অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ২২
আমার জীবনের অন্যতম প্রিয় মানুষ ছিলেন আমার নানাভাই। গোষ্ঠীর একমাত্র আদরের দুলালী হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল ওনারই। আমি একটু ফুঁপিয়ে উঠলেই তেঁতে উঠতেন নানাভাই। কিছু চাওয়ায় আগেই সবকিছু সামনে এনে রাখতেন। একবার আনারস খেয়ে বমি করে ভাসিয়ে দিলাম আমি। সেইদিনের পর যতদিন বেঁচে ছিলেন কোনদিনও আনারস কেনেননি নানাভাই। এতো ভালোবাসার মাঝেও ওনার সঙ্গে ঝগড়া খুনশুটি লেগেই থাকতো আমার। উনি শুতে গেলে বালিশ সরিয়ে দেওয়া। পকেট থেকে সব টাকা নিয়ে যাওয়া। চায়ে চিনি ঢেলে দেওয়া। এগুলো আমার ডেইলি রুটিন ছিল।
আমি তখন ক্লাস ওয়ানের ছাত্রী। বছরের শেষ সময় ছিল। নভেম্বর মাসের চার তারিখ। ঐ সময়টাতেই নানাভাই চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে। তারপর থেকে নানাভাইয়ের ঘরটা বহুবছর ফাঁকা পড়ে আছে। নানুও থাকেনা আর ঐ ঘরে। মাঝেমাঝে টুকটাক পরিষ্কার করা হয় এই আরকি। আর আমি বছর দু একবার কোন এক উপন্যাস বা সায়েন্সের বই নিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকি সেই ঘরে। নানাভাই চলে গেলেও সবার আমায় মাথায় তুলে রাখার স্বভাবটা গেল না। নিজে চলে গেলেও রেখে গেলেন অতি আহ্লাদী, জেদী, স্বেচ্ছাচারী এক মেয়েকে।
আগামীকাল ঈদ। আজ আমার হঠাৎই নানাভাইয়ের কথা মনে পড়ল। আমার বেড়ে ওঠা নানা বাড়িতেই। বাবা-মা দুজনেই চাকুরীজীবি হওয়াতে নানাবাড়িতেই রেখে যেতেন আমাকে। নানাভাই যখন বেঁচে ছিলেন, এই দিনটাতে চাঁদ উঠলেই সবার আগে দৌড়ে নানাভাইর ঘরে যেতাম আমি। নানাভাই তারবাতি নিয়ে আসতেন আমার জন্যে। চাঁদ দেখা যাওয়ার আগে দিতেন না। সব জ্বালিয়ে ফেলব বলে। আজ কথাগুলো খুব মনে পড়ছে তাই নানাভাইর ঘরে চলে গেলাম বিকেলবেলা। ঘরের জানালার পাশে খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলাম। কতক্ষণ কেটে গেছে জানিনা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বুঝলাম সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আযান দেবে। এক্ষুনি ডাক পড়বে ইফতারের জন্যে। আমি তপ্ত শ্বাস ফেলে বেরিয়ে এলাম ঘরটা থেকে। ডাইনিং এ গিয়ে দেখি সবকিছুই প্রায় রেডি। আমাকে দেখে আম্মু বলল, ‘চলে এসছো সোনা মা? তোমাকেই ডাকতে যাচ্ছিলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলে?’
আমি একটা হাই তুলে বললাম, ‘ না, বই পড়ছিলাম।’
হিমু হাত দিয়ে পাশের চেয়ার চাপড়ে দিতে দিতে ওর পাশে বসতে ইশারা করল। মুখে দুষ্টু হাসি। আমি গিয়ে সেই চেয়ারটা টেনে বসলাম। ছোটমামা বলল, ‘শোন অনি, নতুন কয়েকটা বই এনেছি। তোর নিয়ে নিয়ে পড়িস যেগুলো ভালো লাগে। আর পছন্দমতো দুটো নিয়ে যাস। দুটো তোর।’
আমি হেসে মাথা নাড়লাম। আর বেশি কোন আলোচনার সুযোগ হলোনা। আযান দিয়ে দিল। ইফতার শেষে দিকে এমন সময় হিমু বায়না ধরল ওর তারাবাতি লাগবে। কিন্তু ছোটমামা কিনে দিতে নারাজ। তারমতে বাচ্চা মানুষ এসব আগুন-টাগুনের জিনিস নিয়ে খেলবে কেন? ছোটমামাকে রাজি করাতে না পেরে হিমুর সে-কি কান্না। ওর হাত-পা ছোড়া কান্না দেখে সবাই মিলে ছোটমামাকে কনভেন্স করার অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু কোন লাভ হলোনা। কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি উঠে গেল বেচারীর। কিন্তু মামা মানলেন না।
এরপর প্রায় এক ঘন্টার মতো কেটে গেল। ছোট মামী, রুমানা আর সৃষ্টি ভাবী, মলি আপু বসে বসে টিভিতে ঈদের প্রোগ্রাম দেখছে। আমি হিমুকে কোলে নিয়ে বসে আছি। ভাবীরা মেহিদী দিয়ে দেওয়ার কথা বলে কোনভাবে কান্না থামিয়েছে। কান্না থামলেও মন বেজায় খারাপ হয়ে আছে। বড় মামি আর মেঝ মামি রান্নাঘরে। তখনও পরিবেশ মোটামুটি শান্তিপূর্ণই ছিল। কিন্তু সেই শান্তিকে অশান্তিতে পরিণত করে প্রবেশ করল আমাদের বাড়ির বয়েস্ পার্টি। শান্ত, সাম্য আর অর্ণব ভাইয়া। সঙ্গে মোগলাই, চটপটি আর ফুচকা। খাওয়া-দাওয়া, টিভি, আড্ডা একদম জমে উঠল। প্রায় আটটার দিকে সোহেল ভাই আর সজীব ভাই হাজির হলেন। ওনাদের আসাটা স্বাভাবিক বলে তেমন গুরুত্ব দিলাম না। কিন্তু অবাক হলাম তাদের পেছনে আদ্রিয়ান ভাইকে দেখে। পরনে ছাই রঙের পাঞ্জাবী। গোটা রোজার মাসে ওনাকে পাঞ্জাবীতেই দেখেছি আমি। গোটা মাসে তেরোদিন পড়াতে এসেছিল আমাকে। তেরোদিনই পাঞ্জাবী পরেই এসেছিল। তবে আজ টুপি নেই মাথায়। আজ এ বাড়িতে কী করছেন উনি? কাজ নেই না-কি? স্বভাবতই আমার কোল থেকে লাফিয়ে নেমে গেল হিমু। আর দৌড়ে গিয়ে আদ্রিয়ান ভাইয়ের কোলে নিজের আস্তানা করে নিলো। রুমানা ভাবী বলল, ‘ আদ্রিয়ান তোমাকে চা দেব না কফি?’
আদ্রিয়ান ভাই হিমুর চুল নাড়তে নাড়তে বললেন, ‘দুটোই চলে। সবাই যা চায় তাই আনো।’
রুমানা ভাবী আর সৃষ্টি ভাবী কিচেনে চলে গেলেন চা আনতে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে আদ্রিয়ান ভাই তারাবাতির দুইটা প্যাকেট ধরিয়ে দিলো হিমুর হাতে। ওগুলো পেয়ে ওর খুশি আর দেখে কে। পরপর দুটো চুমু খেলো আদ্রিয়ান ভাইয়ের গালে। এরপর সারা রুমজুড়ে দৌড়াতে লাগল। আদ্রিয়ান ভাই হেসে একটা সিঙ্গেল সোফায় বসলেন। ছোট মামি বললেন, ‘ওর বাবা জানলে রাগ করবে কিন্তু।’
উনি হেসে এক পিস মোগলাই সসে ডুবিয়ে বললেন, ‘মামার আসতে রাত দশটা। তার আগেই সব শেষ হয়ে যাবে। এইবয়সে জ্বালাবে না তো আর কবে জ্বালাবে? তবে হিমু, কেয়ারফুল হ্যাঁ?’
বলে মোগলাইর পিসটা মুখে পুড়ে নিলেন। কেউ আর কিছু বলল না। হিমু তারাবাতি জ্বালানোর জন্যে জেদ করলে মামি চোখ রাঙিয়ে বলল, খাওয়া শেষ করে তারপর এসব জ্বালাবে। ইচ্ছা না থাকলেও মেনে নিতে হলো বেচারীকে। এরমধ্যে ভাবীরা চা নিয়ে এলো। মামী, ভাবী, আপুরা মিলে একদম যত্ন করে তুলে তুলে খাওয়াচ্ছে ওনাকে। যেন বাড়ির নতুন জামাই। আর উনিও মহা বিনয়ের সঙ্গে ‘না না’ করেও খেয়ে যাচ্ছেন তো খেয়েই যাচ্ছেন। তারসঙ্গে নানুও এসে যোগ দিলেন। বললেন, ‘এতো আদর কিন্তু আমার জন্যেই পাচ্ছো ছোকরা। দুইমাত্র জামাই আমার। তাই এতো আদর। ভুইলো না।’
আদ্রিয়ান ভাই হেসে দিয়ে বললেন, ‘তা আর ভোলা যায়? আমি তোমার দুইমাত্র জামাই হলেও তুমিতো আমার একমাত্র বউ নাকি?’
‘হো হো’ করে হেসে উঠল সবাই। জোয়ান নাতী-নাতনিদের পেয়ে শরীরের অসুস্থতা ভুলেই গেলেন নানু। আর আমি পায়ে পা তুলে বসে একটা করে ফুচকা মুখে পুড়ছি আর দেখছি এদের তামাশা।
দু হাতে দুটো তারাবাতি জ্বালিয়ে সারা উঠোন জুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে হিমু। ভাইয়ারা সবাই বাইরের সিঁড়ির ওপর বসে আড্ডা দিচ্ছে। আমি আর মলি আপু মাচার ওপর বসে বসে ফোন স্ক্রোল করছি। আপির কথা মনে পড়ছে খুব। কদরের পরের দিনই আপিকে নিয়ে চলে গেছেন রায়হান ভাই। বিয়ের পরের প্রথম ঈদ। শ্বশুরবাড়িতেই করা উচিৎ। কিন্তু আমার ভালো লাগছেনা। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে সব। কিন্তু গেইটের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম আপি ঢুকছে। প্রথম কয়েক সেকেন্ড বোকার মতো তাকিয়ে ছিলাম আমি। এরপরই দৌড়ে গিয়ে জাপটে ধরলাম আপিকে। আপিকে নিয়ে দু চক্কর ঘুরতেই আপি জোর করে আমাকে থামিয়ে দিল। এরপর হাপাতে হাপাতে পেটে হাত দিয়ে বলল, ‘পাগল নাকিরে তুই? এখন আমি ওভাবে ঘুরতে পারি।’
তখন আমার খেয়াল হলো আপি প্রেগনন্ট। তাড়াতাড়ি এক কানে হাত দিয়ে ফিসফিসিয়ে ‘সরি’ বললাম। তারপর গেইট দিয়ে হালকা উঁকি দিয়ে বললাম, ‘রায়হান ভাই আসেনি?’
‘রায়হান আর আনভীর ভাইয়া এসেছে। একটু দোকানে গেছে। চলে আসবে এক্ষুনি।’
আপি আসায় ষোল কলা পূর্ণ হয়ে গেল। আপিকে নিয়ে মাচায় বসলাম। রুমানা ভাবী আর সৃষ্টি ভাবীও চলে এলো কাজ সেড়ে। এদিকে হিমু একের পর এক তারাবাতি জ্বালিয়েই চলেছে। এতক্ষণ ইচ্ছে না করলেও এবার আমারও ইচ্ছে করছে জ্বালাতে। হয়তো মনটা ফুরফুরে আছে তাই। আমি মাচা থেকে নেমে হিমুর কাছে গেলাম। ওখান থেকে দু হাতে দুটো তারাবাতি জ্বালালাম। সেটা দেখে হিমু আরও মজা পেলো। আরও জোরে জোরে লাফাতে শুরু করল ও। ওর সাথে সাথে আমিও বাচ্চা হয়ে গেলাম। হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সার্কেল আঁকা, আরও বিভিন্ন শেপ তৈরী করতে বেশ আনন্দ লাগছে। দুজনেই উচ্চস্বরে হাসছি। এসব করতে করতেই চোখ পড়ল ঘরের ঘরের দরজার সিঁড়ির দিকে। আদ্রিয়ান ভাই সিঁড়ির দেয়ালে হেলান দিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ভাইয়াদের আড্ডায় তার কোন মনোযোগ নেই। সেটা দেখে আপনাআপনি থেমে গেলাম আমি। তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। উনিও তাকিয়ে আছেন। অদ্ভুত দৃষ্টিতে। আমার কী হয়েছিল জানিনা। চেষ্টা করেও চোখ সরাতে পারছিলাম না ওনার চোখ থেকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে হাতের তারাবাতি দুটো নিভে গেল। আমিও চোখ সরিয়ে নিলাম তার থেকে। নতুন আর জ্বালালাম না। কাঠি দুটো ফেলে লক্ষ করলাম রায়হান ভাই আর আনভীর ভাইয়াও দাঁড়িয়ে আছে। আমি দৌড়ে গেলাম রায়হান ভাইয়ের কাছে। ভাইয়া হেসে একহাতে আমাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ কী? বোনকে পেয়ে মন ভালো হয়েছে? তোর জন্যেই নিয়ে এলাম ওকে। মা-তো এই অবস্থায়, এইসময় বের হতে দিতে রাজি হচ্ছিল না।’
আনভীর ভাইয়া রায়হান ভাইর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘সেই! রাজি করাতে বহু কষ্ট করতে হয়েছে আমাদের।’
আমি কিছু বললাম না। ওনাদের নিয়ে ভেতরে এলাম। ওনারা দুজন সিঁড়ির কাছে ভাইয়াদের ওখানে চলে গেল। আর আমি এদিকে মাচার এসে বসলাম আপুদের কাছে। সেখানে গিয়ে বুঝলাম আদ্রিয়ান ভাইকে নিয়েই আলোচনা চলছে। মলি আপু বলছে, ‘আদ্রিয়ান ছেলেটা অদ্ভুত তাইনা। এমন ছেলে সত্যিই দেখা যায় না।’
সৃষ্টি ভাবী বলল, ‘সত্যি! আমি প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম এ বাড়িরই ছেলে হয়তো। আমার কোন দেবর হবে। কিন্তু পরে জানলাম বড়কাকার পরিচিত ওরা। আর হাসান আঙ্কেলের ছোটবেলার বন্ধু ওনার বাবা। দেখো, আজকের দিনটাতেও এখানে একটু সময় কাটাতে চলে এলো।’
আপি বলল, ‘ হ্যাঁ। যেমন মেধাবী। তেমনই দায়িত্বশীল। বেশ রগচটা হলেও মন ভালো। কেমব্রিজের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে। তবুও কোন অহংকার নেই। কখনও এসব জাহির করতেও দেখিনি।’
রুমানা ভাবী বলল, ‘ওর মতো একটা ছেলের সাথে পরিচয় আছে ভাবলেও কেমন ভালো লাগে। বাড়ির কেউ না। অথচ বাড়িতে এলেই মনে হয় এতক্ষণে ঘর পূর্ণ হলো। আশ্চর্য ছেলে! কোরবানির পরতো আবার ফিরে যাবে ইউকে। তারপর ফাঁকা ফাঁকা লাগবে সবটা।’
আমি বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম ওদের দিকে। এরা সবাই ওনার নামে দু ঢোক বেশি পানি খায় আমি জানি। কিন্তু তাই বলে এতো! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে তাকালাম ওনার দিকে। ভাইয়াদের সাথে কথা বলছেন, হাসছেন। কী চমৎকার দৃশ্য! হৃদয়গ্রাসী হাসি। কী স্পেশাল আছে এই ছেলের মধ্যে যে সবাই গলে যায়!
ঠিক পনেরো বিশ মিনিট পর আমাকে ডাকল আনভীর ভাইয়া। কেন জানিনা আনভীর ভাইয়ার ডাক শুনে আমার চোখ ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের দিকেই গেল। তাকিয়ে দেখলাম উনিও তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। আমি একটু ইতস্তত করে গেলাম আনভীর ভাইয়ার সাথে। গেইটের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন আনভীর ভাইয়া। আমিও দাঁড়ালাম। উনি পকেট থেকে একটা ছোট কাগজের প্যাকেট বের করলেন। আমি ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। উনি প্যাকেট থেকে দুটো কানের দুল বের করে আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘তোমার জন্য। ঈদের গিফ্ট। চলে যাচ্ছি এখন তাই_’
আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম দুলের দিকে। তারপর মুচকি হেসে বললাম, ‘বাড়ির সবার জন্যেই গিফ্ট এনেছেন?’
আনভীর ভাইয়ের মুখের হাসিটা মিলিয়ে গেল। খানিকটা ইতস্তত করে বললেন, ‘ না, সবার জন্যে আনা হয়নি। আসলে..’
আমি সঙ্গেসঙ্গে বললাম, ‘সরি ভাইয়া। আমি একা স্পেশালভাবে কোন উপহার আপনার কাছ থেকে নিতে পারব না। কারণ আপনার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা বাড়ির বাকি সবার মতোই। স্পেশাল কিছু না।’
আমার এমন সোজাসাপ্টা কিন্তু তিক্ত জবাবে মুখ কালো হয়ে গেল আনভীর ভাইয়ার। জোরপূর্বক মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘কালকে সবার জন্যে নিয়ে আসব।’
‘ আমাকেও তাহলে কালকেই দেবেন।’
কথাটা বলে আর দাঁড়ালাম না। আপুদের কাছে চলে এলাম। আপুরা জিজ্ঞেস করল, কেন ডেকেছিল। কিন্তু আমি এড়িয়ে গেলাম কোনমতে। কিন্তু সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে আদ্রিয়ান ভাইকে আর দেখতে পেলাম না। চোখে চোখে কয়েকবার খুঁজেছিলাম তাকে। কিন্ত সে রাতে আর তার দেখা পাইনি। পরে শুনেছিলাম চলে গিয়েছিলেন।
পরেরদিন ঘুম থেকে উঠেই দেখলাম ঝুম বৃষ্টি। ঘুমটা হিমুরাণী এসেই ভাঙিয়েছে। বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফুপির বাড়ি অর্থাৎ আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিল। কিন্তু বৃষ্টির জন্যে বের হতে পারছেনা। ঘুম থেকে উঠে লম্বা হাই তুলতেই হাতের ওপর চোখ গেল। দু হাতে মেহেদীর রঙ খুব খুলেছে। কাল রাতে আপুরা মেহেদি দিয়ে দিয়েছিল হাতে। একহাতেই দিতে বলেছিলাম। অপর হাতে ফোন স্ক্রোল করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠেছিলাম সম্ভবত সাড়ে এগারোটার দিকে। উঠে দেখি আরেক হাতেও মেহেদী দিয়ে দিয়েছে। ইংরেজি এ অ্যালফাবেট দিয়ে ডিজাইন করে। বিরক্ত হয়েছিলাম বেশ। হাতে এসব নাম ওয়ার্ড লেখা আমার পছন্দ না। কিন্তু দিয়ে ফেলেছে বলে আর তেমন কিছু বলিনি। তবে সকালে এমন সুন্দর মেহেদীর রঙ দেখে ভালো লাগল। মন ফুরফুরে হয়ে গেল।
সকাল পেরিয়ে দুপুরও প্রায় শেষ হতে চলল। বাইরে থেমে থেমেই বৃষ্টি নামছে। আম্মু বেশ কয়েকবার বলল ঐ বাড়ি থেকে একটু ঘুরে আসতে কিন্তু আমি গেলাম না। আলসেমি লাগছিল প্রচুর। তারওপর বৃষ্টি। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়েই কাটিয়ে দিলাম সারাদিন। কিন্তু বিকেলের দিকে আপি এসেছে শুনে অলসতাকে বহু কষ্টে বিদায় দিয়ে নানাবাড়ি গেলাম।
আপিকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বসে আছি আমি। আপি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি আলতো করে আপির পেটে হাত রেখে বলল, ‘ কবে আসবে ও?’
আপি হেসে ফেলল। আমার মাথায় একটা চাটা মেরে বলল, ‘তুইও তোর ভাইয়ার মতো হয়ে গেলি নাকি?’
উত্তরে হাসলাম আমি। তখনই ফোনে মেসেজ টোন বেজে উঠল। আমি আপিকে ছেড়ে মেসেজটা ওপেন করে একটু অবাকই হলাম। আদ্রিয়ান ভাইয়ের মেসেজ। লিখেছে, ‘কাঠবাগানে অপেক্ষা করছি।’
আমি ঠোঁট ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলাম। কাল কিছু না বলে চলে গেল। অথচ আজ ডাকছে কোন দুঃখে! আপির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। সারাদিন বৃষ্টি হওয়াতে কাঠবাগানের মাটি কাদা কাদা হয়ে আছে। আমি সাবধানে পা টিপে টিপে ভেতরে গিয়ে দেখি একটা গাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোন স্ক্রোল করছেন উনি। উল্টোদিকে ঘুরে আছেন বলে মুখ দেখা যাচ্ছেনা। আমি পেছন দাঁড়িয়ে গলা ঝাড়লাম। উনি বললেন, ‘রোগীদের মতো খ্যাঁক খ্যাঁক না করলেও চলবে। তুই এসেছিস আমি বুঝেছি।’
আমি ভেংচি কাটলাম একটা। উনি দেখছেন না বলেই দিলাম। দেখলে এতো সাহস হতোনা। ভেংচি কাটা পছন্দ করেন না উনি। আমি বললাম, ‘ডাকলেন কেন?’
উনি ফোনটা পকেটে রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন আমার দিকে। ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন, ‘আমি ডেকেছি? কখন? আমিতো লিখেছি ‘অপেক্ষা করছি”। তোকে আসতে হবে সেটা লিখেছি?’
আমি একটা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, ‘ফাইন!’
কথাটা বলে চলে যেতে নিলে উনি আমার হাত ধরে ফেললেন। এরপর ঠেলে এনে গাছটার সাথে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘ খালি তেজ হ্যাঁ?’
আমি চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ “তেজ” ব্যক্তিগত সম্পত্তি আমার।’
আমার কথা শুনে ঠোঁট উল্টে মাথা ঝাঁকালেন উনি। এরপর দুই হাত নিজে সামনে তুলে ধরে দেখলেন। বললেন, ‘ বাপড়ে! হাতভর্তি “এ” এর ছড়াছড়ি। কী ব্যপার? নতুন নতুন প্রেম নাকি?’
‘আমার এতো সুন্দর একটা নাম থাকতে অন্যের নামের অক্ষর লিখব কোন দুঃখে? নিজের নামের অক্ষর-ই লিখেছি।’
উনি আবার একই ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘ভালো, সেল্ফলাভ ভালো।’
এরপর হালকা ঝুকে আমার কানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কান ফাঁকা যে? এতোদিন তো বাক্স ভরে ভরে বাইরে থেকে গিফ্ট আসত। এখন তো আবার দেখলাম আত্মীয় সজনও দিচ্ছে। তবুও ফাঁকা?’
আমি ওনার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললাম, ‘ভেবেছিলাম স্পেশাল কেউ স্পেশাল গিফট দেবে। তাই অন্যকারো কাছ থেকে কিছু নেইনি। কিন্তু এখন দেখছি নিলেই ভালো করতাম। ফাঁকা রাখতে হতোনা। তাইনা?’
উনি ঠোঁটে ঠোঁটে চেপে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। আমি আবার চোখ সরিয়ে নিলাম। হঠাৎই কানে ওনার হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠলাম আমি। হতভম্ব হয়ে ওনার দিকে তাকালাম। নড়তে গিয়েও থেমে গেলাম ওনার হাতের চাপে। সযত্নে আমার দুই কানে দুটো দুল পড়িয়ে দিলেন উনি। হঠাৎ বৃষ্টি ভেজা শীতল বাতাস দোলা দিয়ে গেল গোটা বাগানে। আমি হাত দিয়ে একবার ধরে দেখলাম দুল দুটো। মুচকি হাসি ফুটলো ঠোঁটে। কিন্তু পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে ওনার দিকে তাকিয়ে নিজের হাত বাড়িয়ে দিলাম। ভ্রু নাচিয়ে বললাম, ‘আমার সালামী?’
উনি কোনরকম ত্যাড়ামী করলেন না। নিজের জিন্সের পকেটে ইশারা করে বললেন, ‘পকেটে হাত দিয়ে দেখ কিছু আছে কি-না। যা আছে সব তোর।’
হঠাৎ নানাভাইর কথা মনে পড়ে গেল আমার। উনিও ঠিক এভাবেই নিজের পাঞ্জাবীর পকেট দেখিয়ে বলতেন যা আছে সব আমার। আমি কিছু না বলে ধীর গতিতে ওনার পকেটে হাত রাখলাম। কিছু নোটের সাথেসাথে একটা চকলেটের প্যাকেটও পেলাম। তখন আর গুনলাম না। ওগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলাম পুকুরপাড়ের দিকে। উনিও আমার পাশাপাশি হাঁটছেন। একই গতিতে। আবারও ভেজা ঠান্ডা হাওয়া এসে প্রাণ জুড়িয়ে দিয়ে গেল আমাদের। আমি গেয়ে উঠলাম,
‘তোমার খোলা হাওয়া’
লাগিয়ে পালে,
তোমার খোলা হাওয়া’
আমি থামতেই আমাকে চরম অবাক করে উনি গেয়ে উঠলেন,
‘টুকরো করে কাছি
আমি ডুবতে রাজি আছি।
আমি ডুবতে রাজি আছি।
তোমার খোলা হাওয়া
লাগিয়ে পালে,
তোমার খোলা হাওয়া।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। উনি তাকালেন না। পকেটে হাত ঢুকিয়ে নিচে পড়ে থাকা এক ভেজা চাকায় আলতো করে লাথি মারলেন। বাতাসে ওনার চুলগুলো দুলছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘রবীন্দ্রসঙ্গীতও জানেন আপনি?’
উনি হাঁটতে হাঁটতেই বললেন, ‘আগে জানতাম না। কিন্তু একটা কথা কী জানো? বৃষ্টি, প্রেম আর রবীন্দ্রসঙ্গীতের এক অদ্ভুত মিলবন্ধন আছে। সেজন্যই হয়তো যেদিন থেকে এক বৃষ্টিবিলাসীর প্রেমিকপুরুষ হয়েছি, সেদিন থেকে রবীন্দ্রপ্রেমীও হয়ে উঠেছি।’
আমি কিছু বললাম না। হাঁটতে হাঁটতে উপভোগ করলাম ভেজা ঠান্ডা হাওয়াকে। আর ভাবলাম, ভাগ্যিস! বৃষ্টিবিলাসী আর রবীন্দ্রপ্রেমী দুটোই ছিলাম তাই হয়তো এমন প্রেমিকপুরুষ পেয়েছি।
…
[ রি-চেইক করিনি। আশা করি সকলেই রেসপন্স করবেন আর গঠনমূলক মন্তব্য করবেন।]