অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ২৮
পানসে মুখে ফোন স্ক্রোল করতে করতে আদ্রিয়ান ভাইদের বাড়ির বসার ঘরের সোফায় বসে আছি আমি। জাবিন আর সারা দুজনে আমার দুপাশে বসে একই কাজ করছে। ফোন স্ক্রোলিং। জানুয়ারি মাসের কথা। সম্ভবত জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ ছিল সেটা। আম্মু আর আমি শরীয়তপুর সদরে গিয়েছিলাম এক খালার বাড়িতে। আম্মুর চাচাতো বোন। বিকেলবেলা সে বাড়ি থেকে বের হতেই মামণির ফোন এলো। কী কথা হল তা ঠিক শুনতে পাইনি। তবে আম্মুর ভাষ্যমতে, মামণি এককথায় জেদ ধরে বসল ঐ বাড়িতে যেতেই হবে আমাদের। সদরে এসেও ঐ বাড়ি না গিয়ে চলে যাচ্ছি এ কেমন কথা? একপ্রকার ইমোশনাল ব্লাকমেইল করে নিয়ে গেল সে বাড়িতে। মানিক আঙ্কেল তখন বাড়িতে নেই। আসার পর থেকেই আম্মু আর মামণি রান্নাঘরে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। আমিও এতক্ষণ জাবিন এবং সারার সাথে আড্ডাই দিচ্ছিলাম। কিন্তু আড্ডা দেওয়ার টপিক শেষ তাই তিনজনই ফোনে ব্যস্ত হয়ে গেছি। সারা টিকটকের কিছু ভিডিও দেখতে দেখতে হাসিতে ফেটে পড়ছে, জাবিন ইউটিউবে ব্যস্ত আর আমি এমনিই ফোন নাড়ছি-চাড়ছি। আমার ফোন স্ক্রোল করার নিয়মটা এরকমই। দেখার মতো নির্দিষ্ট কিছু থাকেনা। ফোনে কী করি নিজেই বুঝতে পারিনা। এখনো সেটাই হচ্ছে।
সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহূর্তে বাড়িতে ঢুকলেন আদ্রিয়ান ভাই। আমি একপলক তাকালাম ওনার দিকে। শরীর ঘামে ভেজা। টিশার্টটা অনেক জায়গায় ভিজে লেপটে গেছে গায়ের সাথে। অগোছালো চুলগুলোও কপালের দিক দিয়ে কিছুটা ভেজা। এই শীতেও ঘেমে কী অবস্থা হয়েছে। হাতে ক্রিকেট ব্যাট, ক্রিকেট খেলে এসেছে হয়তো। কতক্ষণ খেলেছে কে জানে? অগোছালো ছোট ছোট দাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছে তিন-চারদিন শেভিং-টেভিং এর ধারেকাছেও যাননি। উনি আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই হাতের ব্যাটটা ঘোরাচ্ছেন। আমি চোখ সরিয়ে আবার ফোনের স্ক্রিনে তাকালাম। আদ্রিয়ান ভাই ব্যাটটা ঘোরাতে ঘোরাতে সারা-জাবিনের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘কী ব্যপার? তোদের দুই পেত্নীর মাঝে এই তৃতীয় পেত্নীটা কে?’
‘পেত্নী’ শব্দটায় আমরা তিনজনের কেউ কোন প্রতিক্রিয়া দেখালাম না। কারণ তিনজনই এসব নামে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। তাই আমি এখানো ফোন থেকে চোখ সরাই নি। কিন্তু আমার দুই পাশে বসে ছিল দুই বিচ্ছু মেয়ে। তারা তাদের বিচ্ছুগিরি শুরু করল। জাবিন অনেকটা অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘ কী বলিস ভাইয়া! কালকেইতো বিয়ে করে নিয়ে এলি। আজকেই ভুলে গেলি?’
আমি ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে চোখ দুটো বড়বড় করে তাকালাম জাবিনের দিকে। আদ্রিয়ান ভাইও ভ্রু কুঁচকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল জাবিনের দিকে। আওয়াজ করে ব্যাটটা ফ্লোরে ফেলে বলল, ‘ওই, একদম উল্টোপাল্টা অপবাদ দিবিনা। আমি এখনো পিওরেস্ট সিঙ্গেল।’
আমি বোকা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম ওনার দিকে। আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে সারা নিজের চেহারায় কৃত্রিম বিস্ময় ফুটিয়ে বলল, ‘দা’ভাই এটা কিন্তু ঠিক না। কালকে বিয়ে করে আজ একরাতের মধ্যেই বউ ভুলে গেলে? তোমাকে ভালো ভেবেছিলাম। এখন দেখছি আসলেই সব ছেলেই একরকম।’
আদ্রিয়ান ভাই ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে রইল নিজের দুই বোনের দিকে। আমি হতভম্ব। এই মেয়েদুটো তো আস্ত ফাজিল! এরকম দুষ্টুমি করে কেউ? এই দুই দুষ্টুর দুষ্টুমিতে আমি এখন পালানোর রাস্তা খুঁজছি। সবগুলো নির্লজ্জ। আদ্রিয়ান ভাই হতাশ কন্ঠে বললেন, ‘এসব সিরিয়াল-টিরিয়াল সব ব্যান করা উচিত। পোলাপান সব অসভ্য হয়ে যাচ্ছে।’
কথাটা বলতে বলতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন উনি। উনি যেতেই জাবিন আর সারা দুজনেই শব্দ করে হেসে দিল। আমি হতাশ দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘এটা কী হলো?’
জাবিন হাসতে হাসতে বলল, ‘সন্ধ্যাবেলার সেরা বিনোদন।’
আবার দুই বোনের সেই অট্টহাসি। এদের দুষ্টুমি দেখে আমিও এবার ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হেসে দিলাম। আদ্রিয়ান ভাই রান্নাঘরের দিকে গিয়ে পানি খেতে খেতে আম্মু আর মামণির সাথে কিছুক্ষণ কথা বলল। কিন্তু তাদের কথার শব্দ এতোদূর আসছেনা। তাই আমি আবারও ফোনে দৃষ্টি দিলাম। কিছুক্ষণ পর উনি আবার এদিকে এলেন। হালকা গলা ঝেড়ে নিজের দুষ্টুমিতে হায়ার ডিগ্রি নেওয়া দুই বোনের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ আমার বউকে তোদের মাঝখানে বসিয়ে না রেখে আমার ঘরে পাঠা। আম্মু কফি বানাচ্ছে। ওটা নিয়েই আসতে বলিস।’
‘আম্মু কফিটা একটু তাড়াতাড়ি।’ কথাটা উচ্চস্বরে বলে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন উনি। আমি অলমোস্ট হা করে তাকিয়ে রইলাম তার যাওয়ার দিকে। শুধু শুধুই সারা আর জাবিনের দোষ দিচ্ছিলাম। ভাইটা এমন হলে বোনদুটোও এমন হবে সেটাই স্বাভাবিক। আমি এসব ভাবতে ভাবতেই সারা আমায় কনুই দিয়ে একটা খোঁচা মেরে বলল, ‘বসে আছো কেন? যাও, বর ডেকে পাঠিয়েছে। যাও, যাও।’
আমি কটমটে চোখে তাকালাম সারার দিকে। আমি তাকাতেই সারা ঠোঁটে আঙুল দিল। সবে ক্লাস টেইনে উঠেছে অথচ কী বিচ্ছু! একই দৃষ্টিতে জাবিনের দিকে তাকাতেই জাবিন বলল, ‘কফি! কফি চাইছিল।’
আমি হেসে ফেললাম। উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললাম, ‘বান্দরের দল সব।’
রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম মামণির কফি বানানো শেষ। আম্মুও পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সন্ধ্যার স্ন্যাকস বানাচ্ছিল হয়তো দুজন মিলে। তার আগেই সাহেবের কফির অর্ডার চলে এসেছে। আমি দুজনের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে মামণির উদ্দেশ্যে বললাম, ‘মামণি কফিটা দাও।’
মামণি আমার দিকে মগটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘সব দেওয়া আছে, তুই শুধু চামচ দিয়ে একটু মিশিয়ে নিয়ে যা মা।’
আমি একটা চামচ নিয়ে নিজের কাছে টেনে নিলাম মগটা। কফিটা নাড়তে নাড়তে বললাম, ‘ছেলেতো বানাও নি আস্ত একটা নবাবজাদা বানিয়ে রেখেছো। খালি অর্ডার করতে পারে।’
মামণি মুখটা অন্ধকার করে ফেললেন। একটু ভারী কন্ঠে বললেন, ‘এভাবে বলছো কেন অনি? ছেলেটা ছয়টা বছর আমার কাছে ছিলোনা। তখনতো সব নিজে নিজেই করতো। বছর খানেকের জন্যে এসেছে। একবার গেলে আবার কবে পাব ঠিক আছে?’
মামণি কথাটা শেষ করতেই আম্মু বলে উঠল, ‘আর তুমি কাকে কি বলছো? রুম থেকে বের হও তুমি? এক গ্লাস পানি নিজে ঢেলে খাও কখনও? কারো কোন কথা কানে তোলো? কেউতো বকেও তোমাকে নড়াতে পারেনা। ঐ বাড়িতে তোমার বাবা আর এই বাড়িতে আদ্রিয়ান। এই দুজনই পারে তোমাকে দিয়ে কিছু করাতে।’
আমি হতাশ হলাম। ভুলেই গেছিলাম আমি পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আছি। আর পৃথিবীতে কারো সামনে দাঁড়িয়ে আমি ওনার নামে বদনাম নামক অ্যাটাক করব আর কোন কাউন্টার অ্যাটাক আসবে না সেটা হতে পারে? কোনদিন না। তাই আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ কফিটা হাতে নিয়ে ওনার ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। ওনার রুমে গিয়ে দেখি উনি ইতিমধ্যে একটা মিনি শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। বরাবরের মতো হাতাকাটা গেঞ্জি আর থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট পরে নিয়েছেন। টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। লোকটা এতো ফাস্ট কীকরে? আমি হলে তো এসে ল্যাদ খেয়েই ঘন্টাখানেক বিছানায় পড়ে থাকতাম। যাই হোক, আমি কফিটা নিয়ে ওনার টেবিলের ওপর রেখে বললাম, ‘আপনার কফি। আর কী সেবা করতে পারি স্যার?’
উনি চুল মুছতে মুছতে দুষ্টুমিমাখা কন্ঠে বললেন, ‘বউদের শুধু কফি এনে দিলে হয়না, আরও অনেক কিছু করা লাগে।’
আমি ওনার টেবিলে ছড়িয়ে রাখা দুটো বই আর খাতা ঠিকভাবে গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললাম, ‘আর কী করা লাগে?’
‘বলব?’
‘বলুন।’
‘না থাক, বাচ্চা মানুষ লজ্জা পাবি। বড় হলে বলব।’
আমার বিষম খাওয়ার জোগাড় হল। এরা ভাই-বোনরা মিলে আজ আমার পেছনে পড়েছে কেন? সমস্যা কী? আমি বিরক্তি নিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনি ইঞ্জিনিয়ারিং এ এখনো পিএইচডি না করলে কী হবে? অসভ্যতামিতে তার চেয়ে ওপরের ডিগ্রি পেয়ে গেছেন।’
উনি দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে আমার মাথায় একটা চাটা মেরে বললেন, ‘ তোর সাহসের প্রশংসা করতে হচ্ছে। চৌদ্দকুলের সবচেয়ে ভদ্র-সভ্য ছেলেটাকে তুই অসভ্য বলে দিলি। অন্যকারো সামনে বললে নির্ঘাত গর্দান নিতো তোর।’
সে আর বলতে! কথাটা মনে মনে বললেও মুখে বললাম, ‘আমি ছাড়া আপনার এই রূপ তো আর কেউ দেখেনা। দেখলে বিনা নোটিসে হার্ট অ্যাটাক করতো।’
উনি হালকা হেসে টাওয়েলটা গলায় ঝুলিয়ে কফির মগটা হাতে নিতে নিতে বললেন, ‘তাইতো দেখাই না। এতোগুলো হার্টকে রিস্কে ফেলা ঠিক হবেনা।’
আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে ওনার বিছানায় বসে পড়ে বললাম, ‘ আপনার শুধু আমার হার্টেরই কদর নেই। কচি হার্টটার ওপর হুটহাট অত্যাচার করে বসেন।’
উনি চমৎকার এক হাসি দিয়ে ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিলেন। তারপর বললেন, ‘তোর আবার হার্টও আছে? জানতাম না তো!’
আমি অবাক হলাম। এ আবার কেমন কথা! আমার হার্ট যাবে কোথায় শুনি? না থাকলে বেঁচে আছি কীকরে? আমি অনেকটা বিস্ময় নিয়ে বললাম, ‘আমার হার্ট না থাকলে আমি বেঁচে আছি কীভাবে? ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তে বায়োলজি গিলে ফেলেছেন আদ্রিয়ান ভাই?’
উনি স্বাভাবিকভাবে বললেন, ‘কিছু মানুষের হৃদয়তো শুধু শরীর টিকিয়ে রাখার জন্যেই থাকে। মনের সঙ্গে তাদের কোন যোগাযোগ নেই। এসব সাইকোলজি তুই বুঝবিনা।’
বরাবরের মতোই ওনার এই রহস্যময় কথা আমার বোধগম্য হলোনা। বোঝার সময়টাও পেলাম না। তার আগেই মামণির ডাক পড়ল দুজনের জন্যেই। সবাই মিলে সন্ধ্যার আড্ডা দিতে দিতে বেশ মজা করেই খেলাম মামণির হাতে তৈরী হোমমেড সিঙ্গারা।
সিঙ্গারা খাওয়া শেষে সন্ধ্যার পর আমরা বাড়ির উদ্দেশ্যে বের হতে যাব এমন সময় মামণি বাঁধ সাধল। আমাকে এখানে রেখে যেতে বলল আম্মুকে। রাতে খাওয়া-দাওয়া করে পরে না হয় আঙ্কেল বা আদ্রিয়ান ভাই গিয়ে দিয়ে আসবে বাড়িতে। আম্মু প্রথমে রাজি না হলেও পরে মামণির জোরজুরিতে রাজি হতে হল। মামণি আদ্রিয়ান ভাইকে জিজ্ঞেস করল দিয়ে আসতে পারবে কি-না। ত্যাড়া মানুষ ত্যাড়াভাবে উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, পারব না কেন? আমিতো আছিই ম্যাডামকে সার্ভিস দেওয়ার জন্যে। তোমার মেয়ে তুমি রেখে দাও।’
সুতরাং থেকে যেতে হল আমাকে। প্রথম আধঘন্টা ভালোই কাটছিল জাবিন আর সারার সাথে টিভি দেখতে দেখতে মজা করে। কিন্তু আধঘন্টা পরেই আদ্রিয়ান ভাই ধমকে দুই বোনকে পড়তে বসিয়ে দিলেন। আজব! জানুয়ারি মাসেই এতো প্রেশার কে দেয়? আস্ত বজ্জাত। মায়া লাগছে বেচারি দুজনের জন্যে। ভাগ্যিস আমার এমন কোন বড় ভাই নেই। বেঁচে গেছি।
কিন্তু সমস্যা হল করার মতো কিছুই নেই। মামণি রাতের রান্নায় ব্যস্ত। আর আমি রান্নার ‘র’ ও জানিনা। সুতরাং ওখানে যাওয়া আর নিজের মুখ কালো করা ইজ সেইম। জাবিন আর সারাও মুখ কালো করে পড়ছে। বোরনেসে অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম আদ্রিয়ান ভাইয়ের রুমে। গিয়ে দেখি সেও পড়ছে টেবিলের সামনে বসে। উফ! কোন বিদ্যাসাগরদের সাগরে ফেলে গেলো আম্মু? আমিতো হাবুডুবু খাচ্ছি! রুমের ভেতরে গিয়ে বিছানায় বসে গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। উনি আমার দিকে না তাকিয়ে বললেন, ‘গালদুটো ফুলিয়ে রেখেছিস কেন? কিছু হয়েছে?’
‘ একা বোর লাগছে।’ অসহায় কন্ঠে বললাম আমি।
উনি কিছু বললেন না। খাতায় মিনিটখানেক কলম চালিয়ে কলমের ক্যাপ লাগালেন। ক্যালকুলেটর, ল্যাপটপ, খাতা সব বন্ধ করে চেয়ার ঘুরিয়ে তাকালেন আমার দিকে। আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘চেজ খেলবি?’
চেজ খেলার কথা শুনে মনটা খুশি হয়ে গেলেও ওনার সাথে খেলতে হবে শুনেই মুখ অন্ধকার হয়ে গেল আমার। কিন্তু বসে বসে বোর হওয়ার চেয়ে ওনার কাছে হারাটা বেটার অপশন বলে মনে হয়েছিল তখন। তাই রাজি হয়ে গেলাম। উনি উঠে গিয়ে কোর্ট আর গুটি নিয়ে এলেন। খেলাও শুরু হলো বেশ জমজমাট। এমনই জমজমাট যে পনেরো মিনিটেই হাতি ঘোড়া মন্ত্রী সব হারিয়ে চেকমেট হয়ে গেলাম। কোন ট্রিক ইউজ করল কে জানে? কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না আমি। হেরে গিয়ে আবার গাল ফুলিয়ে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। উনি ভ্রু নাচালেন। আমি অভিমানী কন্ঠে বললাম, ‘আপনি চিটিং করেন। আমি আর জীবনে খেলব না আপনার সাথে।’
উনি হেসে দিলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘নাচতে না জানলে স্টেজ বাঁকা।’
আমি আড়চোখে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ওটা উঠোন হবে।’
‘কতজনকে উঠোনে নাচতে দেখেছিস?’
আমি আবার বোকা বনে গেলাম। এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কথাবার্তা আমি ছাড়াও দুনিয়াতে আরেকজন মানুষ বলতে পারেন। আর সেটা উনি। কিন্তু আমি আর জবাব দিলাম না। হেরে গিয়ে ভীষণ অভিমান হয়েছে। কী হতো একটু জিতিয়ে দিলে? কয়েক সেকেন্ডের মৌনতা চলল ঘরে। হঠাৎই উনি হাত ধরে টেনে নিলেন আমায় নিজের কাছে। বিছানার চাদর এলোমেলো হয়ে গেল যার ফলে। আমি সরতে নিলেই উনি একহাতে আমায় ধরে রেখে বললেন, ‘রাগ করতে হবেনা। ট্রিকটা শিখিয়ে দিচ্ছি। একদম ইজি।’
আমি এবার নড়াচড়া থামিয়ে দিলাম। দাবায় বরাবরই আমার ভীষণ আগ্রহ। আর আমার দাবা শেখা আর ভালোলাগা জন্মানোর সমস্ত কৃতিত্বটা ওনারই। পাঁচ মিনিটেই খুব সুন্দরভাবে ট্র্যাপটা শিখিয়ে দিলেন উনি আমাকে। কিংস গ্যাম্বিটের ট্র্যাপ ছিল ওটা। নতুন আরেকটা ট্র্যাপ শিখতে পেরে ভীষণ খুশি হলাম আমি। কিন্তু আমার খুশিতে ভাটা ফেলে উনি বললেন,
‘ এইযে ম্যাডাম! অনেক খুশি হয়েছেন এবার বিছানাটা ঝেড়ে গুছিয়ে দিন। কী অবস্থা হয়েছে!’
আমি ভ্রু কুঁচকে ওনার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, ‘আমি কেন করব?’
উনি গা জ্বালানো এক হাসি দিয়ে বললেন, ‘সার্ভিস চার্জ। এইযে দাবার ট্র্যাপ শেখালাম, বাড়ি পৌঁছে দেব। এগুলো সব ফ্রি না-কি? আমায় মাগনা মনে হয়?’
আমি শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম একটা মানুষ কত অসহ্য হতে পারে। কী আর করার? ওনার বিছানাটা ঝেড়ে একদম টানটান করে গুছিয়ে দিতে হলো আমাকে। যেখানে নিজের বিছানাটাই নিজে জীবনে কতবার গুছিয়েছি সেটা গুনে বলতে পারব। এই ছেলে হয়তো আমার জীবনে এসেছেই যেগুলো আমি করিনি সেগুলো আমায় দিয়ে করিয়ে নেবার জন্যে।
বিছানা গোছানো শেষ করে একপ্রকার হাঁফিয়ে গিয়ে বসলাম আমি বিছানায়। উনি আবার পড়তে বসেছিলেন। খাতায় কিছু লিখতে লিখতেই উনি বললেন, ‘এখন বাড়ি গিয়ে কী করবে?’
‘ ঘুমিয়ে পড়ব। ক্লান্ত আমি। কত কাজ করালেন আমাকে দিয়ে। একটা বাচ্চার সাথে এমন করে কেউ?’ হাঁফানো কন্ঠে বললাম আমি।
উনি হাসলেন। লিখতে লিখতেই বললেন, ‘বাচ্চাটাকে বড় করতে হবেতো।’
আমি কিছু বললাম না। উঠে গিয়ে ওনার টেবিলে রাখা পানির বোতলটা নিয়ে পানি খেলাম কিছুটা। উনি বললেন, ‘শোন, ঘুম থেকে উঠে কখনও আমি ছাড়া আর কারো ফোন তুলবিনা।’
আমি ভ্রু কুঁচকে ওনার দিকে তাকিয়ে পানি গিললাম। বোতলের মুখ লাগাতে লাগাতে বললাম, ‘কেনো?’
উনি লেখা থামালেন। শক্ত চোখে তাকালেন আমার দিকে। ওনার দৃষ্টি দেখে আমি খানিকটা নড়েচড়ে উঠলাম। আদ্রিয়ান ভাই কঠোর কন্ঠে বললেন, ‘ আমি বলছি। ইসেন্ট দ্যাট ইনাফ?’
বুঝতে পারলাম উনি যথেষ্ট সিরিয়াস হয়েই বলেছেন কথাটা। তাই আমি আর উত্তর দিলাম না। মাথা নিচু করে ফেললাম। তবে মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। হঠাৎই এভাবে বকার মানে কী? খালি বকার বাহানা খোঁজে। কিছু না পেয়ে খুঁজে খুঁজে এই অদ্ভুত কথা তুলে বকতে হবে? আজব!
রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে উনিই আমায় নিয়ে বের হলেন পৌঁছে দেওয়ার জন্যে। মামণি, মানিক আঙ্কেল অনেকবার বলেছিল থেকে যেতে কিন্তু আমার ভালো লাগছিল না। তাই আর থাকিনি। উনি বাইক চালাচ্ছেন আর আমি ওনার কাঁধে হাত রেখে পেছনে বসে আছি। কিছু বলছিনা। জামতলা এসে বাইক থামালেন উনি। আমি অন্যমনস্ক থাকায় চমকে গিয়ে আশেপাশে তাকালাম। থামানোর কারণটা ওনাকে জিজ্ঞেস করার আগেই উনি বললেন, ‘চা খাবে?’
আমি কয়েকসেকেন্ড তাকিয়ে রইলাম ওনার মুখের দিকে। তারপর ঘাড় কাত করে হ্যাঁ বোঝালাম। উনি মুচকি হেসে নামলেন বাইক থেকে। আমিও নামলাম। চায়ের দোকানে গিয়ে দু কাপ চা দিতে বললেন উনি। আমি হাত ভাঁজ করে দেখছি অন্ধকার আর আলোর মিশ্রণে সজ্জিত রাস্তাটা। রাতের বেলায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাওয়াটা আমার আরেকটা পছন্দের কাজ। তাই বেশ সময় নিয়েই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জানুয়ারির ঠান্ডা, রাতের অন্ধকার আর দোকানের হলুদ বাতির আলো উপভোগ করতে করতেই চা খেলাম। মন খারাপ ভাবটা যেনো ম্যাজিকের মতো হারিয়ে গেল কোথাও একটা। আমি আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিকে তাকালাম, উনিও তাকিয়ে আছেন আমার দিকে, ঠোঁটে হালকা হাসি। আমি চোখ সরিয়ে নিয়ে হাসলাম। চায়ের দাম মিটিয়ে দেওয়ার পর আবার অন্ধকার রাস্তা দিয়ে ছুটলো আমাদের বাইকটা। আমার দুহাত ওনার দু কাঁধের ওপর। কী ঠান্ডা শীতল বাতাস। সবকিছুই কত সুন্দর, স্নিগ্ধ, ভালোবাসাময়। বুঝতে পারলাম এই হালকা ফুরফুরে হাওয়ার মতো আমার মনটাও হালকা ফুরফুরে হয়ে গেছে। সেদিন আরেকটা জিনিস বুঝলাম, কিছু ম্যাজিশিয়ান সরি বলতে না জানলেও এমন সব ম্যাজিক করতে জানে যাতে করে সরি বলার কোন প্রয়োজনই পড়েনা। আর যাদের জীবনে এমন ম্যাজিশিয়ান থাকে তাদের মন খারাপ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনা। সম্ভবই না।
…
[ দিনে কমপক্ষে দশটা মেসেজ আসতো এটা দেওয়ার জন্যে। পোস্ট আর কমেন্টেস এর কথা বাদই দেই। এবার শান্তি? খুশি? এবার শুধু খুশি প্রকাশ না করে সাথে গঠনমূলক মন্তব্যও করে আমাকেও খুশি করে যান দেখি ]