জানেন। আমার মনকে আমার চেয়েও ভালো উনি বোঝেন। সেটাইতো জানতাম এতোদিন। তবুও এলেন না? ওনার গায়ে জ্বালা ধরানো অদ্ভুত কথাবার্তা দিয়ে আমার মন ভালো করলেন না? সত্যিই এলেন না?
অদ্ভুতভাবে আমার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটলো। কেন হাসলাম নিজেও জানিনা। কিন্তু হাসলাম। খেয়াল করলাম বুকের ভেতরটা ভীষণ ভারী মনে হচ্ছে। অসহ্য চিনচিনে এক ব্যথা হচ্ছে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। হাত দিয়ে বুকের বাঁ পাশটা চেপে ধরে লম্বা একটা শ্বাস নিলাম। গা’টা কেমন গুলিয়ে উঠল। কিন্তু আমার ঠোঁটের কোণ থেকে হাসিটা সরল না। এমন অদ্ভুত হাসি হয়তো এর আগে কোনদিন হাসিনি আমি। সোফায় হেলান দিয়ে গা ছেড়ে দিলাম। বন্ধ করে ফেললাম চোখজোড়া। সমীকরণ বোধ হয় মিলল। দীর্ঘক্ষণের হিসেব নিকেশের পর বুঝতে পারলাম, আমি পুরোনো হয়ে গেছি। চার বছর! দীর্ঘ সময়। মানুষতো কয়েকমাসেই হাঁপিয়ে ওঠে। বছর সমাপ্ত হয়না, কিন্তু সম্পর্কের ইতি টানতে হয়। সেখানে চারবছর তো অনেক। হয়তো আমার ওপরেও এখন উনি বিরক্ত। হাঁপিয়ে উঠেছেন নিশ্চয়ই। কিন্তু ছেড়ে দিতে চাইলেই তো হুট করে ছেড়ে দেওয়া যায়না। এতোদিন ছেড়ে যাওয়ার সেই কারণটাই খুঁজছিলেন। আর আজ যখন কারণ পেয়েছেন, তখন সেটাকে আর হাতছাড়া করতে চাইছেন না। নয়তো ছোট্ট বিষয়টাকে উনি এতোটা বড় করতেন না। এইটুকু অপরাধের জন্যে অন্যকারো সামনে আমাকে এভাবে অপমান করতে পারতেন না। সস্তা বলতে পারতেন না। উনি জানেন এরপর আমি আর কোনদিন এমুখো হবোনা। কিছুতেই না। আর উনিও সেটাই চান। উনি চান আমি ওনাকে ছেড়ে চলে যাই। সত্যিই তাই হবে। আজকের পর ওনার সঙ্গে কোনরকম যোগাযোগ করার মতো ভুল আমি করব না আমি। এখনই বাইরে গাড়ি পাবোনা। চারদিক আরেকটু ফর্সা হলেই আমি চলে যাব। আর কোনদিন এ বাড়িতে পা রাখব না। একদমই না। কথাগুলো চিন্তা করতে করতেই বন্ধ চোখের কার্ণিশ বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। দু হাতের তালু দিয়ে মুছে ফেললাম সেই অশ্রুধারা। সঙ্গেসঙ্গেই মনটা হালকা হয়ে গেল। মস্তিষ্ক ঠান্ডা হলো। সারা শরীর জুড়ে অকারণ শান্তি অনুভব করলাম।
মৃদু ঝাঁকি খেয়ে জেগে উঠলাম আমি। রাতে ঘুম হয়নি। সোফার মধ্যেই কখন চোখ লেগে এসেছিল বুঝতে পারিনি। ভালোভাবে চারপাশে চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম জানালা খুলে দেওয়া হয়েছে। সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে বসার ঘর জুড়ে। কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম কে জানে? চোখ কোচলে উঠে দাঁড়াতে নিজের অজান্তেই আদ্রিয়ান ভাইয়ের রুমের দিকেই চোখ চলে গেল। দরজাটা এখন ভেড়ানো। আমি তপ্ত শ্বাস ফেললাম। চলে যেতে হবে আমাকে। আর সেটা এক্ষুনি। কিন্তু কাব্যতো এখান থেকেই স্কুলে যাবে। সে অনুযায়ী-ই ড্রেস নিয়ে এসছে। সামনের স্টপেই আসবে স্কুলের বাস। তারমানে আমাকে একাই ফিরতে হবে। দেরী করে লাভ নেই।
জাবিনের ঘরে গিয়ে দেখলাম শোভা আপু বিছানায় হেলান দিয়ে ফোন স্ক্রোল করছে। জাবিন তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছছে। সারা বোধ হয় ফ্রেশ হচ্ছে। রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মামণি আছেন ওখানে। আমি ওড়নার নিচে হাতটা লুকিয়ে রান্নাঘরে গেলাম। মামণি চা বসিয়েছেন। আমায় দেখে বললেন, ‘উঠেছিস? সোফায় শুয়ে ছিলি কেন? তোকে ঘুমে দেখে আমি আর ডাকলাম না। চোখ-মুখ এমন হয়ে আছে কেন? রাতে ঘুমোতে সমস্যা হয়েছে মা?’
আমি একটু হেসে বললাম, ‘না, সমস্যা হয়নি। ভোর ভোর ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিল তাই একটু একটু হাঁটাহাঁটি করে সোফায় শুয়েছিলাম। কখন ঘুমিয়ে গেছি খেয়াল নেই।’
‘মুখটা কেমন শুকনো লাগছে। খিদে পেয়েছে না? আচ্ছা ভালোভাবে ফ্রেশ হয়ে বস। আমি চা-বিস্কুট দিচ্ছি।’
বলে মামণি আবার কাজে মন দিলেন। আমি কয়েক সেকেন্ড ইতস্তত করে বললাম, ‘মামণি আমি চলে যাচ্ছি। আঙ্কেল বোধ হয় ওঠেনি এখনো। উঠলে বলে দিও হ্যাঁ।’
মামণি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘মানে? সবে সকাল হল। চলে যাচ্ছি আবার কী?’
‘না আসলে কাব্যতো এখান থেকেই স্কুলে চলে যাবে। বেলাও হয়েছে, আর বাড়িতেও কাজ আছে আমার একটু। তাই ভাবছি এখনই বেরিয়ে পড়ি।’
মামণি চা পাতি দিতে দিতে বললেন, ‘চ/ড় চেনো? এক চ/ড়ে কান লাল করে দেব। তুমি এখন এই সকালবেলা একা একা বের হবে না? আর আমি তোমাকে ছাড়বো? চুপচাপ নাস্তা করবি। এরপর আদ্রি বাইকে করে দিয়ে আসবে। কোন বাড়তি কথা শুনবো না।’
আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। মামণি চোখ গরম করে বললেন, ‘আবার কথা বলে! চুপচাপ গিয়ে বসো। আমি আপাতত চা আর বিস্কুট দিচ্ছি। সেটা খাও। যাও!’
আর কী বলব। আমি গোমড়া মুখ করে ফিরে আসছিলাম মামণি বললেন, ‘এই দাঁড়া। হাত এভাবে ওড়নার নিচে লুকিয়ে রেখেছিস কেন?’
আমি হকচকিয়ে গেলাম। কোনরকম ইতস্তত করে বললাম, ‘কই? কিছুইনা। তুমি চা হলে আমাকে ডেকে দিও।’
বলে কোনরকমে পালাতে চাইলাম। কিন্তু পারলাম না। মামণি শাসনের সুরে বলে উঠলেন, ‘দাঁড়া।’
আমি দাঁড়ালাম। মামণি গ্যাসটা অফ করে আমার কাছে এসে বললেন, ‘দেখি হাতটা বের কর।’
আমি হাত বের করব সেই অবধি অপেক্ষা করলেন না মামণি। নিজেই আমার হাতটা বের করে আঁতকে উঠলেন। অবাক হয়ে বললেন, ‘ব্যান্ডেজ কেন? কী হয়েছে?’
মামণিকে মিথ্যা বলতে পারব না। তাই জাবিনের মতো মামণিকেও অর্ধসত্যিটা বললাম যে দরজায় চাপা লেগেছে। আর জাবিন ঔষধ লাগিয়ে দিয়েছে সেটাও বললাম। মামণি কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘কা/টা ঘা নিয়ে এতক্ষণ বসে ছিলি? ফাজিল মেয়ে! ইচ্ছে করছে দেই এক চ/ড়।’
‘ভেবেছিলাম অযথাই চিন্তা করবে তোমরা।’ গোমড়া মুখ করে বললাম আমি।
‘তাতো ভাববেই। পাকা বুড়িতো তুমি। জাবিন ভালোভাবে ঔষধ লাগিয়েছে তো?’
‘হ্যাঁ, চিন্তা করোনা। একদম ঠিক আছি আমি।’
এরমধ্যেই আদ্রিয়ান ভাই এলেন রান্নাঘরে। আমার দিকে বিন্দুমাত্র দৃষ্টিপাত না করে মামণিকে বললেন, ‘আরেক কাপ কফি দিও আমায়।’
উনি ফিরে যেতে নিলে মামণি বললেন, ‘তুই ঘুমোস নি? কাল রাত চারটায় দেখেছি তোর রুমে আলো জ্বলছে। ভোরবেলায়ও ছাদে ছিলি। তোকে বললাম রুমে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নে। শুনছিস না। কী সমস্যা তোর? এভাবে শরীরটাকে শেষ করবি না-কি? চোখ মুখের অবস্থা দেখেছিস?’
উনি ঘুরে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললেন, ‘তোমাকেতো বললাম দু সপ্তাহ একটু প্রেশার যাবে। এরপর ফ্রি আছি। তখন ঘুমিয়ে পুষিয়ে নেব। চাপটা বেশি পড়ছে। এইটুকুই আর কিছু না।’
মামণি বিরক্ত হয়ে সশব্দে কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, ‘আর কিছু হলেও তুমি কাউকে সেটা টের পেতে দেবে, সেই সৌভাগ্য কী আমার আছে, বাবা? পেয়েছিও কপাল করে একখান ছেলে। সবাই বলে রত্ন! রত্নের যে কী ধার সেতো কাছে যারা থাকে তারা জানে।’
উনি ব্যপারটা এড়িয়ে গিয়ে বললেন, ‘ও হ্যাঁ। আমার ঘর থেকে ফার্স্ট এইড বক্সটা কে নিয়েছে দেখেছো? পাচ্ছিনা কেন? ওটার মধ্যে একটা কেঁচি ছিল। সেটা লাগবে আমার।’
মামণি হতাশ কন্ঠে বললেন, ‘জাবিনের রুমে পাবি। দেখনা, কালকে দরজায় লাগিয়ে হাত কেটে ফেলেছে। কাউকে বলেও নি। কতটা কে/টেছে কে জানে?’
না চাইতেও আমার চোখ ওনার দিকে চলে গেল। উনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন আমার হাতের দিকে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কিছু চিন্তা করছেন। হাত থেকে চোখ সরিয়ে উনি আমার দিকে তাকাতেই আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে নিলাম। ব্যস্ত কন্ঠে বললাম, ‘মামণি আমি গেলাম।’
‘দাঁড়া, চা আর বিস্কুট-টা নিয়ে যা। আর আদ্রি ব্যান্ডেজটা খুলে দেখতো কতখানি কে/টেছে? জাবিন কতোটা কী করতে পেরেছে কে জানে? মেয়ে আবার পাকামি করে কা/টা হাত নিয়ে বসে ছিল।’
আমি সঙ্গেসঙ্গেই বললাম, ‘আমি বাড়ি গিয়েই একবার মজিবর আঙ্কেলকে দেখিয়ে আসব মামণি। তুমি চিন্তা করোনা।’
মামণি বললেন, ‘ও একটু দেখে দিলে কী সমস্যা?’
কিছুক্ষণের জন্যে লোক, পরিস্থিতি ভুলে গেলাম আমি। মৃদু হেসে বললাম, ‘ইঞ্জিনিয়ার মানুষদের ভরসা করতে পারিনা মামণি। মেশিন নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে এরা মানুষকেও মেশিন মনে করে। ভাবে, ভাঙবে আবার জোড়া লাগাবে, আবার ভাঙবে কিন্তু ব্যথা লাগবে না। দেখা গেল বাকি ভালো আঙুল দুটোও কে/টে দিল।’
মামণি হেসে ফেললেন। ব্যস্ত হাতে চা আর বিস্কুট রেডি করতে করতে বললেন, ‘ একে অপরের পেছনে লাগার অভ্যাসটা তোদের যাবেনা, না?’
আমি উত্তর দিলাম না। ওগুলো নিয়ে বসার ঘরে চলে এলাম। কিন্তু না তাকিয়েও বুঝতে পারছিলাম পুরোটা সময় আদ্রিয়ান ভাই আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কেন? আমার মতো সস্তা মেয়েকে এভাবে তাকিয়ে দেখার কী আছে?’
সোফায় বসে চুপচাপ চা বিস্কুট খাচ্ছি। দেখলাম আদ্রিয়ান ভাই জাবিনের রুমে ঢুকলেন। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলেন। হাতে সেই ফার্স্ট এইড বক্স। আমি ওদিকে আর মনোযোগ দিলাম না। চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। কিন্তু উনি এসে আমার পাশে বসতেই ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলাম আমি। কিন্তু বাইরে থেকে কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। একদম স্বাভাবিক ভাবেই গরম চায়ে ফুঁ দিচ্ছি। উনি গম্ভীর কিন্তু শান্ত গলায় বললেন, ‘কতটা কে/টেছে?’
আমি উত্তর দিলাম না। যেন শুনতেই পাইনি। উনি আবার বললেন, ‘ব্যথা আছে এখনো?’
কান্না পেলো আমার। ভীষণ কান্না পেল। কিন্তু কাঁদলাম না। বাইরে থেকে প্রতিক্রিয়ার কোন পরিবর্তন হলোনা আমার। উনি এবার কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘আ’ম টকিং টু ইউ।’
এবারেও আমার কোন উত্তর না পেয়ে আমার হাতটা ধরে দেখতে গেলেন উনি। হাত বাড়াতে বাড়াতে বলছিলেন, ‘আমি তখন খেয়া_’
কিন্তু উনি ধরার আগেই আমি হাতটা সরিয়ে নিলাম। উনি থমকালেন। আমি ঝট করে উঠে দাঁড়লাম, কাপ-প্রিচ হাতে নিয়েই। ওনার দিকে একবারও না তাকিয়ে হনহনে পায়ে জাবিন আর সারার ঘরটাতে চলে এলাম। বুঝতে পেরেছিলাম উনি আমার যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে আছেন। কিন্তু ফিরে তাকানোর ইচ্ছে বা প্রয়োজন কোনটাই বোধ করলাম না আমি।
ন’টার সময় সবাই একসঙ্গে খেতে বসল। জাবিন, সারা স্কুলের জন্যে রেডি হয়েছে। আমি ওদের সাথেই এসে বসলাম। এসে দেখি কাব্য, শাওন ভাইয়া, শোভা আপু, ওনার ছোট ভাই সবাই বসে গেছে। মানিক আঙ্কেল কিছুক্ষণ আগে খেয়ে বেরিয়ে গেছেন। কিছুক্ষণ পর আদ্রিয়ান ভাই এলেন। উনি চেয়ার টেনে বসতেই শাওন ভাই বললেন, ‘কী হয়েছে তোর? কাল থেকে দেখছি পেঁচার মতো মুখ করে রেখেছিস। আর এই গরমের মধ্যে হ্যান্ড গ্লাভস পড়েছিস কোন দুঃখে? তাও এক হাতে!’
আদ্রিয়ান ভাই জবাব দিলেন না। তাই কেউ আর কোন কথা বাড়াল না। খাওয়ার মাঝেই মামণি বললেন, ‘শোন আদ্রি, বাইকটা টেনে অনিকে একটু বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে আসিস তো বাবা।’
উনি কোন জবাব দিচ্ছেন না। চুপচাপ খাচ্ছেন। আমি বললাম, ‘তার দরকার নেই মামণি। মেইনরোডে উঠলেই প্রেমতলার অটো পাওয়া যায়। ওখান থেকে জাজিরার অটো অহরহ। আমি যেতে পারব।’
মামণি বললেন, ‘সে আমি জানি। ওর দিয়ে আসতে সমস্যা কী? বাড়িতেই তো আছে।’
‘হ্যাঁ কিন্তু দেখতেই তো পাচ্ছো কত ব্যস্ত। শুধুশুধুই তার ঝামেলা বাড়ানোর কী দরকার?’
টেবিলে শব্দ করে দু হাত রেখে উঠে দাঁড়ালেন উনি। রেগে গিয়ে বললেন, ‘তোমাদের এতো নাটক কিন্তু আমার সহ্য হচ্ছেনা আম্মু। বাড়িতে একটু শান্তিতে থাকার ওয়ে নেই। এখন মনে হচ্ছে ফিরে যাওয়ার ডেটটা পিছিয়ে ভুল করেছি। এ মাসে গেলেই ভালো হতো। ইনফ্যাক্ট দেশে আসাই উচিত হয়নি আমার। এ সপ্তাহে কোর্সটা শেষ হলেই উত্তরা চলে যাব। ইউকে যাওয়ার আগ অবধি ওখানেই থাকব। এটলিস্ট শান্তি আছে ওখানে। রোজ নতুন নতুন নাটক নেই।’
বলে খাবার রেখেই চলে গেলেন উনি। মামণি দু’বার ডাকলেন কিন্তু উনি শুনলেন না। সশব্দে বন্ধ করে দিলেন ঘরের দরজা। মামণি চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘কী হয়েছে, কে জানে? মুখ ফুটে কিছু বলেও না। রেগে গেলে এমনই উল্টাপাল্টা কাজ করে। তুই কিছু মনে নিস না। ও এমনই।’
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস চাপলাম। সেটা আমার চেয়ে ভালো কে জানে?
কাব্য, জাবিন আর সারার বাস সাড়ে ন’টায় ছিল। তাই ন’টা বিশেই বেরিয়ে গেছে ওরা। আমি তৈরী হয়ে দশটায় বের হলাম। বসার ঘরে এসে দেখি মামণি, শোভা আপু, শাওন ভাইয়া তিনজনেই অপেক্ষা করছে। মামণি বললেন, ‘দাঁড়া। আদ্রিয়ান আসছে। ঐ দিয়ে আসবে তোকে।’
আমি কিছু বলতে গিয়েও আদ্রিয়ান ভাইকে বেরিয়ে আসতে দেখে থেমে গেলাম। টিশার্ট আর জিন্স পড়ে তৈরী হয়ে নিয়েছেন। আমি সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে মামণিকে গিয়ে সালাম দিলাম। উনি বরাবরের মতোই আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন। শাওন ভাইয়াকে ‘বাই’ বললাম। বের হওয়ার আগে শোভা আপুও একবার জড়িয়ে ধরল আমাকে। আমি মৃদু হাসলাম।
আদ্রিয়ান ভাই আর আমি একসঙ্গেই বাইরে বেরিয়ে এলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘রাস্তায় গিয়ে দাঁড়া। আমি বাইক বের করছি।’
আমি তাই করলাম। কিন্তু মনে চলছে অন্যকিছু। রাস্তায় গিয়েই তাকিয়ে অটো খুঁজলাম। ভাগ্যক্রমে অল্প সময়ের মধ্যে পেয়েও গেলাম। হাত বাড়াতেই আমার সামনে এসে থামল অটোটা। ততক্ষণে বাইক নিয়ে বেরিয়েছেন আদ্রিয়ান ভাই। আমি সেদিকে না তাকিয়ে দ্রুত অটোতে উঠে বসে বললাম, ‘চলুন।’
অটো ছেড়ে দিল। ঘাড় ঘুরিয়ে ওনার প্রতিক্রিয়া দেখার ইচ্ছেটাও হলোনা আমার। চাইনা দেখতে। ভাগ্যিস ব্যাগে টাকা ছিল। তপ্ত শ্বাস ফেলে বাইরে তাকালাম। অটো নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। কিছুদূর যাওয়ার পর ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করলাম। আদ্রিয়ান ভাইয়ের কল এসেছিল। কয়েকবার। সাইলেন্ট ছিল বলে টের পাইনি। আমি সময় নষ্ট না করে ব্লক করে দিলাম ওনার নাম্বারটা। সবজায়গা থেকে। বাড়ি গিয়ে বাবাকেও বলতে হবে, উনি যেন আমাকে আর পড়াতে না আসেন। আমি বললে বাবা অমত করবেন না। সেটা আমি জানি। সবদিক থেকে ওনার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেব আমি। আমাকে জীবন থেকে ছুড়ে ফেলে দেওয়ার সুযোগ আমি ওনাকে দেবনা। আমাকে চলে যেতে বলে, নতুন করে অপমান করার জায়গাটাই আর রাখব না। তার আগে আমি নিজেই সরে যাবো। অনেক দূরে সরে যাবো।
…
[ রি-চেক করিনি। ]