অনির কলমে আদ্রিয়ান পর্ব ২৯
খুব তাড়ায় আছেন আদ্রিয়ান ভাই। স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটা বেশি গতিতে চালাচ্ছেন বাইকটা। যেন বিশাল কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজে যাচ্ছেন উনি। রকেটের গতিতে পৌঁছাতে হবে তাকে। উগ্র গতিতে প্রেমতলা মোড় পার হওয়ার এক সেকেন্ডের মধ্যেই ওপর পাশ দিয়ে আসা একটা বাসের সাথে তীব্র বেগে ধাক্কা লাগল ওনার বাইকটার। ছিটকে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লেন উনি রাস্তায়। বাইকটা স্লিপ করে রাস্তার আরেক পাশে পড়ে রইল। প্রেমতলা মোড়ের সদা ব্যস্ত রাস্তাটা নিমেষেই জনশূণ্য হয়ে গেল। রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে আছে আদ্রিয়ান ভাইয়ের নিথর দেহ। রাস্তাটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মুখের একপাশ রক্তে ভিজে থেতলে গেছে ওনার। রক্তাক্ত ওনার নিথর শরীর। কিন্তু কেউ আসছেনা ওনাকে বাঁচাতে। কেউ নেই ওখানে। রাস্তাটা নিস্তব্ধ। ভয়ংকর নিস্তব্ধ।
ঝট করে চোখ খুলে তাকালাম আমি। গভীর অন্ধকার চারদিকে। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে যেন কাজ করা বন্ধ করে দিল আমার মস্তিষ্ক। কে আমি, কোথায় আছি, কী করছি কিছুই বুঝলাম না। চেষ্টা করেও শ্বাস নিতে পারলাম না। ধীরে ধীরে সবটা পরিষ্কার হল আমার কাছে। আমার রুমে, আমার বিছানায় শুয়ে আছি আমি। আবছা অন্ধকার রুমে ড্রিম লাইটের লালচে আলো জ্বলছে। শা শা করে আওয়াজ আসছে চলন্ত ফ্যানের। জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিলাম। বুঝতে পারলাম ঘামে ভিজে গেছে আমার শরীর। ফুল স্পিডে ফ্যান চলছে তবুও। মিনিট খানেক ওভাবেই শুয়ে রইলাম চুপচাপ। এরপর আস্তে করে উঠে বসলাম। হাত বাড়িয়ে পানির বোতলটা নিয়ে প্রায় আধ বোতল পানি খেয়ে নিলাম একবারেই। হাত অস্বাভাবিক কাঁপছিল যার ফলে কিছু পানি পড়ে থুতনি গলা ভিজে গেছে। ছোট তোয়ালে টা দিয়ে মুখ গলা সব মুছে নিলাম ভালোভাবে। ক্লান্ত ভঙ্গিতে আবার গা এলিয়ে দিলাম বিছানায়। আস্তে করে বন্ধ করে নিলাম চোখজোড়া। স্বপ্ন ছিল! ভাগ্যিস স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এমন ভয়ংকর স্বপ্ন কেন দেখলাম আমি? তাও এমন ভোরবেলা? কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে আবার বিছানায় ভর দিয়ে উঠে বসলাম চুপচাপ। ফোন চেক করে দেখলাম সাড়ে সাতটা বাজে। আরো খানিকটা পানি খেয়ে নিলাম। আদ্রিয়ান ভাইকে একবার ফোন করব বলে ভেবেও করলাম না। শুয়ে পড়লাম আবার। ঘুমানোর সাহস হলোনা না। আবার যদি দেখতে হয় এই দৃশ্য? এপাশ-ওপাশ করতে করতে কেটে গেল আরও আধ ঘন্টা। এরমধ্যে মা একবার এসে বলে গেল, ‘অনি, চা বানানো আছে। যখন খাবে গরম করে নিও।’
বিছানায় অযথাই আর শুয়ে থাকা গেলোনা। হাত দিয়ে চুল ঠিক করে একটা ব্যান্ড লাগিয়ে বিরক্ত হয়ে চলে গেলাম চা গরম করতে। গরম চায়ের কাপটা নিয়ে চলে এলাম নিজের রুমে। জানালার ধারে এসে দাঁড়িয়ে রইলাম চুপচাপ। কোমল রোদে জ্বলজ্বল করা সকালটা দেখতে দেখতে চুমুক দিলাম চায়ের কাপে। অনেক চেষ্টা করেও স্বপ্নের কথাটা ভুলতে পারছিনা আমি। আমার জীবনের অন্যতম স্পষ্ট স্বপ্ন ছিল ওটা। কিন্তু সব ছেড়ে এই স্বপ্নটাই কেন দেখলাম আমি? ওনার কোন ক্ষতি হবেনা তো? না, কিছুই হবেনা। দুঃস্বপ্ন ছিল এটা, কেবলই দুঃস্বপ্ন। কাল থেকেই ওনাকে নিয়ে বেশি বেশি ভাবছি তাই হয়তো এমন স্বপ্ন দেখেছি। স্বাভাবিক। কিন্তু মস্তিষ্কের দেওয়া এই সান্ত্বনা মন সঙ্গে সঙ্গে খারিজ করে দিয়েছিল। কুসংস্কারে ঘোর অবিশ্বাসী আমার মনটাও সেদিন কেমন অশুভ কিছু হওয়ার ভয় পাচ্ছিল। কাল গভীর রাতেও ওনার প্রতি প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে মানসিক অশান্তিতে ছটফট করতে করতে বলেছিলাম, আদ্রিয়ান নামক এই বিষণ্নতা থেকে নিস্তার চাই আমার, শান্তি চাই। সে জাহান্নামে যাক কিন্তু আমার কাছে যেন আসে। কিন্তু এমন নিস্তারের কথাতো আমি কল্পনাও করতে পারিনা। এমনটা আমি দুঃস্বপ্নেও চাইনা। যেখানেই রাখো, ওনাকে সবসময় সুস্থ রেখো আল্লাহ।
আব্বু-আম্মু অফিসে চলে গেলেন। কাব্য টিউশনে গেছে। বাড়ি একদম ফাঁকা। প্রায় দুপুর পর্যন্ত মনের সাথে ভয়ানক যুদ্ধ করলাম। যতবার তাকে ফোন করার কথা ভেবেছি ততবার মন বলেছে সে যদি আবার ওমন খাপছাড়া কথা বলে তখন? মন আরও খারাপ হবে আমার। কিন্তু ওনার গলার স্বরটুকু না শুনে আমি শান্তও হতে পারছিলাম না। দুপুরের দিকে আর পারলাম না আমি। নিজের কাছেই চরমভাবে পরাজিত হয়ে কল করেই ফেললাম ওনাকে। দ্বিতীয়বার রিং হওয়ার পরপরই আদ্রিয়ান ভাই ফোনটা রিসিভ করল। গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘হ্যালো?’
স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে উনি ঠিক আছেন শুনে। বললাম, ‘ কোথায় আপনি?’
‘ কী হয়েছে? মুড সুইং হচ্ছে? কিছু খেতে ইচ্ছে করছে? আমি আসব?’ কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বেশ উত্তেজিত কন্ঠে কথাগুলো বললেন উনি।
আমি উত্তর না দিয়ে বললাম, ‘আছেন কোথায়?’
‘বাড়িতেই আছি। সমস্যা নেই তুই থাক বাড়িতে। আমি বাইকটা টেনে বিশ মিনিটের মধ্যে আসছি। রিল্যাক্স হ্যাঁ? আমি আসছি।’
উনি বাইকের কথাটা বলার সাথেসাথেই চিৎকার করে বললাম, ‘খবরদার না। আপনি ভুলেও বাইকটা চালাবেন না।’
‘ কী হয়েছে কী? এমন ব্যবহার করছিস কেন?’
আমি শুকনো গলায় একটা ঢোক গিলে বললাম, ‘না কিছুনা। আমি ঠিক আছি। আপনি বাড়িতেই থাকুন, আপনাকে আসতে হবেনা।’
উনি আবার কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে কিছুটা চিন্তিত কন্ঠে বললেন, ‘মামণি কোথায়? ফোনটা দে ওনাকে।’
‘ আম্মু অফিসে আছে বাড়িতে নেই।’ উনি কিছু বলার আগেই আমি বললাম, ‘ আপনাকে আসতে হবেনা। এমনিই ফোন করেছিলাম আমি। রাখছি।’
ওনার উত্তরের অপেক্ষা না করেই ফোনটা কেটে দিলাম। যাক, ঠিক আছেন উনি। কিন্তু তবুও মানসিক শান্তি পাচ্ছিনা। যদি সত্যি সত্যি চলে আসেন বাড়িতে? বাইক নিয়ে আসলে? সেই ভয়ংকর স্বপ্নটার কথা মনে পড়তেই গা শিউরে উঠলো আমার। নিজের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে ওনাকে একটা ছোট্ট মেসেজ পাঠালাম। এরপর গাল ফুলিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে রইলাম চুপচাপ। রাতে ঘুম না হওয়ায় কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম। চেষ্টা করেও জেগে থাকা গেলোনা।
ঘুম ভাঙল সন্ধ্যা হওয়ার ঘন্টাখানেক আগে। অনেক্ষণ হল কিছু খাওয়া হয়নি, তারওপর পিরিয়ড চলছে। গোসলটাও করা হয়নি আজ। লম্বা একটা হাই তুলে উঠে গিয়ে গোসল করে নিলাম। ক্ষিদে পেয়েছে ভীষণ তাই চটপট খেয়ে নিলাম। তবে ক্ষিদে মিটল না। খেতেই পারলাম না বেশি। ভাত খেতে ইচ্ছে করছেনা আজ। হালকা ঝালঝাল কিছু খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ঘরে সেরকম কিছুই নেই।
সন্ধ্যার সময় আম্মু এলো অফিস থেকে। কিন্তু দরজা খুলে আম্মুর সাথে সাথে আদ্রিয়ান ভাইকে দেখে থমকে গিয়েছিলাম কিছু সময়ের জন্যে। উনি আবার কেন? ওনার হাতে একটা প্যাকেট। পরনে লাইট ব্রাউন থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট, কালো টিশার্ট, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে কপাল ভর্তি হয়ে ছড়িয়ে আছে। এমন আধ পাগলের মতো কোথা থেকে এসেছেন উনি? চোখ-মুখ এতো শুকনো কেন? উনি পাশ কাটিয়ে গিয়ে ভেতরে এসে বসলেন। আম্মু আমার মাথায় হাত রেখে বলল, ‘জ্বর এসেছিল আর মা?’
আমি বললাম, ‘ না আম্মু, ঠিক আছি। তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো।’
আমি এক গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিলাম আদ্রিয়ান ভাইয়ের দিকে। কারণ যেকোন জায়গা থেকে এসে পানি খাওয়াটা ওনার অভ্যাস। উনি আমার দিকে একপলক তাকিয়ে গ্লাসটা নিলেন। এক নিঃশ্বাসে গ্লাসটা ফাঁকা করে আবার আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি সেটা নিয়ে টেবিলে রাখতে রাখতে কাব্যও চলে এসেছে ফুটবল খেলে। কাব্য আদ্রিয়ান ভাইকে দেখে বলল, ‘আদ্রিয়ান ভাই, কখন এলে? কেমন আছো?’
‘ ভালো। খেলতে গিয়েছিলি না-কি?’
‘ হ্যাঁ ভাইয়া।’
‘ তোদের জিএসসি তো এবার আর হবেনা। তাই বই-খাতা সব বস্তায় ভরে ফেলেছো নিশ্চয়ই?’
কাব্য হেসে ফেলল। আদ্রিয়ান ভাই বলল, ‘নাইনে সাইন্স নেওয়ার ইচ্ছে আছে না-কি?’
‘ না ভাইয়া। আমি আটর্স নিয়ে পড়ব ভাবছি।’
‘আমিও সেটাই প্রিফার করতাম। যা ফ্রেশ হয়ে তাড়াতাড়ি আয়। খাবার আছে।’
আম্মু চেঞ্জ করে বেরিয়ে আসতেই কাব্য চলে গেল ওয়াশরুমে। আম্মু আমাকে বলল, ‘বড় দুটো প্লেট নিয়ে আয়তো অনি। দেখ কীসব পাগলামী করেছে। এগুলো নিয়ে আসার কী দরকার ছিল বল? ইচ্ছে করছে কান টেনে একটা থাপ্পড় দেই।’
আদ্রিয়ান ভাই কিছুটা মুখ ফুলিয়ে বলল, ‘বাবার সাথে জাজিরা এসেছিলাম। বাবাতো ক্লাবে আঙ্কেলের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। আমার মতো অসহায় ছেলেটাকে একা ছেড়ে দিয়েছে রাস্তায়। ঘুরতে ঘুরতে ফাস্টফুডের দোকান চোখে পড়তেই খেতে ইচ্ছে করল। কিন্তু একা একা খেতে ইচ্ছে হয়? তাই তোমাদের কাছে এলাম খাওয়ার জন্যে। বকাবকি করছো কেন?’
কথাটা এমনভাবে বলল যে আম্মুও হেসে ফেলল। মায়েদের কাছে কেমন একটা বাচ্চা মতন হয়ে যান উনি। আম্মু আলতো করে থাপ্পড় দিল ওনার পিঠে। জবাবে আদ্রিয়ান ভাই সেই মোহনীয় হাসিটা দিলেন। আমি ঠোঁটে চাপা হাসি নিয়ে চুপচাপ চলে গেলাম প্লেট আনতে। প্লেট নিয়ে আসতে আসতে কাব্যও চলে এলো। বার্গার আর চিকেন বল কিনে এনেছেন উনি। আব্বুর জন্যে আলাদাভাবে কিছুটা তুলে রেখে বাকিটা প্লেটে রাখল আম্মু। প্রায় অর্ধেকটা আমি একাই সাবাড় করে ফেললাম। এমনিতেও ক্ষিদে ছিল পেটে, ঝাল খেতে ইচ্ছে হচ্ছিলো। তারওপর পছন্দের খাবার। আমার খাওয়া দেখে কাব্য, আদ্রিয়ান ভাই এ নিয়ে বেশ মজাও নিল। আমি সেসবে মোটেও পাত্তা দেইনি। আজ ঝগড়া-টগড়া করব না। খাওয়া-দাওয়া শেষে কফি খেতে খেতে আম্মু ওনার সাথে কথা বলছে। আমি আমার মগ নিয়ে চুপচাপ চলে এলাম নিজের রুমে। ক্ষিদের চোটে খাবারগুলো খেলেও ওনার প্রতি অভিমান রয়েই গেছে। আজ যাই করুক আমি মানছি না। মানবই না।
প্রায় আধঘন্টা পর হঠাৎই আমার রুমে এসে ঢুকলেন উনি। উনি আসাতে আমি খানিকটা চমকে উঠলাম। খানিকটা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে থেকেই ভিড়িয়ে দিলেন দরজাটা। কেন জানিনা খানিকটা ভয় পেলাম আমি। গা ছমছম করে উঠলো। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে একপ্রকার দৌড়ে চলে গেলাম বারান্দায়। গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি। লাইট জ্বালানো নেই ওখানে তাই আবছা অন্ধকার। হঠাৎ অনুভব করলাম উনি আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। একদম গা ঘেঁষে। আমার গ্রিল ধরে রাখা হাতের ওপর হাত পড়তেই কিছুটা কেঁপে উঠলাম আমি। নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বন্ধ করে ফেললাম চোখজোড়া। তালগাছ মহাশয় আমার কানের কাছে ঝুঁকে বললেন, ‘ কী হয়েছে? মন খারাপ ছিল?’
আমি কিছুই বললাম না। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি চুপচাপ। উনি আবার বললেন, ‘কাল এতোবার কল করলাম। ধরলি না কেন?’
আমি এবারেও নিরব, নিশ্চুপ। আমার কোন উত্তর না পেয়ে আমার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেন উনি। আমায় আলতো করে চেপে ধরলেন গ্রিলের সাথে। কলিজা ছ্যাঁত করে উঠল আমার। ভয়ে জমে গেল শরীর। দরজার দিকে একবার তাকিয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে আটকে যাওয়া কন্ঠে বললাম, ‘ কী করছেন? কেউ চলে আসলে খুব খারাপ হবে। দূরে সরুন।’
উত্তরে উনি উল্টোটাই করলেন আরও খানিকটা কাছে এসে বললেন, ‘ আসবেনা কেউ।’
আমি হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলাম ওনার চোখের দিকে। এই লোকটার মধ্যে ভয় বলে কোন বস্তু নেই? বাড়ির কেউ আমাদের এ অবস্থায় দেখলে কী জঘন্য পরিস্থিতি হবে সেটা ওনার অজানা? এমন করেন কীভাবে?
‘ আপনাকে বলেছে আসবেনা? দরজা খোলা। প্লিজ ছাড়ুন।’
উনি ওনার শক্ত হাতে এবার খানিকটা জোরে চেপে ধরলেন আমার কোমল বাহুদ্বয়। বললেন, ‘হ্যাঁ বলেছে। এবার তুই বল তোর সমস্যা কী? দুপুরের কল করে ওমন অদ্ভুত আচরণ করলি কেন?’
আমি নিচু কন্ঠে বললাম, ‘কিছুনা।’
উনি ওনার ঘনকালো ভ্রু জোড়া কুঁচকে ফেলে বললেন, ‘কিছুনা? হঠাৎ করে ডিসেম্বরে যদি কাল বৈশাখী শুরু হয়। কী এফেক্ট পড়ে আইডিয়া আছে তোর?’
আমিও এবার ভ্রু খানিকটা কুঁচকে তাকালাম ওনার দিকে। উনি গ্রিলের সাথে আমাকে আরও ভালোভাবে ঠেসে ধরে বললেন, ‘একবার তো ভেবেছিলাম তখনই চলে আসব। কিন্তু তুই বাড়িতে একা ছিলি বলে তখন তাই আর আসি নি। আবার মেসেজ করে কী লিখেছিস? এক সপ্তাহ বাইক চালাবোনা? কেন? সমস্যা কী? মরে-টরে যাব নাকি? এমন কিছু জানতে পেরেছিস? হুটহাট এমন টেনশন দিস কেন?’
আমার এবার কান্না পেল। ইচ্ছে হল গত দুইদিনের সব ক্ষোভ দিয়ে ভস্ম করে দেই ওনাকে। কিন্তু পারলাম না। অনেকটা কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বললাম, ‘জঘন্য লোক আপনি।’
‘তারপর?’
‘ আমার জন্যে এতো টেনশন নিতে কে বলে আপনারে? আমি বলছি? নেন কেন? আসতেন না এখানে।’
ওনার সেই বিখ্যাত আড়াআড়ি স্টাইলে ভ্রু জোড়া বাঁকিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর হেসে ফেললেন। না চেয়েও আমি আবার মুগ্ধ হলাম সেই হাসিতে। আমার বাহু থেকে হাত সরিয়ে আমার কানের ওপর দিকে দু গালে হাত রাখলেন উনি। আলতো করে এক চুমু এঁকে দিলেন আমার কপালে। ফিসফিসে আওয়াজে বললেন, ‘পিচ্চিটা।’ যেন একটা ছোট্ট বাচ্চা আমি। আমি স্হির হয়ে গেলাম, পা থেকে মাথা অবধি বরফের ন্যায় জমে গেল আমার, এক চুল নড়ার মতো শক্তি নেই আমার। শুধু স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইলাম ওনার দিকে। উনি একদম নির্বিকার, ঠোঁটে মৃদু হাসি। দ্বিতীয়বারের মতো ওনার স্পর্শ পেয়ে প্রথম বারের মতোই মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার। প্রথমবার প্রচন্ড ভয়ে আর সেবার? সেবারের অনুভূতির নাম জানা নেই আমার তাই লিখতে পারলাম না। কিন্তু প্রথমবারের সময় উনি যেভাবে নিজেই চমকে উঠেছিলেন, নিজেই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন নিজের কাজে সেবার তেমন কোন লক্ষণ প্রকাশ পেলোনা তার চেহারায়। উনি ছিলেন সম্পূর্ণ নিঃসংকোচ। অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। বসার ঘর থেকে মানিক আঙ্কেলের ডাক শুনে উনি নিজেকে সামলে ফেললেন। উনি আবার আমার দিকে ঝুঁকে আমার চুলগুলো ঠিক করতে করতে বললেন, ‘তোমাকে হাসানোর অধিকার শুধু আমার থাকা উচিত। সে নিয়মের ব্যতিক্রম হলে আমি অজান্তেই নিষ্ঠুর হয়ে উঠি, আর উঠবোও। সরি, বাট আই কান্ট হেল্প ইট।’
আমি মূর্তির মতো স্হির হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। উনি মৃদু হেসে আমার কানের কাছে ঝুকে বললেন, ‘এসব নিয়ে ভেবে নিজের মাথা নষ্ট করোনা। জাস্ট রিল্যাক্স।’
কথাটা বলে আমাকে ছেড়ে পেছন দিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে উল্টো ঘুরে চলে গেলেন উনি। আমি স্হির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ওখানেই। কতক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেটা এখনো বলতে পারিনা।
আপির বিয়ে হল। সে বছর পেরিয়ে নতুন বছর চলে এলো। বছরের দুটো মাসও পেরিয়ে গেল। সময় বদলে গেল। কিন্তু বদলালো না ঐ মানুষটা। শুনেছি কিছু জিনিস বদলে গেলে ভালো লাগেনা, তাদের ধ্রুব থাকাই শ্রেয়। হয়তো উনিও তেমনই একজন মানুষ। কী জানি! তাকে বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে। সে এমনই, দুর্বোধ্য। আমার জীবনের সবচেয়ে ধোঁয়াশা কিন্তু ভীষণ প্রিয় চরিত্র।
.
[ রি-চেইক করিনি। লিখতে গিয়েও নিজেকে বলদ মনে হইছে। রিভাইস করতে গেলে দ্বিতীয় দফা বলদ মনে হবে। মুড অফ ছিল তাই আজও এটাই দিলাম। আদ্রিয়ান প্রেমিগণ এবার খুশি? ]